সম্পর্ক,পর্ব-১৩+১৪

#সম্পর্ক
#১৩

‘আপনার মনের ভেতর কী চলতেছে ভাবি? আমাকে বলেন তো।’

শীতের মাস চলে এসেছে। এখনি রাতে ঘুমোতে হলে পাতলা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমাতে হয়। প্রকৃতি নির্জীব, রিক্ত, শূন্য। আকাশে চাঁদ নেই, দূরে দূরে দু-একটা ছোটো ছোটো তারা ছাড়া পুরো নিকষ কালো ঘুটঘুটে আঁধার! সেইদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল রতি। এমন সময় আবিরের কণ্ঠ শুনে একটু চমকালো, কেঁপেও উঠল। তবে ঘুরে তাকাল স্বাভাবিক ভাবে, তারচেয়েও স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘কী চলবে ভাই! কীসের কথা বলছেন?’

আবির ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে। রতি ভীষণ চাপা স্বভাবের মেয়ে এটা সে বেশ ভালো করেই বুঝেছে। এই মেয়ের মুখ থেকে কথা বের করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। পাহাড়সম কষ্ট নিয়েও ও হাসতে জানে!

‘আমি জানি না ভাবি। শুধু মনে হচ্ছে, আপনি সুখী নেই। কোনো একটা কারণে আপনি ভালো থাকতে পারছেন না। সেই কারণটা আমি জানতে চাই।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো আবির। তারপর রতিকে ডিঙিয়ে বারান্দার শেষ কর্ণারে গিয়ে দাঁড়াল। হলুদ গোলাপের গাছ আছে একটা, দুটো ফুল ফুঁটে আছে। সেই ফুল দুটো ভীষণ যত্নে ছুঁয়ে দিয়ে উত্তরের আশায় রতির দিকে তাকাল আবির। রতি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

আসলে, তার মনের ভেতর কী চলছে না চলছে, সেটা সে নিজেও জানে না! একবার মনে হয়, সব ভুলে আরাফের কাছে ফিরে যেতে, তো আবার মনে হয়, ওই নরকে ফেরার কোনো মানেই হয় না। কী করবে রতি, রতি নিজেও ভেবে পায় না। যেদিকে তাকায়, শুধু অথৈ জল, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। ভীষণ রকমের দোটানায় দুলছে মন। রতির বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আবির সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে চমকে যায়। এত গাঢ়, আর ভারী! এতটা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে রতি! আবিরের বুক ভার হয়। সে ভাবে, রতি আর আরাফকে এভাবে আলাদা করে দেওয়া কী ঠিক হলো? না করেও বা উপায় কী ছিল? রতি আসলেই ওখানে ভালো থাকতো না, কোনোদিন না!

আবির চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়, রতি ডেকে উঠল তখন।
‘একটু শুনুন ভাইয়া।’
‘জি ভাবি, বলেন।’
‘আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করব। প্লীজ অন্য মাইন্ডে নিবেন না।’
আবির মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ‘আচ্ছা, বলেন।’
‘আমি চাই না কালকে এই বাসায় কোনো পুলিশ আসুক। উনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আপনি তুলেছেন, সেটা ফিরিয়ে নিন, প্লীজ।’ রতির কণ্ঠে আকুতি, আবির অবাক হলো না। সে জানতো, রতি এমন কিছুই বলবে।
‘আমাকে ভুল বুঝবেন না ভাইয়া। ওই মানুষ টা অমানুষ হতে পারে, আমি তো না। ও আমাকে ভালো না বাসুক, আমি তো বাসি! ও যদি দ্বিতীয় বিয়েও করে, আমি কিচ্ছুটি বলব না। উল্টো দোয়া করব যেন সে সুখী হয়। ভাইয়া, কুকুর কামড়ালেই কুকুর কে কামড়াতে হবে? এর আগে তো কতই আঘাত দিয়েছে আমাকে! সেসবের বিচার যখন হয়নি, তখন এইটুকু আঘাতের বিচার হওয়া লাগবে না। উনাকে ছাড়িয়ে আনুন। আমি চাকরি পেলে এখান থেকে দূরে চলে যাব। তারপর সে আর আমি দু’জন দু রাস্তায়… সে ভালো থাকবে, আমিও থাকবো। ব্যস।’

‘উনি যদি বিয়ে করতে পারেন আপনাকে রেখে, আপনি করবেন না? আপনি কেন জীবনের সব সুখ স্যাক্রিফাইস করবেন?’
রতি অল্প একটু হাসল, ‘কিছু জিনিস একবারই করা যায়। ভালোবাসাও ওমন। হ্যাঁ, অনেকের জীবনে দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রেম আসে, আমার জীবনে আসবে না। আমি আসতে দিব না। এগুলোর প্রতি কোনো টান আমার নেই।আমার ভেতর যতটুকু ভালোবাসা ছিল, তার সবটুকু আমি তাকে ঢেলে দিয়েছি। তাকে ভালোবেসে আমি নিঃস্ব, আমার গোপন কুঠুরি আর কোনো অনুভূতি নেই। তাই চাইলেই কাউকে আর জায়গা দিতে পারব না। সে আমাকে যতই কষ্ট দিক, কিছু ভালো স্মৃতিও তো আছে আমাদের! জানেন ভাইয়া, স্মৃতি নিয়েও কিন্তু দিব্যি বাঁচা যায়!’

