শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব ৮

#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’❤
#’লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ০৮
__________________

—” আমি আপনাকে ভালোবাসি রুদ্র। এভাবে কেন অবহেলা করছেন আমায়? আপনার নিকট কি একটুও ভালোবাসা আশা করতে পারি না আমি?”

অন্দরমহলে নিজ মাতার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেই পথিমধ্যে রত্নমার সঙ্গে দেখা হয় রুদ্রের। রুদ্র না দেখার ভঙ করে সামনে এগোতেই পাশ থেকে রত্নমার ন্যাকামো ভরা কণ্ঠ ভেসে উঠে কর্ণকুহরে। মুহুর্তেই রেগে যান রুদ্র। অতীব জোড়ে ধমকে বলে উঠেন,

—” তোমাকে কতবার বলেছি রত্নমা, আমাকে সম্রাট বলে সম্মোধন করবে। রুদ্র বলে না।”

রুদ্রের ধমকে খানিকটা কেঁপে উঠল রত্নমা। চুপসে গেল তার মুখমন্ডল। মাথা নিচু করে মিনমিনিয়ে বলে উঠল সে,

—” ক্ষমা করবেন সম্রাট। এমন ভুল আর হবে না।”

রুদ্র ভ্রু কুঁচকালেন। রত্নমা থেমে থেমে আবারও বলে উঠল,

—” আমাকে কি ভালোবাসা যায় না সম্রাট? আমি তো আপনার স্ত্রী। সম্পর্কে সম্রাজ্ঞী আপনার।”

রুদ্র ক্রুদ্ধ হয়। কোমড়ে বেঁধে থাকা তলোয়াড় আলতো স্পর্শ করে পরক্ষণেই সেটা শক্ত করে মুঠ করে ধরে। তা দেখে রত্নমা বার কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে। রুদ্রের দিকে একবার মুখ তুলে তাকায় সে। রুদ্রের রাগান্বিত মুখমন্ডল দেখে থমকে যায়। বুঝতে পারছেন না রুদ্র এবার কি করবে তার সঙ্গে। মৃত্যু পুরষ্কৃত করবে না তো? ভয়ে যখন রত্নমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তখন রুদ্র রক্তিমচোখে রত্নমার পানে তাকিয়ে। কিছু না বলে সামনে অগ্রসর হতেই পথ আটকে দাঁড়ায় রত্নমা। রুদ্র ভ্রু ক্রুঁটি করে তাকান রত্ননার দিকে। মেয়েটার সাহস দেখে সে সত্যিই অবাক। চরম ভাবে অবাক! তলোয়াড় থেকে হাত সরিয়ে মুহুর্তেই চোখ-মুখ রাগে পরিণত করে ফেললেন রুদ্র। গলায় কাঠিন্য নিয়ে বলে উঠলেন,

—” সমস্যা কি?”

রত্নমা খানিক্ষণ চুপ থেকে বলে,

—” আপনি এখনও নিরুত্তর সম্রাট।”

প্রায় সাথে সাথে রত্নমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায় রুদ্র। রত্নমা রুদ্রের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। পরক্ষণেই আবিষ্কার করে রুদ্রের চোখে মুখে একটু আগেও যে রাগের সংমিশ্রণ ছিল তা এখন আর নেই। বরং বাঁকা হাসছে সে। হাসার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলো না রত্নমা। সঙ্গে বিস্ময়ও ঘিরে ধরেছে তাকে। রুদ্র তার এত কাছে এই প্রথম এলো। ভাবতেই মুখে হাসি ফুঁটে উঠল রত্নমার। তবে খানিকটা সরে দাঁড়ালো সে। লাভ হলো না তাতে। রুদ্র আবারও রত্নমার নিকটে এসে তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন। রত্নমার গালে হাত বুলাতে শুরু করলেন উনি। এতে যেন রত্নমা আরও অবাক হলো। খুশির আমেজ সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। তবে বেশিক্ষণ না। মিষ্টি হেসে রুদ্রকে সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রত্নমার গাল শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরলেন রুদ্র। মুখে অদ্ভুদ হাসির রেখা ফুঁটিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,

—” নিজেকে অনেক বেশি কিছু ভাবছো দেখি। নিজের অবস্থান বাজে ভাবে ভুলে যাচ্ছো। কেন? মৃত্যু বুঝি বেশি প্রিয়? নাকি আমাকে ভয় লাগে না তোমার?”

শেষের বাক্যটা অনেকটা জোড়েই বলে উঠেন রুদ্র। রত্নমা কেঁপে ওঠে৷ চোখ ভোরে আসে তার। তবুও আমতা আমতা করে বলে ওঠে,

—” আমি আপনাকে ভালোবাসি সম্রাট।”

রুদ্র যেন আরও রেগে যায়। রত্নমার গাল আরেকটু শক্ত করে চেপে বলে উঠে,

—” তুমি একজন রক্ষিতা। নিজের অবস্থানের উর্ধে কোনো স্বপ্ন দেখতে যাবে না। নতুবা তোমার সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে প্রহর গুণতে হবে না আমার।”

আর দাঁড়ান না রুদ্র। দ্রুত পদে প্রস্থান করেন সেখান থেকে। কিন্তু রত্নমা এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জিদে, অপমানে কান্না এলেও এখন চন্দ্রাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে তার। তবে সে সেটা করবে না। বরং রুদ্রকে দিয়ে চন্দ্রার মৃত্যু ঘটাবে। যে করেই হোক!

