হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ পর্ব -০২+৩

#হাজার_ফুলের_মাঝে_একটি_গোলাপ
#পর্বঃ২+৩
#লেখিকাঃদিশা মনি

ললিত ঘরে ঢুকতেই শামিমা গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ললিতের মনে কামবাসনা জেগে ওঠে। সে শামিমার দিকে এগিয়ে যাবে তখনই শামিমা একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।

ললিতের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে শামিমা তার হাতে বালিশ ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘আমার সাথে এক রুমে আপনি থাকতে পারবেন না।থাকলে হলে বাথরুমে গিয়ে ঘুমান।’

ললিত ক্ষেপে গিয়ে বলে,
‘এসব কেমন কথা? আমি তোমার স্বামী। আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোমার উপর।’

শামিমা তা’চ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
‘আপনার মতো দু’শ্চরিত্র মানুষকে আমি স্বামী হিসেবে মানি না। যেদিন আপনাকে পবিত্র করতে পারবো সেদিনই আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেব।’

শামিমার কথা শুনে ললিত ভ্রু কুচকে বলে,
‘এমন ভাব করছ যেন তুমি খুব ভালো মেয়ে। তোমার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। তুমি নিজেই তো ফেসবুকে আমার সাথে প্রেম করতে।’

শামিমা নিজের কান চেপে ধরে বলে,
‘এই কথা শোনাও পাপ। আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি আমি জীবনে কোন ছেলের সাথে প্রেম করা তো দূরের কথা অপরিচিত কোন ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলিনি।’

ললিত বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,
‘নিজেকে এত ধর্মপ্রাণ দেখাতে হবে না। তুমি যে এক নম্বরের বকধার্মিক সেটা আমার বোঝা শেষ।’

শামিমা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘আমার ঈমান নিয়ে কোন কথা বলবেন না। আপনার মতো পাপিষ্ঠের মুখে আমার সম্পর্কে কোন কথা শুনতে চাইনা।’

৩.
এবার ললিত শামিমার চু’লের মুঠি ধরে বলে,
‘এই নাটক করছিস কেন? তুই তো ফেসবুকে মায়াবী রাজকন্যা নাম নিয়ে আমার সাথে প্রেম করতি। রাত বিরেতে আমার সাথেও দেখা করতে চেয়েছিলি। এখন এমন নাটক করছিস যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানিস না।’

শামিমা অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘আমার আল্লাহ জানেন আমি এসব কিছুই করিনি। আমার কোন ফেসবুক একাউন্টই নেই। ফেসবুক তো দূর আমার কাছে স্মার্টফোনই নেই। আমি বাটন ফোন ইউজ করি। পড়ালেখা আর কোরআন শরিফ পাঠ করেই আমি আমার দিন কা’টাই।’

ললিতঃতাহলে তুই ওত রাতে পদ্মবিলের পাশে কি করছিলি একা একা?

শামিমাঃআমি একা যাইনি। আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সাথে আমার ভাইয়াও ছিল। আমরা ৮ টার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম। আমি আমার বান্ধবীদের জন্য ওখানে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম তখনই আপনি এসে,,,,,,’

শামিমার কথাগুলো শুনে ললিতের মাথা গরম হয়ে যায়। ললিত বুঝতে পারে শামিমা তার মায়াবী রাজকন্যা নয়। ললিত তখন শামিমার উপর রাগ ঝাড়ার জন্য তাকে প্র’হার করতে উদ্যত হয়। শামিমা আল্লাহু আকবর বলে ললিতের হাত ধরে ফেলে। তারপর ললিতকে টেনে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে লক করে দেয়। এরপর নিজে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ললিত চিৎকার করতে থাকে। শামিমা সেদিকে কান না দিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে বলতে থাকে,
‘আল্লাহ তুমি আমায় ধৈর্য দাও। আমি যেন মানুষটাকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে পারি। এখন উনি আমার স্বামী। স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব আমার স্বামীকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনা। তুমি শুধু আমায় একটু সাহস আর ধৈর্য দাও আল্লাহ।’

