হৃদয়জুড়ে তুমি পর্ব -১০

#হৃদয়জুড়ে_তুমি
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

সিমা নিজের শাশুড়ির মুখে এমন কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে রেগে যায়। পরক্ষণেই তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
‘আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের মেয়ের দিকে তাকান। প্রেগন্যান্ট আমি নই, প্রেগন্যান্ট আপনার মেয়ে।’

সিমার কথায় যেন খান ভিলার ড্রয়িংরুমে বেশ বড়সড় একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়। রায়খান খান কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন নিজের মেয়ের দিকে। রাগে ক্রোধে হাতের মুঠো শক্ত করে ইনায়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে একের পর এক থা’প্পর মা’রতে থাকেন। মান্নাত বেগমও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। নিজের মেয়ের এমন কুকীর্তির কথা জেনে তার মুখ একদম ছোট হয়ে গেছে।

ইহানও ইনায়াকে বকাবকি করতে থাকে। রায়হান খান ইনায়াকে ছেড়ে মান্নাত বেগমের সামনে এসে বলেন,
‘খুব তো বড় বড় কথা বলো। নিজের মেয়েকে এ কেমন শিক্ষা দিয়েছ? ছি! আমার ভাবতেও লজ্জা করছে। এসব কথা যদি বাইরে জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আমার মান সম্মান পুরো ধুলোয় মিশে যাবে।’

মান্নাত বেগম নিজের মেয়ের দিকে এগিয়ে যান। তাকে এলোপাতাড়ি মা’রতে মা’রতে বলেন,
‘শ’য়তান মেয়ে, এই দিন দেখার জন্য তোকে জন্ম দিয়েছিলাম। সত্যি করে বল এই বাচ্চাটা কার। নাহলে তোকে আমি আজই শেষ করে দেব। তোকে জন্ম দিয়ে যেই পাপ করেছি আজ তোকে মে’রে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব।’

ইনায়া অনবরত কেদেই চলেছে। তার চোখের জল ফুরাচ্ছেই না। ইনায়া কান্নারত অবস্থায় বলে,
‘এটা আমার বয়ফ্রেন্ড জিসানের বাচ্চা। আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম। ওর কাছে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে,,’

এই পর্যায়ে সিমা বলে ওঠে,
‘তোমরা আজকালকার মেয়েরা অনেকেই এই ভুলটা করো। ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে নিজের সতীত্ব বিসর্জন দাও। কিন্তু এটা কোনভাবেই জাস্টিফাই করার মতো কাজ নয়। কাউকে ভালোবাসলে তার দেহ ছুতে চাওয়ার বাসনা পুরোই অপ্রাসঙ্গিক। বরঞ্চ কাউকে যদি ভালোবাসা যায় তার সম্মান হবে আমানতের মতো৷ যেটার খেয়ানত কোনভাবেই করা যাবে না।’

‘আমি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখন আমি কি করব?’

মান্নাত বেগম ইনায়াকে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে বলে,
‘তুই এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। আজ থেকে আমি জানব আমার কোন মেয়ে নেই। ‘

সিমা ইনায়ার পাশে দাড়ায়। মান্নাত বেগমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘যখন নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল রাখার কথা ছিল,আপনি তখন তো রাখেন নি। এখন এভাবে নিজের মেয়ের ঘাড়ে পুরো দোষ চাপানোর মানে নেই। মা-বাবা হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব ছিল আপনার মেয়ে কখন কোথায় যাচ্ছে, কি করছে তার খেয়াল রাখা।’

মান্নাত বেগম রেগে গিয়ে বলেন,
‘তুমি আমাকে জ্ঞান দিওনা। এখন এই মেয়ের জন্য আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।’

‘এমন কিছুই হবে না। আমি সবকিছু ঠিক করে দেব।’

১৯.
জিসান নামের ছেলেটা সিমার বাবার অফিসেই কাজ করে। সিমা তার বাবার সাহায্যে জিসানের সাথে যোগাযোগ করেছে। অতঃপর বিভিন্ন কায়দায় তাকে রাজি করিয়েছে ইনায়াকে বিয়ে করার জন্য। জিসান তাই আজ তার পরিবারকে নিয়ে এসেছে ইনায়াকে দেখার জন্য।

দুই পরিবারের লোক মুখোমুখি হয়ে বসে আছে। রায়হান খান জিসানের বাবার সাথে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছেন। মান্নাত বেগমও জিসানের মা-চাচিদের সাথে টুকটাক কথা বলছেন। দুই পরিবার থেকেই বিয়ের জন্য মত দেওয়া হয়। অতঃপর আগামী সপ্তাহে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। বিয়ের তারিখ ঠিক হতেই ইনায়া সিমার কাছে যায়। তার দিকে কৃতজ্ঞতার সাথে তাকিয়ে বলে,
‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভাবি। আজ শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম।’

সিমা বলে,
‘আমাকে ধন্যবাদ বলো না। আমি তোমার জন্য কিছু করিনি। যা করেছি তোমার বাচ্চাটার জন্য করেছি। কারণ আমি চাইনি তোমার কৃতকাজের জন্য এই নিষ্পাপ বাচ্চাটা কোন শাস্তি পাক। তুমি অন্যায় করেছ এটা ঠিক, কিন্তু এই বাচ্চাটির তো কোন অন্যায় নেই। আর হ্যা, আমাকে ভাবি বলো না, আমার অস্বস্তি হয়।’

