হৃদমাঝারে পর্ব -০৯

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(৯)

অতীত যে সবসময় আনন্দদায়ক সেটা কিন্ত নয়। অনেকের অতীয়ের পৃষ্ঠা উল্টালে শুধু বিষাদের ছায়াই দেখতে পাওয়া যায়। অন্ধকার এক রাতে শুভ্রতাও নিজের অন্ধকার অতীতের পাতা তুলে ধরে মেঘের সামনে।
‘আমি ছোট’বেলা থেকেই চার’দেয়ালের মাঝে বড় হয়েছি। আমাকে সবসময় এটা বলা হতো বাইরের ছেলে’মেয়েদের সাথে মিশতে না। ওদের সাথে মিশলে মুখের ভাষা খারাপ হয়ে যাবে। আমি বরাবরই চাপা স্বভাবের ছিলাম। তাই খারাপ লাগলেও কিছু বলতাম না। সারাদিন টিভি দেখা,পড়া এই অবধি আমার সীমানা ছিলো। আম্মু কোথাও বেড়াতেও যেতো না,আমিও যেতে পারতাম না। আব্বুর ভাষ্যমতে উনি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবেন না। এভাবেই আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। আমি এই চার’দেয়ালের মাঝে হাপিয়ে উঠেছি। প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথের কোনো ফ্রেন্ডের সাথে কথাও হতো না আমার। ভয় লাগতো আবার যদি ওদের সাথেও মিশতে না করে দেয়। বাবা-মার বাধ্য ছিলাম বলে কথা। এসএসসির শেষে পড়া নেই,নিজের একাকিত্বর সাথী হলো মোবাইল। যেটা আমার জীবনের কাল হয়ে এলো। একদিন ফেইসবুকে ট্রলের সময় একটা গান শুনলাম ভয়েসটা অসম্ভব ভালো লেগে গিয়েছিলো আমার। কমেন্ট করেছিলাম। এরপরই ওই গলার মালিক আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠায়। আমি এক্সেপ্টও করি। তার আইডির প্রতিটা গান শুনতাম,ভালো লাগতো। আমাদের মাঝে টুকটাক কথাও হতো। একদিন সে আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমি এক্সেপ্ট করি না। কিন্ত মনে মনে আমিও তাকে পছন্দ করতাম। একদিন শুনলাম সে হসপিটালাইজড। সেদিন রিয়েলাইজ করলাম আই ফল ইন লাভ উইথ হিম! ওকে কল দিলাম। ও জিজ্ঞাস করেছিলো কেনো এতো হাইপার হয়েছি? আমি স্বীকার করেছিলাম যে আমি ওকে ভালোবাসি! এর পর সে বলেছিলো সে ঠিক আছে। আমার মুখ থেকে স্বীকার করানোর জন্য ছোট্ট একটা নাটক করেছে। এরপর থেকে আমাদের নিয়ম করে কথা হতো। দেখা হতো না কারণ,সে বলেছিলো সে আপাদত ঢাকায় আছে। তাদের রেস্টুরেন্ট সামলাচ্ছে। আর আমিও বের হতে পারতাম না। এরপর রেজাল্ট দিলো A+ পেয়েছিলাম। আমাদের জেলার সবচেয়ে বড় কলেজেই চান্স পেলাম! এর কিছুদিন পর সে আসলো দেখা করলো আমার সাথে। তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হলাম।
ঠিক একবছর পর জানতে পারলাম সে আমি থাকা অবস্থায় আরো একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করেছে। আমি দুনিয়া কেঁপে উঠলো। কিন্ত ততোদিনে আমি তার মায়ায় পুরোপুরি ভাবে জড়িয়ে গেলাম। কি করে ছাড়তাম ওকে। যাই হোক সব মেনে আবারও কন্টিনিউ করলাম। সেও সব বাদ দিয়ে দেয়। দেড় বছর পর জানলাম সে আমাকে নিজের ব্যাপারে যা যা বলেছে সব মিথ্যে। তার বাবা দেশে থাকে,সে বলেছিলো বাইরে থাকে। তাদের ঢাকায় কিছুই নেই,সে মিথ্যে বলেছিলো। ভেবেছিলাম তার বাবার সাথে তো আমার কিছু নেই। না থাকলে নাই বা থাকলো ক্ষতি কি। সে বলেছিলো আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে এসব বলেছে! এরপর থেকে ভালোভাবে সবটা চলছিলো। একদিন এসে বললো,,’শুভ্রা আমি চাকরি পেয়েছি!’ খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। ভেবেছিলাম এবার আমাদের ভালো সময় আসবে। আব্বু-আম্মু বিয়ের কথা বললে ওর কথা বলতে পারবো।
একদিন সে এসে বললো বিয়ে করতে চায় আমাকে। আমি বলেছিলাম বাসায় বলো। সে বলে এখন না,আরো কিছুদিন পর তার জায়গাটা আরেকটু শক্ত হোক। আমি বলেছিলাম তাহলে বিয়েও কিছুদিন পর। সে বলে,,”আমি ঢাকায় থাকি,তুমি গ্রামে। আমার ভয় করে। যদি হারিয়ে যাও। বিয়ে করে রেখে দেবো। তোমার বিয়ের কথার সময় সাধারণ ভাবে সম্বন্ধ নিয়ে যাবো। কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলবো না!’ তাও আমি রাজি হতে পারছিলাম না। সে ইমোশনাল ব্ল্যাকম্যাল করতে লাগলো। রাজি হয়ে গেলাম। এরপর লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলি!’