রতির চোখের পাতা ভিজে জুবুথুবু, আবিরের সামনে সে কান্না আটকানোর কোনো চেষ্টা করল না। বরং অবাধ্য পানি গুলোকে মুক্তি দিল। একটু এগিয়ে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়াল। আবির কিছু না বলে জায়গা ছাড়ল…
ভালোবাসায় পুড়ে যাওয়া মনের উত্তাপ আবিরও টের পাচ্ছে!

_________
আহ্নিদের বাসার অবস্থা করুণ। দুপুর একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে দুপুরের ডিভোর্সের কথা। সবাই দুপুরকে নিয়ে যা-তা মন্তব্য করছে। কিছু কথা দুপুর ও শুনেছে, তবে অনেক কথাই কানে আসেনি। যদি আসতো, দুপুর শ্বাস নিতেও কষ্টবোধ করতো। এর মধ্যে আবার আরাফকে থানায় নিয়ে গেছে। তাশরিফ, নাছির মাহতাব, দু’জনেই দৌড়াদৌড়ি করছেন, কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না। তার উপর ঝিলমের অত্যাচারে লিলি বেগমের হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইছে। ঝিলম সাফ সাফ বলে দিয়েছে, সে এত কাজ টাজ করতে পারবে না। যদি তাকে সাহায্য করা হয়, তবেই সে কাজে হাত লাগাবে। দুপুরের অবস্থা এমন যে লিলি বেগম তাকে কিছুই বলতে পারছেন না। আবার আহ্নিকে বললেও শুনে না। তাই বাধ্য হয়ে লিলি বেগমকেই গতর খাটিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। এখন উনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, এত কাজ করার মজা! লিলি বেগম অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করলেন, ‘রতিটা ছিল যখন, একটা কাজেও হাত দিতে হয়নাই।’
ঝিলম রান্নাঘরে পা রাখা মাত্র কথাটি শুনল, ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সে আবার রতির মতো এত ভদ্র,শান্ত স্বভাবের মেয়ে না। সে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘কী বললেন আপনি? এর মানে আপনাকে দিয়ে আমি অনেক কাজ করাই?’
লিলি বেগম কপাল, চোখ মুখ নাক কুঁচকে পাতিল মাজছেন, জবাব দিলেন না।
‘জবাব দেন আম্মা। রতি কে মাগনা চাকর পাইছিলেন, তাই খাটাইয়া নিছেন। আমি কী চাকর নাকি? আমার বাপে এতকিছু দিবে, আমাকে চাকরানি খাটাতে?’
‘আগে দিয়ে নিক, এরপর কথা বলো।’ বিরক্তিতে তেতো মুখ নিয়ে বললেন লিলি বেগম। ঝিলম জবাব না দিয়ে তরকারি কাটতে বসল। সে এই মহিলার কালো মুখ ভেঙে ছাড়বে। বজ্জাত যেন কোথাকার!
ঝিলম লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকালো। লিলি বেগম অবাক চোখে দেখলেন, তার মনে পড়ল, রতি কখনো তার চোখের দিকেও চোখ তুলে তাকায়নি!

________
আহ্নি এসেছে ফটোকপির দোকানে, কিছু জরুরি নোটস কপি করাতে।বাসায় এতদিন ঝামেলার কারণে তার পড়াশোনা লাটে উঠেছে। যদিও এখনো ঝামেলা মিটে নাই, তবুও আহ্নি ধুমিয়ে আবার পড়ায় লাগবে। সামনে তার পরীক্ষা। এভাবে সময় অপচয়ের মানে নেই!

‘মামা, একটা নাম্বার লিখেন তো।’ বলে উঠল একটি চেনা পুরুষালি কণ্ঠ, আহ্নি পাশে তাকাতেই প্রান্তকে দেখতে পেল। প্রান্ত চমকে গেল, ‘আরে, আপনি!’
আহ্নি হাসল, ‘না, আমার ভূত।’
প্রান্তও হাসল, ‘কেমন আছেন? অনেকদিন পর দেখলাম।’
‘ভালো আছি। ব্যস্ত ছিলাম বলে মসজিদে যাওয়া হয়নি কয়দিন। কাল থেকে আবার যাব ভাবছি।’
প্রান্ত মনে মনে বলল, যদি তুমি জানতে তোমাকে একটাবার দেখার জন্য আমি প্রতিদিন সেই মসজিদের সামনে পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে চলে এসেছি, তাহলে এই এক্ষুনি তুমি আমার হাত ধরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে, আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি, চলুন। আফসোস, তুমি কোনোদিনই জানবে না, আমার ভেতরটা তোমাকে ভেবে ভেবে কত নির্মম ভাবে চুরমার হয়!

