#তুমি_আমারই
#পর্ব_২৫(অন্তিম-২য় এবং শেষ খন্ড)
#Sumaia_Jahan
আমি হাতের মেহেদীতে এতোটাই বিভোর ছিলাম যে আমার পাশে দিয়া, রুহি,নিহা মরার মতো ঘুমিয়ে আছে তা ভুলেই গেছি।ওদের কথা মনে আসতেই মেহেদী ছেড়ে ওদের ঘুম ভাঙ্গাতে লাগলাম।
—- এই দিয়া রুহি নিহা তোমরা সবাই উঠবে নাকি পানি মারবো।অনেক বেলা হয়ে গেছে কিন্তু!
দিয়া চোখ বন্ধ রেখেই বিরক্তের সুর নিয়ে ঘুম জরানো কন্ঠে বললো,
—- তোরা দুজনে কি শুরু করলি!একজনে রাত জেগে মেহেদী দেওয়ার উৎসব পালন করবি তো আরেক জন্য সকাল বেলাও একটু ঘুমাতে দিবি না।
—- কি বললি?
দিয়া আমার কথা শুনে হুসে আসে এতোক্ষণ ঘুমের ঘোরে সত্যি টা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।তাই তারাতাড়ি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে একটা বোকা হাসি দিয়ে বললো,
—- কই কিছু বলছিলাম নাকি!আসলে স্বপ্ন দেখতেছিলাম তো তাই স্বপ্নের কথাই বস্তবে চলে এসেছে।
আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,
—- তোর মতো বেস্টু থাকলে শত্রুর আর প্রয়োজন হয় না।তুই কি করে পারলি রোদ্দুর দলে নাম লেখাতে?
কথাটা বলেই আমি উঠে দড়িয়েছি।দিয়াও আমার সাথে সাথে উঠে দাড়িয়েছে। আমাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বললো,
—- একজন লোক যদি তার বউয়ের হাতে মেহেদী পরাতে চায় তাহলে আমি কি করে তাকে আটকাতে পারি।আর রোদ্দুর ভাইয়া কে তুই খুব ভালো করেই চিনিস উনি যা চান তাই করেন।আর তুই তো খুব লাকী যে তুই এমন একটা বর পেয়েছিস যে তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কোথায় খুশি হবি তা না!
—- হয়েছে হয়েছে তার উনার হয়ে গুনোগান গাইতে হবে না।
এরমাঝেই শ্বাশুড়ি মা হাঁপাতে হাঁপাতে আসলো।আমাদের কে দেখেই তৃপ্তির হাসি দিয়ে আমাদের কাছে আসলো।
—- তোরা সবাই এখানে! আমি পুরো বাড়ি খুঁজে এসেছি।আর তোরা কি সারারাত এখানে ঘুমিয়েছিস?
আমরা উদাস হয়ে মাথা নেরে বললাম,
—- কি আর করবো সারা বাড়িতে আমাদের জন্য একটুও জায়গা ছিলো না তাই বাধ্য হয়ে এখানেই রাত কাটাতে হয়েছে।
শ্বাশুড়ি অবাক হয়ে বললেন,
—- কি বলিস কি তোরা?তোদের রুমে লোকজন দেখে তোদের জন্য আমি আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম।আর তোরা কিনা এই ছাদে রাত কাটিয়েছিস।
উনার কথা শুনে আমাদের সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।সারা রাত এই ছাদে ঘুমিয়ে পিঠ আর কোমরে ব্যথা হয়ে গেলো।আর আমাদের জন্য কিনা একটা রুম অপেক্ষা করছিলো।এটা শোনার থেকে কচু গাছের সাথে গলায় দড়ি দেওয়া অনেক ভালো।
রুহি আর নিহা এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো।শ্বশুরি মায়ের এই কথাটা শুনে ওরাও ধড়ফড়িয়ে ওঠে বললো,
—- কিহহহহহহহ? সারা রাত এই ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পিঠের বারোটা বেজে গেলো।ঠিক মতো ঘুমাতেও পারিনি।আর তুমি এখন বলছো আমাদের জন্য অন্য রুমের ব্যবস্থা করে রেখেছো?
শ্বাশুড়ি মা রুহির চিৎকারে কানে হাত দিয়ে বললো,
—- এখন এমন ষাঁড়ের মতো চিৎকার না করে রাতে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হতো।তাহলে আর কষ্ট করে এখানে ঘুমাতে হতো না।
রুহি বিরক্তির সুরে বললো,
—- আমরা কি জানতাম নাকি তুমি অন্য রুমের ব্যবস্থা করে রাখবে!