এটুকু বলে শুভ্রতা দুটো ঢোক গিললো। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে। নিজেকে সামলানোর জন্য বেলকনির গ্রিল খামছে ধরলো। মেঘের দিকে তাকানোর সাহস ফেলো না। কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আবারও বলা শুরু করে,,

‘বিয়ের সতেরো দিনের মাঝেই আব্বু কিভাবে জেনে গেলো সবটা। আমার জীবনের নরক যন্ত্রণা সেদিন আমি টের পেয়েছিলাম। আব্বু-আম্মু জানার দুদিন পর আমাকে উনারা জানিয়েছিলো। দু’দিন আমার সাথে কথা বলেনি ওরা। তাও যতোটা ভয় পাওয়ার প্রয়োজন ছিলো আমি ততোটা পাই নি। ভেবেছিলাম ঝামেলা হলেও শেষ অবধি আমাদের মিল তো হবে! কিন্ত নাহ বাস্তবতা আমার প্রত্যাশার থেকেও যে নিষ্ঠুর। সে আমাকে আরো একবার ঠকালো। তার জব,কাবিননামা সবটাতে ঠকিয়ে দিয়েছে। সে আবারও আমার সাথে মিথ্যে মিথ্যে খেলা খেললো। আব্বু-আম্মু আমার সামনে দু’টো অপশন রাখলো। এক,ওর কাছে যাওয়া সাথে মা-বাবার সাথে আর সম্পর্ক না রাখা। আমি যদি যাই,বাবাও মাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার ভাইটা এতিম হয়ে যাবে। দুই,ওকে ডিভোর্স দেওয়া। আমি পুরো নিঃস্ব হয়ে গেছিলাম। রুহিপু আমার সাথে ছিলো। আমার জেঠুরা আগে চিটাগাং থাকতো। দু’বছর আগে গ্রামে এসেছিলো। রুহিপু আমাকে সামলিয়েছে, আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিলাম। সপ্তাহ খানিকের মাঝে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো। কিন্ত এই অবধি সীমাবদ্ধ থাকে নি। সবাই সবটা জেনে গিয়েছিলো। আব্বু,আম্মুকে ধরে ধরে জিজ্ঞাস করতো। সারাদিন কাঁদতাম তাও কেউ বুঝতো না। পাড়া-প্রতিবেশি সবাই ছিহ ছিহ করতো। কিছু করতে পারতাম না। মা-বাবাও আমাকে বুঝতে পারতো না। যেদিন প্রথম সম্বন্ধ নিয়ে আসে সেদিন আমার মা আমার চোখের ভাষা না বুঝলেও আমি আমার মায়ের চোখের ভাষা পড়েছি। সেখানে ছিলো দায়মুক্তির তাড়া। রাজি না হওয়াতে মা বলেছিলো,,’যা করেছিস করার আগে মনে ছিলো না? বিয়ের জন্য তো পাগল হয়ে গেছিলি। এখন বিয়ে দিচ্ছি তো ঠান্ডা হো!’ নিজের মায়ের মুখ থেকে এই কথা শুনে শুধু তাকিয়ে রইলাম। ইচ্ছে করছিলো মরে যাই,কিন্ত আমি খুব ভীতু আত্মহত্যার মতো পাপ করতে পারি নি।’