‘কী হলো? কী ভাবছেন?’ আহ্নির কথায় প্রান্তের ভাবনার সুতো কাটে। ঠোঁটের হাসি চওড়া করে প্রান্ত মাথা নাড়ে, বলল, ‘উঁহু, কিছু না।’
‘আমার হয়ে গেছে। আমি যাই তাহলে?’
প্রান্ত ইতস্তত করল, আহ্নি ঠোঁট চেপে হাসি আটকাচ্ছে। এই ছেলে যে প্রথম দিন থেকেই তাকে পছন্দ করে, সেটা সে খুব ভালো করেই জানে কিন্তু ভান করছে এমন যেন কিছুই বোঝে না.. আর এতে প্রান্ত আরও বেশি অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে৷ প্রান্তের এই অস্বস্তিমাখা চেহারা দেখতেও দারুণ লাগছে! আহ্নি সময়টাকে উপভোগ করে।

‘আপনি বোধহয় আমাকে আর কিছু বলবেন না, ঠিক আছে। আজ তাহলে আসি। ভালো থাকবেন।’ বলেই পা বাড়ায় আহ্নি, প্রান্ত চেঁচিয়ে উঠে, ‘এই না, বলার আছে তো। অনেক কিছু আছে। একটু দাঁড়ান।’ প্রান্তের চিৎকারে দোকানে থাকা বাকি সবাই, দোকানদার নিজে পর্যন্ত অবাক চোখে তাকায়। প্রান্ত লজ্জা পায়, আহ্নির ভেতরটা হাসিতে ফেটে যাচ্ছে!

প্রান্ত মিনমিনিয়ে বলল, ‘সরি, এভাবে চিৎকার করে ফেলব বুঝিনি! আসলে আপনার সামনে এলে আমার সব গুলিয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়।’
আহ্নি এক হাতে ওড়নার ধারটা টেনে ধরে হাসি চাপিয়ে জবাব দেয়, ‘না, না, ইটস ওকে। আই আন্ডারস্ট্যান্ড..।’
‘আপনার সময় আছে হাতে? আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।’
আহ্নির হাতে যথেষ্ট সময় আছে। বাসায় গিয়ে করবে টাই বা কী! রতিও নেই, তাই বাসাতে আহ্নির মনও বসে না। এই আধ-পাগলের সাথে ঘুরে বেড়ানো যায়, তবে না, এখন না.. আরও দুটো দিন একে দৌড় করানো যাক! নয়তো প্রেমের মজা কী? প্রেম কী এতো সহজেই হয়? হয় না, একদমই হয় না।

‘জি না, আজ আমি খুব ব্যস্ত বুঝলেন ভাই।’

‘ভাই?’ বিড়বিড় করল প্রান্ত, দারুণ ছ্যাঁকা খেল। সে যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতো, তাহলে এই এক্ষুনি কেঁদে ফেলতো বোধহয়। বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে, বাতাসে কী বিষ? এতো জ্বলছে কেন? প্রান্তের রাগ লাগল, তার ইচ্ছে করে বোমা দিয়ে ‘ভাই’ নামক শব্দটাকে উড়িয়ে দিতে..

‘ও, আচ্ছা, ইটস ওকে।’ মলিন গলায় জবাব দিল প্রান্ত। কষ্টে তার চোখ চিকচিক করছে। আহ্নি আজ বাসায় গিয়ে খুব হাসবে, খুব। এরকম মাথা পাগল একজন কে সে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে, ভাবতেও পারেনি!

‘তবে আপনি চাইলে আমি দুটো দিন পর আপনার সাথে দেখা..’ আহ্নির কথা পুরোপুরি শেষ হলো না, প্রান্ত চিৎকারের মতো করে বলল, ‘হ্যাঁ,হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি রাজি আছি।’ মনে মনে বলল, ‘একবার তোমাকে আমার ফাঁদে ফেলি, এই ভাই বলার শোধ আমি নিয়ে ছাড়ব।’
‘আচ্ছা। তাহলে ওই কথাই রইল। দু’দিন পর দেখা হচ্ছে। আসি আজ।’
‘দুদিন পর কোথায় পাব আপনাকে? যদি না পাই?’ প্রান্তের উৎকণ্ঠা।
আহ্নি ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘কিছু মানুষ জীবনে হারিয়ে যাওয়ার জন্য আসে না! থাকার জন্যই আসে। তবুও চিন্তিত যখন, আপনার ফোন দিন।’
প্রান্ত যন্ত্রের মতো নিজের ফোন এগিয়ে দেয়। আহ্নি নিজের নাম্বারটা প্রান্তের ফোনে তুলে সেভ করে ফোনটা আবার ফেরত দিল।
‘আমার নাম্বার, হারিয়ে গেলে খুঁজে নিয়েন।’ এরপর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না আহ্নি, চলে যায় ধীরস্থির পদতলে…
প্রান্ত তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে ফোনের দিকে তাকাতেই চমকে যায়। আহ্নি নিজের নাম্বার “প্রিয়তমা” দিয়ে সেভ করে দিয়েছে। তবে কী আহ্নিও? খুশিতে প্রান্ত’র চোখে পানি চলে আসে।

