সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -২৭

পর্বঃ২৭
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)

সূর্যের কিরণ জানান দিচ্ছে এখন দুপুর গড়িয়েছে। সূর্যের কিরণ কমতে শুরু করেছে কিন্তু তাপ এখনো কমেনি। সূর্যের তাপে মাথার উপর ফ্যান থাকা সত্ত্বেও গরম লাগছে।

বিছানার এক কোণায় রাইদা বসে আছে পাশেই রুহি, পায়েল বসা। ড্রইং রুমের সোফা বেডরুমে টেনে এনে তাতে অর্ক আর ফাহিম বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। অর্ক এসেছে পর থেকে রাইদার সাথে কোনো কথা বলছে না চুপ করে বসে আছে। রাইদা বেশ বুঝতে পারছে অর্ক রেগে আছে। রাইদা বুঝতেই পারেনি রুহি ওকে ঘরে আঁটকে রাখার ফন্দি এঁটেছে। দুপুরে খাওয়ার পর রাইদা একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিলো শব্দ পেয়ে উঠে দেখে সবাই উপস্থিত।
পায়েল ফোন বের করে বাপ্পিকে আবার কল দেয়। দরজায় নক করার শব্দ হলে পায়েল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

পায়েল এসে বিছানায় বসে দরজা লাগিয়ে পিছন পিছন বাপ্পি আসে। সকলের থমথমে মুখ দেখে বাপ্পি পায়েলকে খোঁচা মেরে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। পায়েল জবাব দেয় না বাপ্পিও চুপ করে বিছানায় বসে।

‘সবাই এখানে উপস্থিত আছে এখন আমাদের ডিসকাশন করা উচিত বিষয়টা।’,নিরবতা ভেঙে অর্ক বলে।

‘কি হয়েছে এতো জরুরি তলব করলি কেনো?’,বাপ্পি জিজ্ঞেস করে।

‘আমি ভাবতাম আমরা ছয়জন একটা পরিবার বিপদে আপদে একে অপরের পাশে থাকাই আমাদের বন্ধুত্বের অংশ। সকলকে আমি সমান ভালোবাসি কিন্তু রাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আগে থেকে তাছাড়া আমরা একে অপরকে ভালো করেই বুঝি। সবসময় বিশ্বাস করতাম রাই আমার থেকে কিছু লুকাবে না সেই রাই আমার থেকে এতো বড় কথা লুকিয়েছে ভেবেই নিজেকে ছোট লাগছে।’

অর্কের কথা শুনে রাইদা মুখ কালো করে ফেলে।

‘অর্ক এখনো কিছু প্রমাণ হয়নি তুই রাইকে জিজ্ঞেস কর বিষয়টা।’,পায়েল প্রতিবাদ করে বলে।

‘কর জিজ্ঞেস দেখ কি বলে।’,অর্ক পায়েলের কথার জবাব দেয়।

‘কি হয়েছে?’,বাপ্পি প্রশ্ন করে।

‘অর্ক সন্দেহ করছে রাইয়ের কারো সাথে সম্পর্ক আছে আর এই ফ্ল্যাট সেই ছেলের। পুরো ঘটনা রাই আমাদের থেকে লুকিয়েছে আর বাসা থেকে হয়তো সেই ছেলেকে নিয়ে ঝগড়া করে বেরিয়েছে।’, পায়েল বাপ্পির কথার উত্তর দেয়।

‘তোরা কি ঐ মাসুমের কথার উপর ভিত্তি করে ভাবছিস রাইয়ের বয়ফ্রেন্ড আছে? মাসুমের চরিত্র সকলেরই জানা। আর ফ্ল্যাটের বিষয়টা কোথা থেকে আসছে? কোনো ছেলে যদি এসে নিজের মুখে বলেও আমি রাইয়ের বয়ফ্রেন্ড আমি কখনোই বিশ্বাস করবো না।’,বাপ্পি বলে উঠে।

‘রুহি চুপ আছিস কেনো বল। ‘,অর্ক বলে।

‘রাইয়ের খাটের নিচে ছেলেদের শার্ট,প্যান্ট পেয়েছি। সোফার উপর ব্লেজার দেখেছি আবার কিচেনে দুটো আধোয়া প্লেট পেয়েছি কিন্তু তারমানে এই না যে আমি বলেছি রাইয়ের সাথে কোনো ছেলের সম্পর্ক আছে। এমনও হতে পারে যার ফ্ল্যাট জামা কাপড় তার।’,রুহি জবাব দেয়।

