#এক_ফাগুনের_গল্প
#পর্বঃ-১২
ভেবেছিলাম মোহনার খালু লঞ্চ ঘাটে নিজের কিছু লোকজন পাঠাবেন আমাদের নিয়ে যেতে। কিন্তু সে নিজেই আসবে সেটা কল্পনার বাইরে ছিল তবে তাকে দেখে সেই ধারণা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মুখভর্তি লম্বা দাড়ি সবগুলো সাদা ছিল মনে হয় কিন্তু সম্প্রতি সে মেহেন্দি দিয়ে রঙিন করেছে। সাদা একটা পাঞ্জাবি পরে আছে, ঠোঁটের কোন বেয়ে পানের দু ফোঁটা পিক পরেছে পাঞ্জাবির বোতামের কাছে। মোহনার বড় খালার স্বামী হিসাবে আর তাদের অত্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে বেশ মানিয়েছে। আমি সবাই কে নিয়ে নামলাম, মোহনার খালুর লোকজন মিলে কেবিন থেকে মালপত্র নামিয়ে আনলেন।
গাড়িতে উঠে আমাকে মোহনার পাশে বসতে হলো তাছাড়া উপায় ছিল না। সারাটা পথে দুজনের সাথে দুজনের শরীর লেগে গেছে, মোহনা প্রথম প্রথম দু একবার গাড়ির ধাক্কার সময় স্পর্শ হলে গুটিয়ে যেত। কিন্তু পরক্ষণেই আর সেটা করলো না, গাড়ি আস্তে আস্তে বড় রাস্তা রেখে গ্রামের রাস্তায় নেমে গেল।
প্রায় ঘন্টা খানিক পরে গ্রামের মধ্যে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো। বুঝতে পারলাম এটাই মনে হয় মোহনার খালার বাসা, তাই সবাই আস্তে আস্তে নামার প্রস্তুতি চলছে। গাড়ি থেকে নামার ঠিক সেই মুহূর্তে মোহনা বিড়বিড় করে বললোঃ-
– আমার চেয়ে এক বছরের বড় একটা খালাতো বোন আছে, যদি তার সাথে বেশি কথা বলতে দেখি তবে…।
– বললাম, তবে কি?
– বাড়ির পিছনে খালুর বিশাল বড় মাগুর মাছের পুকুর আছে।
– মানে?
– যদি বেশি আলাপ করতে দেখি তাহলে কেটে কুঁচি কুঁচি করে মাগুর মাছকে খাওয়াব।
– হক মাওলা, কি বলছো তুমি?
– মোহনা এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে সবার সাথে কুশলাদি করতে লাগলো।
আকাশে হুড়মুড় করে বজ্রপাত আরম্ভ হলো, মাত্র কিছু সময়ের মধ্যে চারিদিকে মেঘের অন্ধকারে কালো হয়ে গেল। জৈষ্ঠ্যমাসের ঝড়ে আম পরার সময় চলছে, গ্রামের বাড়িতে এটা আম পাকার মনে হয় উপযুক্ত সময়। বাড়ির মধ্যে যে পরিমাণ মানুষের আশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। আমি আর ফাহিম দোতলায় একটা রুমে চলে এলাম কারণ এখানেই আমরা থাকবো।
ঘরটা সুন্দর, বেশ পছন্দ হয়েছে। রুমের মধ্যে গোসল করার ব্যবস্থা আছে, গ্রামের মধ্যে হলেও এই বাড়ির সবকিছু শহরের অনুরূপে তৈরী করা হয়েছে। বাড়ির বয়স বেশি হলে ৮/১০ বছর হতে পারে তাই বেশ মনে হচ্ছে আমার কাছে। ভেবেছিলাম গোসল করতে পুকুরে যেতে হবে কিন্তু রুমের মধ্যে বাথরুম দেখে সেখান থেকে গোসল করলাম। গোসল করে বেড়িয়ে দেখি রুমের মধ্যে ফাহিমের সঙ্গে আরেকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ফাহিম বললো, স্যার আমাদের সবাই কে নাস্তা করতে নিচে ডাকছে। তাই আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিন, নাহলে আবার পরে যখন না পাই?
– আমি ফাহিমকে বললাম, ইনি কি তোমার খালাতো বোন নাকি?
