সুখতারার খোঁজে পর্ব -০১+২

১.
বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে বরবেশে নিজের হবু স্বামীকে দেখে ভূমন্ডলে ভূমিকম্প অনুভব করলো তারা। তার জিবন যেন থমকে গেলো কিছু সময়ের জন্য। লাল কালোর পাইর দেওয়া শেরোয়ানিতে কবিতার পাশে বসে বেশ হাসি নিয়ে তাকিয়ে অভ্র। তারার শুষ্ক ত্বকে পানির ছোঁয়া। নোনাজলে গড়িয়ে পড়ে মূহুর্তে। বুকে ধুপধাপ শব্দ কর্নকুহরে হানা দেয়।দু পা পিছিয়ে বিস্ফোরিত ছোখে তাকায় তারা। যে ছেলেটা কাল রাতেই কত শত কথা বললো, বিয়ের সম্পর্কে নানান ব্যাবস্হার কথা বললো, আর আজ? তারার চোখের সামনে ভাসছে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি বুড়ি অসুস্থ মা ছাড়া কেউ নেই তারার। লতিফার মেয়ের বিয়ে হবে শুনে সে কতই না খুশি! আনন্দ দেখার মতন নয়। সে মেনেনিতে পারবে তো?

শ খানেক মানুষের মাঝ থেকে একপা একপা করে পিছিয়ে যায় তারা।চোখ বাধ ভেঙেছে। কিছুটা পেছোতেই সোফার এক কোনা খিচে শক্ত হয়ে দাড়ায় তারা। বুক ফেটে কান্না আসছে তারার। দাড়ানো অবস্থাতেই তার কানে আসলো কাজি সাহেবের কন্ঠ,

-মা, এবার তিনবার কবুল বলুন।

এত মানুষের মাঝে কবিতার ‘কবুল’ বলা স্বর কানে আসলো না তারার। তারার তো কলিজা পুড়ছে। তার মাকে কি বলবে ও?

-আরে তুমি এখানে কি করছো? বান্ধবীর বিয়েতে কেউ এরকম দূরে থাকে?

কবিতার মায়ের কন্ঠস্বর! তারা চট করে চোখের পানি মুছে নেয়। ওনার ূিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে তারা,

-আন্টি আসলে আমারএকটু বাড়ি যেতে হবে।

-আরে তুমি কি বলো? ওসব হবে না আসোতো..

একপ্রকার টেনে নিয়ে স্টেজের সামনে আনা হলো তারাকে। তারাকে দেখে অভ্রের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বরং সে খুশি! যেন পৃথিবীটা তার হাতে। অজানা কারনেই তারাকে কষ্ট দিতে প্রচুর ভালো লাগে অভ্রের। অভ্র গলা খাকড়ি দিয়ে তারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আরে শালি যে, আসেন! কই ছিলেন এতক্ষণ?

তারা অস্রুসিক্ত নয়নে তাকায়। ধনি পরিবারের ছেলে অভ্র। তারার সাথে অভ্রের আলাপ করায় তারার চাচা।তাদের তারাকে পছন্দ হয়। সব দিনক্ষন ও ঠিক করে।প্রতিদিন কথা হতো তারা আর অভ্রের মাঝে। অভ্র তাহলে মিথ্যে আশা দিতো? কেন এমন করলো অভ্র? কেন তাকে তার মায়ায় ফেললো? এটাকি উচিত ছিলো? তারার চোখে পানি জমে। সে ভালোবেসে ফেলেছে অভ্রকে। এতদিন যে ছেলেটা তার সাথে কথা বললো, তাকে কত সপ্ন দেখালো, নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের পাশে দেখলে ঠিক কেমন লাগে তা সে হারে হারে টের পাচ্ছে। তারার কান্না সর্বপ্রথম কবিতার চোখে পড়ে। কবিতা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে তারাকে,

-কি রে? তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর?

তারা চোখ মুছে কবিতার পানে চোখ রাখে। ঠোঁট টেনে হেসে বলে,

-তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে কষ্ট হচ্ছে খুব। আমি আসি হ্যা? পড়ে কথা হবে ঠিক আছে?