__________
শুক্রবার, বেলা এগারোটা। আবির আর উকিল বাবার সাথে ম্যারিজ রেজিস্টার অফিসে এসেছে রতি। আজ তাদের ডিভোর্সের দিন! শেষ পর্যন্ত আরাফ তাকে ডিভোর্স দিচ্ছে!
রতি যখন প্রথম প্রথম আরাফের ভালোবাসার জালে আঁটকা পড়েছিল, সেসময়ের কথা। একদিন দুপুরে, কী একটা কথায় কথায় আরাফ হুট করে বলে বসল, ‘আমি যদি তোমাকে ডিভোর্স দেই কখনো? তুমি তখন কী করবে?’
কথাটা শোনা মাত্রই রতির দুই চোখ ভরে উঠেছিল জলে। সে আরাফের শার্ট খামচে ধরে জবাব দিয়েছিল, ‘ওই দিন আসার আগেই আল্লাহ যেন আমার মরণ দেয়।’ এরপর পাক্কা এক ঘন্টা রতি কেঁদে ভাসিয়েছিল। আরাফ তখন রতির গাল দুটোয় আদর মাখিয়ে বলেছিল, ‘ইশ, কী পাগলি তুমি! এখনি এতবেশি কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছো, ওরকম হলে তো কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাবে।’

অথচ আজ, রতি একদম কাঁদেনি। আল্লাহ তাকে নিয়েও যায়নি। সকাল সকাল উঠে রতি সবার জন্য নাশতা বানিয়ে, নিজেও খেয়েছে। দুপুরের জন্য কিছু তরকারি কাটাকুটি করে দিয়ে, সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে তৈরি হয়ে এখানে এসেছে। বসেও আছে চুপচাপ, শক্ত হয়ে, স্বাভাবিক হয়ে। তার ভেতরে যে কী চলছে, তা বোঝার সাধ্যি কারো নেই!

পনেরো মিনিট পর আরাফ আসে। সঙ্গে লিলি বেগম আর তাশরিফ। তিনজনেরই মুখের দিকে তাকানো বড় দায়, তিনি তো রতির দিকে এমন চোখে তাকিয়েছিলেন, যেন রতিকে গিলেই নেবেন টুকুস করে। রতি অবশ্য কারো দিকেই তাকায়নি, আরাফ ছাড়া। এতকিছুর পরও বেহায়ার মতো, কোথাও না কোথাও, রতি চাচ্ছিল,আরাফ একবার সব রাগ অভিমান ফেলে বলুক, ‘কীসের ডিভোর্স? তুমি আমার বউ না? আমার বউকে আমি ছাড়ব না, কক্ষনো না। বাসায় চলো রতি, আর কতদিন শাস্তি দিবা?’
কিন্তু না, আরাফ সেসব বলা তো দূর, রতির দিকে একবার তাকায়নি পর্যন্ত। তাকালে ঠিক দেখতো,ভালোবাসায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া রতি, আজ ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায়…তার আত্মা তো কবেই মরে গেছে! শুধু দেহটা ছাড়তে পারছে না বলে সমাজের চোখে সে জীবিত!

দুই মিনিটের মাথায় কাগজে সাইন করে দিল আরাফ। রতি এবার চোখ সরিয়ে নিল। মানুষটার সাথে সব সম্পর্ক শেষ, সে এখন পর পুরুষ… তার দিকে তাকানোর অধিকার রতির আর নেই!
আচ্ছা, সত্যিই কী একটা কাগজ পারে সম্পর্ক জুড়তে আবার ছিন্নভিন্ন করে দিতে? যদি পারে, তাহলে মন টা আছে কীজন্যে? কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে মানুষ মেরে ফেলার জন্যে?

যাওয়ার আগে আবিরের দিকে তাকাল আরাফ, ঠোঁটে বৈচিত্র্যময় হাসি ফুঁটিয়ে বলল, ‘পথের কাঁটা সরে গেল। এবার আপনারা দু’জন সুখী হন, ভালো থাকেন।’ আবির রক্তচক্ষু করে তাকাল। উকিল বাবা আবিরের হাত চেপে ধরলেন, আরাফ গা জ্বালানো হাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। আর ভাবাভাবির কিছু নেই। এরকম চিন্তাচেতনার মানুষটা বাহিরেই মরে যাক,ভেতরে বেঁচে থাক!
রতি চোখ বন্ধ করে তালাকের কাগজে সাক্ষর করল।

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি

#সম্পর্ক
#১৪

সন্ধ্যা থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টির দেখা, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও বাড়লো। এখন ঝুম বৃষ্টি, সব ভাসিয়ে নেওয়া বৃষ্টি একেবারে.. এই বৃষ্টি বোধহয় পুরোপুরি শীত নামিয়ে দেওয়ার জন্যেই এসেছে!
রতি গায়ের শালটা আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে বারান্দার দরজা আঁটকে দিল। জানালা আঁটকে পর্দাগুলো টেনে দিল। বজ্রপাতের আলোর ঝিলিক দেখলে রতির বুক কাঁপে ছোটো থেকেই, এখনো সেই অভ্যেসটা রয়ে গেছে।

আবিরের উপস্থিতি রতির মনে গাঢ় বিষাদের রেখা টানে। রতি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিতে গিয়ে চা-টাই ফেলে দিল, কামিজে চা দিয়ে মাখামাখি। আবির ছুটেই এলো এক প্রকার, ‘একটু সাবধানে ভাবি।’
বলতে বলতে ফ্লোর থেকে ভাঙা কাপটা তুলে নিতে লাগল সে। রতি জড়তা সমেত বলল, ‘আপনি সরুন, আমি উঠাচ্ছি।’
‘দরকার নেই। আপনি আগে জামাটা পাল্টে ফেলুন।’
‘একটুই তো লেগেছে, কাল পাল্টালেও চলবে। এখন এমনিতেও ইচ্ছে করছে না।’
আবির কথা বাড়াল না, ভাঙা কাপের অংশ তুলে ফেলে দিয়ে হাত ধুঁয়ে আবার রতির ঘরে ঢুকলো।

