প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৩৫+৩৬

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_35
#Writer_TanhaTonu

আরশি লাজুক হেসে সিদ্রাতের রুমে চলে গেলো।দেখল লাইট অফ।শুধু ব্লু শেডের একটা লাইট জ্বালানো।আরশি বক্স দুটো বেডে রেখে লাইট অন করল।সিদ্রাতকে কোথাও না পেয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো…
____________________________

বারান্দায় যেতেই আরশি দেখল সিদ্রাত গ্রিলে হাত দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।আরশির লজ্জা লাগছে সিদ্রাতকে উইশ করতে।যতই সারাদিন ভালোবাসি ভালোবাসি করুক না কেন লজ্জা তো আর একবারে বিসর্জন দেয়নি তাইনা।আরশি একটা শুকনো ঢোক গিলে ঠোঁটটা জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে সিদ্রাতকে মৃদু স্বরে ডাকল…
—”স্যার…”
সিদ্রাত আরশির ডাকে পেছনে ঘুরে তাকালো
—”কিছু বলবে?”
আরশি মিষ্টি হেসে বলল…
—”হ্যাপি বার্থডে স্যার”

আরশির উইশে সিদ্রাতের মধ্যে তেমন ভাবাবেগ দেখা গেলো না।সে ভাবলেশহীন ভাবেই বলল…
—”ওহ..ধন্যবাদ”

সিদ্রাত আবারও ঘুরে বারান্দার গ্রিল ধরে দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।আরশি এতে কিছুটা বিব্রতবোধ করল।এরকম উত্তর তো আর মেয়েটা আশা করেনি।এমন উত্তরের বিনিময়ে আর কি বলা যায় তাই ভাবতে লাগল আরশি।কিছুক্ষণ নীরব থেকে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল…
—”স্যার আপনার কি মন খারাপ?”

সিদ্রাত কোনো উত্তর দিলো না।এবার আরশির খুবই অস্বস্তিবোধ হচ্ছে।এভাবে যদি সামনের মানুষটা চুপ থাকে তাহলে কি কোনো কথা বলা যায়?আর পরিস্থিতিটাই এমন যে চলেও যাওয়া যাবে না।আবারও কিছুক্ষণ নীরবতায় ছেঁয়ে গেলো পরিবেশটা।আরশি একটু এগিয়ে গিয়ে সিদ্রাতের পাশে দাঁড়ালো।জিজ্ঞাসা করল…
—”স্যার কিছুই বলছেন না যে?”
—”এমনি”

এবারের উত্তরটাও আরশির পছন্দ হলো না।ভাবল সময়টা সিদ্রাতের সাথে গল্প করে কাটাবে।কিন্তু সিদ্রাত এমন এমন জবাব দিচ্ছে যে আরশি বিনিময়ে আর কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছে না।ও অনেকটা সাহস নিয়ে জিজ্ঞাসা করল…

—”স্যার আপনার কি মন খারাপ?আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন”

সিদ্রাত এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল।চিল্লিয়ে উঠল আরশির উপর…
—”কি শুরু করেছোটা কি?দেখতেই পাচ্ছো কথা বলছি না তাও নির্লজ্জের মতো শুরু করেছো কেন?হোয়াই??আর কে তুমি হুম?কে??আমার ফ্রেন্ড?ক্লাসমেট নাকি সমবয়সী যে তোমার সাথে আমায় শেয়ার করতে হবে কোনোকিছু?ছোট ছোটর মতোই থাকো..বেশি বড় হওয়ার চেষ্টা করবে না।ডিজগাস্টিং…একটু লাই দিয়েছি আর মাথায় চড়ে বসেছে..অসহ্য!!”

সিদ্রাত চিৎকার চেচামেচি করে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল।দরজার সামনে এসেই থেমে গেলো।কারণ মিসেস আয়িশা আজওয়াদ অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সিদ্রাত চোখ নামিয়ে ফেলল।ওর আম্মু দাঁতে দাঁত চেপে বলল…
—”তুমি লিমিট ক্রস করে ফেলেছো সিদ্রাত যা তোমার উচিত হয়নি”

সিদ্রাত নিচের দিকে তাকিয়েই মিনমিন করে বলল…
—”সিদ্রাত আজওয়াদ সিনান ভালো করেই জানে কোন জায়গায় কি করতে হবে?কোন রোগে কোন ওষুধ লাগাতে হবে”

সিদ্রাত কথাগুলো বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।সিদ্রাতের আম্মুও রেগে নিজের রুমে চলে গেলো…
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বাকরুদ্ধ আরশি তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে চোখটা মুছে ধীর পায়ে চলে যেতে লাগল।যাওয়ার সময় আরও একবার বেডের উপর রাখা গিফট বক্স দুটোর দিকে তাকালো।তারপর চোখটা মুছে স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে নিজের রুমে চলে এলো।কিন্তু রুমে এসে আর স্বাভাবিক থাকতে পারল না।দরজাটা লক করে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে মুখ চেঁপে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।ভিতরের সব কষ্টগুলোকে কান্নার মাধ্যমে বের করে দিতে লাগল।কিন্তু হৃদয়ের আঘাতের দাগ কি সহজে মুছে?এধরণের আঘাত পেয়েই কি প্রতিটি কিশোরি মেয়ে ম্যাচিউরড হয়ে উঠে?নাকি ম্যাচিউরিটি অর্জনের সেই আঘাতগুলো এর চেয়েও বেশি যন্ত্রণাময়!

