এক আকাশ ভালোবাসি পর্ব ৪৮+৪৯

#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

বাড়ির সবাই এতক্ষনে গভীর ঘুমে ডুব দিলো। মৃন্ময় ও মারুকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তবে মুহিত রূপকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। শুধু জ্বালাচ্ছে। গত তিনদিন ধরে রূপ মুহিতের রোমান্টিক অত্যাচারের জ্বালায় ঘুমাতে পারে না। চোখ টেনে সে মেলতে ও পারে না। এরপরে ও মুহিত রূপকে ছাড়ছে না। হয়তো প্রতিদিন এভাবেই চলতে থাকবে। যতো দিন না মুহিত বাচ্চার মুখ দেখবে।

মুহিতের ভালোবাসা ভরা খুনসুটিতে রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে এলো। চারদিকে ফজরের আযান হচ্ছে। মুহিত রূপকে ছেড়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামসে ঘুম দিলো। রূপ কোনো রকমে শাড়িটা গাঁয়ে পেঁচিয়ে আবারো মুহিতের পাশে শুয়ে পড়ল। লম্বা এক্টা ঘুমের আশায় রূপ নিশ্চিন্তে চোখ জোড়া বুজে ফেলল। মুহিত অলরেডি নাক টেনে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। রূপ ও ঘুমানোর প্রবল চেষ্টা করছে।

ঘড়িতে সকাল দশটা বাজছে। মায়া আহমেদ আজ নিজ হাতে সকালের ব্রেকফাস্ট বানিয়েছে। ব্রেক ফাস্ট টেবিলে সবাই খাবারের জন্য ওয়েট করছে। তবে সবার মধ্যে রূপ আর মুহিতকে দেখা যাচ্ছে না। মায়া আহমেদ সবার প্লেইটে প্লেইটে খাবার সার্ভ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ছুটল রূপ আর মুহিতকে খুঁজতে। রুমের দরজা অনেকক্ষন ধরে ধাকাচ্ছে মায়া আহমেদ। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ আসছে না। মায়া আহমেদ এবার জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,

—-“মুহিত, রূপ কোথায় তোমরা? তাড়াতাড়ি নিচে এসো।”

প্রায় অনেকক্ষন চেঁচানোর পর মুহিত চোখ কচলাতে কচলাতে আরামের ঘুম থেকে উঠে উন্মুক্ত শরীরে রুমের দরজা খুলে দিলো। মুহিতকে ঢুলুঢুলু অবস্থায় দেখে মায়া আহমেদ হালকা হেসে বলল,,,,,,,

—–“কি এতো বেলা অব্দি ঘুমিয়ে আছো যে? রাতে কি জেগে ছিলে”

মুহিত আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ঘড়িতে অলরেডি দশটা বেজে গেছে। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে মুহিত আমতা আমতা করে বলল,,,,,,,

—–“হুম। আসলে কাল রাতে রূপের জ্বর উঠেছিলো তো, তাই ঘুম থেকে উঠতে এক্টু দেরি হয়ে গেলো!”

মায়া আহমেদ বেশ বুঝতে পেরেছে মুহিত গোপন কথা আড়াল করার চেষ্টা করছে। মায়া আহমেদ বাঁকা হেসে মুহিতের বুকের দিকে বলল,,,,,,,

—–“তা তোমার গাঁয়ে আঁচড়ের দাগ আসল কোত্থেকে? রূপ কি জ্বরের ঘোরে তোমাকে মেরেছে?”

মুহিত পর পর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,,,,,,,

—–“জ্বর মানে হালকা জ্বর হয়েছিলো। তাই ওর সাথে বসে সারা রাত পায়চারী করেছি। এছাড়া ও রূপের হাতের নখ গুলো খুব বড় তো, তাই ওর পাশে ঘুমুলেই কি করে জানি গাঁয়ে আঁচড় লেগে যায়। বুঝতেই পারি না।”

—–“আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। সাইড দাও রূপকে দেখে আসি। জ্বরটা নামল কিনা।”

মুহিত মাথা চুলকাতে চুলকাতে মায়া আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,

—–“আরে না না আম্মু। রূপের জ্বর এখন নেমে গেছে। এখন এক্টু ঘুমুচ্ছে। সারা রাত ঘুমোয় নি তো তাই। তুমি যাও না। আমি কিছুক্ষন পরেই রূপকে নিয়ে নিচে আসছি।”

মায়া আহমেদ কিছুটা সিরিয়াস হয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“আধ ঘন্টার মধ্যেই নিচে নেমে এসো। জরুরী কথা আছে। এক্টু পর মারজানা চৌধুরী আমাদের বাড়িতে আসবে। উনার সাথে কিছু ইম্পরটেন্ট কথা আছে। আমি চাই তোমরা সবাই উপস্থিত থাকো।”

মুহিত কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। মায়া আহমেদ রুম থেকে বের হয়ে নিচে চলে গেলো। রুমের দরজাটা কোনো রকমে আটকে মুহিত দৌঁড়ে এসে বেডের উপর বসে পড়ল। রূপ এখনো গভীর ঘুমে মত্ত। মুহিত পর পর কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে ও রূপকে ঘুম থেকে জাগাতে পারছে না। এক পর্যায়ে মুহিত দাঁত কিড়মিড় করে রূপের ঠোঁটে কামড় বসিয়ে দিলো। রূপ এবার ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে ঠোঁটে হাত দিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো। মুহিত বেশ ভাবলেস হীন ভাবে রূপের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—–“এই কান্না থামাও। তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে নিচে চলো। কিছুক্ষন পর নিচে জরুরী কথা হবে। আম্মু বলেছে তাড়াতাড়ি নিচে যেতে।”

রূপ কাঁদছে আর মুহিতের দিকে তাকিয়ে বলছে,,,,,,,

—–“কান্না থামাবো না আমি। সারা দিন কান্না করব। তুমি খুব খারাপ এক্টা লোক বুঝেছ? তোমার সাথে আমি আর এক মুহূর্ত ও থাকব না।”