শ্বাশুড়ি মা রুহিকে থামিয়ে বললেন,
—- যা হয়ে গেছে তা তো এখন বদলানো যাবে না এসব এখন ছাড়।আজ যে তোদের বিয়ে তা মনে আছে তো!অনেক কাজ পরে আছে। তোরা তারাতাড়ি নিচে যা তোদের রুমে আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারাতাড়ি খাবার খেয়ে নিবি সবাই। তারপর আবার পার্লারে লোকে চলে আসবে তখন আবার খাওয়া টাইম পাবি না।
শ্বাশুড়ি মায়ের কথায় আমরা সবাই সম্মতি জানিয়ে নিচে নেমে রুমে চলে আসলাম।তারপর একে একে সবাই ফ্রেশ হয়েনিলাম।এরমধ্যেই আমাদের খাবার চলে আসলো।আমাদের খাওয়ার পর্বও শেষ হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পরই পার্লারের মেয়েগুলো আসলো।আচার্যের বিষয় ওরা রুহি দিয়া আর নিহাকে সাজালেও আমাকে সাজাচ্ছে না।আমাকে নাকি একজন স্পেশাল মানুষ সাজাবে তাই তাদের সাজাতে বারন করা হয়েছে।তাই আমাকে পাশের রুমে পাঠানো হয়েছে।রুহি আমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছে।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আমাকে আলাদা করে সাজানো কেন হচ্ছে। তাই এই ছোট্ট মাথাটাকে আর বেশি না খাটিয়ে পাশের রুমে উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
রুমের দরজা টা হালকা খোলাই ছিলো।তাই দরজা টা একটু ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। ওমা ভিতরে ঢুকে দেখি রোদ্দুর। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—- তুমি এখানে কি করছো?
রোদ্দুর ভাব শীল ভাবে বললো,
—- বউ সাজাতে বসে আছি।
আমি তো পুরো অবাক। এই স্পেশাল মানুষের কাছে সাজতে পাঠানো হয়েছে।এর জন্যই রুহি তখন মুখ টিপে টিপে হাসছিলো।ওর কথা শুনে মুখ আপনাআপনিই হা হয়ে গেলো।
—- কিহহ?তুমি বউ সাজাবে মানে?তুমি মেয়েদের সাজ এর ব্যপারে কি জানো হে?
—- কেন এ ঘরে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছো নাকি?
—- কিন্তু তুমি কি সাজাতে পারবে নাকি?
—- কেন পারবো না? আর তাছাড়া আমি এর আগে অনেকবার ইউটিউব দেখে বউ সাজিয়েছি।
চোখ ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞেস করলাম,
—- অনেক বার বউ সাজিয়েছো মানে?সত্যি করে বলো এর আগে কয়টা মেয়েকে বউ সাজিয়েছো?
রোদ্দুর আমার এমন ব্যবহারে থতমত খেয়ে গেলো।তাই তারাতাড়ি আমার কাছে এসে ইনোসেন্ট ফেইস করে বললো,
—- সত্যি বলছি কোনো মেয়ে কে নয়!
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—- কোনো মেয়ে না হলে কাকে বউ সাজিয়েছো?
রোদ্দুর মাথা চুলকে বললো,
—- আমার পরানের ছোট ভাই থাকতে আর কাউকে লাগে নাকি!ওকে দিয়েই কাজ চালিয়ে দিছি।
আমি রোদ্দুর এর কথা শুনে রাহাতের বউ সাজা অবস্থাটা মনে মনে একবার কল্পনা করলাম।রাহাত লাল বেনারসী পরে গায়ে গহনা পরে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আসে। রাহাতের এমব বউ সাজা অবস্থা কল্পনা করতেই আমি হাসতে হাসতে শেষ। আমার হাসার মাঝেই রোদ্দুর আমার সামনে হাটু ঘেরে বসলো আর বলতে লাগলো,
—- বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো আমাদের বিয়েতে তোমাকে নিজ হাতে বউ সাজাবো।প্রথমবার তো পরিস্থিতি অন্য রকম ছিলো তাই ইচ্ছে টা পুরোন করতে পারিনি।এখন দেবে কি আমার বহু দিনের ইচ্ছে টা পুরোন করতে?