—————-
হেমন্তের শেষে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে এলো কুয়াশার চাদর।পৃথিবীটকে মুড়িয়ে দিলো সেই চাদরের আবরণে।আর সেই চাদর নিজেকে বিলিয়ে দিলো মানুষের শরীরের লোমকূপে..কুয়াশার চাদরকে ঢেকে দেয়ার জন্য আরশিও শরীরে মোটা আরেকটা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।মোটামুটি ভালোই শীত পড়েছে। কুয়াশায় আচ্ছন্ন প্রকৃতিটা ভোরে যেনো একদমই দেখা যায়না।আকাশটাও কেমন বিবর্ণ থাকে একদম আরশির মনের ধূসর আকাশটার মতোই।দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আরশি সেটাই ভেবে চলেছে আর প্রতীক্ষায় আছে প্রিয় মুখটি দেখার।দিনের এই একটাই তো সময় মানুষটাকে দেখতে পাওয়ার।সেদিনের পর যে কথা বলা বন্ধ করল মেয়েটা এই একমাস পঁচিশ দিনে নিজের মুখটাও দেখায়নি প্রিয় মানুষটাকে আর না মানুষটার কন্ঠস্বর শুনেছে।টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত বাসায়ই পড়েছে যেনো স্কুলে গিয়ে নিজের অসহ্যকর মুখটা মানুষটাকে দেখাতে না হয়।আর টেস্ট পরীক্ষার পর তো স্কুল বন্ধই দিয়ে দিলো বাসায় বসে পড়ার জন্য…

প্রায় দুটো মাস মানুষটার সামনে না গেলেও প্রতিদিন ঠিকি একবার করে তার মুখটা দেখার জন্য ফজরের পরপরই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে।যখন মানুষটা ফজর নামাজ পড়ে গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে তখন সেই মুখটা দেখে হৃদয়ে যে হাজারো হাহাকারের মাঝেও প্রশান্তির স্রোত বয়ে যায়।কিন্তু এভাবে কতদিন?কতদিন ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে দূরে থাকা যায়?কষ্ট হয়না বুঝি?মানুষটা কি একবারেই বুঝে না দেড়টা মাসের উপর তার কন্ঠস্বরটা না শুনে আরশির হৃদয়টা যে এখন মৃতপ্রায়?নাকি বুঝেও বুঝে না

এসব ভাবতে ভাবতেই আরশি খেয়াল করল সিদ্রাত টুপি মাথায় বাসার ভিতর প্রবেশ করছে।আরশি মলিন একখানা হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে গেলো।কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল।তারপর কিচেনে গিয়ে এক মগ কফি বানিয়ে এনে কফিটা রিডিং টেবিলে রেখে বিজিএস বইটা বের করে বসল..
দিনগুলো যে এভাবেই অতিবাহিত হয়ে আসছে এই এক মাস পঁচিশ দিন ধরে।তবে জানা নেই ভবিষ্যতের দিনগুলো কিভাবে যাবে!

তখন বেলা নয়টা।আরশি এখনো পড়ছে।আরশির আম্মু রুমে এসে মেয়েকে পড়তে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মেয়েটা যে তার আগের মতোই পড়াপ্রেমিক হয়েছে কিন্তু হাসতেই ভুলে গিয়েছে।আজ কত্তগুলো দিন হাসি খুশি চঞ্চল মেয়েটাকে হাসতে দেখে না।জোর করে হাসাতে চাইলেও পিচ্চি মেয়েটার ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি দেখে সে ইচ্ছাটাও মরে যায়।মিসেস রাবিয়া তার মেয়েটার এই মলিন হাসির কারণ,পড়া প্রেমিক হওয়ার কারণ,হাসতে ভুলে যাওয়ার কারণ যে একবারেই বুঝে না তা না..কিন্তু অনেক সময় জানা-বুঝার পরও যে কিছুই করা থাকে না।মিসেস রাবিয়া আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশির মাথায় হাত রাখে।আরশি সেদিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে…

—”আম্মু কিছু বলবে?”
—”হুম সোনা..আজ না ফ্রম ফিলাপের ডেইট।স্কুলে যাবি না?”
—”আমাকে যেতেই হবে?আমি না গেলে হয়না?”