মুহিত ওর বুকের আঁচড়ের দাগ গুলো দেখিয়ে ফেইসে ন্যাকা কান্নার এক্সপ্রেশান ফুটিয়ে বলল,,,,,

—–“চাইলে আমি ও তো কাঁদতে পারি। ব্যাথা তো তুমি ও আমাকে দিয়েছ। কই আমি তো তোমাকে একবার ও খারাপ বলি নি। এমনকি তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ও বলি নি।”

—–“এটাই আপনার প্রাপ্য। এই দাগ গুলোর জন্য আপনিই দায়ী। জোর করলে তো এমনি হবে। নেক্সট টাইম এমন করলে আচড়ের দাগ আরো গাঢ় হবে। এই বলে দিলাম।”

কথা গুলো বলেই রূপ বিছানা ছেড়ে উঠে কাবার্ড থেকে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। মুহিত কিছুক্ষন হেসে কাবার্ড থেকে শার্ট প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। প্রায় অনেকক্ষন পরে রূপ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মুহিত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রূপ চুলটা ভালো করে ঝেঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে নিচে নেমে এলো। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই রূপ আর মুহিতের জন্য ওয়েট করছে। মায়া আহমেদ রূপকে দেখার সাথে সাথেই চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—–“কি রে রূপ? তোর জ্বর নেমেছে তো?”

রূপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাইনিং টেবিলের উপস্থিত সবাই মিটিমিটি হাসছে। মারু অট্ট হেসে বলে উঠল,,,,,,,

—-“মুহিত বলল মাঝ রাতে নাকি তোর খুব জ্বর উঠেছে। জ্বরের ঘোরে নাকি তুই মুহিতকে খুব অত্যাচার করেছিস। এর জন্যই তোরা এতো বেলা অব্দি ঘুমিয়েছিলি।”

রূপ বেশ বুঝতে পেরেছে মুহিত রূপকে ফাঁসিয়েছে। রাগটাকে মনের মাঝেই চেঁপে রেখে রূপ জোর পূর্বক হাসি টেনে আমতা আমতা করে বলল,,,,,,

—–“হ্যাঁ। ঐ আর কি। হালকা এক্টু জ্বর হয়েছিলো। এখন ঠিক আছি।”

রূপ এক্টা চেয়ার টেনে টেবিলে বসে হুদাই হেসে বলল,,,,,,,

—–“ক্ষিদে পেয়েছে। খেয়ে নেই।”

এর মাঝেই মুহিত ডাইনিং টেবিলে চলে এলো। রূপ দাঁত কিড়মিড় করে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিত আগা মাথা কিছু না বুঝে টেবিলে বসে কফিতে চুমুক দিলো। একে একে সবাই খাওয়া শুরু করল। মায়া আহমেদ চা খাচ্ছে আর উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,,,

—–“তোমাদের এক্টা নিউজ দেওয়ার ছিলো।”

সানোয়ার আহমেদ পাউরুটিতে মাখন মাখছে আর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,

—–“আমরা সাকিবের বিয়ের ব্যাপারে ভাবছি। পালাক্রমে সানায়ার ও বিয়ে হবে। তবে সাকিবের টা আগে হবে।”

রেজাউল আহমেদ মৃদ্যু হেসে বলে উঠল,,,,,,

—–“আমাদের সাকিবের কিন্তু পছন্দ আছে।”

সাকিব মাথাটা নিচু করে মৃদ্যু হাসছে। রূপ এক গাল হেসে বলল,,,,,,,

—–“আমি কিন্তু মেয়েটাকে বেশ ভালো করে চিনি।”

মুহিত এক ভ্রু উঁচু করে রূপের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

——“আদ্রিতা নয় তো?”

মারু হি হি করে হেসে বলল,,,,,,,,

——“ইয়েস আদ্রিতা।”

সবাই সাকিবের দিকে তাকিয়ে হাসছে আর ব্রেকফাস্ট করছে। দোলা আর সানায়া কিছুক্ষন পর পর সাকিবকে খোঁচাচ্ছে। সাকিব দাঁত কিড়মিড় করে সানায়া আর দোলার দিকে তাকাচ্ছে। সাথে সাথেই দোলা আর সানায়া হি হি করে হেসে দিচ্ছে। সোহেলী আহমেদ মুচকি হেসে দোলা আর সানায়াকে ধমকের স্বরে বলল,,,,

——“এই তোরা আমার ছেলেটার সাথে এমন করছিস কেনো? একদম লাগতে আসবি না আমার ছেলের সাথে।”

সাকিব মুখ ফুলিয়ে সোহেলী আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

——“আম্মু প্লিজ। তুমি অন্তত এদের দলে যোগ দিও না। আমি বেশ বুঝতে পারছি তুমি ও ওদের দলে। তোমার মুচকি হাসিই সব বলে দিচ্ছে।”

সাকিবের কথা শুনে উপস্থিত সবাই আরো জোরে জোরে হেসে দিলো। এর মাঝেই মারজানা চৌধুরী, আমজাদ চৌধুরী আর আদ্রিতা এসে হাজির হয়ে গেলো। আদ্রিতাকে দেখে সাকিব ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আদ্রিতা লজ্জায় মাথাটা নিচু করে রেখেছে। রূপ আর মারু গিয়ে দৌঁড়ে আদ্রিতাকে ঝাপটে ধরল। নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলে ওরা আদ্রিতাকে ছাড়ল। রূপকে কাছে পেয়ে মারজানা চৌধুরী রূপের সাথে আড্ডা জুড়ে দিলো। পরিবারের সবার সাথে এক এক করে কথা বলে মারজানা চৌধুরী এবার মায়া আহমেদের মুখোমুখি হলো।