– মেয়েটা বললো, না আমার নাম সামিহা আমি এ বাড়িতে থাকি। মা-বাবা মারা যাবার পর চেয়ারম্যান আঙ্কেল আমাকে নিয়ে এসেছেন এ বাড়িতে। আর চেয়ারম্যান আঙ্কেলের মেয়ের নাম মরিয়ম তিনি এখন পাশের বাড়িতে আছে।
– ওহ্হ আচ্ছা।
– জ্বি, আপনারা নাস্তা করতে আসুন।
নাস্তার টেবিলে আমরা ছাড়া আরো তিনজন আছে, বিয়ে বাড়ি তাই দুরের অনেক আত্মীয় স্বজনরা এসে এখানে আছে। রান্না ভালো ছিল, পেটের মধ্যে প্রচুর ক্ষুধাও ছিল তাই সামনে যেটা ভালো লেগেছে সেটাই পটাপট পেটে চালান করে দিছি।
★★
বিকেল বেলা গ্রাম দেখতে বের হলাম, ফাহিম আমি আরেকটা ছেলে আমাদের সাথে আছে। বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা, রাস্তার পাশেই খোলা মাঠ, মাঠে অনেক পানি জমে আছে। আমাদের সাথে যে ছেলে এসেছে তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে জোয়ারের পানিতে এমন অবস্থা। এখন নাকি অমাবস্যার সিজন তাই পানির চাপ বেশি, রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দুর চলে গেলাম। শহরের মাঝে বড় হয়েছি তাই গ্রামের বাড়ি কেমন সৌন্দর্য সেটা ভালো করে উপভোগ করার সুযোগ তেমন হয়নি। কাজেই এখন চোখের সামনে সৌন্দর্যে মুগ্ধ করা গ্রামের দৃশ্য দেখে মন বাড়ি ফিরতে চায় না।
বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন মাগরিব পেরিয়ে গেছে বাড়ির সামনে এসেই মোহনার সাথে দেখা। তার চোখের চাহনি প্রকাশ করে দিচ্ছে অজস্র রাগান্বিত একটা মনুষ্য। সে আমাকে কিছু না বলে ফাহিমকে লক্ষ্য করে বললোঃ-
– কোথায় গেছিলি ফাহিম?
– ঘুরতে গেছিলাম আপু, কত সুন্দর গ্রামের দৃশ্য তাই দেখে আর আসতে মন চায় না।
– বাড়ির পিছনে বাগানের মধ্যে ঘোরাঘুরি করবি তাতেই হবে, শুধু শুধু বাহিরে যাবার দরকার নেই।
– আমি বললাম, বাড়ির পিছনে খালুর বিশাল বড় মাগুর মাছের পুকুর আছে তাই ভয়ে সেদিকে পা বাড়াবো না।
রাতের খাবার শেষ করে আমাদের রুমের মধ্যে বসে গেল বিশাল গল্পের আসর। সদস্যঃ- মোহনা, ফাহিম, সামিহা, মোহনার খালাতো বোন মরিয়ম আরো নাম না জানা দুটো মেয়ে আরেকটা ছেলে।
অনেক রাত অবধি সবাই জেগে ছিলাম, মোহনা বারবার উঠি উঠি করেও বসে রইলো। মূলত তার ইচ্ছে সে সবাই কে নিয়ে বেরিয়ে যাবে কিন্তু আমরা এতটাই আড্ডায় মেতে উঠলাম যে ছাড়তে ইচ্ছে হলো না। সবচেয়ে বেশি হাস্যকর হচ্ছে আমার বলা চট্টগ্রামের ভাষা আর মরিয়ম ও সামিহার বলা বরিশালের ভাষা। আমি যেটা চট্টগ্রামের ভাষায় বলি সেটা তারা বরিশালের ভাষায় বলে।
সামিহা মেয়েটা খুব মিষ্টি করে হাসতে পারে, সামিহা ঠিক যতটা বেশি করে হাসে, মোহনা ঠিক ততটাই মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। আড্ডা চলতে চলতে যখন সবার চোখে ঘুমের আগমন হলো তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। আমি আর ফাহিম বাদে সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল, সবশেষে বের হলো মোহনা। মোহনা আস্তে করে বললোঃ- কাপড় সব তৈরি রেখো, এখানে তোমার থাকতে হবে না।
|
|
সকাল বেলা প্রচন্ড দরজা ধাক্কায় জেগে উঠলাম, হুড়মুড় করে দরজা খুলে দেখি মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললোঃ- সর্বনাশ হয়ে গেছে।
– কি হইছে?
– গতকাল রাতে সামিহা নামের যে মেয়ের সাথে এত হাসাহাসি করলাম, সেই মেয়ে খুন হয়েছে। সে নিচে একা একা একটা রুমে থাকতো, কিন্তু আজ সকালে বাগানের মধ্যে তার গলা কাটা লাশ পাওয়া গেছে।
– কি বলছো? এতো বড় সাংঘাতিক ঘটনা?
– আমার তো খুব ভয় করছে, দুদিন পর আপুর বিয়ে আর আজকে এ বাড়িতে খুন হলো।
– হ্যাঁ সেটাই তো, পুলিশ এসেছে নাকি?
– এখনো আসেনি তবে এসে পরবে।
– চলো তো গিয়ে দেখে আসি।
– চলো।
চলবে…..
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)