হালাল প্রেমের গল্পকথন পর্ব -০৪

#হালাল_প্রেমের_গল্পকথন -৪
Tahrim Muntahana

রাত প্রায় ১২ টা বেজে পনেরো মিনিট। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে আধা শোয়া হয়ে বসে আছে তাযিন। মেয়েটা নামাজ পড়ে যে বের হয়েছে আর আসার নাম নেই। তার‌ই অপেক্ষা করছিল সে, বিকেলে বাজার থেকে একটা গিফট কিনে নিয়ে এসেছে। ভেবেছিল রাতে দিবে অথচ এই মেয়ে কোন ভুলের শাস্তি দিচ্ছে কে জানে। এবার আর থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়ায় সে। দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। প্রথমে রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, নেই। ফিসফিসানির আ‌ওয়াজ শুনে বোনের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে। দরজা বন্ধ নেই, তবুও মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে বলে উঠে,

~ আপু আসবো?

ঘরে অবস্থান করা মানুষ গুলো চমকে যায়। বিশেষ করে চমকায় তাহুর শাশুড়ি মিসেস ফাহিমা। লজ্জা’রা ঘিরে ধরে তাকে। ছেলে দেখলে কি বলবে? তানিয়া উচ্চ স্বরে বলে উঠে,

~ দরজা তো খোলায় আছে ভাই, অনুমতির কি দরকার? আয়!

তাযিন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মুচকি হেসে বললো,

~ অবশ্য‌ই অনুমতি নিতে হবে আপু। সে দরজা খোলা হোক কিংবা ঘরে কোনো ব্যক্তি উপস্থিত না থাকুক। যতক্ষণ পর্যন্ত ভেতর থেকে কোনো হা বোধক আওয়াজ কানে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভেতরে যাওয়ার অনুমতি বা বিধান নেই। সে নিজের মা হোক কিংবা বোন। এতে উপর ওয়ালা নারাজ হন। কেননা, আমি যদি হুট করেই অন্যের ঘরে ঢুকে পড়ি; ভেতরে থাকা মানুষটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে, তার সাথে আমিও এমন অবস্থার সম্মুখীন হবো। আমাদের ইসলাম সহজ, সাবলীল! বুঝতে পেরেছো?

তাযিনের কথায় তানিয়া হেসে মাথা নাড়ালো।
কারও ঘরে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারে আল-কোরআনে আয়াত নাজিল হয়েছে। সুরা আন নুর, আয়াত নং ২৭ এ আল্লাহ বলেন,
“হে মুমিনগণ, তোমরা কখনো নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারও ঘরে অনুমতি ছাড়া এবং সালাম না করে প্রবেশ কর না।
এটা তোমাদের জন্য অতি উত্তম, আশা করা যায় তোমরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।”

জনৈক ব্যক্তি রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করল,
“আমি আমার মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইব?”
তিনি বললেন, “হ্যাঁ, অনুমতি চাইবে।” লোকটি বলল,
“হে আল্লাহর রসুল আমি তো আমার মায়ের ঘরেই একসঙ্গে বসবাস করি।” রাসুল (সা.) বললেন,
“তবু অনুমতি না নিয়ে তুমি ঘরে যাবে না। তুমি কি তোমার মাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পছন্দ কর?
সে বলল, ‘না’। তিনি বললেন, “তাই অনুমতি চাওয়া আবশ্যক।”

বোনকে কথাটা বলে সামনে তাকাতেই তাযিনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। তার সামনে অত্যন্ত প্রিয় তিন রমনী দাঁড়িয়ে আছে অপরূপা সাজে। এত রাতে শাড়ি পড়ার বিষয় টা বুঝলো না সে। মায়ের পেছনে সহধর্মিণী কে লুকিয়ে থাকতে দেখে হেসে উঠলো তাযিন। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

~ মাশাআল্লাহ, আমার জান্নাত কে তো অতি সুন্দর লাগছে। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ দুই সুন্দরী নারী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।‌ কি সৌভাগ্য আমার।

ছেলের কথায় মিসেস ফাহিমা’র ইতস্তত বোধ কেটে গেল। ছেলেটার কথা শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। তানিয়া ছোট ভাইয়ের গালে আদুরে ভঙ্গিমায় চাপট দিয়ে হাসলো। কিন্তু রেগে গেছে তাহু, তাকে মনে হয় এই লোক চোখেই দেখছে না। সে সুন্দরী নয়? কিছুটা রেগেই বললো,

~ সবথেকে বেশী সুন্দর আমাকে লাগছে। আপনি আমার কথা বললেন না কেন?

~ তুমি তো লুকিয়ে ছিলে, আমি ভালো ভাবে দেখিনি তো, তাহলে বলবো কি করে কেমন লাগছে?