মায়া আহমেদ কিছুটা সংকোচ বোধ করে সাকিব আর আদ্রিতার বিয়ের প্রস্তাবটা মারজানা চৌধুরীর কাছে রাখল। আমজাদ চৌধুরী কিছুক্ষন ভেবে চিন্তে মারজানা চৌধুরীর সম্মতিতে মায়া আহমেদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো। বাড়ির সবাই খুশিতে ফেটে পড়ছে। বিশেষ করে রূপ আর মারু। আগামী সপ্তাহে ওদের বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়েছে। পুরো বাড়িতে হাসি খুশি উপচে পড়ছে।

রূপ সবাইকে কনভেন্স করে আদ্রিতা আর সাকিবকে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দিলো। রূপের প্রতি সাকিব বিরাট খুশি। আদ্রিতার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অন্তত কিছুটা সময় সাকিবের দরকার ছিলো। সেই সময়টা রূপ সাকিবকে দিলো। আদ্রিতাকে স্যরি বলার সাথে সাথেই আদ্রিতা সাকিবকে ক্ষমা করে দিলো। দুজন দুজনকে বাহু ডোরে আবদ্ধ করে নিলো। নিজেদের মধ্যকার সব ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে ওরা নতুন এক্টা অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে।

ড্রইং রুমে সবাই আড্ডায় ব্যস্ত। রূপ আর দোলা কিছুক্ষন পর পর সবাইকে স্ন্যাকস সার্ভ করছে। এর মাঝেই আদনান আর মিসেস আয়রা এসে হাজির হয়ে গেলো। দূর থেকে সানায়াকে দেখেই আদনান থেমে গেলো। সে যেনো চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেছে। এক দৃষ্টিতে আদনান সানায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সানায়া এখনো আদনানকে খেয়াল করে নি। সবার সাথে হাসি হুল্লোড়ে সে ব্যস্ত। রূপ ঠিক আদনানের দৃষ্টিকে খেয়াল করছে। মিসেস আয়রাকে দেখে মায়া আহমেদ হাসি হাসি মুখে উনাকে সবার মাঝখানে বসাল। আদ্রিতার পরিবারের সাথে উনাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আদনান এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এক প্রকার মানব মূর্তি হয়ে।

রূপ সবার মাঝ খান থেকে সরে গলাটা ঝাঁকিয়ে আদনানের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৃদ্যু হেসে বলল,,,,,

—–“আমার ননদের দিকে এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেনো?”

আদনান আনমনেই বলে উঠল,,,,,,,

—–“অসম্ভব সুন্দুরী তোমার ননদ। হয়তো প্রেমে পড়ে গেছি।”

রূপ বড় বড় চোখ করে আদনানের দিকে তাকালো। আদনানকে হালকা ঝাঁকিয়ে রূপ বলে উঠল,,,,,,

—–“আর ইউ সিরিয়াস আদনান?”

আদনানের এতক্ষনে সম্মতি ফিরল। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আদনান রূপের দিকে তাকিয়ে কাতর কন্ঠে বলল,,,,,,,

——“প্লিজ রূপ। তোমার ননদকে কিছু বলো না। আসলে তোমার ননদকে আমার খুব ভালো লাগে। অবশ্য ভালো লাগে বললে ভুল হবে, কারণ আমি ওকে ভালোবাসি।”

—–“সত্যি ভালোবাসেন তো?”

—–“তিন সত্যি!”

—–“তাহলে বিয়ের প্রস্তাব দিন!”

—–“তোমাদের ফ্যামিলি যদি না মানে?”

—–“মানবে না কেনো? আপনি কোন দিক থেকে খারাপ?”

—–“আচ্ছা ফ্যামিলি না হয় মানল। তবে সানায়া কি মানবে?”

—–“মানিয়ে নিতে হবে।”

—–“পারব তো?”

—–“অবশ্যই পারবেন। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। আজ রাতেই আমি সবার সাথে আপনার ব্যাপারে কথা বলব।”

আদনান এক গাল হেসে বলল,,,,,

—–“থ্যাংক স রূপ। সত্যিই আশ্বস্ত হলাম।”

এর মাঝেই রূপের মাথাটা কেমন ঘুরে এলো। দূর থেকে মুহিত ব্যাপারটা বুঝে দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে রূপকে দুই হাতে ধরে ফেলল। রূপ নাক, মুখ কুঁচকে মাথায় হাত দিয়ে মুহিতকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“মুহিত আমার মাথাটা খুব ঘুড়ছে। আমাকে রুমে নিয়ে চলো।”

মুহিত তাড়াহুড়ো করে রূপকে কোলে তুলে নিজেদের রুমে চলে গেলো। মায়া আহমেদ ফিসফিসিয়ে মারুর কানে কানে বলল,,,,,,

—–“মারু যাও তো রূপের কাছে। তোমার কাছে এক্সট্রা কোনো প্রেগনেন্সি কিট থাকলে রূপকে দিয়ে এসো। কাল সকালে টেস্ট করতে হবে। আই থিংক খুশির খবর আসছে।”

মারু মিটিমিটি হেসে মাথা নাঁড়ালো। উপস্থিত সবার মুখে ও হাসি। কারন, সবাই রূপের মাথা ঘুড়ানোর ব্যাপারটা এক্টু হলে ও আঁচ করতে পেরেছে। দুপুরের দিকে সবাই খেয়ে দেয়ে যে যার বাড়িতে চলে গেলো। আদনান নানা ভাবে চেষ্টা করেছে সানায়ার সাথে কথা বলতে। বাট সানায়া প্রতি বারই ভাব দেখিয়ে আদনানকে এভোয়েড করে গেছে। শেষ পর্যন্ত আদনান নিরুপায় হয়ে ব্যর্থ মন নিয়ে বাড়ি ফিরল।

মাথা ঘুড়ানোর পর থেকেই রূপের পেটে হালকা ব্যাথা শুরু হলো। খাওয়া, দাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। খাবারের ঘ্রাণ শুকলেই গড়গড়িয়ে বমি করে দেয়। রূপের অবস্থা দেখে মুহিত ও রুম থেকেই বের হচ্ছে না। সারাক্ষন রূপের পাশে বসে আছে। রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রূপকে কোলে তুলে পুরো রুমে পায়চারী করছে। রূপের ছটফটানির জন্য ঐ দিন সারারাত মুহিতকে জেগে থাকতে হয়েছে।

