হারানোর বেদনা পর্ব -০১

নিজের হাতে নিজের স্বামীকে বিয়ের সাজে সাজিয়ে দিচ্ছে মেঘলা।আর চার-পাঁচটা মেয়ের মতো নয় সে।অন্য মেয়েরা যেখানে নিজের স্বামীকে কারো সাথে ভাগাভাগির কথা ভাবতেও পারেনা, সেখানে মেঘলা নিজে তার স্বামী নিলয়ের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থা করেছে।

নিলয় ছলছল নয়নে তাকিয়ে ছিল মেঘলার দিকে।মেঘলা অনুভূতিহীনের মতো দাঁড়িয়ে ছিল।অন্য কোন মেয়ে হলে বোধহয় এতক্ষণে কেঁদেই দিত।কিন্তু মেঘলা কেমন হাসিমুখেই তার স্বামীকে অন্য একটা মেয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে।

নিলয় আফসোরের সুরে বলে,
-“মানছি আমি একটা ভুল করেছি তাই বলে কি আমাকে আর একটা সুযোগ দেওয়া যাবে না? আমি তো সুমিকে…”

মেঘলা এতক্ষণ চুপ থাকলেও আর চুপ থাকেনা।নিলয়কে ঠাসিয়ে একটা চ’ড় মে’রে রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
-“তোমার মতো ছেলেদের আমি কোন সুযোগ দিতে চাইনা।কি মনে করেছ কি তোমরা মেয়েদের জীবন এতটাই ফেলনা? যখন যেমন খুশি ব্যবহার করবে আর তারা সহ্য করে যাবে।তুমি বিবাহিত হয়েও অন্য একটা মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করে এখন বলছ তাকে বিয়ে করতে পারবে না।এখন নিজের স্ত্রী সন্তানের কথা খুব মনে পরছে।যখন মেয়েটার সাথে অবৈধ সম্পর্কে ছিলে তখন আমাদের কথা মনে পড়েনি?”

-“তুমি বিশ্বাস করো মেঘলা সুমির সাথে আমার সম্পর্ক এতদূর অব্দি যায়নি।হ্যাঁ প্রথমদিকে একটু দূর্বলতা ছিল কিন্তু আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।ওর গর্ভে আমার সন্তান নেই বিশ্বাস করো।”

মেঘলা গগণবিহারি হাসি হেসে বলে,
-“বিশ্বাস তাও আবার তোমাকে! বিশ্বাস শব্দটা তোমার সাথে যায়না নিলয়।তুমি আমাদের এত বছরের সম্পর্ককে নষ্ট করেছ।অন্য একটা মেয়ের সর্বনাশ করে আমার সাথে সুখে সংসার করবে সেটা তো আমি মেনে নেব না।”

নিলয় আর কিছু বলার মতো পায়না।এই ক’দিন ধরে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি।মেঘলার সাথে ১২ বছরের সংসার তার।তার আগে ৫ বছরের প্রেমের সম্পর্ক।১০ বছর বয়সী একটা মেয়েও আছে তাদের যার নাম নীলা।এতদিন সবকিছু ভালোই চলছিল কিন্তু বিপত্তি ঘটতে সময় নেয়না।

বছরখানেক আগে সুমি নিলয়ের অফিসে চাকরি নেয়।সুমি বড্ড গায়ে পড়া মেয়ে ছিল।নিলয়ের সাথেও সবসময় গা ঘেঁষে থাকত।নিলয় প্রথমদিকে পাত্তা দেয়নি।কিন্তু ধীরে ধীরে সে সুমির প্রতি কিছুটা দূর্বল হয়ে যায়।কিছুদিন সুমির সাথে সিনেমা হল,পার্কে ঘুরতেও নিয়ে গেছে।তবে তাদের সম্পর্ক কখনো এতদূর এগিয়ে যায়নি যার কারণে সুমি প্রেগন্যান্ট হবে।

গতমাসেই নিলয় নিজের ভুল বুঝতে পেরে সুমির সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে নেয়।সুমি তখন বেশ স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু নিলয় ভাবতেই পারেনি যে এক সপ্তাহ হতে না হতেই সুমি এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে।