‘তোর কথাতেই উত্তর লুকিয়ে আছে।’,অর্ক বলে।

‘রাই তুই চুপ করে আছিস কেনো? তোর নিরবতা আমাদের মধ্যে ভাঙন ধরাবে এটা বুঝতে পারছিস না?’,ফাহিম রাইদাকে বলে।

‘আমার এই বিষয়ে কিছু বলার নেই। তোরা যা ভাবার ভেবে নে, আমি তো জানি কি পরিস্থিতিতে আমি আছি তাই এ বিষয়ে আমি কোনো ডিসকাশন করতে চাই না।’,রাইদা থমথমে গলায় বলে।

‘রাই সবসময় ত্যাড়ামি করে তুই মূল ঘটনা এড়িয়ে যাস এবারো তাই করতে চাইছিস।’,অর্ক রেগে বলে।

‘অর্ক প্লিজ তুই শুধু শুধু ঝামেলা করছিস বিষয়টা নিয়ে। রাইয়ের আরাফ ভাইকে পছন্দ আমাদের তো প্রথমেই বলেছে। এতো জলদি প্রেমের সম্পর্কে যাওয়ার মতো মেয়ে রাই না সেটা আমরা সবাই জানি আর তুই তো আমাদের থেকে ভালো জানিস তারপরও সন্দেহ করে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাচ্ছিস।’,বাপ্পি অর্কের সামনে বসে কথাগুলো বলে।

‘রাই কারো সাথে সম্পর্কে গেলে সমস্যা নেই তো আমিও চাই ওর জীবনে কেউ আসুক কিন্তু সঠিক মানুষট আসুক। আমার সমস্যা ও আমাদের থেকে কথাটা লুকিয়ে রেখে যদি কোনো বিপদে পরে?’,অর্ক জবাব দেয়।

‘রাইয়ের প্রতি তোর যেমন চিন্তা হয় আমাদেরও চিন্তা হয়। আমার জানা মতে রাই আমাদের কষ্ট দেওয়ার মতো কিছু করবে না।’,রুহি রাইদার বাহু ধরে বলে।

সকলের কথা শুনে রাইদার নিজের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করতে শুরু করে।

‘অর্ক তোর উচিত অন্যের কথায় কান না দেওয়া স্পেশালি ঐ মাসুমের কথায়। ও তো সকলের কাছে বলে বেড়ায় রাই ওর গার্লফ্রেন্ড তাই বলে কি মিথ্যা সত্যি হয়ে গেছে? এখন রাইকে আমাদের কাছে খারাপ করতে এই মিথ্যা গুজব হয়তো রটিয়েছে।’,পায়েল বলে।

‘আমি কিছু বলতে চাই। আশা করি সবাই আমার কথা গুলো মন দিয়ে শুনবি আর বুঝার চেষ্টা করবি। বিশাল একটা ঘটনা আমি তোদের থেকে লুকিয়েছি যেটা আমার আগেই বলা উচিত ছিলো।’,রাইদা বল উঠে।

রাইদার এমন কথা শুনে সকলে উৎসুক হয়ে তাকায় রাইদার দিকে। রাইদা চোখ বন্ধ করে কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নেয়ে বলার জন্য।
দরজায় নক করার শব্দ হলে চোখ খুলে তাকায় রাইদা। ধীরে ধীরে নক করার শব্দ বাড়তে থাকে। ফাহিম উঠে গিয়ে দরজা খুলে।

সায়ন তড়িৎ গতিতে বেডরুমে আসে। সায়নকে দেখে রাইদা চোখ বড়বড় করে তাকায় বাকিরা বুঝার চেষ্টা করে লোকটা কে। রাইদা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

সবাইকে অগ্রাহ্য করে সায়নে রাইদার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

‘তোমার ফোন কোথায়? কতগুলা কল দিয়েছি সকাল থেকে খবর আছে তোমার? ফোন দিলে যখন তোমার খবর থাকে না তখন ফোন রাখছো কেনো? কেয়ারলেস মেয়ে। মিটিং ফেলে দুইবার আসতে হলো আমাকে। সকালে এসে তোমাকে পাইনি তাই এখন আবার আসলাম।’,রেগে রাইদাকে কথাগুলো বলে সায়ন।