খাওয়া দাওয়া থেকে রূপের শরীরটা ভীষণ দুর্বল হয়ে উঠছে। তাই কিছুক্ষন বাদে বাদে বমি করছে। মুহিত বার বার বলেছিলো রূপকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যেতে। মায়া আহমেদ বার বার মুহিতকে থামিয়ে বলেছে এক্টা দিন ধৈর্য্য ধরতে। মুহিত ও মায়া আহমেদের কথায় চেঁপে গেছে। রাতে এসে মারু চুপিচুপি রূপের হাতে প্রেগনেন্সি কিটটা ধরিয়ে দিয়ে গেছে। আর বলে গেছে সকালে উঠেই যেনো টেস্ট টা করে নেয়।

পরের দিন। সকাল আটটা। রূপ কিট হাতে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মুখে হাত দিয়ে ছলছল চোখে কিটটার দিকে তাকিয়ে আছে। সারা রাত না ঘুমানোর দরুন মুহিত সবে মাএ চোখটা লাগিয়েছে। রূপ দৌঁড়ে এসে মুহিতের গাঁয়ের উপর উঠে মুহিতকে ঝাঁকিয়ে বলল,,,,,,,

——“মুহিততততততত……. তোমার ফুটফুটে মেয়েটা আমার গর্ভেই আছে।”

কথাটা কানে ঢোকার সাথে সাথেই মুহিত চোখ খুলে রূপকে নিয়ে উল্টো দিকে ফিরে রূপের চোখের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,,,,

——“সসসসত্যি বলছ রূপ?”

রূপ চোখে জল নিয়ে বলল,,,,,,

—–“সত্যি বলছি মুহিত।”

খুশিতে মুহিতের মুখটা চকচক করছে। চোখের কোনে ও জল ধরা দিয়েছে। রূপকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে মুহিত মিনমিন করে বলল,,,,,,

—–“তার মানে প্রথম রাতেই তুমি কন্সিভ করেছ। যেদিন আমাকে ড্রাগস দেওয়া হয়েছিলো।”

—–“হুম। আর এজন্যই আমার এই মাসের পিরিয়ড মিস হয়েছে। তিনদিন ওভার হয়ে গেছে।”

—–“আ’ম সো সো সো হ্যাপি রূপ।”

রূপ মুহিতের থেকে ছুটার জন্য মোচড়া মুড়ড়ি করছে আর বলছে,,,,,,

—–“ছাড়ো ছাড়ো। বাড়ির বাকিদের খবরটা দিয়ে আসি।”

মুহিত রূপকে থামিয়ে বলল,,,,,,,

—–“এই সময় এতো ছুটাছুটি করা যাবে না রূপ। এক্টু স্থির হও। সারা রাত ঘুমোও নি। এখন এক্টু ঘুমাও। পরে আমরা সবাইকে খবরটা জানিয়ে দিবো।”

মুহিতের কথা শুনে সত্যি সত্যিই যেনো রূপের চোখে ঘুমেরা ধরা দিলো। চোখ বুজে রূপ ঘুমিয়ে পড়ল। মুহিত ও রূপের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

দুপুর দুইটায় রূপের ঘুম ভাঙ্গল। মুহিতকে গাঁয়ের উপর থেকে সরিয়ে রূপ বেড ছেড়ে উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সোজা নিচে গেলো। নিচে নেমেই রূপ অবাক হয়ে গেলো। কারণ আদনান আর সানায়া পাশাপাশি বসে কথা বলছে। সানায়া মিটিমিটি হাসছে আর আদনানের দিকে তাকাচ্ছে। বাড়ির বাকিরা এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। রূপ দ্রুত পায়ে হেঁটে আদনানের পাশে বসে মিনমিন করে বলল,,,,,,,,

——“কি ব্যাপার বলুন তো? সানায়া এতো নরমাল কেনো আপনার সাথে?”

আদনান রূপের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,,,

—–“তোমার ননদকে আমার হাতে নিতে বেশি সময় লাগে নি। আলতা, লিপস্টিক, নেইল পলিশ, মেকাপ সব পার্সেল করে গিফট হিসেবে ওর জন্য নিয়ে এসেছিলাম। এমা সাথে সাথে কেমন নরমাল হয়ে গেলো। মেয়ে পটানো এতো সহজ নাকি? আগে জানলে তো তোমাকে ও এভাবে পটিয়ে নিতাম!”

কথা গুলো বলেই আদনার হু হা করে হেসে দিলো। সাথে রূপ ও অট্ট হাসি দিয়ে সানায়ার দিকে তাকালো। সানায়া বেকুব হয়ে রূপ আর আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে।
#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৪৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

কথা গুলো বলেই আদনান হু হা করে হেসে দিলো। সাথে রূপ ও অট্ট হাসি দিয়ে সানায়ার দিকে তাকালো। সানায়া বেকুব হয়ে রূপ আর আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে।

সানায়া কপাল কুঁচকে রূপ আর আদনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—–“আজব তোমরা এভাবে হাসছ কেনো? এখানে হাসির কি হলো?”

রূপ হাসি চেঁপে সানায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—–“শুনলাম তোমার নাকি আদনানকে খুব পছন্দ হয়েছে?”

সানায়া আমতা আমতা করে বলল,,,,,,

—–“পছন্দ হতেই পারে। এতে এতো হাসির কি আছে? তাছাড়া আমি উনাকে জাস্ট পছন্দ করি। ভালো তো আর বাসি না।”

মুহূর্তেই আদনানের হাসি মুখটা চুপসে গেলো। রূপ মুখট কালো করে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—–“শুধু কি পছন্দ হয়েছে? আর কিছুই না?”