তিন সপ্তাহ আগে নিলয় আর মেঘলার বিবাহবার্ষিকীর দিন সুমি এসে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে তারপর কাঁদতে কাঁদতে তাদের সম্পর্কের কথা সবাইকে বলে।সাথে এটাও বলে যে সে নিলয়ের বাচ্চার মা হবে চলেছে।

সেদিন নিলয়ের পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল।সুমি যে এতবড় মিথ্যেটা বলতে পারে সেটা সে কখনো কল্পনা করেনি।সেদিন মেঘলা সবার সামনে সুমিকে কথা দিয়েছিল সে সুমির কোন সর্বনাশ হতে দেবে না।নিলয়ের সাথেই সুমির বিয়ে দেবে।

নিলয় এরপর থেকে মেঘলাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে সবকিছু।কিন্তু মেঘলা নাছোড়বান্দা।সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সুমি আর নিলয়ের বিয়ে দেবেই।নিজের হাতে সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে।নিলয়ের পরিবার,মেঘলার পরিবার সবাই অনেক বুঝিয়েও কোন লাভ হয়নি।মেঘলা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল।

অতীত থেকে বেরিয়ে মেঘলার দিকে তাকায় নিলয়।মেয়েটাকে আজ তার খুব অচেনা লাগছে।এই মেয়েটা প্রথম প্রথম কতটা নরম মনের ছিল।সামান্য আঘাতও সহ্য করতে পারত না।আর আজ এভাবে শক্ত মনিষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।যেন এসবে তার বিন্দুমাত্র কিছু যায় আসে না।
_____________
নিলা সমানে কেঁদে চলেছে।তার দাদী লতিফা বেগম অনেক সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছেনা।কোন মেয়েই বা তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারে।

নিলা সমানে কেঁদে চলেছে আর বলছে,
-“প্লিজ দাদী আব্বুকে বলো সে যেন এই বিয়ে না করে।আব্বু যদি এই বিয়ে করে তাহলে কিন্তু আমি আব্বুর সাথে আর জীবনেও কথা বলব না।আমি আজীবন তাকে ঘৃণা করে যাব।”

আজ নিলার এই অভিমানী কথাতেও লতিফা বেগম ম্যাচুরিটি খুঁজে পেলেন।এতটুকু মেয়ে যেন এই ক’দিনেই অনেক বড় হয়ে গেছে।আকস্মিক আঘাতে মেয়েটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে।নাহলে কাল পর্যন্ত যেই মেয়ে পুতুল নিয়ে খেলত আজ সে এরকম কথা বলছে।

মেঘলা নিলার কাছে আসে।মেঘলাকে দেখে নিলা ছুটে যায় তার দিকে।তারপর বলে,
-“আম্মু তুমি প্লিজ আব্বুকে আটকাও।আমি আব্বুর এই বিয়ে মেনে নিতে পারব না।”

-“শান্ত হও নিলা।তোমাকে কিছু মেনে নিতে হবে না।আজই আমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”

মেঘলার বলা দ্বিতীয় কথাটা শুনে লতিফা বেগমের টনক নড়ে।তিনি মেঘলার হাত ধরে বলেন,
-“কেন এরকম ছেলেমানুষী করছ বৌমা? আমার ছেলেটা তো বারবার বলল সে ভুল করেছে।তাকে একবার সুযোগ দিলে কি হতো? নিজের কথা না ভাবো অন্তত নিজের মেয়েটার কথা ভাবো।”

মেঘলা বেশ শান্তভাবেই বলল,
-“মেয়ের কথা ভেবেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি চাইনা আমার মেয়ে এমন কোন মানুষের সংস্পর্শে থাকুক তার চরিত্রে দাগ আছে।আর তাছাড়া আমি কোন অবলা নারী নই।আমি নিজেও একটা জব করি।নিজের আর মেয়েটার দায়িত্ব আমি একাই সামলাতে পারব।”

-“তাই বলে তুমি মেয়েটাকে বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে? আর নিলয় তো বারবার বলছে যে সুমি মেয়েটা মিথ্যাবাদী।সুমির বাচ্চার বাবা সে নয়।”

