তোকে দিয়েছি মন পর্ব ৩১+৩২

তোকে_দিয়েছি_মন❤
৩১.৩২
পর্ব – ৩১
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বিছানায় বসে ছিলাম। পা গুলো নাড়ানো যাচ্ছে না। কোনোমতে বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবো তার আগেই হঠাৎ ঈশান এসে জাপটে ধরে শুয়ে পড়ল আমার উপর। ঘটনাটা এতোটাই আকস্মিক ভাবে ঘটেছে যে আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই খেয়াল করলাম উনি আমার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছেন। আমি তো নড়াচড়া করতে পারছিই না তার উপর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। উনার শক্ত শরীরের চাপে অনেকটা হালুয়া টাইপ অবস্থা আমার। তার উপর আমাকে চেপে ধরে আছেন। যেন আমার শ্বাসরোধ করাই উনার একমাত্র উদ্দেশ্য। আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম–

ঈশান কি করছেন? প্লিজ ছাড়ুন।

সারারাত তোমার জন্য ঘুমাতে পারিনি। এখন আমি একটু শান্তিতে ঘুমাবো। ডোন্ট ডিস্টার্ব।

আচ্ছা তো ঘুমান না! কে নিষেধ করেছে। কিন্তু আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।

তোমাকে ছাড়া তো ঘুম আসবে না তারা! একরাতেই আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছো তুমি।

ধুর এসব কি আবোল তাবোল বলছেন উনি?? এমনিতেই হাত পায়ের ব্যথায় নাজেহাল অবস্থা….তার উপর এই এক্সট্রা প্রেশার। আমার মনে হচ্ছে আমি এখনি মরে যাবো। এই অত্যাচার কতক্ষণ সহ্য করতে পেরেছি জানিনা। নেক্সট টাইম যখন ঘুম ভাঙল তখন দুপুর ১টা বাজে। ঈশানকে দেখলাম গলায় তোয়ালে জড়িয়ে হাটাহাটি করছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই মুচকি হাসলেন উনি। আমার মাথার সামনে এসে গালে হাত রেখে কপালে কিস দিয়ে বললেন—

গুড আফটারনুন!

এবারও আমার বলতে ইচ্ছে করল গুড আফটারনুনের গুষ্টি কিলাই। কিন্তু বললাম না। তার আগেই ঈশান বললেন–

জলদি উঠো তারা! লাঞ্চ করতে হবে।

আমি গলা খাকারি দিয়ে মৃদু স্বরে বললাম– কিসের লাঞ্চ? আমি তো এখনো ব্রেকফাস্টই করিনি।

উনি আবার একটু হাসলেন। আমার গালে হাত রেখে বললেন— তুমি ব্রেকফাস্ট করেছো বেবি।

কখন করলাম?

মনে পড়ছে না??

আমি অসহায় মুখ করে মাথা নাড়লাম। মানে মনে পড়ছে না। উনি হুট করেই আমায় কোলে তুলে নিয়ে বললেন– এসো মনে করাচ্ছি।

.

.

.
টেবিলে বসে লাঞ্চ করছি। এতোক্ষণ আমাদের ঘিরে অনেকেই দাড়িয়ে ছিল। ডায়না রেকেশী বাবর্চি আঙ্কেল…. আরো নাম না জানা অনেকজন। ঈশান হঠাৎই সবাইকে চলে যেতে বললেন। মুহুর্তেই যে যার মতো গায়েব হয়ে গেল। উনি তখন নিজের চেয়ার টেনে খানিকটা আমার কাছে এসে বসলেন। খুব সিরিয়াস একটা ভাব করে বললেন–

তারা শোনো! এখন আমি তোমাকে খুব ইম্পোরটেন্ট একটা বিষয় জানাতে চাই। কিন্তু তার আগে তোমাকে মেন্টালি প্রিপেয়ারড হতে হবে।

আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম– তাহলে পরে শুনবো। আগে হাতটা ধুয়ে আসি?