সম্বোধনে তুমি শুনে রাগ টা যেন উবে গেল তাহুর। মিষ্টি হেসে ঘুরে ঘুরে বললো,

~ এখন বলেন আমাকে বেশী সুন্দর লাগছে না?

~ মাশাআল্লাহ, অনেক সুন্দর আমার অর্ধাঙ্গিনী।

আরো কিছু বলতে ইচ্ছে হলেও তাযিন চুপ হয়ে গেল। মা, বড় বোনের সামনে স্বামী স্ত্রীর গোপনীয়তা বজায় রাখা উচিত। তাহুও আর কিছু বললো না, বরং এতটুকু প্রশংসায় সে খুশি। তাযিন বললো,

~ এত রাতে কেন? ঘুমোবে কখন?

~ আর বলিস না ভাই, তোর ব‌উয়ের জেদ। বলেছি দিনে পড়বো। দিনে মা লজ্জা পায়, চাচি ওরা যদি দেখে ফেলে, তাই সুনু এই রাতের বেলায় মা কে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। আর আমার মা ও নাচুনি বুড়ি! শাশুড়ি ব‌উ পড়েছে ভালো।

তাযিন আর কিছু বললো না, বিনিময়ে হেসে তিন রমনীকে নিজেদের মতো ছেড়ে দিয়ে নিজ ঘরে চলে যাবে, ঠিক তখনি তাহু বললো,

~ আপনি ক‌ই যাচ্ছেন? আমাদের সাজগোজ শেষ, আপনি ছবি তুলবেন। একটা ছবিও খারাপ হলে, সকালে আপনার কপালে ভাত জুটবে না।

তাযিন মন ভরে তার প্রিয় রমনীদের মিলমিশ দেখে। আল্লাহ’র কাছে দোয়া করে এমন মিলমিশ যেন আমৃত্য থাকে। তার জান্নাত কেউ সে কষ্ট দিতে পারবে না, তার জান্নাতের সঙ্গীকেও সে কষ্ট দিতে পারবে না আবার তার নিয়ামত তার অতি প্রিয় বোন কেউ কষ্ট দিতে পারবে না। একজন পুরুষ তখন‌ই সব থেকে বেশি অসহায় হয়ে পড়ে যখন তাকে মা বা ব‌উ কোনো একজনের সাপোর্ট হতে হয়। এই মুহূর্তটা একজন পুরুষ কে কতটা যন্ত্রণা দেয় তা যদি একজন মহিলা বুঝতো তাহলে হয়তো ব‌উ শাশুড়ি কখনোই দ্বন্দে লিপ্ত হতো না। বরং তাদের সম্পর্ক হতো অত্যন্ত মিষ্টতায় ঘেরা।

গভীর রাত। মিসেস ফাহিমা, তানিয়াও হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তিন রমনী আজ নিজেদের মতো আনন্দে মেতে ছিলো। সেই আনন্দের‌ সাক্ষী হয়ে তাযিনের নিজেকে সবথেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। সবে ঘরে এসেছে দুজন। তাযিন সন্তর্পণে পকেট থেকে একটা চেইন বের করে তাহুর গলায় পড়িয়ে দেয়। কিছুটা চমকালেও, স্বামীর তরফ থেকে প্রথম গিফট তাহুকে পুলকিত করে। এবার তাযিন তাহুকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,

~ জান্নাতের হুর দের থেকেও আমার অর্ধাঙ্গিনী সুন্দর। আমার হৃদয়ের রাজরানী, আমার ফুল!

তাহুর ছোট্ট মনে কথা গুলো এমন ভাবে গেঁথে যায়, ঠোঁটের কোণ থেকে মুচকি হাসি সরে না। স্বামী প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে তাহু বললো,

~ আমিও আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর মতো বলতে চাই আপনি হলেন সবার থেকে উত্তম পুরুষ। উত্তম সন্তান, উত্তম ভাই এবং উত্তম স্বামী। আমার ভালোবাসার লালা গোলাপ, আমি আপনাকে আল্লাহ’র জন্য ভালোবাসি।

স্ত্রীর এরকম প্রেমময় বাণীতে যেকোনো পুরুষের‌ই সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে যাবে। তাযিনের হৃদয় যেন শিতল হয়ে গেল। অর্ধাঙ্গিনীর ললাটে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বিছানায় বসলো।

‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ও আয়েশা (রা.) ছিলেন পরস্পরের ভালোবাসায় তৃপ্ত। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও বদান্যতায় আরবের প্রবাদতুল্য পুরুষ আবু জারআর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে নবীজি (সা.) আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর উদ্দেশে বলেন,
“আবু জারআ তার স্ত্রী উম্মে জারআর জন্য যেমন আমিও তোমার প্রতি তেমন।”
আয়েশা (রা.) বলেন,
“বরং আপনি আবু জারআর থেকেও উত্তম।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৮৯; ফাতহুল বারি : ৯/২৭৫)