দেখতে দেখতে কেটে গেছে পঁচিশ দিন। আজ রাত তিনটায়, আবিরের সৌদি আরবের ফ্লাইট। সে চলে যাচ্ছে…
এই নিয়ে বাড়ির সবারই একটু না, অনেকটাই মন খারাপ। সবাই জানতো, আবিরকে আবার যেতে হবে তবুও, বিদায়বেলায় অবাধ্য মন একটু তো নকড়াছকড়া করেই! রতিরও খারাপ লাগছে। আবিরটা তার জন্য কতকিছু করল! তাকে আরাফ নামক পঁচা নর্দমা থেকে তুলে এনে নতুন জীবন দিল, আবার আহ্নির মাধ্যমে সার্টিফিকেট গুলো আনিয়ে একটা প্রজেক্টের কাজও যোগাড় করে দিয়েছে। রতির কাজের বয়স সাত দিন।

‘আমি তো আজকে চলে যাচ্ছি ভাবি।’ কথাটা কেন বলল, আবির জানে না। রতি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এটা তো জানিই!’
আবির হেসে ফেলল, ‘তবুও কেন বললাম, জানি না। আসলে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না!’
রতি চোখ নিচে রেখে চুপ করে রইল। আবিরও চুপ, দু’জনেই কিছু বলতে চায়, কিন্তু কোনো এক জড়তার জন্য বলতে পারে না। কীসের জড়তা, দু’জনের কেউই জানে না..

একসময় নিরবতা ভেঙে রতি বলল, ‘আবির ভাই, একটা কথা বলার ছিল।’
আবির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,কথা খুঁজে পাওয়ার জন্য, ‘জি বলেন।’
‘আবির ভাই, মাঝে মাঝে জীবন এমনকিছু মানুষের সাথে দেখা করিয়ে এমনকিছু ঘটায়, যেটার কোনো মানে বের করতে গেলে পুরো জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে। সবাই বলে, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যেই করেন। সেই আবার যখন জীবনে বিনা কারণে এলোমেলো ঝড় আসে, তখন আমরা হাজার ভেবেও কূল পাই না যে কোন ভালোটা হলো এই ঝড়ের মধ্য দিয়ে! আসলে আমরা পজিটিভলি চিন্তাই করি না অতটা, আমাদের যত চিন্তা সব নেগেটিভ। তাই না?’
‘অনেকটা.. আমাদের চারপাশের পরিবেশটাই তো নেগেটিভ ভাবি।এই যে আপনাকে আমি কোন কারণে ওই ঘর ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম, আর সমাজ কোন কারণটা বুঝলো!’
রতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আবিরদের বাসায় আসার পর থেকে পুরো এলাকায় রতির নাম সবার মুখে মুখে। রতি যেন হট নিউজ! ননদের জামাইর সাথে বড় ভাইয়ের বউ পালিয়ে গেছে — এমন একটি নিউজ শুনতে শুনতে রতির কান ঝালাপালা! এমনকি রতির বাবাও… আরাফের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পরে আরাফ রতির বাবাকে ফোন দিয়ে সব বলে দিয়েছে, আর এও বলেছে, ‘রতির সাথে আমার সব সম্পর্ক যেহেতু শেষ তাই আপনার মেয়ের কোনোকিছু হলে কক্ষনো আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না। জিজ্ঞাসাবাদ ও করতে পারবেন না।’ তারপর রতির বাবা রতিকে সেদিনই ফোন দিয়ে কাটাকাটা গলায় বলেন, ‘একবার আরাফের সাথে পালালি, আমরা মেনে নিলাম। এখন আবার.. ছিঃ তুই এই শিক্ষা নিয়ে বড় হইছিস? এইসব শিখাইছিলাম তোকে? তোর জন্য সম্মান থাকল না আর! শোন, ওই ছেলের মধু খাওয়া শেষ হলে যদি ফেলে চলে যায়, আমার বাসার এদিকে ভুলেও চোখ তুলে তাকাবি না। আসা তো দূরের কথা। আমি ভাববো, আমার কোনো মেয়েই ছিল না। কীরে, শুনছিস?’
রতির ঠোঁট জুড়ে সেদিন খানিকটা বিদ্রুপ আর খানিকটা কষ্টের হাসি ফুঁটে ছিল। তার বাবা কোনদিনই বা তাকে মেয়ে ভেবেছিল? শুধু মাথার উপর একটা ছাদ, আর পেটে তিনবেলা খাবার দিলেই বাবা-মা হওয়া যায়? বাবা-মা হওয়া এতোই সহজ?
রতি চোখের জল মুছে একদম স্বাভাবিক গলায় সেদিন উত্তর দিয়েছিল, ‘মরে যাওয়া সহজ, তবুও কখনো তোমাদের কথা ভাববো না। রাখছি।’