____________________

বিষণ্ণ মনে আকাশের পানে এক পলকে তাকিয়ে আছেন চন্দ্রা। “তার পিতা-মাতা আর এ পৃথিবীতে বেঁচে নেই”- ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন অর্তনাদ সৃষ্টি হয় তার। বুক চিঁড়ে অর্তনাদগুলো বেড়িয়ে আসতে চায় বারংবার। ইচ্ছে করে সব ধ্বংস করে ফেলতে। সব! কিন্তু মাথার ভেতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। রত্নমা কি সত্যি বলছে? নাকি তাকে কোনো সরযন্ত্রের শিকার করাতে চাইছে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। শুধু চাইছে যেন সব মিথ্যে হয়ে যাক। রুদ্রের সাথে যেন তার কখনও দেখা না হোক। চন্দ্রা যেন ফিরে যেতে পারে অতীতে। যেখানে সে ভুলেও কোনোদিন পিতার কাছে শিকার করার বায়না করবে। আদর্শ রাজকুমারী হয়ে থাকবে৷ তবে তা কি আদৌ হবে? মোটেও না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চন্দ্রা। আকাশের পানে তাকিয়ে কি যেন পর্যবেক্ষণ করতে লেগে গেলেন। এ সময় কক্ষে প্রবেশ করেন কিরণ। চন্দ্রার শিবিরে এসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠেন,

—” ক্ষমা করবেন রাজকুমারী! আপনার আহার করার সময় হয়ে গেছে। দয়া করে খেতে আসুন।”

চন্দ্রা চোখ তুলে কিরণের দিকে তাকালেন। ‘কিরণ’ চন্দ্রার সবচেয়ে প্রিয় দাসী। যে কিনা তার জন্যই এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। অথচ এখন তার সামনে অন্য এক কিরণ দাঁড়িয়ে। যাকে সে চিনে না, জানে না। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিরণকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন চন্দ্রা। লাবণ্যময় চেহারা, কালচে গায়ের রঙ, মুখে মিষ্টি হাসি। যেন ঠিক চন্দ্রার মৃত কিরণের মতো। তবে একটা অমিল বেশ খিঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর খুঁজে পেলেন চন্দ্রা। আর তা হলো কিরণের চোখজোড়া। মৃত কিরণের চোখে ছিল প্রচুর মায়া, আর রঙটা খানিকটা সবুজ। এ কিরণের তো চোখে তেমন মায়া নেই। না সবুজ রঙের চোখ তার। বরং সাধারণ কালো রঙের মনি তার। চন্দ্রা বেশ খানিকটা সময় পর্যবেক্ষণ করলেন কিরণকে। কিরণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় চন্দ্রা বুঝতে পারেন কিরণ অস্বস্তি বোধ করছে। কিরণ থেকে চোখ সরিয়ে ফেলে মৃদুস্বরে বলে ওঠেন চন্দ্রা,

—” আমার ক্ষুধা নেই। চলে যাও কক্ষ থেকে।”

কিরণ আপত্তি প্রকাশ করে বলল,

—” কিন্তু রাজকুমারী..!”

কথা শেষ হবার আগেই চন্দ্রা বলে উঠেন,

—” তোমাকে আমি যেতে বলেছি।”

অনেকটাই ধমকের সঙ্গে বলে ওঠেন চন্দ্রা। কিরণ মাথা নিচু করে ফেলে। চন্দ্রাকে অভিবাদন জানিয়ে বের হয়ে যায় কক্ষ থেকে। চন্দ্রা আবারও তাকায় আকাশের পানে। ভাবতে থাকে, হঠাৎ কি হলো তার? সে তো কারো সঙ্গে এরুপ ব্যবহার করে না। তাহলে?

____________________

রাণী অমরা আর রুদ্রের প্রথম দু’জন স্ত্রী বিন্দু এবং লতা কেদারায় বসে নানা বিষয়ে পরামর্শ করছিলেন। তখনই একজন দাসী তাদের শিবিরে এসে অভিবাদন জানায় তাদের। বলে উঠে,

—” ক্ষমা করবে রাণী। সম্রাট কক্ষে প্রবেশ করছেন।”

বলেই আবারও অভিবাদন জানিয়ে কক্ষের বাইরে চলে গেল সে। রাণী অমরা, বিন্দু এবং লতা কক্ষের প্রবেশ পথে তাকালেন এবার। রুদ্রকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে তিন’জনই দাঁড়িয়ে যান। রুদ্র তাদের সামনে এসে দাঁড়াতেই রুদ্রকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানায় বিন্দু এবং লতা। সেদিকে একবার তাকান রুদ্র। পরক্ষণেই বুকের বাম পাশে এক হাত রেখে একটু ঝুঁকে রাণী অমরাকে অভিবাদন জানান রুদ্র। পরপরই জড়িয়ে ধরেণ অমরাকে। শান্ত করে বলে উঠেন,

—” আপনি কি আমার সঙ্গে রেগে আছেন মাতা?”