এই বলে উঠে যেতে নিলেই উনি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন–

না! আগে শুনে যাও৷

আমি হতাশ হয়ে বললাম— ওকে বলুন।

কাল আমরা তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তারিফের হাতে গুলি লেগেছে।

কথাটা শুনে আমি স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ হ্যাং মেরে বসে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলাম —

কি?? ভাইয়া এখন কোথায়??

উনি আমার কাধে হাত রেখে বললেন– তারা রিলেক্স! ভয়ের কিছু নেই । তারিফ একদম ঠিকাছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে….. গুলিটা আমাকে উদ্দেশ্য করে মারা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত তারিফের গায়ে লেগেছে।

কথাগুলো শুনে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। যেন মাথার সব সিস্টেম লস হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। টেবিল ছেড়ে পড়ে যেতে নিলেই উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমায় ধরে ফেললেন। খুব অস্থির হয়ে বললেন–

তারা তুমি ঠিকাছো??

আমি অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলাম– আপনাকে কে মেরে ফেলতে চাইছে?

আমি যাকে সন্দেহ করছি সেইই।

আমি আধখোলা চোখে উনার দিকে তাকালাম। কয়েকবার পলক ঝাকিয়ে বলে উঠলাম— কাকে সন্দেহ করছেন??

থাঞ্চু।

আমি কোনো কথা বলার সাহস পেলাম না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। জায়মার ঘটনাগুলো মাথায় নাড়া দিচ্ছে। উনি আমার দুই কাধ হালকা ঝাকিয়ে আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে বললেন–

তারা ঠিকাছো?

হ্যা? হ্যা ঠিকাছি( নড়েচড়ে বসলাম) আপনি যেন কি বলছিলেন।

উনি এবার হাটু গেড়ে আমার চেয়ারের সামনে বসলেন। আমার দুই হাতের উরু শক্ত করে চেপে ধরে আমার চোখে দৃষ্টি রেখে বললেন–

আমি থাঞ্চুকে উঠিয়ে এনেছি তারা।

আমি সঙ্গে সঙ্গে চেচিয়ে উঠলাম– মানে??

উনি আমার দুই গাল চেপে ধরে বললেন– হুম! আমাদের সাথে আমি থাঞ্চুকেও উঠিয়ে এনেছিলাম। কাল সারাটাদিন থাঞ্চু সেন্সলেস হয়ে গাড়ির পেছনের ডিকিতে বন্দী ছিল। কাল সন্ধ্যায় এইজন্যই আমি বেরিয়েছিলাম। থাঞ্চু এখন হসপিটালে এডমিট আছে। দেখা করতে যাবে একবার?

আমি রসগোল্লা শেপ চোখ নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এ কোন হিটলারের সামনে বসে আছি আমি ?? থাঞ্চুর মতো শয়তানকে হসপিটালে পাঠিয়ে দিয়েছে?? এখন আবার জিজ্ঞেস করছে দেখা করতে যাবো কিনা!! হে আল্লাহ আমায় ধৈর্য দাও। এই বুঝি জ্ঞান হারালাম।
🍂

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – অতিরিক্ত পর্ব
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি আর ঈশান ভাইয়া এখন দাড়িয়ে আছি ৩৬ নং কেবিনের ৩০৭ নম্বর বেডের সামনে। থাঞ্চু আধমরার মতো বিছানায় পড়ে আছে। আমার যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। থাঞ্চুর মতো এতো ডেয়ারিং একটা মানুষকে এই দশায় দেখতে হবে সেটা আমার কল্পনাতীত ছিল। থাঞ্চুর শরীরের প্রায় সব জায়গায় ক্ষত চিহ্ন থাকলেও ব্যান্ডেজটা শুধু মাথায় করা। তাও আবার খুব জটিল ভাবে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। অনেকটা হেলমেটের মতো। আমি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এতোটা নৃশংস দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা আমার এখনো হয়ে উঠেনি। ঈশান ভাইয়ার শার্ট মুষ্টি তে ধরে উনার বুকে মাথা রেখে দাড়িয়ে রইলাম আমি। একটা নার্স এসে বলে উঠল–

পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। কন্ডিশন খুব সিরিয়াস ছিল। ডেঞ্জার যোন থেকে বেচে ফিরেছে। কংগ্রাচুলেশনস! আপনাদের লাক ভালো।

আমি মাথা তুলে নার্সটার দিকে তাকালাম। নার্সটা ঈশান ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছিলেন। আমি এবার ঈশান ভাইয়ার মুখের দিকে তাকালাম। উনি স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন– থ্যাঙ্ক গড। আলহামদুলিল্লাহ!

