সোনাবউ পর্ব ১

#সোনাবৌঃ
১ম খন্ডঃ
মোর্শেদা হোসেন রুবী
**************

যথেষ্ট সময় নিয়ে খুব যত্ন করে স্কার্ফটা পড়লো স্বর্ণা।সাদা আর সোনালী কারুকাজ করা স্কার্ফটা চমৎকার! স্কার্ফটা ওকে বিয়ের আগে বড়ভাইয়া কিনে দিয়েছিলেন।ওর বিদায়ের সময় মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন-‘ও বাড়ীতে যেয়ে ইসলামের নিয়মকানুন গুলো ভুলে যাসনা রে…,পর্দাটা ধরে রাখিস।পারলে সামনে এগোবি,পিছোস না যেন!”
..
স্বর্ণা মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল ভাইয়ের কথায়।কিন্তু বিয়ের পর থেকে নামাজ পড়া আর পর্দা করা দুটোই ভীষণ কঠিন হয়ে উঠেছে স্বর্ণার কাছে।কারন ওর শ্বশুড়বাড়ীর সবাই খুব আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন।
তাদের কাছে ইসলাম হলো জুম’আর আর দুই ঈদের নামাজ,বুড়ো বয়সে হজ্জ করা আর লাইন ধরে যাকাত দেয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ।
…..
স্বর্ণার স্বামী মেরাজ পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।
সম্পর্কে তিনি স্বর্ণারই এক দুরসম্পর্কের ভাই হন।একবার এক বিয়েবাড়ীতে স্বর্ণাকে দেখে পছন্দ করেন তিনি।তারপর মা’কে বলে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
স্বর্ণাদের বাড়ী থেকে কিছুটা আপত্তি উঠেছিল কারন প্রথমতঃ মেরাজ’রা বেশ ধনী।সে হিসেবে স্বর্ণারা মধ্যবিত্ত শ্রেনীর।
দ্বিতীয়তঃ স্বর্ণাদের বাড়ীতে যথাসম্ভব ইসলামিক নিয়মকানুন মেনে চলার চেষ্টা করা হয়,স্বর্ণার বাবা ছাড়া বাকীরা সবাই যেমন-স্বর্ণার মা,বড়ভাই-ভাবী নামাজ রোজা-পর্দার পাবন্দী করতে চেষ্টা করে!সে দিক দিয়ে মেরাজের পরিবার যথেষ্ট আধুনিক মনস্ক।
এই দুই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দুনিয়াবী চাহিদারই জয় হলো।ভালো ঘর ভালো বর পেলে কে হাতছাড়া করে।স্বর্ণার বাবা এমন সুপাত্র হাতছাড়া করতে মোটেও রাজী নন।
বাবার আগ্রহ আর পীড়াপীড়িতে অবশেষে স্বর্ণাকেও রাজী হতে হলো।
….
স্বর্ণার বিয়ে হয়েছে মাত্র মাসখানেক হয়েছে।এখনো নতুন বউ দেখতে আসা মেহমানের কমতি নেই।প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে।
আজ মেরাজের সব বন্ধু আর তাদের বউরা আসবে।
যাবার আগে মেরাজ তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে তৈরী হতে বলে ড্রইংরূমে গেছে।
স্বর্ণাও বলেছিল-“ভাবীদের ভেতরে পাঠিয়ে দিন,ওনাদের সাথে কথা বলি,ড্রইংরুমে সবার সামনে যেতে হবে কেন?
মেরাজ ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল-“আনকালচার্ডদের মতো কথা বলো না তো!তারা আজ বাসায় আসবে নতুন বউ দেখতে,তোমার সাথে পরিচিত হতে আর তুমি কিনা…!”
স্বর্ণা বেশী কিছু বলার সাহস পায়না।কারন মেরাজ তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে বললেও রেগে গেলে ওর হুঁশ থাকেনা।বিয়ের কিছুদিন পরই খুব সামান্য একটা কারনে মেরাজ হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মেরে চুরমার করেছিল।স্বর্ণার শ্বাশুড়ী সেদিন স্বর্ণাকে বলেছিল-শোনরে মা,আমার ছেলেটার রাগটা একটু বেশী।ওর সাথে কখনো তর্কে জড়াবি না,যা বলে চুপচাপ মেনে নিবি!”
অভিমানে স্বর্ণার চোখ ফেটে পানি বেরিয়েছিল সেদিন।সে আর কিছু বলেনি এ নিয়ে।পরে অবশ্য রাতে বাসায় ফিরে খুব হাতপা ধরে মাফ চেয়ে স্বর্ণার ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছিলো মেরাজ।