সানায়া ভাবলেসহীন ভাবে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“হুম জাস্ট ভালো লেগেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু না।”

আচমকা আদনান বসা থেকে উঠে গলাটা ঝাঁকিয়ে ড্রইং রুমে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,

—–“হ্যালো হ্যালো এভরি ওয়ান। আমি আপনাদের সবার সাথে কিছু ইম্পরটেন্ট কথা বলতে চাই। প্লিজ সবাই আমার কথাটা মনযোগ দিয়ে শুনুন।”

মুহিত সিঁড়ি বেয়ে নামছে আর জোরে চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,,

—–“হুম আদনান বলো। আমি ও জয়েন করছি। আমরা সবাই তোমার ইম্পরটেন্ট কথা শুনতে চাই।”

উপস্থিত সবাই আদনানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আদনান মাথাটা নিচু করে হালকা হেসে বলল,,,,,,

—–“আসলে আমি তোমাদের সবার কাছে এক্টা প্রস্তাব রাখতে চাই।”

উপস্থিত সবাই মাথা নাঁড়িয়ে সম্মতি জানালো। রূপ মিটিমিটি হেসে মুহিতের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,,,

—–“আমি জানি আদনান কি বলতে চাইছে।”

মুহিত মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই আদনান সানায়ার দিকে তাকিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—–“আমি সানায়াকে বিয়ে করতে চাই।”

সানায়া চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড় বড় করে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহেলী আহমেদ আর মিসেস আয়রা দুজন দুজনের দিকে থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে। মায়া আহমেদ তব্দা লেগে বসে আছে। মাঝখান থেকে মারু এসে সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,,

—–“প্লিজ সবাই রাজি হয়ে যাও না। দুটো বিয়ে একসাথে হবে। কতো মজা হবে বলো।”

রূপ ও মারুর সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—–“হ্যাঁ হ্যাঁ প্লিজ রাজি হয়ে যাও না। আদনান কিন্তু ছেলে হিসেবে খুব ভালো। আমার আর মারুর খুব পছন্দ। আশা করি তোমাদের ও কম বেশি পছন্দ হয়ে গেছে।”

মিসেস আয়রা আদনানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সোহেলী আহমেদের হাত ধরে মলিন হেসে বলল,,,,,,,

—–“ভাবী। আমি আর কি বলব বলুন? ছেলে তো সবার সামনেই খোলসা করে সব বলে দিলো। এখন আপনারা কি বলেন? আশা করি আপনাদের উওরটা হ্যাঁ ই হবে।”

সোহেলী আহমেদ মৃদ্যু হেসে মায়া আহমেদের দিকে তাকালো। মায়া আহমেদ মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। রেজাউল আহমেদ, সানোয়ার আহমেদ ও সম্মতি জানালো। সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে সোহেলী আহমেদ মুচকি হেসে মিসেস আয়রার হাত ধরে বলল,,,,,,

—–“আমরা রাজি ভাবী।”

সাথে সাথেই পুরো বাড়িতে হাসির রোল পড়ে গেলো। সানায়া তেড়ে এসে আদনানকে টানতে টানতে কিচেন রুমের দিকে নিয়ে এলো। আদনান বেকুব হয়ে সানায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সানায়া কোঁমড়ে হাত দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“এটা কি হলো? বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে বিয়ের প্রস্তাব রেখে দিলেন?”

—–“হুম। কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই। সংসার করতে চাই। চার চারটে সন্তানের বাপ হতে চাই। বয়স তো আর কম হলো না তাই।”

—–“আপনি কি পাগল? বিয়ে হলো না এখনো পর্যন্ত অথচ সংসার আর বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে পড়েছেন!”

আদনান সানায়ার গাল দুটো টেনে বেশ আহ্লাদি স্বরে বলে উঠল,,,,,,

—–“এভাবে বলতে নেই সোনা। সামনের সপ্তাহেই আমাদের বিয়ে। দুটো বিয়ে একসাথে হবে। আ’ম সো এক্সাইটেড। বিয়ের এক বছর পরেই বাপ হয়ে যাবো। আহ্ কি শান্তি!”

সানায়া চোখ লাল করে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে আদনান সানায়ার দিকে এগিয়ে এসে সানায়ার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। সানায়া চোখ বড় বড় করে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে। আদনান এক চোখ মেরে সানায়ার কোমড় আঁকড়ে ধরল। সানায়া ও কিছুটা শান্ত হয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে আদনানের শার্ট আঁকড়ে ধরল।

,,
,,

ড্রইং রুম জুড়ে আড্ডা আর খুনসুটি চলছে। মুহিত রূপকে অনেকক্ষন ধরেই বলছে কিছু খেয়ে নিতে। তবে রূপ কোনো কথাই শুনছে না। সবার সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। এর মাঝেই আচমকা রূপের মাথা ঘুড়িয়ে এলো। মারু তাড়াহুড়ো করে রূপকে দু হাতে চেঁপে ধরল। মুহিত তেঁড়ে এসে বেশ চিন্তিত হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,

—–“বলেছিলাম না কিছু খেয়ে নিতে। কাল থেকে উপোস আছো। এই সময়ে এক্টু নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হয় তো নাকি?”

মুহিতের কথা শুনে সবাই রূপ আর মুহিতকে চেঁপে ধরল। মায়া আহমেদ রূপের পাশে বসে রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,,,,

—–“গুড নিউজটা আগে বললি না কেনো? অনেকক্ষন ধরেই তো এখানে ছিলি!”