এরপর শামিমা ঘুমিয়ে পড়ে। ললিতও একসময় ক্লান্ত হয়ে বাথরুমেই ঘুমিয়ে পড়ে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে শামিমা বাথরুমের দরজা খুলে দেয়। তারপর ললিতকে ডেকে তুলে বলে,
‘ফজরের নামাজের সময় হয়ে এসেছে। একটু পর আযান দেবে। আপনি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে মসজিদে চলে যান।’

ললিত বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
‘আমি নামাজ পড়ি না। এত সকালে ঘুম থেকে ডাকলি কেন? আমি কোনদিন ৮ টার আগে ঘুম থেকে উঠিনা।’

শামিমা শান্তভাবে বলল,
‘এতদিন যা করেছেন তা আর এখন করতে পারবেন না। এখন আমি আপনার স্ত্রী। আপনাকে দ্বীনের পথ দেখানো আমার কর্তব্য। আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলুন। তাহলে জীবন সুন্দর হবে। নিন উঠে পড়ুন। আব্বুর সাথে যান মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে নিন।’

ললিত কোন কথা না বলে আমার শুয়ে পড়ল। শামিমা এক মগ পানি এনে ললিতের গায়ে ঢেলে বলল,
‘উঠে পড়ুন বলছি। আপনার মধ্যে বসবাস করা শ’য়তানকে আমার কাছে হারতেই হবে।’

ললিত রাগে শামিমার দিকে তাকায়। শামিমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক বাতলি পানিতে গিয়ে শামিমার মুখ ডুবিয়ে দেয় ললিত। শামিমার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল তার জীবন বুঝি এখানেই থমকে যাবে। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় শামিমা।

ললিত শামিমার গলা টি’পে ধরে বলে,
‘আমার সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করলে এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি হবে।’

কথাটা বলে ললিত বেরিয়ে যায়। শামিমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ললিতের যাওয়ার দিকে। আড়ালে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শামিমা বলতে থাকে,
‘আপনি যে খারাপ মানুষ সেটা আমার বোনের সাথে যখন প্রেম করতেন তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি সুমিকে কত বুঝিয়েছি কিন্তু সুমি বোঝেনি। প্রতিদিন মোনাজাতে আল্লাহর কাছে চাইতাম সুমি যেন আপনার মতো খারাপ মানুষের কবল থেকে বের হয়ে আসে। আমার সেই দোয়া কবুল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দেখুন ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ আমি আপনার স্ত্রী। তবে আল্লাহর উপর আমার বিশ্বাস আছে। তিনি যা করেন তার পিছনে বড় কোন উদ্দ্যেশ্য থাকে। আপনার সাথে যখন আমার বিয়ে হয়েছে তখন আপনার স্ত্রী হিসেবে সব কর্তব্য আমি পালন করবো।চেষ্টা করবো আপনাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। বাকিটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম।’

শামিমা ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। তারপর ছাদে চলে যায়। সকালের মিষ্টি বাতাস যে তার খুব প্রিয়। ছাদে গিয়ে শামিমা দেখে শাহনাজ পারভীন আড়ালে লুকিয়ে কাদছেন।

শামিমা খুব ভালোভাবেই জানে উপরে উপরে যতই রাগ দেখান না কেন তার আম্মু তাকে খুব ভালোবাসে। শামিমা তার আম্মুর কাছে গিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,
‘আম্মু,,,,’

শাহনাজ পারভীন রেগে গিয়ে বলেন,
‘কে তোর আম্মু? আমার শুধু দুটো ছেলে মেয়ে সুমি আর শাহাদাত। তুই আমার কেউ না দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে।’

শামিমার চোখে জল চলে আসে। অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে শামিমা বলে,
‘আমাকে দূরে চলে যেতে বলছো। একদিন খুব করে চাইবে আমাকে। আমাকে ফিরে পেতে চাইবে। কিন্তু সেদিন আমি আসব না।’

৪.
ললিত রাগে টগবগ করতে করতে ক্লাবে চলে আসে। ক্লাবে ললিতের বন্ধুরা মিলে ক্যারাম খেলছিল। ললিত এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।

ললিতের এক বন্ধু তাকে বলে,
‘কি রে ললিত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিলি যে? আমাদের তো দাওয়াতও দিলি না।’

আরেকজন বলে,
‘আরে বুঝলি না সব টাকা বাচানোর ধান্দা। আজ কিন্তু তোর কোন কথা শুনব না। আমাদের সবাইকে কিন্তু ট্রিট দিতেই হবে।’

ললিত তার বন্ধুর কলার ধরে বলে,
‘কিসের ট্রিট চাস? আমার জীবন নষ্ট হওয়ার?’