….
স্বর্ণা তৈরী হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজেকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন এ্যাংগেলে দেখে নিচ্ছে যে তার সারা শরীর শালীনভাবে ঢাকা পড়েছে কিনা।সোনালী জামদানীতে স্বর্ণাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো।ঠোঁটে ন্যাচারাল কালারের লিপষ্টিক ছুঁইয়েছে।
একেবারে না লাগালে আবার মেরাজ রাগ করবে।তাই খুব সামান্যই দিয়েছে।স্কার্ফটাও সোনালী বোতাম দিয়ে পরিপাটি করেছে।এমন সময় মেরাজ ঘরে ঢুকল-“কই…ডার্লিং সোনা…তুমি রেডী…?” বলে স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।
হাসিমুখের আলো ধীরে ধীরে কমে গেল-“এটা কি পরেছো তুমি?”
স্বর্ণা বুঝলো মেরাজ তার স্কার্ফের দিকে আঙ্গুল তুলেছে!সে কাঁপা স্বরে বলল-“কেন,স্কার্ফটা তো সুন্দর!”
-“প্রশ্নটা তো সুন্দর অসুন্দরের না রে বাবা!এটা পরে ওদের সামনে যাবে তুমি,খোলো স্কার্ফ..!”
স্বর্ণা থমথমে মুখে বলল-“পরপুরুষের সামনে চুল খুলে আমি যাবোনা!”
মেরাজ মেজাজটা সামলে নিলো চট করে,তাছাড়া স্বর্ণাকে এ মুহূর্তে কড়া কথা বলতে চাচ্ছেনা মেরাজ।স্বর্ণার যা স্বভাব….কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলবে! দরকার নেই।
মেরাজ শান্ত স্বরে বলল-“মাথায় কাপড় দিতে চাও ভালো কথা…আঁচলটা আছে কি করতে?”
স্বর্ণা মৃদু স্বরে আবদারের সুরে বলল-“থাকনা এটা,এতো কষ্ট করে পড়েছি যখন।”
মেরাজ ঠান্ডা স্বরে বলল-“না মানে…না!”