রূপ কিছু বলার আগেই মুহিত বলে উঠল,,,,,,,,

—–“এতো সবের মধ্যে আসল কথাটা বলতেই ভুলে গেছি আম্মু।”

মুহিত কিছুটা লজ্জা পেয়ে মাথাটা নিঁচু করে বলল,,,,,,

—–“আমি বাবা হতে চলেছি আম্মু।”

সানোয়ার আহমেদ এক গাল হেসে মুহিতকে ঝাপটে ধরে বলল,,,,,,,

—–“কংগ্রাচুলেশনস বেটা। আমার দু দুটো ছেলের দু দুটো নাতি, নাতনী। তাও আবার একই বছরে। সত্যি খুশি আর ধরছে না।”

মুহিতকে ছেড়ে সানোয়ার আহমেদ দৌঁড়ে সদর দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছে আর পিছু ফিরে জোরে চেঁচিয়ে বলছে,,,,,,,,

—–“সবাই ওয়েট করো। আমি মিষ্টি নিয়ে আসছি।”

বাড়ির সবাই হাসি মুখে সানোয়ার আহমেদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। মায়া আহমেদ আর মারু রূপকে ঝাপটে ধরে হাসছে আর রূপের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। মারু ক্লোজ আপ স্মাইল দিয়ে রূপের কানে ফিসফিসিয়ে বলছে,,,,,,,,

—–“আজ থেকে আমার দল ভারী হলো বল? এবার থেকে তুই আর আমি মিলে আচার খাবো। ছাদ থেকে আচার চুরি করে খাওয়ার মজাই আলাদা।”

রূপ চোখ রাঙ্গিয়ে মারুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,

—–“তার মানে তুই এতোদিন ধরে ছাদ থেকে আচার চুরি করে খেয়েছিস?”

মারু জিভ কেটে রূপের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপ কিছুক্ষন কঠোর দৃষ্টিতে মারুর দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকাই হু হা করে হেসে দিলো। মারু ও রূপের সাথে তাল মিলিয়ে হাসি জুড়ে দিলো। মুহিত কিচেন রুম থেকে এক প্লেইট খাবার এনে রূপকে টেনে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দিলো। লোকমা ধরে মুহিত রূপকে খাইয়ে দিচ্ছে।

প্রায় ঘন্টা খানিক পর সানোয়ার আহমেদ হাতে করে দুই কাটুন মিষ্টি নিয়ে এলো। মায়া, আহমেদ আর সোহেলী আহমেদ মিলে সবাইকে মিষ্টি মুখ করালো। আদনান আর সানায়া ও এসে সবার সাথে যোগ দিলো। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে। মিষ্টি মুখ করার পর পরই সবাই এবার বিয়ের ডেইট নিয়ে কিছুক্ষন আলোচনা করে সাকিবের বিয়ের দিনই সানায়ার বিয়ের ডেইট ফিক্সড করে নিলো। মায়া আহমেদ ফোন করে মারুর পুরো পরিবারকে বিয়ের দাওয়াত করে দিলো। আর শর্ত রাখল যে, বিয়ের দুই দিন আগেই যেনো ওরা সবাই ঢাকা চলে আসে। মারুর পরিবার ও হাসি হাসি মুখে সব মেনে নিলো। মারু খুব খুশি মায়া আহমেদের এমন সিদ্ধান্তে।

মৃন্ময় মাএ অফিসের কিছু ইম্পরটেন্ট কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে। দু দুটো খুশির সংবাদ পেয়ে সে ভীষণ খুশি। মারুর খুশি দেখে মৃন্ময় হেসে হেসে মারুকে ঝাপটে ধরছে। এভাবেই সকাল থেকে দুপুর ঘনিয়ে এলো। বাড়ির কাজের লোকরা রান্না বান্না করে ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিলো। খাওয়া দাওয়া করে বিকেলের দিকে আদনার আর মিসেস আয়রা বাড়ি ফিরে গেলো। বাড়ির বাকিরা যে যার রুমে চলে গেলো।

রূপ রুমে ঢুকে বেডের উপর বসে বেশ সিরিয়াস হয়ে মুহিতকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“মুহিত….. আমি এক্টা জিনিস নিয়ে খুব ভাবছি। আমি স্থির ও করে নিয়েছি আমায় কি করতে হবে।”

মুহিত রূপের পাশে বসে রূপের হাত ধরে বলল,,,,,,

—–“তা কি স্থির করলে?”

রূপ এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,,,,

—–“আমি ভাবছি মামুর বিরুদ্ধে কেইসটা তুলে নিবো।”

—–“হোয়াট? কি যা তা বলছ এসব?”

—–“আমি সত্যিই বলছি মুহিত। মামু অনেক অনুতপ্ত উনার কাজে। আমার মনে হচ্ছে উনাকে এক্টা সুযোগ দেওয়া উচিত। উনার পাপের ফল উপর ওয়ালাই উনাকে দিবে। হয়তো এই দুনিয়ায় উনি বেঁচে কুল পেয়ে যাবে, তবে উপর ওয়ালার থেকে বেঁচে কুল পাবে না। উনি পাপের শাস্তি ঠিক পাবে।”

রূপ কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,

—–“উনি বাঁচবেই বা আর কতো দিন বলো? যে কয়েকটা বছর বেঁচে আছে ঐ বছর গুলো যেনো পরিবারের সাথে হাসি খুশিতে কাটিয়ে দিতে পারে আমি কেবল ঐটাই চাই। তাছাড়া উনাকে ছাড়া মামানী, আদনান কেউ ভালো নেই। সব দিক বিবেচনা করে আমার মনে হচ্ছে উনাকে ছাড়িয়ে আনা উচিত। তবে আমি উনাকে এই জীবনে ক্ষমা করতে পারব না। উপর ওয়ালা ই উনার বিচার করবে। উনার জন্য আমি আমার মা-বাবাকে হারিয়েছি। আমার পরিবারকে হারিয়েছি।”

কথা গুলো বলার সময় রূপের গলাটা ধরে আসছিলো। চোখ দিয়ে ও টলটলিয়ে পানি পড়ছে। মুহিত রূপের চোখের জল গুলো মুছে রূপকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে বলল,,,,,,,

—–“আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই রূপ। তুমি খুবই ভালো এক্টা ডিসিশান নিয়েছ। উনার পাপের শাস্তি উপর ওয়ালাই উনাকে দিবে। যতো দিন বেঁচে আছে এক্টু আনন্দ উল্লাস করে যাক। ফ্যামিলির সাথে সময় কাটিয়ে যাক।”