আরশির আম্মু আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল…
—”পাগলী মেয়ে তুই না গেলে কি করে হবে?এসে আবার পড়িস।রেডি হয়ে নে”

আরশির আম্মু চলে গেলো।আরশি লম্বা একটা শ্বাস ফেলে রেডি হয়ে নিলো।মুখটা নিকাব দিয়ে ভালো করে ঢেকে নিলো যেনো প্রিয় মানুষটা তার অপ্রিয় মুখটা দেখতে না পারে…

স্কুলের সব ফর্মালিটিস শেষ করে অফিস রুম থেকে বের হয়ে একটু সামনে আগাতেই নিরা আর ছোঁয়া এসে দাঁড়ালো আরশির সামনে।আরশি সরু চোখে তাকালো।নিরা শয়তানি হেসে বলল…
—”কিরে সিদ্রাত স্যারের রক্ষিতা..তোর সিদ্রাত কি তোকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দিলো নাকি?চোখ মুখ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে”

নিরার কথা শুনে আরশির শরীর রাগে রি রি করে উঠল।তবুও কোনো সিনক্রিয়েট না করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো।তখনই ছোঁয়া হেসে বলল…
—”আরে নিরা তুইও না..এসব মেয়েদেরকে জানা আছে।বাবা-মা শিক্ষা দিতে পারেনি বলেই তো স্যারদের সাথে নষ্টামি করে।আর সিদ্রাত স্যারই কি ধোঁয়া তুলসি পাতা?দেখ গিয়ে কয়টা মেয়েকে প্রেগনেন্ট করে মজা লুটে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে…”

ঠাশশ ঠাশশ ঠাশশ….
আরশি ছোঁয়ার গালে পরপর তিনটা চড় দিলো।আশেপাশের সবাই অবাক নয়নে ওদের তিনজনের দিকে তাকালো।ছোঁয়াকে ছেড়ে আরশির নিরার গালেও তিনটা চড় দিলো।অফিস রুম থেকে স্যার ম্যাডামরাও বেরিয়ে এলো।আরশি নিরাকে আরও দুটো চড় মারতে মারতে দুজনের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলল…
—”তোর বাবা-মায়ের শিক্ষায় গলদ রয়েছে এজন্য তোর ব্যবহার এতোটা খারাপ।তোর সাহস কি করে হয় আমার সিদ্রাতকে নিয়ে এতো বাজে কথা বলার?কি করে সাহস হয়?বললি না সিদ্রাত স্যার মেয়েদের মজা লুটে?আরে আমি বলছি তোর জন্মেরই হয়ত ঠিক নেই।কে জানে কার পাপ তুই এজন্য এতো বাজে কথা বলিস.তোর বাবা-মা-ই চরিত্রহীন এজন্য তুই জন্মেছিস”

ঠাশশ,,,

এবার যেনো পুরো পরিবেশটাই স্তব্ধ হয়ে গেলো।আরশির বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।এটাও কি তার পাওনা ছিলো?সিদ্রাত কি একাজটা না করলে পারত না।আরশি ছলছল চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে রইল।সিদ্রাত চিৎকার করে বলতে লাগল…
—”তুমি আসলে চাওইনা আমি একটু শান্তিতে বাঁচি তাইনা?আর কত আমার সম্মান নষ্ট করবে তুমি?কত তামাশা বানাবে?”

আরশি ছলছল চোখে ধরা গলায় জিজ্ঞাস করল…
—”আমি তামাশা বানাচ্ছি?”
সিদ্রাত আবারও চিৎকার করে বলল…
—”হ্যা তুমিই তামাশা বানাচ্ছো..একটু আশেপাশে তাকাও..সব টিচার্স আর গার্ডিয়ানরা তোমার বানানো তামাশা দেখছে।আমার সম্মান তুমি আজ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছো।নিরা আর ছোঁয়া কিছু বললেও সেটা আজ তোমার কারণেই বলতে পারছে।শুধু মাত্র তোমার কারণেই আজ টিচার হয়েও স্টুডেন্টদের কাছ থেকে আমায় অপবাদ পেতে হচ্ছে।এরপরও তুমি বলবে তুমি কিছুই করোনি।আমার লাইফটাকে হেল করে দিচ্ছো তুমি।ধ্যাত..আমিই আর এই স্কুলে থাকব না।আজই রিজাইন দিবো..অশান্তি আর ভালো লাগে না”

সিদ্রাত এটা বলে হনহনিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের দিকে যেতে নিলে আরশি সবার সামনেই সিদ্রাতের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ে।হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে…
—”প্লিজ স্যার এমন করবেন না।আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন।আমার জন্য আপনার নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করবেন না।আঙ্কেল যে আপনার উপর অসন্তুষ্ট হবে।আমি আর কখনো আপনাকে ডিস্টার্ব করব না।আমার কারণে আপনাকে আর কখনো কথা শুনতে হবে না।তবুও প্লিজ রিজাইন দিবেন না”

আরশি এগুলো বলে হু হু করে কাঁদতে লাগল।সিদ্রাত কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে পরে হনহন করে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলো।প্রিন্সিপালের স্যারের ধমকে সবাই ওখান থেকে চলে গেলো…

————
সিদ্রাত সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল।স্কুল থেকে যে,সকালে বের হলো রেগে তারপর সারাদিন এক বন্ধুর বাসায় ছিলো।সন্ধ্যায় বাসায় আসতেই কেমন যেনো অন্যরকম লাগল পরিবেশটা।প্রতিদিন তো এই টাইমে ওর আম্মু আর আরশির আম্মু মিলে ওদের লিভিং রুমে আড্ডা দিতো।আজ কেউ নেই কেন?সিদ্রাত বেশি মাথা না ঘামিয়ে রুমে চলে গেলো।কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসতেই ছোট্ট একটা চিরকুট দেখে ভ্রু কুচকালো।।টাওয়ালটা পাশে রেখে চিরকুটটা খুলে পড়তেই এই শীতের মধ্যেও ঝরঝর করে ঘাম ঝরতে শুরু করল সিদ্রাতের কপাল বেয়ে।চিরকুটটায় আরশি লিখেছে…