রাইদা কোনো জবাব না দিয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। বিছানার উপর থাকা রাইদার ফোন নিয়ে সায়ন দেখে ফোনে চার্জ নেই। ফোনটা নিয়ে চার্জে লাগায়।

‘রাই উনি কে?’,অর্ক জিজ্ঞেস করে।

‘তোমরা নিশ্চয়ই রি এর বন্ধু?’,অর্ককে প্রশ্ন করে সায়ন।

‘আমরা যেই হই আপনি নিজের পরিচয় দেন আগে।’,সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে বলে অর্ক।

‘আপনি প্লিজ এখান থেকে যান আপনাকে আমি কল দিবনি। অর্ক শোন আমরা এই বিষয়ে এখন ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো।’,অর্কের হাত ধরে সায়নের সামনে থেকে অর্ককে সরিয়ে রাইদা বলে।

অর্কের হাত রাইদা ধরায় সায়নের বিষয়টা ভালো লাগেনি। রাইদার আরেক হাত সায়ন চেপে ধরে।

‘কোন পরিচয় জানতে চাও শালাবাবু? তোমাদের বন্ধু নিশ্চয়ই আমার বিষয়ে কিছু বলেনি? আমি ইমতিয়াজ সায়ন আরেকটা পরিচয় হলো তোমাদের দুলাভাই হই সম্পর্কে।’, বাম হাত দিয়ে রাইদার হাত চেপে ধরে ডান হাত পকেটে ভরে কথাগুলো বলে সায়ন।

সায়নের মুখে এমন কথা শুনে বসা থেকে সকলে দাঁড়িয়ে যায়। রাইদা মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘মানে? কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন?’,বাপ্পি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

‘আপনি সেই সায়ন? কিন্তু আপনার কথার মানে কিছুই বুঝতে পারছি না।’,পায়েল ও প্রশ্ন করে।

‘বিষয়টা না বুঝার কি আছে শালিকা? তোমার বান্ধবী আমার বিয়ে করা বউ হলে তোমরা আমার শালক-শালিকা হও সিম্পল। বিয়েটা এতো তাড়াতাড়ি হয়েছে আমরা নিজেরাও প্রস্তুত ছিলাম না।’,সায়ন আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে জবাব দেয়।

‘বিয়ে? কবে হলো বিয়ে? রাই আপনাকে বিয়ে করবে এটা অসম্ভব। রাই তো আপনাকে পছন্দই করে না।’,পায়েল অবাক হয়ে বলে।

‘ভাগ্যে থাকলে অপছন্দের মানুষটাই জীবন সঙ্গী হয় আর না থাকলে পছন্দের মানুষটাকেও মানুষ জীবনে পায় না।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘উনি যা বললো সেগুলো কি সত্যি? চুপ করে থাকিস না প্লিজ জবাব দে রাই।’,অর্ক রাইদাকে প্রশ্ন করে।

‘হ্যা উনি যা বলেছে সত্যি কিন্তু এর মধ্যে অনেক ঘটনা আছে আমাকে একটু সময় দে বুঝিয়ে বলছি।’,রাইদা করুণ স্বরে অর্ককে বলে।

‘থাক তোর আর কিছু বুঝাতে হবে না আমাকে। স্বামী পেয়েছিস এখন তো আর বন্ধুদের প্রয়োজন নেই। দোয়া করি ভালো থাক তুই।’,অর্ক কথাগুলো বলে।

অর্ক রাইদার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মেইন দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়।

‘আমি আমার বলা কথা ফিরিয়ে নিলাম রাই।’,বাপ্পি বলে।

‘আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না তুই আমাদের থেকে এতো বড় কথা লুকিয়েছিস! সত্যিই রাই বিশাল সারপ্রাইজ দিলি।’,পায়েল তাচ্ছিল্য স্বরে রাইদাকে বলে।

সকলে রাইদার পানে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে যায়। মিনিটের মধ্যে সকলে পুরো ফ্ল্যাট খালি করে বের হয়ে যায়। সায়নের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করি রাইদা। সায়ন যখন বুঝতে পারে তার কারণে রাইদা আর ওর বন্ধুদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে তখন হাত ছেড়ে দেয় রাইদার। ততক্ষণে রাইদার বন্ধুরা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে চলে গেছে।

রাইদা ফ্লোরে বসে পরে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না।

‘পানি খাও আমি দেখছি কি করা যায়।’,রাইদার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে সায়ন।

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সায়নের শার্টের কলার দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে রাইদা।

