#শ্রাবণ রাতের বর্ষণ❤
লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
পর্বঃ ০৬
_________________
দীর্ঘসময় পার করে নিজ রাজ্যে পা রেখেছেন সম্রাট রুদ্রদীপ। সঙ্গে সঙ্গে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে রাজ্যের কোণায় কোণায়। করবেই না কেন? বিনা কোনো রক্তারক্তি করে কূঞ্জনরাজ্য জয় করেছে তাদের সম্রাট রুদ্র। তবে রাজ্যের এসব উৎসবে বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই রুদ্রের। সে তো চন্দ্রার পানে তাকিয়ে থাকতে ব্যস্ত। কিন্তু চন্দ্রা! সে কি রুদ্রের পানে তাকিয়েছে একবারও? না! বিষন্ন মন নিয়ে স্থলের দিকে চোখ তার। রুদ্র একটা লম্বা শ্বাস টেনে চন্দ্রার কাছে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে দাঁড়ালেন সিংহাসনের একটু অগ্রে। এতে মুহুর্তেই উৎসবমুখর পরিবেশ একদম স্তব্ধ হয়ে উঠল। সকলেই রুদ্রের এহেন কান্ড দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের মতে চন্দ্রা তো এ রাজ্যের একজন দাসী কিংবা রুদ্রের রক্ষিতা। তাহলে? রুদ্র তো কখনও বিভিন্ন রাজ্য জয় করে সেখানকার রাজিকুমারীদের এভাবে নিজ ঘোড়ায় চড়িয়ে রাজ্যে আনেন নি। কিংবা রাজদরবারের সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের নিয়ে একসঙ্গে দাঁড়ান নি। চন্দ্রার বেলাই এমন কেন? প্রশ্নগুলো যেন সবার মস্তিষ্কেই বিরাজমান। সম্রাট রুদ্রের মাতা রাণী অমরা এগিয়ে এলেন রুদ্রের অগ্রে। বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “এ কি করছ তুমি রুদ্র?”
সম্রাট রুদ্র সামান্য ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “কি করেছি?”
— “একজন দাসীকে নিজের পার্শ্বে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করছ কি করেছি?”
রুদ্র এবার পূর্ণভাবে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “কে দাসী?”
ক্ষাণিকটা বিরক্তি প্রকাশ করলেন রাণী অমরা। চন্দ্রার মাথা থেকে পা অব্দী একবার পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন,
— “তোমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা। কূঞ্জনরাজ্যের রাজকুমারী।”
রুদ্র স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
— “যেহেতু আপনি জানেনই চন্দ্রপ্রভা একজন রাজকুমারী তাহলে দাসী বলছেন কেন? তাছাড়া ও হচ্ছে এই সিংহিদীপ সম্রাজ্যের পরবর্তী রাণী। সম্রাট রুদ্রের সম্রাজ্ঞী।”
বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল রাণী অমরার। সাথে রাজ্যের সকলের। রুদ্রের তিন বউ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রুদ্রের দিকে। এ কি শুনছে তারা? যে কিনা তার বিবাহিত স্ত্রীদের কখনও স্ত্রীর মর্যাদা দেয় নি, সর্বদা রক্ষিতা বলে এসেছে। সেই সম্রাট কিনা এখন একজন রক্ষিতাকে নিজের সম্রাজ্ঞী হিসেবে মর্যাদা দিচ্ছে। পরবর্তী রাণী হিসেবে ঘোষণা করছে? হিংসায় জ্বলে উঠল তারা। তবে রুদ্রের প্রথম দু’জন স্ত্রীর হিংসে হলেও তা শুধু ভেতরে ভেতরে। রুদ্রকে কিছু বলার বা কওয়ার সাহস নেই তাদের। কিন্তু রত্নমা হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। হিংসার প্রবল উত্তাপে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে সে। এদিকে রুদ্রের মুখে বাঁকা হাসি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে চন্দ্রপ্রভার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলেন রাজপ্রাসাদের ভেতর। তবে যাওয়ার আগে মিষ্টি করে হেসে বলে গেছেন,
— “আমার বিবাহে আমার তরফ থেকে সকলকে অগ্রীম নিমন্ত্রণ রইল।”
____________________
কূঞ্জনরাজ্যের কক্ষ থেকেও দ্বিগুণ বড় কক্ষের সামনে এসে রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভাকে নিয়ে সম্রাট রুদ্র প্রবেশ করলেন কক্ষের ভেতর। সাথে সাথে সকল দাসী মাথা নত করে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। তারা যেতেই মুখে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটিয়ে চন্দ্রাকে বলে উঠলেন রুদ্র,
— “কেমন লেগেছে এই কক্ষ তোমার রাজকুমারী? নিশ্চয়ই ভালো লেগেছে তাই না?”
