বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে “মেঘ”। অপেক্ষা করছে তার প্রিয় মানুষটার ফোন দেবার অপেক্ষায়। পুরো দুটো দিন কথা হয় না। হঠাৎ ই ফোনের রিংটোন বেজে স্ক্রিনটা জ্বলে উঠলো। স্ক্রিনে সেই প্রিয়,পছন্দ আর ভালোবাসার নাম “আবিদ”। মেঘ কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো কারন সাথে সাথে ফোন রিসিভ করলে আবিদ মনে করবে আমি তার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।কেনো অপেক্ষা করবো?ঝগড়া করে দুদিন কথা বলা অফ রাখবে আমার অভিমান হবে না বুঝি? অভিমান কেনো বলছি আমার তো রাগ হবার কথা কিন্তু হচ্ছে না কেনো? মেঘ এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেলো। মেঘ উঠে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে বসলো। আবার কল আসলো। মেঘ এবার এক মুহুর্তও দেরী না করে ফোনটা রিসিভ করে নিলো।
দুদিকেই নিস্তব্ধতা। দুজনই অপেক্ষা করছে একে অপরের আওয়াজটা শোনার জন্য। আবিদ জানে মেঘ এখন আগবাড়িয়ে কথা বলবে না কারন মেঘ অভিমান করেছে। কিন্তু আবিদ যদি এখন একটু নরম হয় তাহলেই মেঘ চেপে বসবে। আবিদের খুব ইচ্ছে করছিলো সরিটা এক্ষুনি বলে ভালোবাসি কথাটা বলে দিতে কিন্তু মেঘ তাহলে আলহাদ শুরু করে দিবে। আবিদের মেঘের আলহাদগুলো খুব ভালোলাগে। এ পৃথিবীতে আবিদের সবচেয়ে পছন্দের জিনিস হলো তার “মেঘ এবং মেঘের সবকিছু” হোক না কেনো তা মেঘের বদ অভ্যাস। আবিদ নিস্তব্ধতা ভেঙে বললো।
– ” আমার তোমার বাসার সামনে যেতে বরাবর ১০ মিনিট লাগবে। তুমি ৫ মিনিটে নিচে এসো। দেখা করবো। ”
আবিদ কিছুটা রুক্ষতা মেখে কথাগুলো বললো। মেঘ বুঝলো আবিদের রাগ পড়ে নাই। এখন আবিদকে রাগালে আবার কয়দিন কথা না বলে থাকতে হবে কে জানে? কিন্তু এখন তো ভাইয়া বাসায়। আমি নিচে যাবো কীভাবে?
– ” শোনো না। ভাইয়া একটু আগে বাসায় আসছে। ড্রয়িংরুমে বসা।আমি কীভাবে নিচে আসবো বলো? ”
– ” আমি জানি না আমি এক্ষুনি দেখা করবো। তোমার কাছে ৫ মিনিট আছে! ”
কথাটা বলেই আবিদ ফোনটা কেটে দিলো।কারন আবিদ জানে ও আর কিছুক্ষন ফোনে কথা বললে মেঘ গুছিয়ে কথা বলে ওকে বশ করে নিতো। কিন্তু এখন বশ হলে চলবে না দুই দিন সে তার মেঘকে দেখে না।আজ জড়িয়ে ধরে মেঘের ঘ্রান না নিলে হয়তো রাতে ঘুম ই হবে না। আবিদ জ্যাকেট পড়ে গায়ে শালটা জড়িয়ে নিলো। আবিদ শাল পড়া একদম পছন্দ করে না। কিন্তু এটা মেঘ দিয়েছিলো তাই এই শালটা ওর খুব পছন্দের। বাইকের চাবি,লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো আবিদ।
আবিদ এখন মেঘের বাসার সামনের বড় গাছটার পেছনে। বাইকটা স্ট্যান্ড করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মধ্যে আলো শুধুই ওই জ্বলন্ত সিগারেট টা। মনের সুখে সিগারেটে টান দিচ্ছে আবিদ আর এই ভেবে মুচকি হাসছে যে একটু পরেই মেঘকে দেখতে পাবে।
পাশের বাসায় যাচ্ছি বলে মেঘ বের হয়ে লিফট দিয়ে সোজা নিচে চলে এলো। মেঘ জানে আবিদ কোথায় অপেক্ষা করছে। এ যায়গায় বহুবার দেখা করেছে তারা। মেঘ রাস্তাটা পার হয়ে ফোনের ফ্ল্যাশটা অন করে গাছের পেছনে চলে গেলো। আবিদ ফ্ল্যাশের আলো দেখেই সিগারেট টা ফেলে দিলো।কিন্তু মেঘ ঠিকই দেখে ফেললো আবিদ সিগারেট ফেলে দিচ্ছে।