‘এটাই চেয়েছিলেন তো? এখন খুশি আমাকে একা করে দিয়ে? কি ভেবেছেন আমি একা হলে অসহায় হয়ে যাবো? আর সেই অসহায়ত্বের সুযোগ নিবেন আপনি? আপনি একজন খারাপ লোক বহুত খারাপ। আগেরবারও আমায় কষ্ট দিয়েছেন এবারো দিলেন। আপনি প্লিজ আমায় একা ছেড়ে দেন। প্লিজ একা ছাড়ুন।’,কথাগুলো বলতে বলতে সায়নের কলার ছেড়ে রাইদা কান্নায় ভেঙে পরে।

রাইদার কান্না দেখে সায়ন বিচলিত হয়ে যায়। দু’হাতে রাইদাকে আগলে রাইদার মাথা নিজের বুকে রাখে। সায়নকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে রাইদা।

‘ওরা চলে গেলে আমি কাদের নিয়ে বাঁচবো? আমার পরিবার বলতে ওরাই আছে। বাবা-মা যেই ভালোবাসা যত্ন দেয়নি সব অর্ক দিয়েছে। সবসময় ছায়ার মতো পাশে ছিলো আজকে সেই ছেলেকে আমি মিথ্যা বলে কষ্ট দিলাম।’,কাঁদতে কাঁদতে রাইদা বলে।

সায়ন চুপচাপ রাইদার কথা শুনতে থাকে। কিছুক্ষণ পর রাইদার হুঁশ আসে সে সায়নকে জড়িয়ে রেখেছে সাথে সাথে সায়নকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে ফেলে। রুম থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। রাইদার যাওয়ার পানে তাকিয়ে সায়নও বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। মেইন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে রাইদা বুঝতে পারে সায়ন বের হয়ে গেছে ফ্ল্যাট থেকে। সায়ন যাওয়ার কয়েক মিনিট পর রুমের দরজা খুলে রাইদা বের হয়। ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খোলার চেষ্টা করলে বুঝতে পারে বাহির থেকে দরজা লক করে গেছে সায়ন।

সায়নের এমন কান্ডে রাইদার প্রচন্ড রাগ হয়। রুমে গিয়ে দেখে তার ফোনটাও নেই। পুরো রুমে খুঁজে কিন্তু ফোন পায় না, বুঝতে পারে সায়ন ফোনটা হয়তো নিয়ে গেছে। এবার রাইদার মনে ভয়,রাগ দু’টোই হয়। একে তো রাইদার ফোনে কোনো লক করা নেই আবার আরাফের দেওয়া মেসেজ গুলোও তার ফোনে রয়ে গেছে। সেগুলো একবার যদি সায়ন পড়ে তাহলে আরেক ঘটনা ঘটবে।
কি হবে ভেবেই দু’হাতে দিয়ে মাথা চেপে ফ্লোরে বসে পরে রাইদা।

..

কতক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে রাইদার জানা নেই তবে বাহিরে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে দেখে আন্দাজ করলো ঘন্টা দু’য়েক পেরিয়েছে সে এখানে বন্দি। মেইন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে রাইদা বুঝতে পারে সায়ন হয়তো এসেছে তাই সে বেডরুমের দরজা আঁটকে দেয়।
দরজা আঁটকে বিছানায় গিয়ে বসে আর পণ করে দরজা খুলবে না। দরজার অপরপাশ থেকে নক করার শব্দ হয়।

‘রাই দরজা খোল জলদি।’
অর্কের কন্ঠ পেয়ে রাইদা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে।
দরজা খুলে রাইদা অর্ককে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।

‘বিশ্বাস কর আমি এসব তোদের থেকে লুকাতে চাইনি শুধু লুকিয়েছি কারণ এ বিয়ে আমি মানি না। ভেবেছিলাম তোদের বললে তোরাও সকলের মতো আমাকেই অপবাদ দিবি তাই বলিনি।’,কান্না জড়িত কন্ঠে বলে রাইদা।

‘আম সরি রাই আমি বুঝতে পারিনি এতো কিছু ঘটেছে তোর সাথে। তুই তো জানিসই তোকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা হয় তাই কয়েকদিন ধরে তোর অস্বাভাবিক ব্যবহারে আমি চিন্তায় ছিলাম। হুট করে আজকে এসব শুনে মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি। আমার তোর সাথে ওমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি।আমাকে মাফ করে দে রাই।’,অর্ক অপরাধীর ন্যায় বলে।