চন্দ্রা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। রুদ্র হেসে ভ্রু চুলকে বলল,
— “একটা মজার ব্যাপার কি জানো চন্দ্রা।”
চন্দ্রা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্রের দিকে। রুদ্র বলে উঠে,
— “তোমার জন্য যে দাসী রাখা হয়েছে তার নাম কিরণ। তোমার সবচেয়ে পছন্দের দাসীর নাম ছিল এটা তাই না?”
চোখ ভরে এলো চন্দ্রার। মৃদু কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল,
— “আমার কিরণ ঠিক আছে? ও কি এখনও বেঁচে আছে?”
রুদ্র জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। চন্দ্রা আবারও বলল,
— “হত্যা করেছেন তাকে?”
রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো চন্দ্রপ্রভার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ধরা পরল চন্দ্রার ক্রুদ্ধ চোখ জোড়া। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে রুদ্র বলে উঠলেন,
— “ক্ষুধা লেগেছে তোমার? আহারের ব্যবস্থা করছি আমি। তুমি স্নান করে এসো।”
বলেই উত্তরের অপেক্ষা করলেন না রুদ্র। একজন দাসীকে ডেকে উঠলেন। কিরণ নামের দাসী। কিরণ এসে রুদ্র আর চন্দ্রাকে নতজানু করে অভিবাদন জানালো। রুদ্র বলে উঠল,
— “স্নানাগার তৈরি আছে তো? রাজকুমারীর সকল দাসী কে ডেকে আনো যাও। রাজকুমারী চন্দ্রা স্নান করবেন।”
— “যা আদেশ সম্রাট। আমি এখনই যাচ্ছি।”
বলেই চলে গেল দাসী। পরপরই রুদ্র কেমন করে যেন তাকালো চন্দ্রার দিকে৷ চন্দ্রা মাথা নিচু করে ফেলল। মনে সাহস সঞ্চয় করে মৃদু স্বরে বলে উঠল,
— “বৃদ্ধা-বৃদ্ধকে কি বন্দী করে রেখেছেন আপনি?”
রুদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে খানিকটা রাগী কণ্ঠে বললেন,
— “সেটা তোমার না জানলেও চলবে।”
দমে গেলেন চন্দ্রা। তবে পরক্ষণেই আবারও বলে উঠলেন,
— “আমার পিতা-মাতা কোথায় আছেন? আমি তাদের সাথে সাক্ষাত করতে চাই।”
মুহুর্তেই রুদ্রের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। শুকনো ঢোক গিললো সে। উত্তর না দিয়েই প্রস্থান করল কক্ষ থেকে। চন্দ্রা তাকিয়ে রইল রুদ্রের যাওয়ার পানে। চোখ আবারও জলে ভরে আসছে তার। এ জীবনে কি আর নিজ পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাত হবে না তার? এত নিষ্ঠুর কেন সিংহদীপ সম্রাজ্যের সম্রাট?