রতি স্মৃতি হাতড়ে বাস্তবে ফিরে, গাঢ় শ্বাস বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে আবিরের দিকে তাকায়। আবির প্রসঙ্গ ঘুরায়, ‘কী যেন বলছিলেন..’
‘ও, হ্যাঁ, বলছিলাম যে..’ রতি নিজেকে পুরোদস্তুর স্বাভাবিক করে বলতে লাগল, ‘বলছিলাম যে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমার বিবাহিত জীবনে, আমি অনেকবার বাচ্চা নিতে চেয়েছি, আরাফ সবসময় না না করতো। আমি মন খারাপ করলেও কিছু বলতাম না। কারণ, অনেকেই এসে আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, কেন বাচ্চা নেই না। আমার কোনো সমস্যা আছে নাকি। থাকলে ডক্টর দেখাচ্ছি কীনা, ইত্যাদি! আবার আমার পাগল মন তখন ভাবত, হয়ত বাচ্চা হলে সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। আরাফ আমার না খেয়াল রাখুক, তার বাচ্চার মায়ের তো রাখবে। শ্বাশুড়ি আমায় না ভালবাসুক, তার নাতির মা’কে তো বাসবে.. থার্ড ক্লাস মেন্টালিটি! হাহ! অথচ এখন বুঝি, আসলে তখন বাচ্চা নিলে আমি জীবনে ও ঘর ছেড়ে বেরোতে পারতাম না। জন্মের মতো আঁটকে যেতাম। আল্লাহ তো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকারী। তাই তিনি আমার ভবিষ্যত দেখেই আমাকে বাচ্চা দেননি.. কথাগুলো এজন্য বলছি ভাইয়া, হয়ত দুপুরের সাথে যা হয়েছে তার জন্য আপনি ভাগ্যকে দোষারোপ করছেন এখন, কিন্তু একদিন আপনি বুঝবেন, এই ঝটকাটাই আপনার লাইফে দরকার ছিল। এখন যে জেদ, যে কষ্ট আপনার ভেতর আছে, সেটা থেকেই আপনি আরও বেশি সাকসেস হয়ে হোক না হোক, দুপুরকে দেখানোর চেষ্টা করবেন। বোঝাতে চাইবেন, দেখো দুপুর, দেখো, একদিন যাকে পায়ে ঠেলেছো, আজ তার ঘরে রাজরানি হয়ে থাকতে পারতে!
আপনার আম্মা অনেক ভাল, আপনার আব্বাও অনেক ভাল মনের মানুষ। আপনাদের পুরো পরিবারটাই ভীষণ সুন্দর। আর আপনি আপনার আব্বা-আম্মার একমাত্র ছেলে। তাদের শেষ বয়সের ভরসা শুধু আপনিই… তাই যদি কখনো কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রস্তাব উঠে বা সাবজেক্ট আসে, তাহলে ওয়াদা করুন, আপনি দূরে সরে সবার মনে কষ্ট দিবেন না। বরং ওই মেয়েটির প্রতি প্রচন্ড দায়িত্বশীল থাকবেন। ভালোবাসায় কোনো কমতি দিবেন না তাকে.. ওয়াদা করুন ভাই, আপনাদের এই সুন্দর বাগান যেন আপনার কারণে কখনো নষ্ট না হয়।’

আবির নিশ্চুপ, সে কী উত্তর দিবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে রতির প্রতিটি কথার মানে সে বুঝেছে। রতি একদৃষ্টে আবিরের দিকে তাকিয়ে, উত্তরের আশায় তার চোখের দৃষ্টি খাঁ খাঁ করছে। আবির পা দিয়ে মেঝেতে খুঁটাখুঁটি লাগায়। মিনমিনিয়ে বলল, ‘সেরকম সময় আসুক, ভেবে দেখব।’
রতি লম্বা করে শ্বাস টেনে নেয়। তার বুক একটু হলেও শান্ত হয়েছে। যদি আবির বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, তবে সে রতির কথার ঠিক অর্থ ধরতে পারবে। আর রতির কথার যথার্থ অর্থ হলো, সেই মেয়েটি অন্য সবাই হলেও, রতি কখনোই নয়….

_________
বাম পাশে তাকালে পুরোটা জুড়ে ঝিল, তাই এই জায়গাটার নাম ঝিল পাড়। এটা আহ্নিদের এলাকারই একটি অংশ। একসময় এই ঝিলে প্রচুর মাছ চাষ করা হতো, তবে এখন আর হয় না। এমনিতেই পড়ে থাকা ঝিল পাড় এখন বৈকালিক ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত জায়গা। সব বয়সের মানুষের আনাগোনা এখানে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, কপোত-কপোতীদের। আহ্নি আর প্রান্তও আজ এখানে এসেছে। ওদের সম্পর্কের বয়স বাইশ দিন।

প্রান্ত বলল, ‘এভাবে কী হাঁটবেই? কোথাও বসবে না?’
‘আমিও এই কথাটাই বলতাম জানো। আচ্ছা তুমি কী আমার ‘মন’? সব বুঝে যাও কী করে?’
উত্তরে প্রান্ত হেসে বলে, ‘ওদিকে চলো। ওই জায়গাটা নিরিবিলি আছে।’
‘চলো।’ বলে প্রান্তের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে হাঁটতে শুরু করে আহ্নি।