রাইদার চুলে অর্ক হাত বুলিয়ে দেয়। পাশে দাঁড়ানো সায়ন জোরে জোরে কাশি দেয়। সায়নের কাশির শব্দে রাইদা চোখ খুলে সায়নের দিকে তাকায়। সায়ন চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। সায়নের সামনে অর্ককে জড়িয়ে ধরেছে মনে হতেই অর্কের থেকে সরে দাঁড়ায় রাইদা।

‘সায়ন ভাই আমাকে সব বিস্তারিত বলেছে। আমি রাগ করতাম না যদি তুই প্রথম দিনই আমার সাথে বিষয়টা শেয়ার করতি। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে কথা বলতে চাই না। ভবিষ্যতে আমার থেকে কিছু লুকাবি না এটাই চাওয়া আমার।’,অর্ক রাইদাকে বলে।

‘আমিও এইসব ঝামেলা নিয়ে থাকতে চাই না। এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই।’,থমথমে গলায় রাইদা বলে।

‘দুই বন্ধুকে মিলিয়ে দিয়ে মাঝে আমি ভিলেন হয়ে গেলাম? শালাবাবু এটা তো কথা ছিলো না! তোমাকে এনে তো আমার ক্ষতি হলো। বউ তো আমার সামনেই তোমার সাথে প্লান শুরু করে দিয়েছে আমাদের সংসার ভাঙার।’,সায়ন নিজের দু’হাতে পকেটে গুঁজে বলে।

‘আমি আপনার সাইডের ঘটনা শুনেছি কিন্তু এখনো রাইয়ের সাইডের ঘটনা শুনিনি। ওর সাইডের ঘটনা শুনি, ও কি চায় সেটাও শুনি এরপর কাকে সাহায্য করবো সেটা একান্ত আমার বিষয়। আর হ্যা আমাদের ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই।’,অর্ক হেঁসে জবাব দেয়।

অর্কের কথা শুনে সায়ন ঠোঁট চেপে হাসে।

‘তুই রেস্ট কর আমি এখন গেলাম কালকে ভার্সিটিতে বাকি কথা শুনবো।’,অর্ক রাইদাকে বলে।

‘বাকিরা কোথায়? ওদের বুঝিয়ে বলিস প্লিজ।’,রাইদা অর্ককে বলে।

‘চিন্তা করিস না আমি ম্যানেজ করে নিবো। তুই নিজের খেয়াল রাখ,গেলাম আমি।’, রাইদাকে বিদায় দিয়ে অর্ক চলে যায়।

অর্ক যেতেই রাইদা দরজা লাগিয়ে বেড রুমে আসে। বেডরুমে ঢুকলে সায়নের কথা মনে পড়ে তখন পিছনে ঘুরে সায়নকে দেখতে নিলে সায়নের সাথে ধাক্কা খায়। বাম হাত দিয়ে রাইদার কোমড় ধরে নিজের কাছে টেনে আনে সায়ন। ডান হাত দিয়ে রাইদার গালে থাকা চোখের অশ্রু গুলো মুছে দেয়।

‘বন্ধুকে কেউ ঐভাবে জড়িয়ে ধরে তাও বরের সামনে? তোমার বন্ধুর কপাল ভালো তুমি জড়িয়ে ধরেছো যদি ও জড়িয়ে ধরতো তাহলে ওর হাত একটাও আস্ত থাকতো না। এখন লক্ষি বউয়ের মতো আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো।’,সায়ন গম্ভীর মুখে বলে।

‘আমি কিন্তু এখনো আপনাকে মানি না তাই দূরে থাকুন আমার থেকে।’,হাত দিয়ে সায়নকে সরানোর চেষ্টা করে বলে রাইদা।

