সম্পর্কের প্রণয় পর্ব -০৩

#সম্পর্কের_প্রণয়
#পর্ব_০৩
#নুর_নবী_হাসান_অধির

তনুর এমন কান্ড দেখে গুলবাহার অনেক রেগে যান৷ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়েন৷ ঘৃণার সহিত বলে উঠলেন,

❝দিন দিন অবাক হয়ে যাচ্ছি এর ব্যবহারে৷ এমন নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি৷ বড়দের সামনে কিভাবে পারল এমন কাজ? মেয়ে মানুষের এত জিৎ ভালো নয়৷ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে এখন নিজেকে সাধু দাবী করছে৷❞
ঋষিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
❝মিথ্যাবাদী মেয়েকে আমি কখনও মেনে নিতে পারব না৷ মেয়ে ছিল না৷ তাকে পেয়ে মেয়ের অভাব ভুলে গেছিলাম৷ মেয়ের মতো ভালোবাসতাম৷ আমিও চাইতাম সে এই বাড়িতেই থাক৷ দ্বিতীয় বিয়ে তো কি হয়েছে? মানুষ কি পারে না’কি অতীত ভুলে নতুন করে সবকিছু তৈরি করতে! আমার মন বলছে তার এমন ব্যবহারের জন্যই তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। আজ আমি তোকে বলছি তুই তনুকে ডিভোর্স না দিলে সামলা৷ পরবর্তীতে এমন কাজ যেন করার সাহস না পায়৷❞
ঋষি কোন কথা বলছে না৷ মাথা নিচু করে মায়ের কথা শুনে যাচ্ছে । আসিফ চৌধুরী বলে উঠলেন,

❝এ নিয়ে কোন কথা শুনতে চাইনা৷ নিজেকে তার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখো৷ সে ভেবেছিল সারাজীবন এক সাথে ঋষির সাথে জীবন পার করবে৷ কিন্তু তোমার ছেলে ডিভোর্সের জন্য মা হবার জন্য অপেক্ষা করবে৷ তারপর ডিভোর্স দিবে৷ তার জায়গায় আমি হলে আর বেশি কিছু করতাম৷❞

আসিফ চৌধুরী আর কিছু বললেন না৷ স্বল্পভাষী আসিফ প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না৷ গুলবাহার স্বামীর পিছন পিছন চলে গেলেন৷ রাগে কথা বলতে পারছে না ঋষি৷ মনের মধ্যে রাগটা যেন পুষে রেখেছে৷ রাগ নিয়ে এগিয়ে গেল তনুর রুমের দিকে৷ তনু বারান্দার গ্রিল ধরে চোখের জল ফেলছে৷ নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না৷ কি থেকে কি হয়ে গেল? ঋষি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

❝এসবের মানে কি? তোমার স্বভাব এতটা নিচে নামবে ভাবতে পারিনি৷❞
তনু চোখের জল মুছে পিছনে ঘুরে তাকাল৷ কান্না করে চোখ ফুলে গেছে৷ কবে হাসছিল তা ভুলে গেছে! হাসি নিজের জীবন থেকে চলে গেছে৷ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগী গলায় বলল,

❝যা করেছি বেশ করেছি৷ আমি মেয়ে বলেই এত অবহেলিত। মেয়েদের কোন আত্মমর্যাদা নেই৷ যখন ইচ্ছা কাছে টেনে নিবেন। ইচ্ছা পূরণ হলেই দূরে ঠেলে দিবেন৷❞

❝তোমার কথার ধরন দেখে মনে হচ্ছে তুমি নয়৷ আমি তোমাকে অপমান করছি৷ মা বাবার সামনে এমন কান্ড ঘটিয়ে তোমার স্বাদ মিটেনি৷ এখন আমাকে কথা শুনাচ্ছো৷ আমায় আর রাগিয়ে দিও না৷ রাগ ভালো তবে অতিরিক্ত রাগ ভালো নয়৷❞
ঋষি এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইল না৷ তনুর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে সকল রাগ চলে গেছে৷ ইচ্ছা করছিল কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে৷ বুঝিয়ে দিতে নিজের স্থান৷ ভেজা টলমল নেত্রদ্বয় মনের গহীনে ভালোবাসা জাগিয়ে তুলল৷ ঋষি দরজার কাছে আসতেই তবু বলল,

❝মহান হওয়ার চেষ্টা করছেন নাকি আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন? আপনার সন্তানের মা হতে চলছি বলেই এত দয়া৷ আমার প্রতি আপনাকে কোন দয়া দেখাতে হবে না৷ আমি চলে যাব দূরে কোথাও৷ আমি আমার সন্তানকে মেরুদন্ডহীন বাবার কাছে তুলে দিতে পারব না৷ যে বাবা জোর গলায় বলতে পারে না সন্তানের জন্য হলেও তোমাকে আমার চাই৷ তুমিময় আমি আবদ্ধ। তুমি ছাড়া আমি শূন্য৷ কিন্তু স্ত্রী নয় সন্তান চান মহান ব্যক্তি৷❞

তনুর কথা পা আটকে গেল ঋষির। সত্যিই কি সে মেরুদণ্ডহীন! সে কি তনুর সাথে অন্যায় করছে? তবে তনুর কথা ঋষিকে রাগিয়ে দিল। রাগী গম্ভীর কন্ঠে বলল,