এবং কি আয়েশা (রা.) বলেন,
“রাসুল (সা.) ভালোবেসে কখনো কখনো আমার নাম হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৭৪)’

স্ত্রীদের ভালোবাসে বিভিন্ন নামে ডাকা সুন্নত।
আবার একটা রাত দুজনের গল্পগুজব, ভালোবাসা ময় খুনসুটি, ইবাদতে কেটে গেল। সময় গুলোও যেন দুজনের খুনসুটির প্রভাবে অনন্য রূপ ধারণ করে।

এবার তাহুর বাড়ি ফেরার পালা। কালকের মতো মন খারাপ তার হচ্ছে না, বরং খুশি লাগছে। গোধূলি বিকেলের পরিবেশ টা মন কাড়ার মতো। তাহু রেডি হয়েই বসে আছে। এমন সময় তাযিন এসে বললো,

~ দেনমোহরের টাকা টা নিয়েছো?

~ না, আপনার কাছেই থাকুক।

~ আমার কাছে থাকবে কেন? তোমার হক তুমি সাথে করে নিয়ে যাবে।

~ আমার আর আপনার পার্থক্য আছে নাকি? আমি ওত টাকা সাথে নিয়ে ঘুরতে পারবো না। নিজেই ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না।

~ বোকার মতো কথা বলো না সুনু। এই ব্যাপারে তোমার আর আমার পার্থক্য আছে। এটাতে সম্পূর্ণ তোমার অধিকার, আমার নয়। ঠিকাছে তুমি মন থেকেই দেনমোহরের টাকা টা আমার হাতে তুলে দিলে, তবে আমাদের মাঝে যে কোনো রকম মান-অভিমান-ঝগড়া হবে না তার গ্যারান্টি তো দিতে পারবো না। শয়তানের প্ররোচনায় কখন কি হয়ে যায় ঠিক নেই। তখন তোমার মনের মধ্যে যদি একটু পরিমাণ সন্দেহ সৃষ্টি হয় দেনমোহর নিয়ে, তোমার প্রতি আমার স্পর্শের জন্য কিয়ামতের দিন ব্যাভীচারীদের কাতারে দাঁড়াতে হবে। এমন দায় আমি নিতে পারবো না। আমি তো যাচ্ছি তোমার সাথে, কোনো সমস্যাই হবে না।

তাহু আর কথা বাড়ালো না, আলমারি থেকে সাদা খামটা বের করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।

‘ইসলামী শরিয়ত স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করা স্বামীর ওপর ফরজ করে দিয়েছে। আর মোহর পরিশোধ করা ছাড়া বিয়েই হতে পারে না। সূরা নিসা আয়াত নং ২৪ এ আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,
“তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের থেকে যে স্বাদ গ্রহণ করো তার বিনিময়ে অপরিহার্য ফরজ হিসেবে তাদের মোহর পরিশোধ করো!”
অনেক পুরুষ ই সমাজে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করে, যা দিতে অপারগ হয়ে স্ত্রীর কাছে মৌখিক স্বীকারোক্তি নিয়ে নেয়, যা করতে আল্লাহ পাক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। নিজের সাধ্যের মধ্যে দেনমোহর ধার্য এবং স্ত্রীর সান্নিধ্যে আসার আগেই পরিশোধ করার হুকুম দিয়েছেন।’

শশুড়-শাশুড়ি আশেপাশের কিছু মানুষদের থেকে বিদায় নিয়ে তাহু র‌ওনা হয় বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আসার সময় শশুড়ের কাছ থেকে গুণে গুণে দুইশত টাকা নিয়ে এসেছে, মফিজুর রহমান টাকা টা তার জন্য রাখলেও, সে ঠিক তানিয়ার মতোই চেয়ে নিয়েছে। ব‌উদের মতো আচরণ তাকে দিয়ে হবে না, সে মেয়ে হয়েই থাকতে চায়। কয়েকদিনেই সংসারটার উপর তাহুর অগাধ মায়া পড়ে গেছে, এখন ছেড়ে যেতে তাহুর কষ্ট হচ্ছে। তবুও যেতে হবে। মন টা খানিক ফ্রেশ করতে তাহু তাযিন কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে উঠে,

~ শাশুড়ি বাড়ি, তুমি মন খারাপ করো‌না। এক সপ্তাহ পর আমি আবার আসবো। একদম পনেরো দিন থেকে যাবো।

চলবে…?

(আপনারা রিয়েক্ট দিতেও কার্পন্য করেন! একটা পর্ব লিখতে কতটা সময় ব্যয় করতে হয় যদি বুঝতেন! তাহলে এমন কার্পন্য করতেন না। মন্তব্য না করলেও রিয়েক্ট তো করতেই পারেন!

আমি প্রতিদিন গল্প দেওয়ার চেষ্টা করবো। যেদিন দিতে পারবো না, কমেন্টে বলে রাখবো! অনেক অনেক শুকরিয়া!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here