মুহিত কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,,

—–“হলুদের দিন রাতেই আমরা উনাকে ছাড়িয়ে আনব। আদনান আর মামানীকে বড় সড় এক্টা সারপ্রাইজ দিবো। খুব খুশি হবে সবাই।”

রূপ হালকা হেসে মুহিতের বুকে চুমো খেয়ে বলল,,,,,

—–“ভালোবাসি মুহিত।”

মুহিত রূপের মথায় চুমো খেয়ে বলল,,,,

—–“আমি ও ভালোবাসি রূপ। খুব খুব খুব ভালোবাসি।”

,,
,,,
,,,,

এভাবে কেটে গেলো এক সপ্তাহ। আজ সানায়া আর সাকিবের গাঁয়ে হলুদ। একসাথেই ওদের গাঁয়ে হলুদ পড়ানো হবে। তবে বিয়ের দিন সানায়ার বিয়েটা আগে হবে। এরপর সাকিবের। সানায়াকে বিদায় দিয়ে সাকিবের বৌ আনা হবে। মানে আদ্রিতাকে উঠিয়ে আনা হবে। দুটো বিয়ে একসাথে বলে বাড়িতে কাজের অভাব নেই। দুইদিন আগে থেকেই কাজ কর্ম শুরু হয়ে গেছে। পাড়ার মানুষরা খুব অবাক। কারণ, এই প্রথম ওদের পাড়ায় ভাই-বোনের বিয়ে একসাথে এবং একই দিনে। বাড়ির ভিতরে বিশাল এক প্যান্ডেল করা হয়েছে। আর গেইট টা তো রাজকীয় ভাবে সাজানো হয়েছে। একেবারে তাক লেগে যাওয়ার মতো।

মারুর পুরো পরিবার গতকাল ঢাকা এসেছে। মায়া আহমেদ উনাদের পেয়ে খুব খুশি। সানোয়ার আহমেদ তো অলরেডি আব্বাস আহমেদের সাথে সখ্যতা জুড়ে দিয়েছে। মাইমুনা আহমেদ এসে খুব সহজেই মায়া আহমেদ আর সোহেলী আহমেদের সাথে মিশে গেছে। মিনা আর মেঘা আরো ইজিলি দোলা আর সানায়ার সাথে মিশে গেছে। আর টায়রা বুড়ি তো আসার পর থেকেই পুরো বাড়ি মাথায় করে রেখেছে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ টায়রাকে মাথায় তুলে রেখেছে। মিনার স্বামী এখন পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে। নতুন কোম্পানী খুলে বসেছে। মেঘার হাজবেন্ড আগে থেকেই খুব ভালো। উনার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। কাজের চাঁপে মিনা আর মেঘার হাজবেন্ড ঢাকায় আসতে পারে নি। পরিবারকে কাছে পেয়ে মারু খুশিতে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। ওর যেনো খুশি আর ধরছে না।

রূপ আর মুহিত সকাল থেকেই থানায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। কেইস উঠানোর জন্য। গত একদিন আগে থেকেই মুহিত থানার গন্ডিতে ঘোরা ফেরা করছে। বড় বড় আইনজীবিদের থেকে বিভিন্ন রকমের মতামত নিচ্ছে। অনেক খাটা খাটনি শেষে কেইস উঠানো হলো। এর জন্য রূপকে অনেক কটু কথা ও শুনতে হয়েছে। যাক অবশেষে কেইস উঠিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই মিঃ হাসিবকে নিয়ে রূপ আর মুহিত বাড়ি ফিরল। মিঃ হাসিব এখনো অনুশোচনায় ভুগছে। রূপ বা মুহিত কারো দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। উনাকে নিয়ে রূপ আর মুহিত সোজা আদনানের বাড়ি চলে এলো। আদনানদের পুরো বাড়িটা বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে।

আদনান আর মিসেস আয়রা খুশিতে ছলছল দৃষ্টিতে মিঃ হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে। মিঃ হাসিব চোখের জল ছেড়ে মিসেস আয়রা আর আদনানকে ঝাপটে ধরল। বাড়ির সব মেহমানরা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদনান ইশারা দিয়ে রূপকে ধন্যবাদ জানালো। মিসেস আয়রা ও হেসে হেসে রূপের দিকে তাকালো।

রূপ আর এক মুহূর্ত ও ঐ খানে দাঁড়ালো না। দৌঁড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে বসে পড়ল। মুহিত ও রূপের পিছু পিছু দৌঁড়ে এসে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট করে দিলো। রূপ গাড়িতে বসে অঝড়ে কেঁদে যাচ্ছে। কিছুতেই যেনো ওর কান্না থামছে না। শুধু ওর মা-বাবার কথা মনে পড়ছে। মুহিত ও রূপকে বাঁধা দিচ্ছে না। কারণ, কাঁদলেই মনের কষ্ট টা হালকা হবে।

বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো। মুহিত প্যান্ডেলের ভিতর ঢুকেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাড়ির ড্রইং রুমে পা রাখার সাথে সাথেই মারু এসে রূপকে ঝাঁকিয়ে বলল,,,,,,,

—–“সানায়াকে সাজানো হচ্ছে। চল আমরা ও সেজে নেই।”

রূপ জোর পূর্বক হাসি টেনে বলল,,,,,,,

—–“আগে ফ্রেশ হয়ে নেই। এরপর সাজব।”

মায়া আহমেদ রূপের কাছে এগিয়ে এসে এক গাল হেসে বলল,,,,,,,,

—–“রূপ….. তুই যা করেছিস, নিঃসন্দেহে ভালো করেছিস। খুব পুন্য করেছিস। তোর মামুর পাপের ফল উপর ওয়ালাই উনাকে দিবে। তুই যা করেছিস তার জন্য তুই অনেক গুলো মানুষের মনের দো’আ পেয়েছিস। বাকিটা জীবন তুই খুব সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দিবি। মা তোকে অনেক অনেক দো’আ করে গেলাম। জানি না তোর এই পাপি মা টার দো’আ আদৌ কবুল হবে কিনা!”