আমি ভ্রু কুচকে উনাকে দেখতে লাগলাম। নিজেই মেরে এমন বেহাল দশা বানিয়েছে….. আর এখন এমন একটা ভাব করছে যেন পেশেন্ট উনার আপন খালাতো ভাই। এক্সিডেন্ট করে লাইফ রিস্ক হয়েছিল। আমার সন্দেহী দৃষ্টি দেখে উনি অপ্রস্তুত হলেন। আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আশেপাশে তাকালেন। আমি এবার উনাকে ছেড়ে দিয়ে থাঞ্চুর পাশে গিয়ে দাড়ালাম। এই প্রথম বেচারার জন্য দয়া হচ্ছে আমার। আগে যার সামনে গেলে ভয়ে শরীরের লোম পর্যন্ত কেপে উঠতো….. এখন তার জন্য করুণা লাগছে। থাঞ্চু আমার দিকে চোখ মেলে তাকাতেই আমি কিছুটা নরম সুরে বলে উঠলাম—

ভাইয়া ভালো আছেন?

থাঞ্চু নির্বিকার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ চোখ পিটপিট করে খুব অস্পষ্ট ভাবে বলল–

আপনি…… আপনি কে??

আমি অবাক হয়ে ঈশান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ঈশান ভাইয়া অপরাধী কণ্ঠে বললেন—

ওর কিছু মনে নেই তারা! সব ভুলে গেছে। কোমায় চলে গিয়েছিল। আমি তো ভেবেছিলাম মার্ডার কেইস হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে একটুর জন্য বেচে গেছে।

আমি চোখ সরু করে রাগী গলায় বললাম–

আপনি কি করেছেন ওর সাথে?? কি দিয়ে মেরেছেন যে এই অবস্থা হলো??

আরে রাগ উঠে গিয়েছিল প্রচুর । যাইই জিজ্ঞেস করি কোনো উত্তর দেয়না। খালি হাসে। তাই রাগের মাথায় দিলাম চেয়ার উঠিয়ে একটা বারি তাও আবার মাথা বরাবর। তারপর থেকে যে ফ্ল্যাট হয়েছে…. আর কোনো রেসপন্স পাইনি । এইমাত্র চোখ খুলে তাকালো। (একটু থেমে) আরেকটু হলেই ফেসে যেতাম তারা! একটুর জন্য বেচে গিয়েছি।

বলেই বড় করে হাফ ছাড়লেন উনি। আমি হেসে দিলাম। ইচ্ছে করছে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে। কেনো এতো হাসি পাচ্ছে নিজেও জানিনা।