“প্রিয় ভালোবাসা,
চলে যাচ্ছি বহুদূর।আর কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না,অসম্মান করবে না,সারদিন পিছন পিছনে ঘুরে বলবে না ভালোবাসি।জানি না আর কখনো দেখা হবে কিনা।দেখা হলেও কবে কোথায় কীভাবে হবে তাও জানা নেই আমার।হয়ত মাস পেরিয়ে,বছর পেরিয়ে যাবে…নতুবা কয়েক যুগ।ভালো থাকবেন প্রিয় আর এটুকু মনে রাখবেন আপনার অপ্রিয় ছাত্রী আপনাকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো।আপনি যে তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিলেন প্রিয়তম…
ইতি
আপনার অপ্রিয় কেউ একজন”

চিঠিটা পড়ে সিদ্রাত ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল।চোখ বেয়ে তার অশ্রুকণা গড়াতে লাগল অনর্গলভাবে…
চলবে….
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_36
#Writer_TanhaTonu

শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসতেই ছোট্ট একটা চিরকুট দেখে ভ্রু কুচকালো।।টাওয়ালটা পাশে রেখে চিরকুটটা খুলে পড়তেই এই শীতের মধ্যেও ঝরঝর করে ঘাম ঝরতে শুরু করল সিদ্রাতের কপাল বেয়ে।চিরকুটটায় আরশি লিখেছে…

“প্রিয় ভালোবাসা,
চলে যাচ্ছি বহুদূর।আর কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না,অসম্মান করবে না,সারদিন পিছন পিছনে ঘুরে বলবে না ভালোবাসি।জানি না আর কখনো দেখা হবে কিনা।দেখা হলেও কবে কোথায় কীভাবে হবে তাও জানা নেই আমার।হয়ত মাস পেরিয়ে,বছর পেরিয়ে যাবে…নতুবা কয়েক যুগ।ভালো থাকবেন প্রিয় আর এটুকু মনে রাখবেন আপনার অপ্রিয় ছাত্রী আপনাকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো।আপনি যে তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিলেন প্রিয়তম…
ইতি
আপনার অপ্রিয় কেউ একজন”

চিঠিটা পড়ে সিদ্রাত ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল।চোখ বেয়ে তার অশ্রুকণা গড়াতে লাগল অনর্গলভাবে…
________________________________

বসন্তের প্রথম দিন আজ।উৎসবে-আমেজে সারা ঢাকা শহর মুখোরিত।টিএসসি,শাহাবাগ থেকে শুরু করে রমনা,শাপলা চত্বর,ধানমন্ডি লেক,গুলশান লেক…সবই নতুন বর্ণে বর্ণিল,মানুষের সমারোহে পরিপূর্ণ।উৎসব মুখর বর্ণিল এই দিনটি যেনো সবার মনে ফাগুন হাওয়া লাগিয়ে যাচ্ছে।বিভিন্ন ধরণের ফুল খোপায় গুঁজে নানা রঙের শাড়ি পড়ে প্রিয় মানুষটার সাথে বসন্ত বরণ যেনো এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।এতো আনন্দের ছড়াছড়ি চারদিকে অথচ সেই আনন্দের বিন্দুমাত্র রেশও ছুঁয়ে দিতে পারছে না সিদ্রাত আজওয়াদ সিনানকে।সে দশতলায় নিজের ক্যাবিনে কাচের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে থাই দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে মানুষের আনাগোনা।কারও আওয়াজে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে সিদ্রাত…

—”মে আই কাম ইন স্যার?”

সিদ্রাত থাইয়ের সামনে অফ হোয়াইট পর্দাটা টেনে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে আর বলে…
—”ইয়াহ কাম ইন”

অনুমতি পেয়ে একজন চব্বিশ বা পঁচিশ বছরের এক যুবক ভিতরে প্রবেশ করে কফি নিয়ে।সিদ্রাতের দিকে কফিটা এগিয়ে দিতেই সিদ্রাত বলে…

—”রুহান তুমি নিজে কেন আনতে গেলে কফি?পিয়নকে বললেই তো হতো”
—”ইটস ওকে স্যার।পিয়ন বড় স্যারের রুমে ছিলো।তাছাড়া আমি তো আপনার পিএস-ই।আপনার দেখভালের দায়িত্ব তো আমারই”

সিদ্রাত আর জবাব দিলো না।কফির মগে চুমুক দিলো।রুহান আমতা আমতা করে বলল…

—”স্যার আজ তো ডক্টর সাঈদের কাছে আপনার এপয়েন্টমেন্ট ছিলো..সন্ধ্যা ছয়টায় সিরিয়াল”