-“ও সুমির বাচ্চার বাবা হোক বা না হোক সেটা বড় কথা নয়।বড় কথা এটা যে ও আমায় ঠকিয়েছে।আমার এত বছরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে ও অপমান করেছে।আমি আর যাই হোক একটা ঠকবাজের সাথে সারাজীবন সংসার করতে পারব না।আর বাবার ভালোবাসার কথা বলছেন! এই পৃথিবীর অনেক মেয়েই বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত থাকে।এই যে আমাকেই দেখুন না আমার যখন মাত্র ৫ বছর বয়স তখন আমার বাবা মারা যায়।তাই বলে কি আমি বেঁচে নেই? নিলাও অভ্যস্ত হয়ে যাবে।”

কথাটা শেষ করে মেঘলা আর দেরি করল না।নিলাকে কোলে তুলে বেরিয়ে পড়ল।লতিফা বেগম আর আটকানোর চেষ্টা করলেন না।কোন অধিকারে আটকাবেন? মেঘলা ডিভোর্স পেপারে সই করে দিয়েছে অনেক আগেই।নিলয় প্রথমে না না করেও মেঘলার জেদের কাছে হার মেনে ডিভোর্স পেপারে সই করে দিয়েছে।

মেঘলা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল সে নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখবে।নিলয় প্রথমে বিরোধিতা করেও কোন লাভ করতে পারেনি।তাছাড়া একটা মেয়ে তার সৎমায়ের কাছে কেমন থাকবে সেটা জানাই যায়।তাই লতিফা বেগমও মেঘলাকে সমর্থন করেন।নিজের ছেলের উপর তারও যে খুব রাগ জমেছেম।কিন্তু হাজার হলেও মা তো।মা হয়ে নিজের ছেলের জীবনের এই ঝড়, নিজের সাজানো সংসারের এই অবস্থা কিভাবে মেনে নেবেন তিনি?
__________
কখন থেকে সবাই বরের দিকে তাকিয়ে ছিল।সবাই অপেক্ষায় ছিল কখন নিলয় কবুল বলে সুমিকে নিজের বউ হিসেবে স্বীকার করবে।তবে নিলয় চুপ ছিল।কোন কথা বলছিল না।তাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে সুমির বাবা এগিয়ে এসে বলেন,
-“তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে বাবা? এভাবে চুপ আছ কেন?”

-“আমি আপনার মেয়ের মতো একটা ঠক প্রতারককে বিয়ে করতে পারব না।আমি আজ এখানে শুধু একটা কারণেই এসেছি।সেই কারণটা হলো আপনার মেয়ের সব অপকর্মের হিসাব নিতে।সুমি তুমি বলবে কিছু নাকি এভাবে চুপ থাকবে।”

নিলয়ের কথা শুনে সুমি ঘামতে থাকে।এত সুক্ষ্ম পরিকল্পনা যে এভাবে ভেস্তে যাবে সেটা তার জানা ছিল না।কিন্তু সে ঠিক করে নিয়েছে যাই হয়ে যাক না কেন সে মুখ খুলবে না।

কিন্তু নিলয়ের গর্জনের সামনে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারল না।সে এবার সব দোষ স্বীকার করল।
-“হ্যাঁ আমি প্রেগন্যান্ট নেই।সব নাটক করেছি।আপনার সাথে প্রেমটাও আমি নিজের ইচ্ছাতে করিনি।যা করেছি টাকার জন্য করেছি।আমাকে একজন টাকা দিয়ে এসব অভিনয় করতে বলেছিল।”

-“আমি আগেই ভেবেছিলাম এমন কিছু হবে।প্রথম প্রথম যখন তুমি আমার কাছে আসার চেষ্টা করতে তখনই এটা বুঝেছি।তাই এতদিন তোমার সাথে নাটক করেছি যাতে তোমার সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারি।কিন্তু তুমি যে এতবড় চাল চালবে বুঝতে পারিনি।এখন বেশি কথা না বলে কার নির্দেশে তুমি এমন করেছ সেটা বলো।”

সুমি ভয়ে কাপতে কাপতে বলে,
-“সে আপনার খুব আপনজন।”
(চলবে)
#হারানোর_বেদনা
#লেখক_দিগন্ত
#পর্ব_১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here