_______________________
চন্দ্রার সাথে সাথে রুদ্রও নিজ কক্ষে স্নান সেরে নিলো। পোশাক পরিধানের পরপরই সম্রাট রুদ্রের বিশ্বস্ত দাস প্রতাব এসে হাজির হলো তার সামনে। নতজানু হয়ে সম্মান জানিয়ে বলল,
— “ক্ষমা করবেন সম্রাট। এসময় আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।”
— “বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই প্রতাব। কি জন্য এসেছ তা বলো।”
— “আসলে সম্রাট রাণী রত্নমা এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে।”
মুহুর্তেই বিরক্তি যেন চারদিকে ঘিরে বসলো রুদ্রকে। চরম বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল সে,
— “তোমাকে কতবার বলেছি প্রতাব, ওদের রাণী বলে সম্মোধন করবে না। যদি করারই হয় তাহলে রাজকুমারী চন্দ্রাকে করবে। আর হ্যাঁ, তাকে যেতে বলো এখান থেকে। আমি তার সাথে দেখা করতে আগ্রহী নই।”
প্রতাব আপত্তি প্রকাশ করে বলল,
— “আমি বলেছিলাম তাকে সম্রাট। সে আপনার সঙ্গে দেখা না করা ছাড়া যেতে চাইছে না।”
রুদ্র চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠল,
— “কক্ষে আসতে দাও তাকে।”
প্রতাম মাথা নত করে রুদ্রকে সম্মান জানিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। ক্ষাণিকবাদ রত্নমা এসে হাজির হলো কক্ষে। মাথা নত করে প্রথমেই বলে উঠল,
— “কেমন আছেন আপনি সম্রাট?”
রুদ্র জবাব দিলো না। আড়চোখে রত্নমার দিকে একবার তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে বেজায় বিরক্তি নিয়ে আবারও চোখ ফিরিয়ে নিলো। কেমন খোলামেলা পোশাক পরে নিজেকে রুদ্রের সামমে উপস্থাপন করছে রত্নমা, যা দেখে বিরক্ত লাগছে রুদ্রর। রত্নমার দিকে না তাকিয়েই রুদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “কেন এসেছো এখানে?”
রত্নমা জবাব দিলো না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্রের সৌম্য রুপের পানে। যে কোনো নারী রুদ্রের এই সৌম্য রুপের প্রেমে পরে যেতে পারে মুহুর্তেই। তাই জন্যই তো রত্নমা রুদ্রের মাতা অমরাকে নানা কৌশলের মাধ্যমে রুদ্রকে তার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য রাজী করেছে। অথচ রত্নমার নারী হিসেবে এত রুপ থাকা সত্ত্বেও রুদ্র তার দিকে ফিরেও তাকায় না। ভেবেই হতাশ হলো রত্নমা। পরক্ষণেই হিংসে জ্বলে উঠল চন্দ্রার কথা ভেবে। এদিকে রত্নমার এভাবে মূক(বোবা) বনে থাকা দেখে রুদ্র রেগে যাচ্ছে তীব্রভাবে। কোনো ভাবে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে উঠল সে,
— “কোনো কথা বলতে না চাইলে যেতে পারো রত্নমা। আমার বিরক্ত লাগছে তোমাকে।”
ন্যাকা কান্নায় মেতে উঠল রত্নমা। টাক টেনে টেনে বলল,
— “আমার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছেন আপনি রুদ্র? আমি আপনার সম্রাজ্ঞী হই। এত অবহেলা কেন করছেন আমায়?”
রুদ্র এবার চেঁচিয়ে উঠল,
— “তোমার সাহস দেখে আমি অতীব অবাক হচ্ছি। সাহস কিভাবে হয় আমার নাম ধরে ডাকার? সম্রাট বলবে আমায়। সম্রাট!”
থেমে থেমে রুদ্র আবার বলে উঠল,
— “আর হ্যাঁ, তুমি আমার সম্রাজ্ঞী নও। সামান্য একটা রক্ষিতা। যাকে আমার ছুঁয়ে দেখতেও ঘৃণা করে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাও এখনই। নতুবা তোমার গর্দান ক্ষত-বিক্ষত করতে প্রহর গুণব না আমি।”
অপমান, রাগ, ক্ষোপ ও হিংসায় রত্নমা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে৷ রুদ্র তখনও রাগে ফুঁসছে। আপাতত নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে চন্দ্রার সাথে সাক্ষাত করতে যেতে হবে তার।
.
_______________চলবে_______________
বিঃদ্রঃ Afrin Shuvra, Soleman Khan Uzzal, ঘুমন্ত পরী সবাইকে অনেকগুলো ধন্যবাদ।
Ishanur Tasmia