রুহানের কথা শুনে সিদ্রাত নাক মুখ কুচকে বিরক্ত গলায় বলল….
—”সাইক্রিয়াটিস্ট ডক্টর সাঈদ কবির?”
রুহান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।সিদ্রাত ভাবলেশহীনভাবে বলল…

—”এপয়েন্টমেন্ট যেহেতু তোমার বড় স্যার দিয়েছে তাহলে উনাকেই নিয়ে যাও।আমি আর সাঈদ কবিরের কাছে যাবো না।গত আড়াই বছর ধরে জোর করে তো নিয়ে গেলো অথচ আমি বলছি আমি টোট্যালি সুস্থ আছি।আর ওই ডক্টরকে তো পেলে আমি খুন করব।সে লাস্টবার হিপনোটিজের মাধ্যমে আমার ব্রেইন থেকে আরশির স্মৃতি মুছে দিতে চেয়েছিলো..ডাফার!”

সিদ্রাত কথাটা বলে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল।তখনই চেনা এক কন্ঠ শুনে চোখ খুলে তাকালো…
—”রুহান তোমার স্যার কমপ্লিটলি ওকে তাইনা?এজন্যই কি এই তিন বছরে একবার না দুইবার না একদম তিনবার সুইসাইড করতে গিয়েছিলো।এটা কি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ?”

সিদ্রাত লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ওর আব্বুর দিকে তাকালো আর বলল…
—”আহ আব্বু প্লিজ লেট ইট বি।পাস্ট ইজ পাস্ট।এখন তো আর তেমন কিছু করছি না তাইনা?”

—”সেটা আমার দেখার ব্যাপার না।তুমি আজ আড়াই বছর ধরে উনার আন্ডারে আছো।এখন ট্রিটমেন্ট প্রায় শেষের দিকে।আমি এ মূহুর্তে কোনো অবহেলা চাচ্ছি না।টাইম মতো চলে যাবে। সাথে রুহানকে নিয়ে যাবে”

সিদ্রাতের আব্বু কথাগুলো বলে চলে গেলো।সিদ্রাত আড়চোখে রুহানের দিকে তাকালো।রুহান ঠোঁট টিপে হাসছে।সিদ্রাত ভ্রু কুচকে তাকাতেই চুপসে গেলো।সিদ্রাত উঠে দাঁড়িয়ে গেলো আর বলল…
—”বাসায় চলে যাও।আমিও চলে যাচ্ছি।সন্ধ্যায় আমি ফোন দিবো যাওয়ার আগে”
—”ওকে স্যার”

সিদ্রাত রুহানকে বিদায় দিয়ে নিজেও বাসায় চলে আসল।এসে আগে ফ্রেশ হলো।তারপর বেডে শরীরটা এলিয়ে দিতেই চোখ গেলো পাশের বেড সাইড টেবিলে থাকা এক্যুরিয়ামটার দিকে।মেয়ে মাছটা পালাতে চাচ্ছে আর ছেলে মাছটাও ওর পিছনে দৌড়োচ্ছে।সিদ্রাত মুচকি হেসে ওদিকে তাকিয়ে ছেলে মাছটার উদ্দেশ্যে বলল…

—”লাভ নেই..দৌড়ে কোনো লাভ নেই।ও ধরা দিবে না এখন।বড্ড অভিমানী যে মেয়েটা..অনেক বেশিই অভিমানী”

সিদ্রাত এটা বলে চোখ বন্ধ করল।পাপড়ি গুলো ভিজে উঠল সাথে সাথে।চোখ বন্ধ রেখেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলতে লাগল…

—”তুমি অনেক দুষ্টু ছিলে,চঞ্চল ছিলে কিন্তু এতোটাই অভিমানী ছিলে তা তো বললে না পিচ্ছি।আমি তো জানতামই না পিচ্ছিটার এতো রাগ!আচ্ছা এখন তো অনেক বড় হয়ে গিয়েছো তাইনা?হাহা..কিন্তু আমার কাছে তুমি অলওয়েজই পিচ্ছি..পিচ্চি আরশি…”

সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।কিছুক্ষণ পর আবারও বলতে লাগল…
—”তবে তুমি আমার উপর যত রাগই করো না কেন আজ তুমি সাকসেস আরশি।আর কিছু মাস..তারপরই তোমার লাইফের নিউ একটা চ্যাপ্টার শুরু হবে.. হাহ..আচ্ছা তুমি কি এখনো রাতে আমার মতো আকাশের দিকে তাকাও?মিস করো তোমার সিদ্রাতকে?আমি আজও তোমায় মিস করি আরশি..অনেক মিস করি।তবে তোমার কাছে আমি যাবো না কারণ তুমি যে বড্ড আবেগী আরশি পাখি।আমি তোমার সামনে গেলে তুমি আবারও ভেঙে পড়বে..সরি পাখিটা..সরি সেদিন তোমায় ইনসাল্ট করার জন্য।কিন্তু তুমি যে আমায় এভাবে ছেড়ে এতো দূর চলে যাবে তা কেন বুঝলাম না আমি।আমি তো শুধু তোমার থেকে সাময়িক দূরত্ব চেয়েছিলাম।বাট তুমি আমায় দূরত্বের খাচায় আটকে দিয়ে চলে গেলে।অনেক ইনসাল্ট করেছি সেদিন তোমায় বাট আই ওয়াজ হেল্পলেস মাই হার্ট..আই ওয়াজ হেল্পলেস.. ও তোমার ক্ষতি করে দিতো যে”

সিদ্রাতের চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়তে থাকল।কিছুক্ষণ নীরবে অশ্রু বর্ষণের পর সিদ্রাত মলিন হাসি দিয়ে চোখটা মুছে ফেলল..