তারা কোন দিকে না তাকিয়ে চলে যায় তৎক্ষনাৎ। পেছন থেকে কবিতা ডাক দেয় কয়েকবার। তারা শোনে না। চলে যায় সেখান থেকে।
______

বাড়িতে এসেই বিছানায় মুখ গুজে ডুকড়ে ওঠে তারা। বুকে এক বিশাল পাথর জমেছে। কবিতার বলা সারপ্রাইজটা এত বিরাট, বিকট হবে তা কল্পনাতেও আসেনি তারার।

পাশের রুম থেকে খক খক কাশির শব্দ কানে আসতেই চোখ মুছে বিছানা থেকে ওঠে তারা। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে পাশের ঘরে যায় তারা। তারার মৃত্যুর পর থেকে তারার মা অসুস্থ। তারার এক চাচা আছে। এমনিতে কথা না বললেও, সাংসারিক ভাবে কোন অর্থ না দিলেও, তারার বিয়েতে তার প্রবল আগ্রহ। অজানা করনেই সে যেন খুব উদগ্রীব হয়ে থাকে এ ব্যাপারে। অভ্রের ব্যাপারটাও তিনিই বলেছেন।

তারা তার অসুস্থ মায়ের সামনে বসে। গর্তে তলিয়ে যাওয়া কুটি কুটি দুটি চোখ নিয়ে তাকান লতিফা। মা হয়ে মেয়ের মন বুজতে সময় লাগেনা লতিফার। তিনি আলতো হাতে মাথায় হাত রাখেন তারার। তারা চকিতে দৃষ্টি নিয়ে রয়েছে।

-কি হয়েছে মা?

তারা নিশ্চুপ! লতিফা ফের জিজ্ঞেস করেন,

-কি হয়েছে বলবি তো।

তারা বিষন্ন মুখটা উবু করতেই লতিফা বলে ওঠেন,

-বিয়েতে গিয়ে ফিরে আসলি যে?

-বিয়েটা হবেনা!

নির্লিপ্ত উত্তর তারার। তার বুকে চলছে করাতের ছোবল। ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সব। লতিফা উৎগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-ভেঙে গেছে?

-হুম। কবিতার নয়, আমারটা!

লতিফা পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। অহরহ এমন ঘটছে! কিন্তু চোখে তার পানি জমেছিলো।
তারাউঠে নিজ ঘরে চলে যায়।

_________

-তোমার বেস্টফ্রেন্ডকে একবার কল করলে না? সে পৌছায়ছে কি না শুনবে না একবার?

বাসররাতে স্বামী অভ্রের এমন কথা চমকে তোলে কবিতাকে। কবিতা অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অভ্রের দিকে। অভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতন তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,

-না মানে একা একলা মেয়েকে পাঠিয়ে দিলে, একবার কল করা উচিত তোমার।

কবিতা প্রথম ধাক্কা খেয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটা! বাসররাতে কেউ এসব বলে? কবিতা সৌজন্য দেখাতে ফোন হাতে নেয়। ফের একবার অভ্রের দিকে তাকায়। অভ্র ফোনের দিকে ইসারা করতেই ফোন করে কবিতা। প্রথমবারেই ফোন রিসিভ করে তারা,

-কি রে? তুই এখন?

কবিতা একবার অভ্রের দিকে আরেকবার ফোনের দিকে তাকায়। সব গুলিয়ে আসছে তার। সে কি বলবে বুঝতেই পারছে না। অভ্র ভ্রু কুঁচকে ইসারা করতেই কবিতা বলে ওঠে,

-কেমন আছিস তুই?

কিছুক্ষণ নিরবতা কাটে। তারপর তারা জিজ্ঞেস করে,

-রাত ১১ টায় বলছিস কেমন আছিস?

অভ্র ফিসফিস করে বলে,

-আরে জিজ্ঞেস কর, সে পৌছায়ছে কিনা! ড্যাম ইট।

কবিতা একটা ঠোক গিলে বলে,

-পৌছায়ছিস তুই তারা?