‘রি! একটা কথা রাখবে আমার?’, জড়ানো স্বরে বলে সায়ন।

সায়নের জড়ানো কন্ঠ শুনে রাইদার শরীরে কাটা দেয়। চোখ তুলে সায়নের চোখে চোখ রাখে।

‘কি হলো রি উত্তর দিচ্ছো না কেনো?’,সায়ন আবারো অধৈর্য্য হয়ে বলে।

‘বলুন শুনছি আমি, যদি রাখার মতো কথা হয় চেষ্টা করবো।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘তোমার থেকে আমার কোনো চাওয়া নেই। তোমাকে আমার সাথে এক ঘরে থেকে সংসার করতে হবে না,এক বিছানায় ঘুমাতে হবে না,অন্য বউদের মতো স্বামীর অধিকারও আমায় দিতে হবে না, এমন কি আমার পরিবারের সামনেও কখনো যেতে হবে না। যেভাবে সব চলছে চলুক শুধু এই সম্পর্কটা ভেঙে দিও না রি। তোমার সাথে আমার এই সম্পর্কটাই এখন আমার জীবনের একটা অংশ। এতদিন তোমায় খুঁজে আশায় থাকতাম এখন সেই তোমাকে পেয়ে যদি আবারো হারাই আমি সহ্য করতে পারবো না। তোমায় এতো ভালোবেসে ফেলেছি এখন তোমার সাথে কাউকে দেখলেও আমার হিংসা হয়।’, নিজের দুইহাত দিয়ে রাইদার দুই গাল ধরে ব্যাকুল কন্ঠে বলে সায়ন।

রাইদার কোনো জবাব না দিয়ে সায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে। সায়নের এমন ব্যাকুল কন্ঠ সে শুনেছিলো আট বছর আগে তাও ফোনে,সেদিন সায়নের আকুল আবেদন রাইদার মন গলাতে পারেনি আজও রাইদার শক্ত মনটা গলতে চাইছে না কিন্তু সায়নের এমন কথাবার্তা তাকে ভাবাচ্ছে।

‘কি হলো রি জবাব দিচ্ছো না কেনো? বলো এই সম্পর্কটা কখনোই ভাঙার চেষ্টা করবা না। শুধু রোজ একবার এসে তোমায় দেখে যাবো আর ফোন দিয়ে একটু খোঁজ নিবো এর বেশি কখনোই অধিকার দাবী করবো না কথা দিলাম।’,সায়ন আবারো ব্যাকুল স্বরে বলে।

‘আমাকে ভাবার সময় দিন সায়ন। সব কিছু ভালো করে চিন্তা করে আমি সিদ্ধান্ত নিবো। জীবনটা তো ছোট আর এই ছোট জীবনটা আমি নিজের অপছন্দের মানুষের সাথে কাটাতে চাই না।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘তোমাকে এই অপছন্দ মানুষের সাথে জীবন কাটাতে হবে না শুধু সম্পর্কটা রেখে দাও যেই সম্পর্কে তোমার বরের তোমার প্রতি কোনো অধিকার থাকবে না। আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে যেই স্থানটা দিয়েছি সেটা থাকুক সারাজীবন সেটাই শুধু চাই।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সায়নের হাত দু’টো নিজের গাল থেকে সরিয়ে দেয় রাইদা। সায়নের থেকে সরে রান্নাঘরে চলে যায়। সায়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে রাইদাকে পর্যবেক্ষণ করে। রান্নাঘরে গিয়ে রাইদা ভাবতে থাকে কীভাবে কি করবে। সে এই সম্পর্ক থেকে,সায়ন থেকে মুক্তি চায় কিন্তু আজ কেনো সায়নের মুখের উপর না বলতে পারছে না? এতোদিন তো সায়নের কোনো কথা রাখেনি সরাসরি প্রতিবার করেছে তবে আজ সে পারছে না কেনো? তবে কি অজান্তেই সায়নের প্রতি সে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?
এমন অযাচিত প্রশ্ন মাথায় আসায় রাইদা মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের প্রতি বিরক্ত হয়।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বেডরুমে গেলে দেখে সায়ন মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে। গায়ের ব্লেজারটা খুলে বিছানাতেই রেখেছে। রাইদা ধীর পায়ে গিয়ে সায়নের পাশে বসে। সায়ন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

হুট করে রাইদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সায়ন। চোখ বন্ধ করে নিজের ওষ্ঠ দ্বয় নিয়ে রাইদার ললাতে গভীর চুম্বন একেঁ দেয়। আবেশে রাইদা চোখ বন্ধ করে ফেলে। একটু পর রাইদাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নিজের ব্লেজারটা নিয়ে মেইন দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। দরজা খোলার শব্দে রাইদা কেঁপে উঠে কিন্তু চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে আজ বড় অসহায় লাগছে রাইদার হুট করে মনে হচ্ছে আজ যদি মা পাশে থাকতো তাহলে হয়তো এই সিচুয়েশনে কি করতে হবে নিশ্চয়ই সুপরামর্শ দিতো।


চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here