ঈশান আর আমি এখন দাড়িয়ে আছি মেইন রাস্তার মোড়ে। উদ্দেশ্য আইসক্রিম খাবো। থাঞ্চু ডেঞ্জারজোন থেকে বেচে ফিরেছে এই বিষয়টা সেলিব্রেট করা দরকার। আমি কতটা খুশি জানিনা…… কিন্তু ঈশান তো ব্যাপক মাত্রায় খুশি। খুশিতে পারলে একশো জন হতদরিদ্র মানুষ বাসায় এনে মিলাদ পড়িয়ে ফেলে। যাক,,, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। কিন্তু আমি এখন চিন্তা করছি উনার এই হ্যাপিনেস টা আরেকটু বাড়িয়ে দিতে। জায়মার ব্যাপারটা কি উনাকে বলবো?? শকের ঠেলায় হার্ট অ্যাটাক করবেন না তো?? না থাক এখন বলে কাজ নেই। বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলবো। ঈশানের ছোয়ায় আমার ঘোর কাটল। ইশারা করে আমায় সামনে হাটতে বলছেন উনি। সামনে তাকাতেই দেখলাম বিশাল আইসক্রিম পার্লার। কিন্তু পার্লারের ভেতর ঢুকতে নিয়েই থমকে গেলাম আমি। আমার চোখ আটকালো খানিকটা দুরে ফুটপাতে বসে থাকা টিয়াপাখিওয়ালার উপর। অনেক গুলো খাচা একসাথে নিয়ে বসে আছে লোকটা। উনার কাছে অনেক ধরণের পাখি দেখা যাচ্ছে। লাভ বার্ডসও আছে তবে টিয়াপাখির সংখ্যা বেশি। আমার এবার টায়রার কথা মনে পড়ছে। কেমন আছে টায়রা?? মা ওর যত্ন করছে তো ঠিকমতো?? তিনবেলা শশা খেতে দিচ্ছে তো! ঈশান ভাইয়া একটু নিচু হয়ে আমার মুখের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন—

কি ভাবছো তারা! মনখারাপ?

আমি ঘোর কাটিয়ে জবাব দিলাম– না তো কিছু না! ( মুখে জোরপূর্বক হাসি এনে) চলুন যাই।

উনিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। দুজনেই ঢুকে পড়লাম আইসক্রিম পার্লারে।

.

.
শীতকালে কোন ভুতে পেয়েছিল যে আইসক্রিম পার্লারে গিয়েছিলাম। ঠান্ডায় এখন গলা ধরে আসছে আমার। গরম চা কফি কিছু একটা খেয়ে গলাটা ঠিক করে নিতে হবে। বাসায় ফিরেছি প্রায় দশ মিনিট মতো । কিন্তু রুমে ঢুকতে ঢুকতেই অবস্থা কাহিল। বাসাটা খুব অতিরিক্ত বড়। আর অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। সেটা বাসা হোক কিংবা আইসক্রিম পার্লারের আইসক্রিমই হোক ! হাতের ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে কুর্তিটা উঠাতে যাবো অমনি ঈশান ভাইয়া দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। দরজা খোলার আওয়াজ আমার কানে না এলেও আয়নাতে উনার অবয়ব দেখে অনেকটা ভয়েই ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে বসলাম আমি। চটজলদি জামা ঠিক করে পেছন ফরে তাকালাম। ভ্রু কুচকে কোমরে হাত রেখেই বলে উঠলাম —

কি সমস্যা আপনার?? ম্যানারস জানেন না?? একটু নক করে ঢুকলে কি সমস্যা?

আমার আচরণে উনি হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজার বাহিরে গিয়ে দাড়ালেন। দু একটা টোকা মেরে বললেন–

ম্যায় আই কাম ইন?

উনার কান্ড দেখে আমি হাসবো না কাদবো ঠিক ডিসাইড করতে পারছি না। তাই বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম–

হুহ!

উনি হালকা হেসে আবার ভেতরে ঢুকলেন। হুট করেই আমার কোমর জড়িয়ে ধরলেন। কপালে কিস দিয়ে চুলে মুখ ডুবালেন। আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। উনি কিছুক্ষণ পর জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললেন—

এবার ভাল্লাগছে।

আমি মুখে পেচকি কেটে বললাম– মানে?

কিছুনা। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

কি সারপ্রাইজ?

আগে চলো! তারপর বলছি।

কথাটা শেষ করেই আমাকে কোলে নিয়ে হাটতে শুরু করলেন। আমার কেনো জানি ভয় লাগছে খুব। এখন আবার থাঞ্চুর ডেডবডি দেখতে হবে না তো আমায় ?? ভয় আর আতঙ্ক একসাথে মনের মধ্যে চেপে রেখে অপেক্ষা করতে থাকলাম। সারপ্রাইজের অপেক্ষা!