মায়া আহমেদ এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রূপের গালে হাত রেখে ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়ে আবার বলল,,,,

—–“যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ আমি আমার তিন মেয়েকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিবো। খুব শখ হচ্ছে তোদের সাজিয়ে দিতে।”

রূপ মায়া আহমেদকে ঝাপটে ধরে চোখের জল ছেড়ে বলল,,,,,,,

—–“ভালোবাসি মা। খুব খুব খুব ভালোবাসি। আমি আমার এই মা টা কে কোথাও হারাতে দেবো না। সারাজীবন তোমাকে আঁচলে বেঁধে রাখব। কোথাও যেতে দেবো না।”

রূপের সাথে সাথে মারু আর দোলা ও এসে মায়া আহমেদকে ঝাপটে ধরল। মায়া আহমেদ চোখের জল ছেড়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,,,,,,,,

—–“যেদিন উপর ওয়ালা ডাক দিবে, ঐ দিন পৃথিবীর সব মায়া কাটিয়ে আমাকে যেতেই হবে। ঐ দিন পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাকে বেঁধে রাখতে পারবে না। উপর ওয়ালার ডাকে সাড়া দিতেই হবে। তোদের কাছে আমার এক্টাই রিকুয়েস্ট মা…… আমার মৃত্যুর পর প্রতিদিন নামাজ পড়ে আমার জন্য দো’আ করিস। কোরআন পাঠ করিস। আমার নাতি, নাতনীদের কাছে সবসময় আমার কথা বলবি। ওরা যেনো আমাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখে।”

কথা গুলো বলেই মায়া আহমেদ সবাইকে ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রূপ, মারু আর দোলা চোখে অসংখ্য জল নিয়ে মায়া আহমেদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। সানায়ার আহমেদ দৌঁড়ে রুমে ঢুকে মায়া আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মায়া আহমেদকে ঝাঁকিয়ে বলল,,,,,,,

——“কি হয়েছে তোমার? কয়েক দিন যাবত কিসব হেয়ালী কথা বার্তা বলছ?”

মায়া আহমেদ নিচের দিকে তাকিয়ে কেবল চোখের জল ছাড়ছে। মুখে টু শব্দ ও করছে না। সানোয়ার আহমেদ অশ্রুসিক্ত চোখে কিছুক্ষন মায়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে থেকে মায়া আহমেদকে ঝাপটে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। মায়া আহমেদ ও সানোয়ার আহমেদকে ঝাপটে ধরে নীরব কান্না জুড়ে দিলো।

,,
,,
,,

রূপ ফ্রেশ হয়ে বেডের উপর বসে আছে। কিছুতেই যেনো ওর মন ভালো হচ্ছে না। মুহিত কাজ ফেলে রূপের কাছে চলে এলো। রুমের দরজা লাগিয়ে মুহিত রূপের পাশে বসল। মুহিতকে দেখে রূপ মুহিতের বুকে মাথা রেখে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। মুহিত রূপের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,,,,,,,

—–“কি হয়েছে তোমার হুম? এভাবে আপসেট থাকার কোনো মানে হয়?”

আচমকাই রূপ মুহিতের বুক থেকে মাথা তুলে চোখ জোড়া বন্ধ করে মুহিতকে ইশারা করে বলল ঠোঁটে চুমো খেতে। মুহিত বাঁকা হেসে রূপের ঠোঁট জোড়া আ্ঁকড়ে ধরল। এর মাঝেই রুমের দরজা খুলে মারু, দোলা আর মায়া আহমেদ রুমে ঢুকে পড়ল। ওরা তিনজনই জিভ কেটে মুখটা ঘুরিয়ে উল্টো পাশে ফিরে গেলো। মুহিত চরম লজ্জা পেয়ে রূপকে ছেড়ে মাথাটা নিচু করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রূপ লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। পারছে না মাটি ফাঁক করে মাটির ভিতর ঢুকে যেতে।

মারু আর দোলা রূপের পাশে বসে রূপকে খোচাচ্ছে আর হাসছে। মায়া আহমেদ ওদের দুজনকে থামিয়ে কথা ঘুড়ানোর জন্য মিটিমিটি হেসে বলল,,,,,,,,

—–“তোমরা এই মাএ যা যা দেখেছ, সব ভুলে যাও। সবাই এক এক করে দাঁড়িয়ে পড়ো। আমি আমার সাজানো শুরু করি।”

মারু আর দোলা জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,

—-“আমরা দুজন আগে সাজব। এরপর রূপ সাজবে।”

রূপ মাথা নাঁড়িয়ে মায়া আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—–“আচ্ছা আগে ওদের ই সাজিয়ে দাও। আমি নিচ থেকে আসছি। মিনা আপু আর মেঘা আপুর সাথে কথা বলে।”

রূপ রুম থেকে বের হয়ে সোজা নিচে চলে গেলো। মায়া আহমেদ এক এক করে মারু আর দোলাকে সাজানো শুরু করল। রূপ নিচে নেমে প্যান্ডেলের ভিতর ঢুকেই হঠাৎ থেমে গেলো। মুহিত ভিডিও কলে কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। রূপ পা টিপেটিপে নিশব্দে মুহিতের পাশে দাঁড়ালো। ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই রূপ অবাক হয়ে গেলো। কারন মুহিত অনিকের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। অনিকের পাশে এক্টা সুন্দুরী মেয়েকে ও দেখা যাচ্ছে। অনিক আর মেয়েটা হেসে হেসে মুহিতের সাথে কথা বলছে।

রূপ মুখে হাত দিয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিত পাশে রূপের উপস্থিতি টের পেয়ে রূপকে এক হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ করে অনিক আর মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে হেসে হেসে বলল,,,,,,,,

—–“লুক ভাবী। সি ইজ রূপ। আমার প্রিয়তমা, আমার সহধর্মিণী, আমার অর্ধাঙ্গিনী। যাকে আমি এক আকাশ ভালোবাসি।”

#চলবে,,,,,,,,,,,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here