রাণী অমরা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যার অর্থ তিনি রেগে আছেন। রুদ্র হাসলেন। রাণী অমরা সরে দাঁড়ালেন। এতে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

—” কেন রেগে আছেন? চন্দ্রার কারণে?”

রুদ্রের কথায় সায় দিয়ে রাণী অমরা বলে উঠেন,

—” অবশ্যই। আমি বুঝতে পারছি না ওই সামান্য যুবতীর জন্য এত পাগল হচ্ছো কেন তুমি? তাকে এ রাজ্যের রাণী বানাতে উঠে পরে লেগেছো। তোমার তো তিন-তিনটে স্ত্রী আছে রুদ্র। তাদেরকে তো স্ত্রীর মর্যাদা কখনও দাও নি তুমি। সর্বদা রক্ষিতা হিসেবে পরিচয় দিয়েছো। অথচ ওই সামান্য যবতীকে….! আমার ভাবতেও অবাক লাগছে রুদ্র।”

রুদ্র হাসে। বলে,

—” আপনার কি চন্দ্রাকে পছন্দ হয় নি?”

রাণী অমরা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

—” তা নয়। তবে পছন্দও নয়। আচ্ছা রুদ্র সত্যি করে বলো তো মেয়েটার থেকে কি চাইছো তুমি? যা না দেওয়ায় তাকে এ রাজ্যে রাণী বানাতেও দ্বিধা করছো না।”

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলেন,

—” আপনার কি মনে হয় আমায়? আমি যা চাই তা নিজের আয়ত্ত্বে আনতে আমার এতসব করতে হবে? মোটেও না। আমি শুধু এসব করছি কারণ আমি চন্দ্রাকে ভালোবাসি।”

চমকে উঠলেন রাণী অমরা, বিন্দু এবং লতা। বিন্দু এবং লতার চোখে ইতিমধ্যে পানি এসে হানা দিচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তাদের এই ভেবে যে তারা রুদ্রের মনে জায়গা করতে পারলো না৷ বরং দু’দিনের মেয়ে রুদ্রকে নিজের বসে নিয়ে নিলো। কিভাবে? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক কাচ্ছে তাদের। এদিকে রাণী অমরা রেগে বলে উঠেন,

—” এসব কি বলছ রুদ্র? এমন ছোট রাজ্যের রাজকুমারী ভালোবাসো তুমি? অসম্ভব! আরে তিন-তিনটে স্ত্রী থাকতে ওই মেয়েকেই কেন ভালোবাসতে হবে তোমার? রত্নমা তো যথেষ্ট সুন্দরী। তাকে ভালোবাসো। চন্দ্রা তোমার যোগ্য নয় রুদ্র। তাকে রক্ষিতা হিসেবে মানায়। রাণী হিসেবে নয়।”

রুদ্র চমকান। মুহুর্তেই চোখ দু’টো লাল হয়ে যায় তার। রাগী দৃষ্টিতে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেন। বিন্দু এবং লতার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকান একবার। চোখের ইশারা বুঝতে মেরে তারা মাথা নুইয়ে বের হয়ে যায় কক্ষ থেকে। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। রাণী অমরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন,

—” আমি চন্দ্রাকে ভালোবাসি মা৷ অন্য কাউকে না। কাউকে না! যে আমাকে চন্দ্রার কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইবে কিংবা চন্দ্রাকে অপমান করবে তাকে ধ্বংস করে দেবো আমি। তাই সবাইকে আগে থেকেই সতর্ক করে দিন মাতা। নিজেও সতর্ক হোন। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”

কথাটা বলেই সরে দাঁড়ালেন রুদ্র। রাজকীয়ভাবে বের হয়ে গেলেন কক্ষ থেকে৷ আর রাণী অমরা, তিনি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন রুদ্রের যাওয়ার পানে।

___________________

মাঝরাত। নিজ শয্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন চন্দ্রা। তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রুদ্র। আর কি যেন বিড়বিড় করছেন৷ হাত দিয়ে চন্দ্রার কপালে পরে থাকা চুল কানে গুঁজে দিয়ে কপালে আলতো ছোঁয়া এঁকে দিলেন রুদ্র। পরক্ষণেই চন্দ্রাকে কোলে তুলে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন।

.
.
চলবে…….
Afrin Shuvra, নীলাবতি নিল, Yasmin Putul সহ সবার জন্য ভালোবাসা রইল❤
Ishanur Tasmia

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here