ললিতের বেস্ট ফ্রেন্ড আমান তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন? যতদূর শুনলাম ঐ মায়াবী রাজকন্যা আইডির মেয়েটার সাথেই তোর বিয়ে হয়েছে।তোর তো খুশি হবার কথা।’

ললিত আমানের দিকে তাকিয়ে কষ্ট কষ্ট মুখ করে বলে,
‘ওটা বউ নয় রা’ক্ষসী।’

ললিতের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। ললিত অপমানিত বোধ করে। আমান ললিতকে শান্তনা দিয়ে বলে,
‘বিয়ের পর এমন কথা সবাই বলে। কয়েকটা দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন দেখবি আমাদের ভুলে যাবি আর সারাক্ষণ বউ বউ করবি।’

ললিত এবার বাধ্য হয়ে তার বন্ধুদের সব ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। সব শুনে আমান মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘তোর দুঃখের গল্প শুনে আমি শিহরিত। আসলে জীবনটাই বেদনাময়। তুই চিন্তা করিসনা দোস্ত। সব সমস্যার সমাধান আমার কাছে আছে। বাজার থেকে নতুন মাল এনেছি। খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা পুরো বোতল ম’দ শুধু তোর জন্য।’

ম’দের কথা শুনে ললিত খুশি হয়। এটা তার প্রিয় নেশা। মদ পেলে সব ভুলে যায়। ললিত ঢকঢক করে মদ গিলে খায়।

মদ খেয়ে মাতাল হয়ে টলতে টলতে শামিমার বাড়ির দিকে যেতে থাকে ললিত।

শামিমা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। বোরখা পড়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে তখনই ললিত এসে উন্মা’দের মতো দরজা ধাক্কাতে থাকে। শামিমা দরজা খুলে ললিতকে মদ্যপ অবস্থায় দেখে রেগে যায়। নাক হাত দিয়ে বলে,
-“আপনি কোন সাহসে এসব হারাম খেয়ে বাড়িতে এসেছেন? আপনার কি একটুও লজ্জা নেই ছিহ!”

ললিত শামিমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
‘বেশ করেছি মদ খেয়েছি। আরো হাজারবার খাবো। কি করবি তুই?’

শামিমা ললিতকে জোর করে টেনে রুমে নিয়ে যেতে থাকে। শাহনাজ পারভীন ললিতকে এই অবস্থায় দেখে রেগে গিয়ে বলেন,
‘এই দিন সেখার আগে আমার মৃত্যু হলোনা কেন? শেষে কিনা এইরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করলি তুই শামিমা। এক্ষুনি এই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের কর।’

শামিমা তার আম্মুকে অনুরোধের সুরে বলে,
‘আমি ওনাকে সামলে নেব। তুমি দয়া করে আব্বুকে কিছু বলোনা।’

শাহনাজ পারভীন মুখ বাকিয়ে বলেন,
‘তাকেই সবার আগে বলব। আসতে দে তোর আব্বুকে। নিজের ফুলের মতো পবিত্র মেয়ে কেমন ছেলেকে বিয়ে করেছে দেখে যাক।’

শামিমার চোখে জল চলে আসে। তার আম্মুর এইরকম ব্যবহার তার ভালো লাগছে না। অনেক কষ্টে ললিতকে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। রাগে শামিমার শরীর জ্ব’লে যাচ্ছিল। শামিমা লেবুর সরবত করে এনে ললিতকে খাইয়ে দেয়। ললিত প্রথমে খেতেই চাচ্ছিল না। শামিমা জোর করে খাইয়ে দেয়। ললিত হঠাৎ বমি করতে শুরু করে। তারপর জ্ঞান হারায়। শামিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ললিতকে পরিস্কার করিয়ে দেয়। তারপর ললিতকে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে চলে যায় ভার্সিটির উদ্দ্যেশ্যে।

শামিমা ভার্সিটিতে ঢোকার সাথে সাথেই তার বান্ধবী মোহনা এসে শামিমার হাত ধরে বলে,
‘আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি শামু। আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবি?

