হৃদয়ের দহন পর্ব ৪

#হৃদয়ের দহন
#পর্বঃ৪
#সামিরা পপি

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।সকালে সামিরা যে রাস্তার পাশে বসেছিল সেখানে এখনও বসে আছে।কোথায় যাবে সে?তার তো আর কোন আত্মীয়-স্বজন নেই।আর এই শররের যতটুকু জায়গায় গিয়েছে ততটুকু ছাড়া আর কিছুই চিনেনা সে।তাই সেই জায়গায় বসে আছে মাথা নিচু করে।কান্না করতে করতে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।এখন আর কান্নাও আসছে না।মামি ধাক্কা দেওয়ায় যে ইটের সাথে বারি খেয়েছে মাথায় সে জায়গায় প্রচুর ব্যাথা করছে।ব্যাথাটা যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে।ব্যাথায় সম্পূর্ণ মাথা টনটন করছে।সকালে যে রিহান নিজের হাতে নাস্তা খায়য়ে দিয়েছিল সেই খাওয়ায় এখনও পানিও পড়েনি পেটে।খিদের ছুটে পেটের দড়ি ছিড়ে যাচ্ছে।সাথে মাথা ব্যাথা।তার মধ্যে রাত হয়ে আসছে।আবার আশে পাশের লোকজন তারদিকে তাকাচ্ছে।সব মিলিয়ে এক অস্বস্থিকর অবস্থা।ভয়, কান্না যেন ঘিরে ধরেছে।হঠাৎ খেয়াল করল সামিরা তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।মাথাটাও ঘুরছে।কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে।সামিরা চাচ্ছে কোনভাবে উঠে দাঁড়াতে কিন্তু পারছে না।হাত পা গুলোও কেমন অবশ হয়ে আসছে।একসময় সামিরা অজ্ঞান হয়ে রাস্তার পাশেই পড়ে যাই।কত মানুষ তার লুটিয়ে পড়া দেখে ঘিরে ধরে।কিন্তু কেউ সামিরার কাছে আসেনা।তাকে ছুঁয়েও ধরে না।এইখানে যেন কোন সিনেমার শুটিং চলছে সবাই এক জুট হয়ে তা দেখছে।ভিড় ঠেলে ভেতরে আসে একজন মধ্য বয়ষ্ক লোক।সাদা শার্ট,কালো কোর্ট,কালো প্যান্ট।চোখে গোল ফ্রেমের চশমা।তিনি এসেই সামিরার এই অবস্থা দেখে দ্রুত সামিরাকে কোলে নেয়।নিয়ে গাড়িয়ে শুয়ে দিয়ে দ্রুত নিকটবর্তী এক হসপিটালের নিয়ে যাই।আধা ঘন্টা পর ডাক্তার চেকাপ করে লোকটাকে বলেন,
—-“আসলে মেয়েটা সারাদিন কিছু খায়নি হয়তো আবার মাথায়ও চোট লেগেছে তাই প্রেশার লো হয়ে গেছিল।আর শরীর অনেক দূর্বল।আমি ওষুধ দিচ্ছি সেগুলো খাওয়াবেন।আর ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করলে দুইদিনে ঠিক হয়ে যাবে।”
লোকটা বলল,
—-“ওকে ডক্টর।আর আমি কি দেখা করতে পারি ওর সাথে?”
—-“জ্বী অবশ্যই।”
লোকটা সামিরার কাছে গিয়ে সামিরার পাশে বসে।সামিরা চোখ বন্ধ করে আছে।কপালে ব্যান্ডেজ করা।মুখটা শুকিয়ে গেছে একদম।কেমন যেন নিষ্প্রাণ লাগছে তাকে।তা দেখে লোকটার বেশ মায়া হলো।সামিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।সামিরা কারো সাথে মমতায় ভরা স্পর্শ পেয়ে চোখ খোলে।লোকটা সামিরাকে বলে,
—-“ভালো লাগছে এখন?”
সামিরা আস্তে করে বলল,
—-“জ্বী।কিন্তু আমি এইখানে কেন?আর আপনি কে?”
—-“আমার নাম হচ্ছে আজাদ।তুমি রাস্তার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে।তাই আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি। তা তোমার নাম কি মা?”
—-“আমার নাম সামিরা।”
—-“ওহ আচ্ছা।তা বলো তোমার বাসা কোথায় বলো আমি দিয়ে আসি?”
বাসার কথা মনে হতেই সামিরার সকালে মামির কথা মনে পড়ে গেল।তার প্রচুর কান্না পাচ্ছে।কিন্তু কোন মতে ধরা গলায় বলল,
—-“আমার বাড়ি নেই।”
সামিরার কথা শুনে মিস্টার আজাদ বেশ অবাক হলো।
—-“কি বলছ তুমি?সবার বাডি থাকে আর তুমি বলছ নেই।নিশ্চয় ঘরে কারো সাথে রাগ করেছ তাই না?”
—-“না আঙ্কেল এমন না।আসলে আমার আপন বলতে কেউ নেই।”
আজাদ সাহেব আরো অবাক হয়ে বলল,
—-“মানে?”