-হ্যা কিন্তু..

-আচ্ছা রাখ তাহলে।

কবিতা বড় করে শ্বাস নিয়ে অভ্রের পানে ফের তাকায়। অভ্র পাশে শুয়ে পড়ে বলে,

-ঘুমাও এখন।

________

কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তারা। সারাটা রাত তার ঘুম হয়নি! একটু ফ্রেসনেসের জন্য খুব সকালে উঠে তারা। মাকে একবার বলে বেড়িয়ে পড়ে তারা। চাচাকেও আর কিছু বলেনি তারা। বলতেও চায়না। সে একাই থাকতে চায়। নিজে আর নিজের মাকে নিয়ে।

পথ পেড়িয়ে হাইওয়ে রাস্তায় তারা। আজ কোন রিকশার দেখা নেই। অনেক্ষন দাড়িয়ে থেকেও একটা রিকসা পেলো না তারা। তার উপর সূর্যের প্রখড় রোধ! তারার রোদ সহ্য হয়না! একটুতেই চোখমুখ জ্বলে যেন।

হঠাৎ সামনে এসে কালো রঙা একটি কার এসে থামে। তারা বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে নেমে আসে অভ্র। অভ্রকে দেখেই তারা সরে যায়। যে মানুষটা তার মুমুর্ষ মাকে কষ্ট দিয়েছে সে কেন আসেছে, আসবে? আর তারাই বা কেন তার সাথে কথা বলবে? ভালোবাসার মানুষটা সবথেকে চরম আঘাত দিয়েছে কালকে। তারার সামনে দাড়ায় অভ্র। তারা লক্ষ করতেই সরে যায়। অভ্র তারাকে টিটকারি দিয়ে বলে,

-পালাচ্ছো যে?

তারা চুপ থাকে। তার বুকে ছাইয়ে ডাকা আগুন আবারো জ্বলে উঠছে। বুকের পাথর ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে তারার। ভালোবাসার মানুষটা, যে কিনা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ শুধুই প্রাক্তন! যার ছবি মনে সবসময় আকঁতো তারা সে আজ তার প্রক্তন এটা মানতে যেমন কষ্ট হচ্ছে তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে সেই তার সামনে দাড়িয়ে বাঁকা হাসছে। তারা কিছু বলে না। তার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। দাড়ানো ভার হয়ে যাচ্ছে। অভ্রকি তারাকে কাঁদাতে এসেছে?

-কেন এসেছেন আপনি?

নিজেকে কঠোর করে বলে উঠলো তারা। অভ্রের বাঁকা হাসির মাত্রা দ্বিগুন হয়! অভ্র পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলে,

-কলেজ?

ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করে অভ্র। তবুও চুপ তারা। সে এখন অপেক্ষা করছে একটা রিকশার। যা পেলেই সে স্থান ত্যাগ করবে।

-কথা বলবে না?

-কোন অধিকারে বলুন তো? বিয়ের পর কেন অন্য একটি মেয়ের কাছে এসেছেন আপনি? আপনার স্ত্রী হয়তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। প্লিজ যান এখান থেকে। একা থাকতে চাই আমি। কেন এসেছেন?

চিৎকার করে বলে উঠলো তারা। অথচ অভ্র হাসছে। যেন খুব মজার কথা বলেছে তারা।

-জানো তারা? আমাদের কাল রিসিপশন। আর কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা হানিমুনে যাবো। আমার না ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে যে শুধু আমি আর কবিতা, কবিতা আর আমি একা, একলা সেখানে! উফফ! হাউ রোমান্টিক না?

তারা ফুপিয়ে ওঠে! এমন আকিঁবুকিঁ তারাও করেছিলো ভালারবাসার মানুষটাকে নিয়ে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। ক্রমশ অসর হয়ে আসছে হাত পা। বুক ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে অভ্রের প্রতিটা কথায়। অথচ, অভ্র হাসছে, সে তারাকে কাঁদাতে পেরে যেন বিশ্বজয় করেছে।
#সুখতারার_খোঁজে🧚‍♀️
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ২

ভালোবসার মানুষটার রিপশনেও যেতে হবে তা কল্পনায়েও ভাবতে পারেনি তারা। আবার ঘটা করে নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে। পাথারচাপা বুক ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে। ফোনের ওপারে কবিতা উত্তরের অপেক্ষায়। তারার গলায় দলা পাকাচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব! কিন্তু কার জন্য? একজন প্রতারক? তার জন্য?