—”আরে তুমি আর কথা বলো না আমার সাথে।মেজাজ খারাপ আমায়।আজ বসন্ত বরণ অথচ ও নাকি বেরই হবে না।বেয়াদ্দপটার জন্য আমিও বের হতে পারছি না”

নুসাইফার কথার জবাবে ফোনের ওপাশ থেকে নিহান বলল…
—”ওহহো নুসু তুমিও না।আরশি না আসতে চাইলে থাকুক না বাসায়।আমি আর তুমি আজ পুরো টিএসসি ঘুরবো,রোমান্স করব,বাদাম খাবো..ও হয়ত ইচ্ছে করেই আসতে চাচ্ছে না আমাদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হবে না বলে।ও কি তোমার মতো গাধা?”

নুসাইফা নিহানের কথায় এবার গর্জে উঠল..
—”ওই কুত্তা তুই থাক তোর রোমান্স নিয়ে।আমি আমার বেস্টুকে বাসায় একা রেখে তোর সাথে রোমান্স করব তাইনা?যা ব্রেকাপ..তুই থাক তোর মতো”

নুসাইফা ফোনটা কেটে দিয়ে ধপ করে বেডে বসে পড়ল।আরশি নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে ভাবলেশহীনভাবে বলল…
—”নিহান ভাইয়ার সাথে আজ তোর কত তম ব্রেকাপ হলো রে?পঁয়তাল্লিশ তম না?”

নুসাইফা রাগী চোখে আরশির দিকে তাকালো।আরশি দাঁত কেলিয়ে হাসল।নুসাইফা রেগে একটা বালিশ আরশির মুখপানে ছুড়ে মারল..
—”আউচ্চ..নুসুউউ..আমার নাক!”
—”একদম ঠিক হয়েছে।কথা বলবি না তুই আমার সাথে”

নুসাইফা রেগে মেগে আরশির পাশে কম্বল মুরিয়ে শুয়ে পড়ল।আরশি মৃদু হেসে এসির পাওয়ার আরও লো করে দিলো।নুসাইফা কম্বলের ভিতর থেকে মাথা তুলে বলল…
—”এসির পাওয়ার লো করলি কেন?”
—”একে তো গরমের মধ্যে কম্বল জড়িয়েছিস গাধার মতো আবার প্রশ্নও করছিস গাধার মতো..গাধা একটা”

আরশি আবারও ফেইসবুকে মনোনিবেশ করল।কিছুক্ষণ পর মেসেঞ্জারে টোন বাজায় ও মেসেজ ওপেন করল।অনেকেই মেসেজ পাঠাচ্ছে একসাথে।মেসেজগুলো দেখে আরশি রেগে নুসাইফার পিঠে কিল বসিয়ে দিলো

—”আয়াহ..আরশিইই..কিল দিলি কেন?”
—”তুই আগে বল তুই কার পার্মিশনে ফেইসবুকে পোস্ট করেছিস আমাদের মেডিকেলে চান্স পাওয়ার কথা?”

নুসাইফা লাফ দিয়ে উঠল আরশির কথা শুনে।শরীরের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে নিজের ফোনটা নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকতেই অনেকগুলো কংগ্রাচুলেশনস মেসেজ দেখতে পেলো।মেসেজগুলো দেখে একদম খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো নুসাইফা।আরশি হালকা রেগে বলল….

—”তুই আজ আমার হাতে থাপ্পর খাবি।নিজেরটা তো পোস্ট করেছিস সাথে আমারটাও”
—”কুল বেবি কুল।দেখ আমরা রেটিনায় ডিএমসিতে চান্স পেয়েছি..যে সে কথা নাকি?বুঝিস..ডি,,এম,,সি,,এখন যদি সবাইকে না জানাই তো হলো?”

আরশি দাঁত কটমট করে তাকালো।নুসাইফা হাসল।তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে বলল…
—”ওহ আরশি তোকে বলতে ভুলে গিয়েছি আজ সন্ধ্যায় একটু একটা হসপিটালে যেতে হবে।আমার মামাতো ভাইয়া একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে আসবে।বসন্ত বরণ উৎসব উপলক্ষে কিছু গিফট দিবো ভাইয়াকে”
—”তোর ওই মামাতো ভাইয়া যে গত বসন্ত বরণ উৎসবে আমাদের জন্য অনেক গিফট পাঠিয়েছিলো?”