মাথার উপর সারি সারি নারিকেল গাছ। গাছের নিচে স্পেস দিয়ে দিয়ে সিমেন্টের বেঞ্চ বানানো। যারা কিছু সময় কাটানোর জন্য এখানে, তাদের জন্য বসার ব্যবস্থা আর কী। সেরকমই একটা বেঞ্চে গিয়ে আহ্নি, প্রান্ত বসল। আহ্নি কাঁধ থেকে ব্যাগটা খুলে পাশে রাখে। প্রান্ত আড়মোড়া ভেঙে মুখ দিয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

‘কতক্ষণ সময় আছে হাতে?’ প্রান্তের প্রশ্ন।
‘আছে ভালোই। দুই ঘন্টা!’ জবাব দিল আহ্নি।
‘এতক্ষণ আজ? সচরাচর তো এতো টাইম নিয়ে বের হও না। তোমার বাসায় আবার প্রবলেম হবে না তো?’ প্রান্তের উৎকণ্ঠা।
জবাবে আহ্নি মাথা নাড়ায়, ‘না, কোনো প্রবলেম হবে না। আর হলেও আমি ভয় পাই না। আমি তো চুরি ডাকাতি করছি না, প্রেম করছি! আর প্রেম তো সবাই করে… কী করে না? আর এমনিতেও বাসায় আজকে আমার খোঁজ পড়বে না।’
‘কেন?’
‘বড় ভাইয়ের বউয়ের পরিবার আসবে। এতক্ষণে এসেও পড়ছে বোধহয়। সবাই জানে, আমি বড় ভাইয়ের বউকে সহ্য করতে পারি না। সো তার পরিবারকেও সহ্য করার কথা না! এইজন্যে বাইরে সময় কাটাচ্ছি। ব্যস,সিম্পল।’
প্রান্ত অল্প একটু হাসে। এই মেয়েটার মনের জোর খুব বেশি! সাহসও প্রচুর!
প্রান্ত বলল, ‘একটা কথা আস্ক করব করব করে করা হয় না। আজকে যখন সুযোগ পেলাম, আজ বলেই ফেলি।’
‘কী?’
‘তুমি তোমার ছোটো ভাইয়ের বউকে প্রচুর ভালোবাসো। তার ব্যাপারে সবকিছুই আমাকে বলেছো। সে যেখানে থাকে সেখানেও যাও দেখা করতে। কিন্তু বড় ভাইয়ের বউকে আজ পর্যন্ত ভাবি বলেই ডাকলে না, অন্তত আমার সামনে। আবার এখন বললে সহ্য করতে পারো না। কেন আহ্নি? না মানে, দুই ভাইয়ের বউয়ের প্রতি দুই রকম মনোভাব কেন?’

জবাবে আহ্নি দম টেনে নেয়। ঝিলের সবুজ শ্যাওলা পানি স্থির হয়ে আছে, একদম টান টান.. সেদিকে চোখ নিবদ্ধ করে আহ্নি বলল, ‘তোমাকে তো বলেছিই রতি ভাবি কেমন মেয়ে। তার এই অসহায়ত্ব নাকি সরল মন,আমি জানি না, কিছু একটা আমায় খুব টেনেছে। সে আমার ভাবি না, এর চাইতেও বেশি। বোনেরও উপরে… দুপুরের জন্য আমার যতটা টান আসে, তার চাইতেও বেশি আসে ভাবির জন্য। আমার কী মনে হয় জানো? ভাবির জন্য আমি জান দিতেও দ্বিধা করব না, আবার জান নিতেও!’

প্রান্ত চমকায়, আহ্নি প্রান্তের দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘এভাবে লাফিয়ে উঠলে কেন?’
‘কীরকম আবোলতাবোল বলছ আহ্নি!’ প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
‘আবোলতাবোলের কী আছে। যেটা মনে হয়, সেটা বললাম। আর বড় ভাইয়ের বউকে আমার পছন্দ না এই কারণে যে, উনি অনেক স্বার্থপর মানুষ। আর প্রচুর দেমাগ, হিংসুক, অহংকারী। এই জিনিসগুলো আমি পছন্দ করি না তাই এই জিনিস যার ভেতর আছে তাকেও আমার পছন্দ নয়। বুঝছ? সে এক বাচ্চা না দশ বাচ্চার মা থাক, তবুও যদি নরম, সরল মনের হতো, আমি তাকেও ভালবাসতাম। কিন্ত… উনার বিহেভই আমাকে উনার থেকে দূরে ঠেলে দিছে।’
যেন সব বুঝে গেছে, এমনভাবে মাথা ঝাকিয়ে প্রান্ত বলল, ‘হুম, বুঝলাম। আর তোমার পরিবার তোমার পছন্দ নয় কেন? তারা তো তোমার নিজের লোক।’
‘তাতে কী? তারা অন্যায় করলেও আমার সায় দিতে হবে তাতে? তাদের সাথে মিলে অন্যায় করতে হবে? যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই… সে যেই করুক। বাদ দাও এসব কথা। তোমার সাথে ঘুর‍তে আসছি, একটু মুক্ত বাতাস মুঠো ভরে নিতে। আর তুমি এসব কী শুরু করলা!’
‘আচ্ছা, বাবা, সরি। আর কোনো বাজে প্যাঁচাল না। ওয়েট, তোমার আমার মধ্যে কী আর কেউ এসে বসবে?’
‘আর কেউ আসবে মানে! কে আসবে?’
‘তাহলে তুমি আমার থেকে ওত দূরে সরে আছ কেন? কাছে আসলে কী খেয়ে ফেলব?’
আহ্নি শব্দ করে হেসে উঠল। প্রান্তের দিকে এগিয়ে বসে বলল, ‘বিয়েটা হতে দাও, কে কাকে খায়, দেখতে পারবা।’
‘মানে কী! তুমি আমাকে খাবা?’ প্রান্ত বিস্মিত।
আহ্নির দুষ্টু জবাব, ‘হ্যাঁ, খাব। কচকচ করে পানি ছাড়া চিবিয়ে খেয়ে ফেলব। এই যে এভাবে..’ বলে বড় হা-মুখ করে প্রান্তের দিকে ঝুঁকে আহ্নি, প্রান্ত দ্রুত মাথা পিছিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘না বাবা, তোমার বিশ্বাস নাই।’
আহ্নি হো হো করে হেসে উঠে….