-তারা তুই কথা বলছিস না কেন? কি রে?তুই লাইনে আছিস?

তারার ধ্যান ভাঙে। সে একটা শুকনো ডোক গিলে নিজেকে সামলানোর ব্যার্থ চেষ্টা করে। অত সহজ কাউকে ভোলা? পারে কেউ? পারে হয়তো, কিন্তু তারা পারছে না। বাধ ভাঙা নদীর মতন চিৎকার ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। বুকের কোথাও কাটা বিধছে, মাত্রাতিবিষাক্ত সে কাটা!

তারা ফোনটা ঠিক করে নেয়। তার হাত কাঁপছে। যেখানে কবিতা নিজেই ফোন করে বলছে সেখানে কি করে না করতে পারে তারা? তারা এক বিন্দু অস্ত্রু ফেলে উত্তর দেয়,

-আরে..যাবো না কেন? নি..ষ্চই যাবো। নিষ্চই। কাল দেখা হবে কেমন?

ফোনটা কাটার আগেই ওপাড় থেকে কবিতা বলে ওঠে,

-বন্ধুবী দাড়া! তোর দুলাভাই কথা বলবে।

তারা স্তব্ধ! না করবে? এটাতো খারাপ দেখায়। ওপাড়ে কবিতা অভ্রকে ফোন দেয়। অভ্র ফোন হাতে নিয়েই বলে,

-শালির তাড়াহুড়ো খুব দেখছি। একটি মাত্র শালি আমার। তোমায় চটজলদি আসতে হবে কিন্তু। আর হ্যা, আমাদের গিফটটা নিয়ে আসিও কেমন?

ঠেস দিয়ে কথাটা বলে উঠলো অভ্র! বরংবার শালি বলে কি সে বোঝাতে চায় অভ্র? সে সুখি? নাকি কষ্ট দিতে চায়?,ভাবে তারা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব। ওপারে অভ্র ব্যাস্ততার সহিত বলে,

-কি হলো? কথা বলেনা কেন? এ তোমার কেমন বন্ধু কবিতা?

তারা নিজেকে সামলে বলে,

-নিশ্চই যাবো। তাহলে বিকেলে দেখা হচ্ছে।

-আরে বিকেলে মানে? এত এত কাজ! তুমি তাড়াতাড়ি আসো। শালিকা হিসেবে একটু খাটবে না? কাল দুপুরের দিকেই চলে এসো কেমন?

-জ্বি

বলেই ফোন কেটে দেয় তারা।বুক ফেটে আসছে। কেন তাকে একলা করে গেলো তার বাবা? কেন এত বড় বড় কঠিন পরিক্ষা দিতে হচ্ছে তাকে? অন্য সবার মত তার জিবনটা হতে পারতো না? খুব খারাপ হতো? তারার মনে অভিযোগ জাগে। নিম্ন মধ্যবিত্য পরিবারের তারা। গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান আমিন আহমেদ। তার ছোট্ট সাক-সবজির দোকান ছিলো। তা দিয়েই সংসার চলতো। কিন্তু উনার মৃত্যুর পর লতিফা ব্যারামে আক্রান্ত হন! কঠোর রোগের বাসা বাঁধান শরীরে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি খাওয়া নাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। ফলে রোগ অতি তারাতাড়ি জায়গা করে নেয় শরীরে লতিফার। সয্যাসাহী হয়ে পড়েন লতিফা। নবমে পড়ুয়া তারা তখন কেবল পৃথিবী জানতে লেগেছে! কিন্তু যখন তার পড়াশোনা, হাসি মজার দিন ছিলো তখনি তাকে ধরতে হয় সংসারের হাল। তারার একটিমাত্র চাচা যে কিনা আমিনের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তারাদের খোজ খবর প্রায় দিনেই নিতো সে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়। পথ একটিই তখন খোলা ছিলো তারার কাছে। টিউশনি! সেটাই করিয়ে সংসার, নিজের পড়াশোনা চালায়, চালিয়েছে! তবে এখন একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায় তারা। একজন প্রাইভেজ টিচার হয়ে। চাকরির জন্য আবেদনও করেছে তারা।