মেঘ আবিদের থেকে কিছুটা দূড়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আছে। আবিদ একটু মুচকি হেসে মেঘের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ফ্ল্যাশটা নিচের দিকে রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো মেঘ। আবিদ কাছে গিয়ে মেঘ এর কানের কাছে মুখ নিয়ে মিষ্টি করে বললো “কেমন আছে আমার মেঘবানু?” মেঘ মাথা তুলে বললো “তুমি না বলছো সিগারেট কমিয়ে দিবা? এখন দেখা করতে এসেও সিগারেট কেনো খাচ্ছিলা?” আবিদ বুঝলো যে মেঘ দেখে ফেলেছে সিগারেট। আবিদ নরম ভাবে উত্তর দিলো ” দুদিন যদি আমার খোজ না নাও, দুদিন যদি আমি তোমায় না দেখতে পাই তাহলে সিগারেট খাবো না তো কী করবো?”। মেঘ চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,” খোজ না নেওয়ার পেছনে, দেখা না হওয়ার পেছনের কারনটা আপনি নিজেই। আমি তো আর ইচ্ছে করে বলি নী যে ঝগড়া করুন। ঝগড়া করে আমার থেকে দুড়ে থাকুন। “।আবিদ খুব ভালো করেই জানে এই পরিস্থিতিতে ঠিক করলে মেঘ গলে যায়। আবিদ আর কোনো কথা না বলে মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ” জানোই তো আমার শর্ট টেম্পার মাত্রাতিরিক্ত, ইগো বেশি।তুমি ফোন দিলেই তো হতো! ” মেঘ আবিদকে জড়িয়ে ধরে নিজের মাথাটা আবিদের কাধে রেখে অভিমানের স্বরে বলছে ” কেনো করবো ফোন? তুমি নিজেই তো ফোন দিতে না করছিলে। আবিদ মেঘকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো ” সরি মেঘবানু!”
– “কীসের সরি? তোমার শাস্তি হবে কাল। কোনো সরি তে কাজ হবে না। অনেক জ্বালাইছো এই দুই দিনে।”
আবিদ মেঘের গলায় হালকা করে কামড় দিয়ে বললো, “আচ্ছা আমার মেঘবানু!”
মেঘ আবিদের কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে আবিদের কলার ঠিক করতে করতে বললো, ” আজ বেশি প্রেম করার সুযোগ দিতে পারলাম না। ভাইয়া বাসায় তো তাই। আমি পাশের বাসায় যাচ্ছি বলে বের হয়ে আসছি। এখন বাসায় গিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে যাও। কাল সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৬ টা অবধি প্রেম করবো” বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো মেঘ।তারপর আবার একটু আলতো ন্যাকা রাগ মিশিয়ে বললো, “আরকি তোমার শাস্তি কাল সারাদিন। এই দুদিন কষ্ট দিছো তাই!” বলেই মেঘ আবিদের দুই গালে চুমু দিলো। মেঘ আবিদের কপাল চুমু দিতে গিয়েও পারলো না।কারন আবিদ মেঘের চেয়ে যথেষ্ট লম্বা। মেঘ আবিদকে বললো ” এই লম্বু মাথা নামাও আমি কপালে চুমু খাবো! ” আবিদ মেঘের কোমড় ধরে উচু করে নিলো। মেঘের শরীরের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে আবিদের স্পর্ষে।মেঘ আবিদের গলা জড়িয়ে ধরে আবিদের কপালে চুমু খেলো। তারপর বললো, ” ভালোবাসি মেঘবানুর জামাই। এখন আমি যাই নাহলে ভাইয়া আমার ক্লাস নিয়ে নিবে। কাল ৮ টায় কলেজের সামনে থাকবা। এখন গিয়েই ঘুম দিবা।”
আবিদ এখনও মেঘকে উপড়ে তুলে আছে। মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ” প্রেম করবে আর পরিবারের বকা শুনবা না, ভাইয়ার কাছে কট খাবা না তা হয় নাকি? প্রেম করলে একটু সাহস রাখতে হয়!” মেঘ আবিদের নাক ধরে টান দিয়ে বললো ” আবিদের মতো ছেলে আমার কাছে মিয়াও মিয়াও করে তাহলে এবার ভাবো আমার কত সাহস!” বলে হেসে দিলো মেঘ। মেঘের কথা শুনে আবিদও হেসে দিলো।
– ” নামাও এবার, যেতে হবে!”
– ” আমার ঠোট দুটো কী দোষ করলো? ঠোটে চুমু খাবে না?”
– ” ঠোট দিয়ে সিগারেট খেয়ে মেঘবানুর ঠোটের স্পর্ষ পাবে ভাবলে কী করে? সিগারেট না খেলে অবশ্যই চুমু খেতাম।এবার নামাও লেট হচ্ছে! ”
আবিদ মেঘকে নামিয়ে দিয়ে মেঘের কপালে চুমু দিয়ে বললো, ” ভালোবাসি মেঘবানু!”