শামিমা ভ্রু কুচকে বলে,
‘তোকে না কতবার বলেছি আমাকে শামু নামে ডাকবি না। আমার কত সুন্দর একটা নাম আছে শামিমা। আমাকে শামিমা বলেই ডাকবি আর না পারলে ডাকবি না। তবুও এরকম আজেবাজে নামে ডাকবি না।’

মোহনা মুখ বাকিয়ে গিয়ে বলে,
‘তুই এতো ব্যাকডেটেড কেন? খালি আম্মা-খালাম্মার মতো কথাবার্তা। আমি যেটা বলছি সেটা শোন আগে।’

শামিমা মোহনাকে ভালো করে পরখ করে নেয়। মোহনাকে কিরকম অস্থির লাগছে।

শামিমার অনুমতি না নিয়েই মোহনা বলতে শুরু করে,
‘আসলে ফেসবুকে মায়াবী রাজকন্যা নামে আমার একটা ফেক আইডি আছে। সেই আইডি দিয়ে আমি ললিতের সাথে কথা বলতাম। কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে ওর উপর একটা আসক্তি তৈরি হয়। তাই ওকে বলি ওর সাথে দেখা করব। দিনের বেলা তো ভার্সিটি,টিউশনি এসবেই চলে যায়। তাই আমি ওকে বললাম রাতে দেখা করতে। তুই তো জানিস আমার বাবা-মা কেমন? কোনদিনও আমায় রাতে বাড়ি থেকে বের হতে দিত না। তাই আমি ফন্দি করে তোদের সবাইকে নিয়ে পিকনিক করতে চলে যাই। আমার পরিকল্পনা ছিল ললিতের সাথে কথা বলব। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল আর,,,,,’

মোহনা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই শামিমা তার গালে জোরে একটা থা’প্পর মা’রল। মোহনা রাগী চোখে শামিমার দিকে তাকায়।

শামিমা এবার কেদেই দেয়। মোহনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘কেন করলি এমন তুই? আজ তোর জন্য আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমার মা-বোন সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। প্রতি মুহূর্তে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি। তুই আমাকে এ কোন জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিলি।’

মোহনা শামিমাকে শান্তনা দিয়ে বলে,
‘আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে। আমি ললিতের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম ছেলেটা সত্যিই ভালো না। আমি কি করব বল। তুই একটা কাজ কর ডিভোর্স দিয়ে দে ললিতকে।’

শামিমা মোহনার কথা শুনে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে। মোহনার থেকে কিছুটা দূরে এসে বলে,
‘বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক। যেভাবেই হোক না আমাদের বিয়েটা হয়েছে। ওনার স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব ওনাকে সঠিক পথ দেখানো। আমি চেষ্টা করে যাব। দেখা যাক কি হয়। আমি এত সহজে ধৈর্য হারালে তো চলবে না।’

মোহনাঃআমি শুনলাম ললিত তোর বোনের বয়ফ্রেন্ড। তোরা তো এখন একই বাড়িতে আছিস। আমার খুব ভয় লাগছে যেন কোন অঘটন না ঘটে যায়।

মোহনার কথায় শামিমার মনেও একটা আশংকার জন্ম হয়। মোহনা তো কথাটা ভুল বলেনি। এই বিষয়ে শামিমাকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।

৫.
ললিতের ঘুম ভাঙতেই নিজের চোখের সামনে সুমিকে দেখতে পায়। সুমিকে দেখে ললিত কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখে মিথ্যা হাসি দেয়।

সুমি ললিতের মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘তুমি ঠিক আছো তো ললিত। আমি জানি তুমি বাধ্য হয়ে আমার আপুকে বিয়ে করেছ। তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো তাইনা?’