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ৩২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশানদের বাড়ির সদর দরজার ভেতরে বিরাট এক ফুলের বাগান। এই বাগানে এতো এতো ফুলের গাছ আর এতো প্রজাতির ফুল যে নাম মনে রাখাও মুশকিল। এমন অনেক অনেক ফুল আছে যেগুলোর নাম আমি জীবনে কোনোদিন শুনিও নেই। এতো শত শত বাহারি সৌন্দর্য্যের ফুলের মধ্যে আমার পছন্দের ফুল গুলোই বেশি চোখে পড়ছে। টকটকে লাল গোলাপ… কাঠ গোলাপ,, ভালো বাসার অর্কিডস,,, টিউলিপ,, গাদা,, পদ্ম, সুর্যমুখী,,জুই,, জবা,, ল্যাভেন্ডার,,লিলিফুল,,,ডালিয়া,, এসব ছিল আমার পরিচিত ফুল আর যেগুলো অপরিচিত সেগুলোর সাথেও ঈশান আমায় পরিচয় করিয়ে দিলেন। এর মধ্যে কিছু কিছু নাম খুব অদ্ভুত লাগল। যেমন স্বর্গীয় পাখি। এইটা পাখির নাম না ফুলের নাম সেটা নিয়েই কিছুক্ষণ কনফিউশনে ভুগলাম আমি। এছাড়াও আছে প্যারোট বীক,, ব্লিডিং হার্ট,, ডেফোডিল,, মর্নিং গ্লোরি,, লরেল,, প্লুমেরিয়া,, ইত্যাদি ইত্যাদি প্রায় ৫০ প্রজাতির ফুল গাছ মনে হয় বিশাল এই বাগানেই উপস্থিত। এইটাকে বিরাট একটা নার্সারীও বলা যেতে পারে। বাগানের ঠিক মাঝখানে তো গোল পুকুর বানিয়ে শাপলাও চাষ করা হয়েছে। আরো অনেক ভাসমান ফুলেরও উপস্থিতি দেখলাম। এই বাগানের নির্মাতা হচ্ছেন আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ী মা। উনার প্রধান শখই হলো বাগান করা। সংসারে কতটা মনোযোগ দিয়েছেন জানিনা…..তবে বাগানটা দেখে আস্তো একটা সংসার মনে হচ্ছে আমার। সবকিছু কতটা যত্নের সাথে গড়ে তোলা হয়েছে। সত্যিই অসাধারণ। আমি আপাতত এই বিষয় নিয়ে আমার শাশুড়ী মায়ের প্রতি খুব ইম্প্রেসড। উনি দুইটা জিনিস খুব দারুণ তৈরি করেছেন। একটা তো হলো এই অপুর্ব সুন্দর বাগান। আরেকটা হল আমার ঈশান। যিনি নিজেই আমার কাছে আস্তো এক সৌন্দর্য্যের ফুলঝুরি। ঈশান এবার আমার বাগান বিলাসে বাগড়া দিয়ে টেনে নিয়ে গেলেন বাগানের ঠিক পেছনে এক চিলেকোঠার ঘরে। এই জায়গাও অসম্ভব সুন্দর। অবশ্য এই বাড়িতে আসার পর থেকে ডাইনি আর রাক্ষসী ছাড়া কোনো অসুন্দর জিনিসই আমার চোখে পড়েনি। সবকিছুই অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। যত দেখি ততই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আমি মুগ্ধ হই। ঈশান চিলেকোঠার দরজাটা খুলতেই চমকে উঠলাম আমি। সাথে সাথে আমার চোখ দুটো গোল আলুর শেপ ধারণ করলো। মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে পুরো ঘরটা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এতোক্ষণ তো দেখেছি ফুলের মেলা। আর এখন দেখছি পাখির মেলা। রঙ বেরঙের অজস্র পাখি নিশ্চিন্তে উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন পাখিদের চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়েছি আমি। না চিড়িয়াখানা বললে ভুল হবে। এটা যে পাখিদের স্বর্গ! মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুসময় তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ টায়রার ডাকে আমি হোশ ফিরে পেলাম। টায়রা আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমার কাধে এসে বসল। টায়রাকে দেখে আমি সম্পুর্ণ নির্বাক হয়ে গেলাম। খুশিতে চোখ দুটো আমার চিক চিক করছে। এই বুঝি গড়িয়ে পরল জল! আমার অবাকের মাত্রা শেষ হওয়ার পর টায়রাকে এবার হাতের মুঠোয় নিলাম আমি। একসাথে অনেকগুলো চুমু একে দিলাম সবুজ অঙ্গের সর্বস্থানে। ঈশান মুখে হাত রেখে আমার কান্ড কারখানা দেখছেন। টায়রাকে পেলে আমি একদম পাগলামি শুরু করে দেই। আর সেই পাগলামি গুলো উনি উপভোগ করে খুব উৎসাহের সাথে। এইটাও হয়তো উনার কাছে এক অন্যরকম প্রশান্তির নাম। আমি ঈশান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলাম। উনি আমার গাল দুটো টিপে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললেন—