নুসাইফা মুচকি হেসে বলল…
—”হুম”
—”আচ্ছা সমস্যা নেই”
—”আলবাত সমস্যা আছে।প্রতিদিন রাতে কেঁদে কেঁদে ফেইসের কি হাল করেছিস দেখেছিস?আমি ফেইস প্যাক বানিয়ে দিচ্ছি। ওটা এখন মুখে লাগিয়ে বসে থাক”

আরশি ফিক করে হেসে দিয়ে বলল…
—”মাইর চিনিস?আমি কি শশুর বাড়ি যাচ্ছি যে ফেইস প্যাক, এই প্যাক, সেই প্যাক লাগাতে হবে?”
নুসাইফা বিড়বিড় করে বলল…
—”শ্বশুর বাড়ি আর কি যাবি সেখানেই তো আছিস”

আরশি ভ্রু কুচকে বলল…
—”কি বিড়বিড় করিস?”
—”হু?না কিছু না”

সন্ধ্যায় সিদ্রাত রুহানকে নিয়ে হসপিটালে যায়।ওদের সিরিয়াল আসতেই ওরা ডক্টরের চ্যাম্বারে যায়।ডক্টর সব টেস্ট রিপোর্ট আর সিদ্রাতের প্র‍্যাক্টিকেলি কিছু টেস্ট নিয়ে বলে…

—”আপনার মেন্টাল কান্ডিশন অনেকটাই ডেভালপ হয়েছে মিস্টার আজওয়াদ।অনেকটা বলতে একদম ঠিক হয়ে গিয়েছে বললেই চলে।আমি মেডিসিনগুলো চেইঞ্জ করে দিচ্ছি।যে মেডিসিনগুলো লিখে দিয়েছি সেগুলো আরও তিনমাস কন্টিনিউ করবেন।তারপর আশা করি আর প্রয়োজন হবে না”

—”ওকে এন্ড থ্যানক্স ডক্টর”
ডক্টর মুচকি হেসে বলল..
—”মাই প্লেজার”

নুসাইফা আর আরশি হসপিটালের গেইটে দাঁড়িয়ে আছে।আরশি বিরক্তি নিয়ে বারবার নুসাইফার দিকে তাকাচ্ছে।আর না পেরে এবার বিরক্তি নিয়ে বলেই ফেলল…
—”নুসু তোর ভাইয়া কি আসবে?নাকি আপাতত তাকে মেন্টাল সিকনেসের কারণে পাবনা পাঠানো হয়েছে”
—”আহ আরশি প্লিজ বি সাইলেন্ট।ভাইয়া আসবে না এখানে।আমাকে মিসড কল দিলে আমিই ভিতরে যাবো বাট তুই এখানেই আমার জন্য ওয়েট করবি।আর হ্যাঁ আমার ভাইয়াকে তুই পাগল বললি কোন সাহসে?”

আরশি মুখ বাঁকা করে বলল…
—”তো কি বলব আর?পাগলরাই তো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে আসে হুহ”

নুসাইফা এবার কিছুটা রেগে গেলো।রেগেই বলল…
—”জাস্ট শাটাপ।ভাইয়াকে পাগল বলবি না।পাগল হলে বাবার বিজন্যাস সামলাতে পারত না।একটা কারণে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলো।হয়ত এমনিই ঠিক হয়ে যেতো কিন্তু মামা-মামী রিস্ক নিতে চায়নি”
—”ওহ তা বল।তো প্রেম ঘটিত ব্যাপার টেপার নাকি?”

নুসাইফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল…
—”হু..হবু বউকে ডক্টর বানানোর জন্য দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে।সেই শোকেই পাগল হয়ে ডিপ্রেশনে গিয়েছে..হাহ”

নুসাইফার কথায় আরশির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।ও আফসোস করে বলল…
—”তোর ভাইয়ার কপালটাই খারাপ।তো এখন হবু বউ কি তার সাথে যোগাযোগ করেনা?যোগাযোগ করলে তো এমন অবস্থা হওয়ার কথা না।বেয়াদ্দপ স্বার্থপর মেয়ে একটা”

আরশির কথা শুনে নুসাইফা ফিক করে হেসে দিলো।আরশি ভ্রু কুচকে তাকালো।নুসাইফা হেসে মিনমিন করে বলল…
—”নিজেকেও যে নিজে বকতে পারে কেউ তা যে দেখেছে সে-ই বুঝে কত মজাদায়ক..হিহি”

আরশি ভ্রু কুচকে বলল…
—”কিসের মধ্যে কি বলিস?”
—”আচ্ছা বাদ দে।একটা মুভির সিন মনে পড়ে গেলো”

আরশিও হেসে দিলো নুসাইফার কথায়।নুসাইফার ফোনে কল আসতেই আরশিকে হসপিটালের বাইরে দাঁড় করিয়ে ভিতরে চলে গেলো।আরশি সেখানেই ওয়েট করতে লাগল।কিছুক্ষণ পর হঠাৎ চোখ পড়ল রিক্সায় বসে থাকা এক কাপলের দিকে।কাচা হলুদ কালার সুতির শাড়ি পরিহিতা মেয়েটার চুলের এক পাশে নীল পাঞ্জাবি পড়া ছেলেটা একগুচ্ছ গোলাপ গুঁজে দিচ্ছে।দুজনের চোখে-মুখে খুশির ছোঁয়া।আরশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এরকম কিছু মূহুর্ত যে ওরও স্বপ্ন ছিলো এক সময় যা আজ অর্থহীন কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। সবকিছু ঠিক থাকলে,সিদ্রাত যদি ওকে মেনে নিত তাহলে হয়ত বসন্ত বরণে ওরাও টিএসসির প্রান্ত ধরে প্রেমালাপ করত হেঁটে হেঁটে।আরশি আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেজা পাপড়িগুলো মুছে নিলো..
মোবাইলে টাইম দেখল সাতটা বাজে।আরও বিশ মিনিট ওয়েট করেও নুসাইফা ফিরে এলো না।আরশি এবার বেশ বিরক্ত হলো..