অগত্যা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চেপে স্বর্ণাকে স্কার্ফ খুলতে হলো।আঁচলটা দিয়ে যতটুকু পারা যায় মাথাটা ঢেকেঢুকে ড্রইংরুমে আসলে সবাই একযোগে তার দিকে তাকালো।
এক ভাবী উঠে এসে স্বর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-“বাহ্..মেরাজ ভাই…ভাবী তো খুব্বি কিউট।স্বর্ণা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল।মেরাজের এক বন্ধুকে বলতে শুনলো-“কিরে!ভাবীকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবিনা?”
মেরাজ-“ওহ্..ইয়েস..!”বলে একে একে সবার নাম ধরে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো মেরাজ।
-“এ হলো শাওন..মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার।ও..জাভেদ..বিরাট ব্যবসায়ী…..বুঝলে….!কিন্তু জিজ্ঞেস করলেই শুনবে ওর ব্যবসা ভালো যাচ্ছেনা..হা হা..হা..ঘরে একদফা হাসির রোল উঠল।
আরেক বন্ধুকে দেখিয়ে বলল-“এ হলো জামিল,নামকরা আর্টিস্ট..এখনো বিয়ে করেনি..ও নাকি ওর মনের মত কাউকে এখনো খুঁজে পায়নি।জামিল নামের লোকটি বলল-“ভাবী চাইলে আমার ছবির মডেল হতে পারে,ভাবীর মধ্যে ঐ জিনিস আছে”।
আরেক বন্ধু পেছন থেকে বলে উঠল-“ব্যাটা তোর নজর ভালো কর্,পরের বউকে মডেল বানাবি কেন? নিজের বউ যোগাড় করে মডেল বানা..হা..হা..হা..আরেকদফা হাসির রোল উঠল।স্বর্ণার মনে হলো ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে।মনে মনে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে পড়তে গলা শুকিয়ে এলো।মেরাজ তখনো বলে চলছে-“ওহ্ হো তোমাকে তো আরেক ব্যাচেলরের সাথে পরিচয় করানো হয়নি..কিরে তুই বাইরে বারান্দায় কেন?”‘বলে সেই বন্ধুটিকে ডাকলো মেরাজ।
সেই বন্ধু ঘরে ঢুকলে মেরাজ বললো-“এ হলো আমার স্কুল লাইফের বেষ্ট ফ্রেন্ড প্লাস তোমার প্রতিবেশী।আমাদের বাড়ীর অপজিটের বাসাটাই ওদের।বেচারা এখনো বিয়ে করেনি কারন সেও তার মনমতো মেয়ে পায়নি। ও আবার হলো গিয়ে…আমাদের বিশেষ ..আলিম সাহেব…।ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স করেছে।এখন কুষ্টিয়া ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে!ও মেয়েদের সামনে যায়না তাদের দিকে তাকায়না।বেচারা আজ আমার ঝগড়ার ভয়ে পদধূলি রেখেছে।ওর নাম হলো আলিফ”।
স্বর্ণা এক ঝলক তাকিয়ে সালাম দেবার আগেই তার সামনের শশ্রুষামন্ডিত লোকটি মার্জিত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে সরে গেল।স্বর্ণার মনে হলো পুরো ঘরটাতে এই একজনই মানুষ যে তাকে দেখে কোনো মন্তব্য না করে সরে গেছে।স্বর্ণার লজ্জা আরো বেড়ে গেলো এই ভেবে যে,লোকটি নিশ্চয়ই স্বর্ণাকে বেহায়া ভাবছে।কিন্তু স্বর্ণাই বা কি করবে!স্বামীর আদেশের কাছে সে তো নিরূপায়!

কিছুক্ষণ বসে থেকে স্বর্ণা মাথা ব্যথার অযুহাত দিয়ে উঠে এসেছে।কারন মেরাজের এক বন্ধু বারবার স্বর্ণার দিকে তাকাচ্ছিলো।স্বর্ণা এক ঝলক তাকিয়েই বুঝেছে,লোকটা খারাপ।

সবাই বিদায় নিলে মেরাজ থমথমে মুখে ঘরে এলো।স্বর্ণা ততক্ষণে পোশাক বদলে নিয়েছে।স্বর্ণা নিজেই জিজ্ঞেস করল-“আপনাকে কি চা দেবো?”
মেরাজ কোনো উত্তর করলোনা।স্বর্ণা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল-“মন খারাপ?”
মেরাজ এবার যেন ফেটে পড়ল-“তোমার মত আনকালচার্ড বউ যার আছে তার সমাজে মুখ দেখানোর কোনো উপায় আছে?ওরা তোমার সাথে ছবি তুলতে চাইলো দিলেনা,সহজ ভাবে কারো সাথে কথা বললেনা,এতো ঢং কোথায় শিখেছো? কলেজ-ভার্সিটিতে যখন গেছো তখন কি কোনো ছেলের সাথে আড্ডা দাওনি? আজ যে বড় ধোয়া তুলসিপাতা সাজলে?”
স্বর্ণা মুখ বন্ধ করে মেরাজের অশ্রাব্য কথাগুলো শুনতে লাগল।একপর্যায়ে মেরাজ নিজেই ক্লান্ত হয়ে পাশের স্টাডিরুমে চলে গেল।আর স্বর্ণা বালিশে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো।

রাত কত হয়েছে স্বর্ণা বলতে পারবেনা।চোখটা লেগে এসেছিলো।হঠাৎ মেরাজের ডাকে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।জড়ানো স্বরে ওকে ডাকছে মেরাজ।স্বর্ণার মনটা বিষাক্ত হয়ে গেলো।সে কি এই লোকটার খেলার পুতুল?মন চাইলে ছুঁড়ে ফেলবে, মন চাইলে কোলে তুলে নেবে?
……
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here