আর বলতে পারলো না শুভ্রতা। গলা থেকে যেনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। কেউ চেপে ধরে আছে যেনো। শরীরটা যেনো ছেড়ে দিচ্ছে। কান্না করতে ইচ্ছে করছে কিন্ত তাও কাঁদতে পারছে না। বিয়ের দিন প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলো আর দুর্বল হবে না কিন্ত তাও আজ আটকাতে পারছে না। গ্রিল ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো। মেঘ নিঃশব্দে এগিয়ে এলো শুভ্রতার পাশে। শুভ্রতাকে নিজের বাহুডোরে আবন্ধ করে নিলো। শুভ্রতার যেনো এই শান্তিটারই প্রয়োজন ছিলো। লেপ্টে রইলো মেঘের উষ্ণ বুকে। মেঘের মাঝে যেনো শান্তি খুঁজে ফেলো। মেঘ একহাতে শুভ্রতাকে ধরে আরেক হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,’কুল ডাউন শুভ্র! কিচ্ছু হই নি। শান্ত হও!’

মেঘের কথায় শুভ্রতা হুহু করে কেঁদে দিলো। নিজেকে আটকাতে পারলো না। মেঘের টি-শার্টের পেছনের অংশটা খামছে ধরে বলে,,
‘মেঘ ও ওরা আমার চরিত্রেও কালি ছিটিয়েছে। আমাকে আমাকে ওই সব মেয়েদের সাথে তুলনা.. ‘ শুভ্রতা আবারও থেমে গেলো।
মেঘ শুভ্রতাকে শান্ত করার জন্য বলে,,’শুভ্র! শান্ত হও। আমি আছি না। তোমাকে কেউ আর কিছু বলতে পারবে না। আমি আছি তো তোমার সাথে!’ ‘আমি আছি তো তোমার সাথে!’ মেঘের কথাটা শুভ্রতাকে শান্ত করার জন্য কাজে দিলো। শুভ্রতা হালকা মাথা উঁচু করে মেঘের মুখের দিকে তাকালো। আবছা অন্ধকারেও যেনো সে মেঘের মুখ দেখতে পারছে। মেঘও শুভ্রতার মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখে পানি চিকচিক করছে।
‘সত্যি আপনি থাকবেন তো আমার পাশে? আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো? আপনিও আমায় ভূল বুঝে দূরে যাবেন না তো? আপনিও আমাকে অবিশ্বাস করবেন না তো? বলুন না। প্লিজ বলুন না!’ শুভ্রতা কেমন যেনো হাইপার হয়ে উঠলো। মেঘ শুভ্রতাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। পারলে যেনো বুকের মধ্যেই ঢুকিয়ে নেয়।
‘প্লিজ শুভ্র! শান্ত হও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কখনো একা ফেলে যাবো না। তুমি শুধু একটু শান্ত হও!’ মেঘের কথার মাঝেই শুভ্রতার শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। মেঘ শুভ্রতাকে ভালোভাবে ধরে ফেলে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। মেঘ তড়িঘড়ি করে খাটে শুইয়ে দেয়। গালে হালকা চাপড় মেরে বলে,,’শুভ্র!শুভ্র!চোখ খুলো প্লিজ!’ কিন্ত শুভ্রতার কোনো সাড়া নেই!

#চলবে?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here