—”উফফ এই মেয়েটাকে আজ আমি মেরে শেষ করে দিবো।চল্লিশ মিনিট ধরে যে আমায় এখানে রেখে গেলো অথচ তার কোনো খোঁজই নেই..বেয়াদ্দপ”

আরশি বিড়বিড় করতে করতে হসপিটালের ভিতরে গেলো।কিন্তু বুঝতে পারছে না কোন ফ্লোরে যাবে।হসপিটালের দেয়ালে টানানো ডক্টরদের চার্ট দেখে বুঝল আজ দুজন সাইক্রিয়াটিস্ট আছে হসপিটালে।আরশি রিসিপসনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল…
—”এক্সকিউজমি..ডক্টর হারুন-উর-রশীদ কোন ফ্লোরে আছেন”

রিসিপসনিস্ট মেয়েটি বলল..
—”ডক্টর হারুন-উর রশীদ ফিফট ফ্লোরে আছে ম্যাম”
—”ওহ..আর ডক্টর সাঈদ কবির?
—”দুজন একই ফ্লোরে ম্যাম”
—”থ্যানক্স”

আরশি লিফটের ফোর চেপে দাঁড়িয়ে রইল..

—”ভাইয়া আমি যাই এখন।আরশি নিচে ওয়েট করছে”
—”হুম ভালো থাকিস নুসু আর আমার পিএস তোকে এগিয়ে দিবে। এতগুলো গিফট তুই একা নিতে পারবি না”
—”আচ্ছা..ভালো থেকো”

নুসাইফা নিজের কেনা গিফটগুলো ওর মামাতো ভাইকে দিয়ে তার থেকে তিন ডাবল গিফট নিয়ে পিএস ছেলেটার সাহায্যে সিড়ি দিয়েই নিচে নেমে এলো…

সিদ্রাত হসপিটাল থেকে চলে আসতে নিবে তখনই ওর খেয়াল হলো মোবাইলটা ডক্টরের চ্যাম্বারে রেখে এসেছে।সিদ্রাত এক্সকিউজমি বলে আবারও ডক্টরের চ্যাম্বারে ঢুকল…
—”মিস্টার আজওয়াদ এনি প্রবলেম?”
—”সরি ডক্টর..একচ্যুয়ালি আমার ফোনটা ফেলে গিয়েছি”

ডক্টর টেবিলে তাকিয়ে খেয়াল করল ওখানে সিদ্রাতের ফোন।বলল..
—”ইটস ওকে মিস্টার আজওয়াদ”

সিদ্রাত মৃদু হেসে ফোনটা নিয়ে বেরুতে লাগল আর আরশিও লিফট থেকে বেরুলো।একটু সামনে আগাতেই চেনা মুখটা দেখে ওর ভিতরটা কেঁপে উঠল।হাতগুলোও থরথর করে কাঁপতে লাগল।বুকের ভিতর ডিপডিপ আওয়াজ হতে লাগল।সিদ্রাতকে লিফটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই আরশি সরে গেলো।সিদ্রাত লিফটে ঢুকে গেলে আরশিও বেরিয়ে এলো।চোখের পানিগুলো চেয়েও আটকাতে পারছে না মেয়েটা।ইচ্ছা করছে দৌড়ে গিয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে।এতো অস্থির লাগছে বলার বাইরে।পুরো তিনটা বছর!যাকে না দেখে তিন ঘন্টাও থাকতে পারত না তাকে ছাড়া যে কত কষ্টে তিনটা বছর কাটিয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বুঝবে না..
সিদ্রাত যেই ক্যাবিনটা থেকে বেরুলো আরশি সেটার সামনে যেতেই আরশি ভ্রু কুচকে ফেলল।কারণ দরজায় বড় বড় করে ডক্টর সাঈদ কবিরের নাম ও তার ডিগ্রি লিখা আছে।আরশি চিন্তায় পড়ে গেলো…
—”উনি সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে আসল কেন?ভিতরে গিয়ে একবার ডক্টরের সাথে আলাপ করলেই তো হয়”

আরশি ডক্টরের চ্যাম্বারের দরজার হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই ওর ফোন বেজে উঠল।একপাশে সরে এসে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নুসাইফা চিল্লিয়ে বলল…

—”আরশির বাচ্চা কোথায় তুই?আমি এত্তগুলো বক্স নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছি।তাড়াতাড়ি আয় নাহলে তোর পিঠে আমি আজ লাঠি ভাঙব”

নুসাইফার চিৎকার শুনে ফোনটা কানের কাছ থেকে আরশি সরিয়ে নিলো।চোখ-মুখ কুচকে ডক্টরের চ্যাম্বারের দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলো…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here