❝সত্যি কি তাই! তোমার কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যায়! ছয় মাস একসাথে ঘর বেঁধেছি কোনদিন সত্য কথা বলার সাহস পাওনি৷ কোনদিন বলতে পারনি কেন তুমি আমার আগে অন্য কারো সনে ঘরে বেঁধেছিলে৷ অবশ্য তোমার মুখ থেকে শুনলে রাগ হতো৷ সে রাগ কতদিন থাকত৷ সর্বোচ্চ এক বছর৷ কিন্তু দিন শেষে তুমি আমারই থাকতে৷❞

❝আমাকে কোনদিন কিছু বলার সুযোগ দিয়েছিলেন৷ সবথেকে বড় কথা হচ্ছে বিয়ের আগে কি কারোর কাছ থেকে জানতে পারেননি? আমার এটা দ্বিতীয় বিয়ে। কেননা পাড়া প্রতিবেশি কখনও লুকিয়ে রাখত না৷ আপনার সাথে তো হুট করেই বিয়ে হয়নি৷ দুই পরিবারের কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে তারপর আমাদের বিয়ে হয়েছে৷ এর মাঝে কেউ কি বলেনি এ কথা৷ একবার আপনার মা বাবাকে এই প্রশ্নটা করবেন৷❞

❝তোমার কথা মানছি এখানে আমাদের দোষ আছে৷ কিন্তু তোমার বাবা৷ তুমি তোমার বাবার একটুও দোষ দেখছো না৷ তোমার বাবা তো আমাদের কাছ সবকিছু লুকিয়েছেন৷ সেদিনও তো কথা কম বলেননি৷ আজ কেন আমি এসব কথা তুলছ?❞

❝ আমি একা থাকতে চাই৷ দয়া করে আমাকে একা ছেড়ে দেন৷ এখন আপনার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই৷ আসরের নামাজ পড়েছে৷ আমার কাছে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর অনুগত্য করা পারলে আপনিও নামাজ পড়ে নেন৷❞
ঋষি আর কথা বাড়াল না৷ তবে মনের গহীনে অনেক প্রশ্নের নাড়া দিল৷
______________________________
আঁধার কেটে দিনের আলো ফুটেছে। মহান সৃষ্টি কর্তা ধরনীর বুকে নতুন দিনের সূচনা করলেন৷ সবাই একসাথে বসে গল্পগুজবে মশগুল।
তনু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

❝অনেক হয়েছে আমাদের মধ্যে কাঁদা ছুটাছুটি। আমি চাইনা আমাদের কথা বাহিরের কেউ জানুক৷ বাহিরের মানুষের কানে এসব কথা ছড়িয়ে পড়লে উভয় পরিবারের মান সম্মান যাবে৷ সবথেকে বেশি অবহেলিত হবে আমার সন্তান৷ দয়া করে এমন কিছু আর করবেন না৷ আমার ভুলের জন্য আপনাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি৷❞
তনুর এমন হঠাৎ পরিবর্তন সবার মনে সন্দেহের বীজ বপন করল৷ তিন জোড়া নেত্র তনুর দিকে আবদ্ধ৷ তনু আবারও বলা শুরু করল,

❝ঋষি যা বলবে তাই হবে৷ তার কথার দ্বিতীয় কিছু হবে না৷ আমি যতদিন আপনার সাথে আছি ততদিন একটু শান্তি চাই৷ প্রাণ খুলে হাসতে চাই৷ সেই আগের মতো বাঁচতে চাই৷ মনের গহীনে জমিয়ে রাখা রাগ দূরে ঠেলে দিতে চাই।❞
গুলবাহার ঋষির দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,

❝তোমার কথা আমরা মেনে নিলাম৷ তুমি যা বলছো একদম ঠিক বলছো৷ তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে?❞
তনু ভয়ে ভয়ে বলল,

❝আপনাদের শর্ত আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।❞
গুলবাহার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

❝আমাদের সাথে থাকতে হলে আগে তোমার বাবার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে হবে৷ আমি যতদূর জানতে পেরেছি তোমার বাবার কাছে বিয়েটা একটা ছেলেখেলা। তিনি মনে করেন মেয়ে মানুষ কিছু করলে তাকে তার উপর অধিকার ফলানোর ক্ষমতা থাকবে না৷ তবে উনার একটা চিন্তা ধারাকে আমি সম্মান করি। সেটা হলো নিজের পরিচয় তৈরি করা৷ আমরাও চাই তুমি তোমার পরিচয়ে বড় হও৷ তোমাকে সবাই জানুক৷ কিন্তু খারাপভাবে নয়৷❞
তনুও এ কথা নিয়ে ভেবেছে৷ যতবারই তার বাবার সাথে কথা হয়েছে ততবারই তিনি ডিভোর্সকে প্রাধান্য দিয়েছেন৷ উনি শুধু বলতেন “আমার মেয়ে আমার কাছে বেশি হয়নি৷ আমি সারাজীবন আমার মেয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারব৷ ঋষি ডিভোর্স দিতে চাইলে একবারও মানা করেনি৷ আরও ডিভোর্সটা সহজ হওয়ার জন্য দেনমোহর ক্ষমা করে দিয়েছেন। দেনমোহর তো ক্ষমা হয়নি৷ দেনমোহরের সমস্ত টাকা বহন করেছে তনু৷ তনু কোমল গলায় বলল,

❝আমি বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিব৷ আমি চাই নিজের পরিচয়ে বাঁচতে৷ সাথে আরও একটা পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাই৷ সেটা হলো আমি একজন আদর্শ বউ৷ আর শেষ নিঃশ্বাস অব্দি ঋষির পাশে থাকতে চাই৷❞
ঋষির মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না৷ তনুর কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসল৷ তারপর তনুকে উদ্দেশ্য করে বলল….

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here