ললিতঃহ্যা জানু। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার মনে হয় এইসব তোমার আপুর চক্রান্ত। সেই তোমার থেকে আমাকে কেড়ে নেওয়ার জন্য এমন করেছে।

সুমিঃআমারও তাই মনে হয়। আপু ছোটবেলা থেকেই আমাকে হিংসা করে। আমার মতো সুন্দরী নয়তো তাই আমাকে দেখে জ্ব’লে।

ললিত বিড়বিড় করে বলে,
‘তুমি তো একটা মেকআপ সুন্দরী। মেকআপ না করলে ভূতের মতো লাগে। সেই তুলনায় তোমার আপু তোমার থেকে অনেক সুন্দরী। যাকে বলে ন্যাচারাল বিউটি।’

সুমিঃকিছু বললে ললিত?

ললিতঃনা কিছু না। আচ্ছা তোমার আপু কোথায়?

সুমিঃকোথায় আবার যাবে ভার্সিটিতে গেছে।

ললিতঃতোমার কলেজ নেই?

সুমিঃআছে তো। আমি আজ কলেজ যাইনি। তোমাকে এরকম অসুস্থ ফেলে রেখে আপু ভার্সিটিতে যেতে পারে কিন্তু আমি কলেজে যাবো না।

ললিতঃভালো। আমারও আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হলো না। কাল চলে যাব। তুমি আমার জন্য কিছু নিয়ে আসতে পারবে?

সুমিঃতুমি কি খাবে বলো আমি এখুনি এনে দিচ্ছি।

ললিতঃআমি এই বাড়ির নতুন জামাই। আমার জন্য ভালো ভালো খাবার আনো। পোলাও,কোরমা,কাবাব এসব কিছু আনো।

সুমিঃআমি এগুলো কোথায় পাবো? আমি তো এসব রান্না করতে পারিনা।

ললিতঃতোমার আম্মুকে বলো রান্না করতে।

সুমিঃআচ্ছা তুমি দাড়াও আমি দেখছি।

সুমি দৌড়ে রান্নাঘরে চলে আসে। শাহানাজ পারভীন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত ছিল। সুমি এসে তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কি রান্না করছ আম্মু?’

শাহানাজ পারভীন বেগুন কা’টতে কা’টতে বলেন,
‘এইতো বেগুন ভাজি দিয়ে ভাত করব। সাথে মুসুর ডাল।’

সুমি মুখ বাকিয়ে বলে,
‘ঘরে যে নতুন জামাই এসেছে তাকে এসব খাওয়াবে?’

সুমির কথা শুনে শাহানাজ পারভীন তেলে বেগুনে জ্ব’লে ওঠেন।
‘ঐ ছেলেটার জন্য তো আমি এক গ্লাস পানিও দিতে চাইনা। সকাল সকাল মদ খেয়ে এসেছে। গোটা এলাকায় কথাটা রটে গেছে। আমি লজ্জায় কাউকে মুখই দেখাতে পারছি না। তার জন্য ভালোমন্দ রান্না করব এটা ভাবলি কি করে? যা হয়েছে তা দিয়ে খেলে খাবে না খেলে নাই। আমার কোন ঠেকা পড়েনি জামাই আদর করে খাওয়ানোর।’

সুমি রেগে গিয়ে তর্ক করতে শুরু করে। একপর্যায়ে শাহানাজ পারভীন রাগ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। সুমি রেগে গিয়ে রান্নাঘরের সব জিনিস ফেলে দিতে থাকে।

আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ছুটে এসে এমন অবস্থা দেখে রাগারাগি করতে করতে বলেন,
‘এসব কি করছিস সুমি? বৌমা কই তুমি। তোমার মেয়ের কাণ্ড দেইখা যাও।’

সুমিকে আটকাতে গেলে সে আয়েশা বেগমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে,
‘এই বুড়ি একদম বাড়াবাড়ি করবি না। বসে বসে খেয়ে যে আমার বাবার টাকা ধ্বংস করছিস তার উপর আমাকেই তে’জ দেখাচ্ছিস। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঘাড় ধরে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসব।’

কথা বলা শেষ হতেই সুমির গালে ঠাস করে একটা থা’প্পর এসে পড়ে। শক্ত হাতের থা’প্পরে সুমি দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। শামিমা রাগে টগবগ করতে করতে সুমির দিকে তাকিয়ে আছে। সুমি উঠে এসে শামিমাকে বলে,
‘তোর এত বড় সাহস তুই দাদিকে এভাবে বলছিস। এত সাহস তুই পেলি কোথায়? ভুলে গেলি এই দাদিই তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। আজ শুধু আব্বুকে একবার আসতে দে তারপর দেখ আমি কি করি।’

সুমি শামিমাকে হুমকি দিয়ে বলে,
‘তুই যদি আব্বুকে কিছু বলিস তাহলে আমি কিন্তু,,,,’

শামিমাঃকি করবি তুই?

সুমিঃললিতকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব।

শামিমাঃসুমি!

সুমি আর কোনকিছু না বলে চলে যায়। শামিমা আয়েশা বেগমকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলে। পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছেন তিনি। শামিমা তার কোমড়ে মালিশ করে দিতে দিতে বলে,
‘তুমি ঠিক আছো তো দাদি? বেশি ব্যাথা লাগে নি তো?’

আয়েশা বেগম চোখ থেকে অশ্রু মুছতে মুছতে বলেন,
‘আল্লাহর রহমতে তোর মতো একটা নাতনী পেয়েছি। আমি কিভাবে খারাপ থাকবো?’

শামিমা বিনিময়ে মৃদু হেসে তার মোলায়েম হাত দিয়ে দাদির কোমড়ে মালিশ করতে থাকে।

৬.
শাহানাজ পারভীন এবং আলতাফ উদ্দিন অনেকক্ষণ থেকে বসে আছেন। শামিমা তাদের বসে থাকতে বলে কোথায় যে চলে গেল তারপর থেকে আর আসছেনা৷ কিছুক্ষণ পর শামিমা মোহনাকে নিয়ে তাদের সামনে আসে।

মোহনাকে দেখে শাহানাজ পারভীনের ভ্রু কুচকে যায়। মেয়েটাকে এমনিতেই তার ভালো লাগে না। মোহনা বলতে শুরু করে,
‘ললিত সেদিন আমার সাথে দেখা করতেই এসেছিল। এখানে শামিমার কোন দোষ নেই আঙ্কেল আন্টি। আমার জন্যই সব হয়েছে। আপনারা প্লিজ শামিমাকে আর দোষ দেবেন না।’

শাহানাজ পারভীনকে উদ্দ্যেশ্য করে আলতাফ উদ্দিন বলেন,
‘দেখেছ তো, তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমাদের মেয়ে এরকম কাজ করতেই পারে না।’

শাহানাজ পারভীনঃতোমার মেয়ে কি করেছে না করেছে সেটা বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হলো এটা যে ওর জন্যই সমাজে সবাই আমাদের নিয়ে খারাপ কথা বলছে। আমার ওকে আর সহ্য হচ্ছেনা।

শামিমাঃআম্মু। এসব কি বলছ তুমি?

শাহানাজ পারভীনঃযা বলছি একদম ঠিক বলছি। আমি আগেই জানতাম তুই এরকম কোন কাজ করতে পারিস না। দোষটা আসলে তোর নয় তোর ভাগ্যের। কিন্তু আমি কি করব বল, সমাজের লোকের এত মন্দ কথা যে আমার সহ্য হচ্ছেনা। তাই তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করছি। আগে যখন সবাই আমাকে শামিমার মা বলত তখন গর্বে আমার বুক ফুলে যেত। আর এখন মাথা নিচু হয়ে যায়। সমাজের লোক যে এতকিছু বুঝবে না। তারা শুধু সমালোচনা করে যাবে।

কথাটা বলে চোখের জল মুছতে মুছতে শাহানাজ পারভীন চলে যান। আলতাফ উদ্দিন এসে শামিমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে বলেন,
‘কোন চিন্তা করিস না। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর আম্মুকে একটু সময় দে।’

শামিমা মুখে একটা মিথ্যা হাসি আনে। কারণ সে তার মাকে চেনে। একবার যখন সে রাগ করেছে তখন এত সহজে সেই রাগ ভাঙানো সম্ভব নয়।

মোহনাকে বাইরে একটু এগিয়ে দিয়ে এসে শামিমা নিজের রুমে প্রবেশ করে। শামিমা রুমে আসতেই ললিত তার দিকে একটি পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘নাও এই পেপারে সাইন করে দাও।’
চলবে….
>>>আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্ব সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানান। গল্পটা আপনাদের কেমন লাগছে ভালো নাকি খারাপ সেটাও জানাবেন অবশ্যই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here