সামিরা কান্না করে দিল।তারপর তার সব কথা খুলে বলল।সব শুনে আজাদ সাহেবের ও খারাপ লাগছে প্রচুর।এইটুকু একটা মেয়ে কই যাবে এখন?আর দিন কালও ভালো না।দেশের যে পরিস্থিতি।পুরুষ মানুষরা ত মেয়েদের একা পেলে কথায় নেই।পারেনা ছিড়ে খেতে।সব ভেবে আজাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারপর বলল,
—-“আচ্ছা তুমি আর কান্না করো না।ঠিক আছে?তুমি আমার সাথে আমার বাসায় চলো।”
সামিরা আজাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-“কিন্তু আঙ্কেল?”
—-“কোন কিন্তু না।তুমি আমার মেয়ের মতই।তুমি এখনও ছোট।তোমাকে তো আমি একা ফেলে যেতে পারিনা।আর তুমি আমাদের ঘরে ভালো থাকবে।আমাদের ঘরে তেমন কেউ নেই।শুধু আমি,আমার ছেলে আর তোমার আন্টি ছাড়া।তাই আর কথা বলো না।চলো।”
সামিরা আর কিছু বলতে চেয়েও পারল না।আর তার এখন একটা আশ্র‍য়ের খুব প্রয়োজনও।তাই আজাদ সাহেবের সাথে সামিরা তার বাসায় আসে।বাড়িটা মোটামুটি অনেক সুন্দর। বেশি বড়ও না আবার ছোটও না।সামিরাকে নিয়ে আজাদ সাহেব ঘরে প্রবেশ করে।আজাদ সাহেবের সাথে সামিরাকে দেখে আজাদ সাহেবের স্ত্রী বলেন,
—-“এইটা কে?”
—-“সব বলছি তুমি তার আগে ওর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করো।মেয়েটার শরীর অনেক দূর্বল। ”
—-“আচ্ছা।”
বলেই আজাদ সাহেবের স্ত্রী খাবার আনতে যাই।আর আজাদ সাহেব সামিরার উদ্দেশ্য বলেন,
—-“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো।”
সামিরা কোন কথা বলল না।চুপচাপ বসল।আজাদ সাহেবের স্ত্রী সামিরার জন্য ভাত তরকারি নিয়ে এলো।আজাদ সাহেব স্ত্রীর উদ্দেশ্য বলল,
—–“ওকে একটু হাত মুখ ধুয়ে দাও তো।”
আজাদ সাহেবের স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে বাথরুমে গেল।সামিরা এদের স্বাভাবিক আচরন দেখে খুব অবাক হলো।সবাই কত ভালো। ওর কত আদর যত্ন করছে।সামিরা বাথরুমে না গিয়ে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবছিল।তখন আজাদ সাহেবের স্ত্রী বলল,
—-“কি হলো?যাও হাত মুখ ধুঁয়ে আসো?”
সামিরা বাথরুমে গিয়ে পানিতে হাত দিল।সাথে সাথেই হাত জ্বলতে শুরু করল।সামিরা একটা চাপা আর্তনাদ করল “আহ্”। তখনি আজাদ সাহেবের স্ত্রী ভেতরে গিয়ে বলল,
—–” কি হয়েছে তোমার?”
সামিরা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে কান্না করে উঠেছিল।সামিরার দৃষ্টি অনুসরন করে তিনিও তাকালেন।আর সাথে সাথেই শিউওরে উঠলেন।তবে সামিরার কান্না দেখে কিছুই বললেন না।তিনি নিজেই সামিরাকে হাত মুখ ধুঁয়ে দিলেন।এতে সামিরা আরো অবাক হলো।খাওয়ার সময় আজাদ সাহেবের স্ত্রী নিজেই খায়য়ে দিল।সামিরা এত আদর যত্ন দেখে মা’য়ের কথা মনে পড়ে গেল।তখনি দুকরে কেঁদে উঠল।
আজাদ সাহেবের স্ত্রী রোমানা বললেন,
—-“কি হয়েছে কাঁদছো কেন?”
সামিরা ধরা গলায় বলল,
—–“আম্মুকে মনে পড়ছিল তাই।”
—–“ওহ।আচ্ছা কান্না করিও না।আমি কি তোমার মা’য়ের মত না?তুমি আমায় মামনি ডাকিও কেমন?আমার তো একটা মেয়ের শখ ছিল কিন্তু হয়নি।”
সামিরা রোমানার কথা শুনে আরো কান্না করে দিল।রোমানা সামিরাকে খাবার খায়য়ে দিল।খাবার খাওয়া শেষে আজাদ সাহেব ওষুধ গুলো দিয়ে গেল।সেগুলোও সামিরাকে খাওয়ালো।আজাদ সাহেবের কথা মত সামিরাকে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।কিন্তু এর ভিতর সামিরার ব্যাপার কিছুই জিজ্ঞেস করল না রোমানা।কারন সে জানে সব কথা স্বামী বলবে তাকে।সামিরাকে ঘুম পাড়িয়ে সামিরার ব্যাপারে রোমানা আজাদ সাহেবের সাথে কথা বলেন।তখন রোমানা সব শুনে নিজেও কান্না করে দিলেন।সেই থেকে সামিরাকে প্রচুর ভালোবাসে রোমানা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here