তারা রান্নাঘরে চলে যায়। উনুনে ভাত, সবজি বসিয়ে নিজের বইগুলো নিয়ে বসে। সামনে তার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের এক্সাম। তার সব ওলট পালট করে দিয়েছে অভ্র নামক মানুষটা! ঠকিয়েছে তাকে।

২.
সকালের সুভ্র আলো ফুটেছে!
পাখিদের কিচিরমিচিরের আওয়াজ ভেসে আসে কানে। তারা চোখ মেলে তাকায়। সূর্যের আলো ফুটতে আর মাত্র কয়েক মুহুর্ত বাকি। তারার মুখ শুকনো। পুরো রাত তাকে কাদিয়েছে অভ্রের কিছু প্রাক্ত মেসেজ, কল! তারা বড্ড মিস করছে অভ্রকে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ফোনটা একবার হাতে নেয় এই আশায় হয়তো তার একটি মেসেজ পাবে! পরক্ষণেই ভাবে, সে এখন বিবাহিত! এসব কি ভাবছিস তুই তারা? কবিতা, যে কি না তোর বেস্টফ্রেন্ড…

তারার মনে পড়ে কালকে রাতের কথা। রিসিপশনে গেলে তো কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হবে! তারা কি নেবে? মাস তো প্রায় শেষের পথে। টাকা বলতে মাত্র দুটো পাচঁশত টাকার নোট! তারা ছুটে উইখাওয়া কাঠের টেবিলের কাছে যায়। টেবিলে পাতানো ওড়না তুলতেই দেখতে পায় দুটো নোট। টাকাগুলো হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের নোনাজল আড়াল করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে তারা। এখনো তার মায়ের ঔষধ কেনা বাকি! কোন কিছু আর ভাবতে পারেনা তারা। টাকাগুলো নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

৩.
মিষ্টি কালারের সালোয়ার কামিজ পড়েছে তারা।চোখে দিয়েছে একটু কাজল! তার লম্বা কালো কেশগুলো একপানে রেখে গাঁথুনি বিনি দিয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার এতটুকুতেই অপ্সরি লাগছে তারাকে। তার রেশমি কালো চুল তার প্রখড়ভাবে দ্বিগুণ করে তুলেছে। টেবিল থেকে গিফট বক্সটা হাতে নিয়ে তার মায়ের কাছে চলে যায়। বুড়ি মা দিনদিন বেশি অসুস্থ হচ্ছে। উল্টোদিক ফিরে শুয়ে আছেন লতিফা। তারা ডাক দেয়,

-মা..

লতিফা ওভাবেই উত্তর দিলেন,

-বল তারা।

-আমি একটু বেরোচ্ছি। আজ কোচিং বিকেলবেলা। তোমার পাশে সবই দেয়া আছে। কিছু লাগলে পাশ থেকে নিও।

-আচ্ছা।

তারা একপাএগিয়েই আবারো পেছন ফিরে বলে,

-তোমার পাশে দুধ রাখা আছে। খেয়ে নিও।

কথাটা কর্নকুহরে যেতেই ঘুরে শোন লতিফা। জিজ্ঞেস করেন,

-দুধ? কই পেলি?