তুমি ভাবলে কি করে তারা যে তোমার থেকে আমি টায়রাকে আলাদা করবো? তোমাদের বন্ডিংটা আমি খুব রেসপেক্ট করি। আর টায়রা তো এখন আমারও ভালোবাসা। ওর মিষ্টি মধুর কণ্ঠ না শুনলে আমারো তোমার মতোই দম আটকে আসে। ( আমি অবাক চোখে তাকাতেই) ট্রাস্ট মি! সত্যি বলছি।

আমি হালকা হাসলাম। আরেকবার চিলেকোঠার ঘরটার দিকে নজর দিলাম। চিলেকোঠার ঘরের উপরে চাল নেই। খোলা আকাশে পাখিগুলো সম্পুর্ন উন্মুক্ত। আমি কপালে বিস্ময়ের রেখা টেনে ঈশানের দিকে প্রশ্ন ছূড়লাম–

আচ্ছা? এই এতো এতো পাখি এইখানে থাকে কিভাবে?? ওরা উড়ে চলে যায়না?

ঈশান ভাইয়া পকেটে হাত গুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–

নাহ।

আমার কুচকানো ভ্রু দুটো আরো একটু কুচকে গেল উনার কথায়। আবার প্রশ্ন করলাম–

কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব??

উনি মৃদু হেসে বললেন— আসলে যায়। কিন্তু আবার ফিরেও আসে। কারণ ওদের প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থার যোগান দেওয়া হয় এখানে । রোজ সবকিছু খুব সুক্ষ্মভাবে নজর রাখা হয়। বিশেষ করে পাকিরা যেন ভয় না পায় এই বিষয়টি। পাখিরা এখানে নিজেদের নিরাপদ মনে করে। তাইতো ফিরে আসে।

সবাই ফিরে আসে??

সবারই ফিরে আসা উচিৎ। তবে যারা আসেনা….. তারা হয়তো রাস্তা ভুলে যায়…. আর নাহলে মারা যায়। এই দুটো অস্বাভাবিক কারণ ছাড়া মোটামোটি সবাই দিনশেষে এখানে এসেই ভীড় জমায়। রাতে দেখা যায় পাখিদের মজলিস…… সুন্দর না?

আমি বিমোহিত চোখে তাকিয়ে বললাম– হুম! খুব সুন্দর। কিন্তু এই পাখির বাগান কে তৈরি করেছে?? আমার শাশুড়ী মা??

ঈশান ভাইয়া ঠোট চেপে হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন– উহুম! শাশুড়ী মায়ের ছেলে।

আমি চোখ বড় করে বললাম— তার মানে আপনিও আমার মতো পাখিপ্রেমী?

উনি উনি হো হো করে হেসে সম্মতি জানিয়ে বললেন–

ছোটবেলা থেকেই। পাখি অনেক ভালোবাসি।

আমিও উনাকে একগাল হাসি ফিরিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। সত্যিই পাখি পালার কি ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া! উনি আসলে প্রকৃত পক্ষেই প্রকৃতিপ্রেমী। চোখজোড়া আরেকবার সিক্ত হয়ে আসলো আমার। এতোটা আনন্দ কেনো হচ্ছে কে জানে?
🍂
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here