মেঘ একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায়।
আবিদ বাইক স্টার্ট করে, একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইকটা হালকা স্পিডে চালানো শুরু করলো। সিগারেটটা দু ঠোটের কোনায় চেপে ধরে পারদর্শিতার সাথে নাক দিয়ে ধোয়া ছাড়ছে আর বাইক চালাচ্ছে আবিদ। আর মুচকি মুচকি হাসছে তার “মেঘবানুর” কথা ভেবে। মেঘের পুরো নাম “আদনিন রহমান মেঘ” আবিদ আদর করে “মেঘবানু” বলে ডাকে। কিন্তু সমসময় মেঘবানু বলে না যখনই মেঘ রাগ করে তখনই মেঘবানু বলে মানিয়ে নেয় মেঘকে। আবিদ বাইক পার্কিং এ পার্ক করে। লিফট দিয়ে উঠে বাসার কলিং বেল বাজানো শুরু করলো। দুবার কলিংবেল বাজাতেই আবিদের ছোট বোন ইসরাত এসে দরজা খুলে দিলো। আবিদকে দেখেই ইসরাত ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো – “কীরে মেঘমেখে এলি নাকি?মুখ লাড্ডুর মতো লাগছে কেনো?”
আবিদ ইসরাতের মাথায় গাট্টা মেরে বললো, “হুম মেঘমেখেই আসছি। আম্মু কই? ভাত খাব!”
ইসরাত কিছুটা রেগে বললো “আগে মাইর খা তারপর ভাত খাইস। ”
– ” ইসু,মজার মুড নাই। খেয়ে ঘুম দিবো সকালে ৮ টায় আবার মেঘ মাখতে যেতে হবে!”
– “ইস আমি যে কবে প্রেম করবো তোর আর মেঘ ভাবির মতো।আমার প্রেমিকপুরুষ কোথায়?”
– ” আমি বেচে থাকতে তুই শান্তিতে প্রেম করতে পারবি না। আর তোর মতো মেয়েকে যে ছেলে প্রোপোজ করবে সে ছেলের রুচি নেই বললেই চলে! ”
ইসরাত আবির হাতে একটা রামচিমটি দিয়ে বললো আজকেও ৪ টা ছেলে প্রোপোজ করছে খালি আমায় কেউ ইম্প্রেস করতে পারে না বলে।
– ” হুম প্রোপোজ ঠিক আছে। কিন্তু তুই না বলার পরে কোনো ছেলে বিরক্ত করছে না তো?”
ইসরাত নিজের কোমড়ে হাত দিয়ে আবিদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো আমায় বিরক্ত করবে এমন সাহস আছে নাকি কারো? ইসরাত তালুকদার সিস্টার অফ আবিদ তালুকদার ওরফে টেম্পার আবিদের বোন আমি। আরে ওরা প্রোপোজই তো করে মেয়েদেরকে দিয়ে। তোর ভয়ে সামনে এসেও প্রোপোজ করে না। কিন্তু ওরা তো জানেই না টেম্পার আবিদ আমায় কতটা ভয় পায়। বলেই হাসা শুরু করে দেয় ইসরাত। এর মধ্যেই “রিনা তালুকদার” মানে আবিদের মা এসে জিজ্ঞেস করে।
– “কিরে আবিদ কোথায় গেছিলি?”
ইসরাত বলে মেঘমা.. তার আগেই আবিদ ইসরাতকে চিমটি দিয়ে থামিয়ে দেয়।
– ” এইতো আম্মু নিচে গেছিলাম একটু! ”
রিনা বেগম ভালোভাবেই জানে তার ছেলে মেঘের সাথে দেখা করে এসেছে। তা তার ছেলের মুখেই স্পষ্ট!
আবিদ খেয়ে-দেয় মাত্র শুয়েছে। তখনই মেঘ ফোন দিলো।
– ” আজ অনলাইনে থাকবো না। কাল তোমার অপেক্ষায় রাত জেগেছিলাম তাই আজ ঘুম আসছে খুব। ঘুমাইয়া যাও সকালে দেখা হবে!”
– ” সরি কালকে রাত জাগিয়ে রাখানোর জন্য!”
– ” হুম ভালোবাসি, ঘুমাবো টাটা!”
– ” আচ্ছা টাটা, ভালোবাসি!”
মেঘ গ্যালারিতে ঢুকে আবিদের একটা ছবি দেখে। ফোনটা পাশে রেখে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুম দিলো। আবিদ শুয়ে শুয়ে ভাবছে সেই কলেজের বিদায় বছরের জুনিয়রদের নবীনবরনটা। সেই নবীনবরনেই প্রথম দেখেছিলো তার প্রেয়সি, প্রিয়তমা তার মেঘবানু। আবিদ চোখ বন্ধ করে সেই নবীনবরনটা ভাবতে থাকে।।
চলবে!
গল্প: প্রিয় পরিনতি!
পর্ব: ০১!
লেখক: তানভীর তুহিন!