-তোমার শরীরের দিনদিন যা অবনতি হচ্ছে..কাল নিয়েছি এক পোয়া তুলি বুবুর থেকে নিয়েছি। খেয়ে নিও।

তারা বেড়িয়ে যায়। লতিফার কোথাও গর্ব হচ্ছে।

হাইওয়েতে উঠে রিকশা করে রওনা হয় তারা। রিকসা অভ্র মঞ্জিলের সামনে থামে। ভারা মিটিয়ে ভেতরে যেতেই কিংকর্তব্যবিমুঢ। গাধা ফুল, রজনীগন্ধার মালা গেথে সাজানো হয়েছে পুরো বাড়ি, চিকচিকে আলোয় চকচক করছে সন্ধ্যার পুরো গার্ডেন। মানুষও কম নয়। শ’খানেক মানুষ এরিমধ্য উপস্থিত। তারা গার্ডেন পেড়িয়ে ভিতরে যায়। কবিতার সাথে দেখা করার জন্য। বাড়িতে পা রাখতেই তার উদ্ভট এক শিহরণ হয়। এটা হয়তো হতে পারতো তার শশুরবাড়ি! দরজা পেরোতেই ড্রইংরুমে চোখে পরে পলক ইরাকে। উনি অভ্রের মা। তারাকে দেখেই উনি চলে আসলেন। বললেন,

-এত দেড়ি কেন করলে?

-দেড়ি হয়ে গেল। কবিতা কই আন্টি?

-উপরে। রুমেই আছে। যাও, দেখ হয়তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছে।

তারা মুচকি হেঁসে পাশ কেটে উপরের দিকে হাটা দেয়। বিশাল এক বাড়ি অভ্র মঞ্জিল। রুমের অভাব নেই। তারা হেটে চলে। অভ্রের রুম অচেনা তারার কাছে। তবুও হেঁটে চলে তারা। একটি রুম থেকে কবিতার আর একটি মহিলার হাসাহাসির আওয়াজ আসছে। তারা সেদিক পানে এগোয়। কিন্তু রুমে ডোকার আগেই কেউ হেঁচকা টান দিয়ে দেয়ালে মিশিয়ে নেয়। আচমকা এমন হওয়ায় হকচকিয়ে ওঠে তারা। জান যেন উড়ে যাচ্ছিলো। চোখ খিচে বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে তারা। সামনের লোকটা হাতদ্বয় দেয়ালে খিচে ধরে। তারা তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে। কালো পাঞ্জাবি পড়নে অভ্র বাকা হাসছে। তারার মেজাজ গরম হয়ে যায় অভ্রকে দেখে। চেয়াল খিচে বলে,

-এসব কিরকম অসভ্যতা আপনার?

অভ্র মুখ তারার কানের কাছে এনে বলে,

-অসভ্যতা? তুমিতো এমনই কিছু চাও তাইনা?

তারার ঘৃনা দৃষ্টিতে তাকায় অভ্রের দিকে। একজন মানুষ আর কতটা নিচ হতে পারে? তারার নিজেকে ধিক্কার দেয়,’তার লজ্জা হয় এরকম কুৎসিত মনের একজনকে সে ভালোবেসেছে। তারা বলে ওঠে,

-আমার লাগছে ছাড়ুন। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।

-তো করো না! ভাঙুক তোমার বেস্টফ্রেন্ডের সংসার। করো চিৎকার। আমায় আর তোমায় এভাবে দেখলে তো যে কেউই মেনে নেবে যে আমাদের মাঝে কিছু আছে। নাও স্টার্ট প্লিজ।

তারা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। অভ্রের মুখটা তার কাছে এখন বিষ মনে হচ্ছে। অভ্র চেয়াল খিচে শক্তহাতে তারার হাত গাল টিপে ধরে। তারা কেঁদে ফেলে। অনুনয়ের ন্যায় বলে,

-ছাড়ুন আমায়। যেতে দিন। বিশ্বাস করুন, আমি আর কোনদিন আসবো না।

চেয়াল শক্ত করে তারাকে বলে অভ্র,

-এতটুকুতেই? যা করতে পারবি না তা বলিস কেন হু?

‘হুহ্’ শব্দটি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো অভ্র।

-অভ্র!

তৃতীয় কারো স্বর পেতেই তারাকে ছেড়ে দেয় অভ্র। কবিতাকে দেখেই থমকে যায় তারা, অভ্র। তারার ভূমন্ডলে দ্বিতীয়বারের মতন ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here