ঝিলম প্রজাপতির মতো উড়ছে। তার মনে আনন্দের জোয়ার, বাবা, মা, বড় ভাই আসবে তাই। ভাবিও আসতো, তবে সে গর্ভবতী বলে আসতে পারল না।
ঝিলম রান্নাঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে দুপুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই দুপুর, রুই মাছ রাঁধা কী শেষ?’
দুপুর অগ্নি চোখে ঝিলমের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই চোখ নামিয়ে ফেলে। আবিরের সাথে ডিভোর্সের পর, তার জীবনে আরও একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে আর তা হলো, চাঁদকে টাকা না দেওয়ার কারণে চাঁদ সব ছবি নেটে ছেড়ে দেয়। দুপুরের কাছে টাকা ছিল, আবিরের ঝামেলার কারণে সব ভুলে গিয়েছিল সে.. আর ফলাফল, ইন্টারনেট জগতে দুপুর ভাইরাল!
এলাকা পুরো গরম হয়ে উঠেছিল। মানুষ এসে কত কটু কথা শুনিয়ে গেছে। কেউ কেউ তো বলেছে, রতির সাথে অন্যায়ের শাস্তি এসব। এরপর থেকেই আরাফ, তাশরিফের চোখে দুপুরের মূল্য শেষ। কয়েকদিন আগে, দুপুর বসে বসে খায় দেখে তাশরিফ কত বকাঝকা! পরে আরাফের কাছে বিচার দিলে আরাফও উল্টো বলে, ‘তোরে ইচ্ছা করে বকছে নাকি? কাজ করোছ না, বকব না? কাজ করলে শরীর কমে নাকি? উল্টা ভালো থাকে।’
এরপর দুপুর বুঝে গেছে, তার মূল্য কতটা!যদি ভাই, ভাইয়ের পয়সা খেতে হয় তাহলে আর বসে থাকার জো নেই। মা’কেই ছাড় দেয়নি এরা, আর তো বোন!

দুপুর রাগটুকু গিলে নিয়ে কোনোরকমে জবাব দেয়, ‘রান্না তো অনেক আগেই শেষ।’
‘তুমি এখন শশাগুলো কেটে রাখতেছ ক্যান? এগুলা শুকিয়ে চেপ্টা লেগে থাকবে তো।’
‘লাগবে না ভাবি, ফ্রিজে রাখব।’

ঝিলম কিছু বলল না। চলে গেল। দুপুরের দুই চোখ ভরে যায়। সে মিনমিনিয়ে বলল, ‘আম্মু, আমাকে কী আর বিয়ে দিবে না? এই জীবন ভাল লাগে না।’
লিলি বেগম সেমাইয়ে কিচমিচ ছাড়তে ছাড়তে মুখ বাঁকালেন, ‘যেই আকাম ঘটাইছেন, এখন আপনেরে বিয়ে করব কেডা?’
‘এই এলাকায় না সই, দূরের কোথাও হলেও দাও। এই ঘরে কামলা খাটতেছি, এর চেয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়েই খাটি। তাও তো মনটারে বুঝাতে পারব!’
‘টাকা পাব কই? তোর বাপের কামাই আছে? যে সম্পত্তি ছিল গ্রামে ওটাও তো বেঁচে তোকে বিয়ে দিলাম নাকি? এখন কী এই বাড়ি বিক্রি করে তোর বিয়ে দিব? আহ্নিটা কে দিতে হবে না?’
‘শুধু ছোটো মেয়ের কথাই ভেবে গেলা। ভাবো, ভাবো।’
‘একটা চড় দিব, বেয়াদব। তোকে তো একবার দিছি বিয়া, তুই না খাইতে পারলে আমার কী দোষ? কী বলছিল এইনে ওইনে ঘুরতে হ?’
দুপুরের বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মা’টাও পাল্টে গেছে। আজকে তো আরও বেশি গদগদ করছে ঝিলম কে, কী স্বার্থপর!

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া রুহি
*ছোটো পর্ব বলে অভিযোগ করবেন না প্লীজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here