ইনায়া এবার অপরাধবোধ থেকে বলে,
‘তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই। তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি আমি, যা হয়তো ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু আমি আজকে মন থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

জিসান তার পরিবারকে নিয়ে বিদায় নেয়। সবাই চলে যাওয়ার পর মান্নাত বেগম সিমার কাছে আসে। সিমার হাত ধরে বলে,
‘তুমি আমার অনেক বড় উপকার করলে। সত্যি মানুষ ঠিকই বলে, রূপ দেখে কাউকে বিচার করা উচিৎ নয়। মানুষের মনটাই আসল।’

সিমা কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘আপনি যে বুঝতে পেরেছেন সেটাই অনেক। কিন্তু আমি কিন্তু এত সহজে আপনি আমাকে যা যা অপমান করেছেন সেটা ভুলে যাব না। এতটা দয়ালু আমি নই। তবে আপনার কাছে অনুরোধ আর কখনো গায়ের রং বা চেহারা নিয়ে কাউকে খোটা দিবেন না। এই দেখুন না, আমার গায়ের রং কালো, কিন্তু আমি কখনো এমন কোন কাজ করিনি যার জন্য আমার বাবাকে অসম্মানিত হতে হয়েছে। বরং আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নিজের বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছি। অপরদিকে, আপনার মেয়ে ইনায়া। ও তো অনেক সুন্দরী, অনেক ফর্সা অথচ দেখুন ও আপনার মুখল উজ্জ্বল তো করেই নি বরং আর একটু হলে আপনাদের মুখে কালো করে দিত। এইজন্য কারো বাহ্যিক রূপ দেখে তাকে বিচার করবেন না, চরিত্র দেখে বিচার করুন।’

সিমা এই কথাগুলো বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। মান্নাত বেগম তার শাড়ির আচল দিয়ে নিজের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া কয়েক বিন্দু অশ্রু লেপন করে বলে,
‘আমি বুঝতে পেরেছি সবকিছু। আল্লাহ এতদিনে আমাকে সঠিক বুঝ দিয়েছেন। আমি খাটি হিরে চিনতে ভুল করেছিলাম। কিন্তু এতদিনে যখন আমি হিরের সন্ধান পেয়েছি তখন আর তাকে হারাতে দেব না। তোমার থেকে ভালো মেয়ে যে আমি আর আমার ইহানের জন্য পাবো না সিমা।’

২০.
সিমার ফোনে রাতে হঠাৎ একটি আননোন নম্বর থেকে কল আসে। সিমা ফোনটা রিসিভ করে। বিপরীত দিক থেকে কোন শব্দ না আসায় সে হ্যালো, হ্যালো করতে থাকে, তবুও কোন উত্তর আসে না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কল কে’টে যায়। সিমার একটু খটকা লাগে বিষয়টা তবে সে এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না।

সিমা নিজের একটি প্রজেক্টের কাজে লেগে পড়ে৷ রাত ১২ টার দিকে আচমকা ঘরে কারো আগমন টের পায় সিমা। চকিত হয়ে সামনে তাকাতেই ইহানকে দেখতে পায়। এত রাতে ইহানকে নিজের রুমে দেখে অবাক হয় সিমা। জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি এত রাতে আমার রুমে কি করছেন?’

ইহান পকেটে হাত গুজে বলে,
‘তোমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছিলাম। তোমার জন্যই আমাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হতে হতে বেচে গেল।’

‘আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। আপনি বরং নিজের মানসিকতা বদলান তাহলেই আমি খুশি হবো। আপনার সুন্দরী বোনের এমন কাণ্ড দেখে নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পেরেছেন যে, সুন্দর হলেই কেউ ভালো হয়না। চরিত্র এবং মন সুন্দর হওয়াটাই বড় ব্যাপার।’

ইহান এবার একটু কড়া গলায় বলে,
‘তুমি আমাদের উপকার করেছ তাই ধন্যবাদ দিতে এসেছি। তাই জন্য এটা ভেবে নিও না যে আমি তোমাকে বউ বলে মেনে নেবো।’

‘সেটা আমি কখনো আশা করিনি আর না এখন করি। আমি শুধু এটুকু আশা করব যেন আপনি নিজের মানসিকতা বদলান। আর আপনি আমাকে মেনে নেওয়ার কে, আমি নিজেই আপনাকে স্বামী হিসেবে কখনো মানব না। আপনার মতো নিচু মানসিকতার মানুষকে আমি স্বামী হিসেবে চাই না।’

ইহান সিমার দিকে রাগি দৃষ্টি প্রেক্ষাপটের করে গটগট করে রুম থেকে চলে যায়। সিমা পুনরায় নিজের কাজে মনযোগ দেয়।

মান্নাত বেগম এতক্ষণ ধরে দরজায় দাড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনিই তো ইহানকে পাঠিয়েছিলেন সিমার সাথে কথা বলার জন্য। ভেবেছিলেন তাদের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে হিতে বিপরীত হচ্ছে। মান্নাত বেগম হাল না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করে বলেন,
‘যে করেই হোক ইহান ও সিমাকে আমি এক করেই ছাড়ব।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here