আমার অনেক আগেই হাসি থেমে গেছে।একটা মানুষ কতোটা ভালোবাসলে একটা মানুষ কে নিয়ে এতোটা স্বপ্ন দেখে তা আমার রোদ্দুর কে না দেখলে জানাই হতো না।ওর এমন এমন আবদার রে যতোটা ভালো লাগা কাজ করছে তার থেকে অনেক বেশি লজ্জা গ্রাস করলো। আমি লজ্জায় পুরো লাল হয়ে গেছি কোনো উত্তরই আমি দিতে পারছি না।তাই আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম আর তাতেই রোদ্দুর এর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ফুটে উঠলো। কারন ও যে ওর উত্তর পেয়ে গেছে।
আমাকে লাল আর গোল্ডেন কম্বিনেশনে একটা শাড়ি পরালো।আমাকে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে দিয়ে একদম প্রফেশনাল পার্লারের লোকেদের মতো সাজাতে লাগলো।আর ওর প্রতিটা ছোঁয়ায় আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি।এভাবে আদা ঘন্টার মধ্যেই আমাকে পুরো বউ সাজিয়ে ফেললো।এতো তারাতাড়ি কোনো পার্লারের লোকও বোধ হয় এতো নিখুঁত ভাবে বউ সাজাতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।আমার পুরো সাজ কমপ্লিট করে একটা তৃপ্তির হাসি দিলো।আর আমি ফেলফেল করে ওর কর্ম কান্ড দেখে যাচ্ছি।
।
।
।
একে একে আমাদের সবাইকে বিয়ের আসরে বসানো হলো।মাঝে একটা পাতলা আবরন দিয়ে প্রত্যেক বর কনে কে সামনাসামনি বসানো হলো।আজ আমার মনে বিয়ের প্রতিটা অনুভূতি কাজ করলো।একে একে সবাই সবার বিয়ের কাজ শেষ করে। আমার আর রোদ্দুর এর বিয়ের কাজ শুরু হলো।বিয়ের সব ফর্মালিটি শেষ করে আমাকে যখন কবুল বলতে বললো তখন আগের বারের মতো এবারও আমার চোখে পানি চলে আসলো।তবে এবার চোখের পানিটা ছিলো সুখের পরম সুখের।ভালোবাসার মানুষটার সাথে সারাজীবন চলার সুখ টা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সুখ। আর সেই সুখটা সবার ভাগ্যে থাকে না।খুব কম মানুষের ভাগ্যেই এই সুখ টা জোটে।আর আমি সেই কম মানুষের মধ্যেই একজন।এটা যে কতো বড়ো পাওনা তা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
রাতে,,,,,
আমি রোদ্দুর এর ঘাড়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি।আর রোদ্দুর চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।একটু আগে আমি যখন বাসর ঘরে বউ সেজে বসে রোদ্দুরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন রোদ্দুর রুমে ঢুকেই আমাকে ছাদে নিয়ে আসলো। ও নাকি চন্দ্র বিলাস করবে!তাই তখন থেকেই ছাদের দোলনায় এভাবে বসে আছি। নিরবতা ভেঙ্গে রোদ্দুর বলতে লাগলো,
—- যতদিন তোমার থেকে দুরে বিদেশে ছিলাম তখন প্রতিটা সকাল শুরু করতাম তোমার সেই ছোট্ট হাসি মাখা মুখের ছবি দেখে।আমি যে রুমটা তে থাকতাম পুরো রুম জুরে তোমার ছবি লাগানো ছিলো।তাতে আমার মনে হতো তুমি আমার সাথেই আছো।কখনো মন খারাপ হলে চোখ বন্ধ করে তোমার খিলখিল হাসির দৃশ্য টা মনে করতাম আর তাতেই আমার মন খারাপ নিমিষেই উধাও হয়ে যেত।এমন কোনো মুহূর্ত ছিলো না যখন তোমায় নিয়ে কল্পনা করতাম না।
রোদ্দুরের এমন আবেগ মাখানো কথায় আমার দু চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো।এই লোকটা কতোটা ভালোবাসে আমায় আর আমি কিনা সবসময় কষ্ট দেই।রোদ্দুর আমার চোখে পানি দেখে হন্তদন্ত হয়ে বললো,
—- এই পাগলি কাঁদছো কেন?এখন থেকে যেন চোখ থেকে আর এক ফুটোও পানি বের না হয়!তাহলে কিন্তু করলার জুস খাইয়ে দিবো।
ওর এমন কথায় কান্নার ভিতরও হাসি ফুটে উঠলো।কয়েকটা কিল ঘুসি দিয়ে ওর বুকে মাথা গুঁজলাম। রোদ্দুরও একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
এভাবেই ওদের হাসি খুসিতে কাটুক ওদের ভালোবাসা।দোয়া করবেন ওদের জন্য।
_________________সমাপ্ত ____________________
[এই গল্পটা আমার প্রথম ধারাবাহিক গল্প ছিলো।প্রথম থেকেই অনেক ভালোবাসা পেয়েছি আপনাদের থেকে।গল্প লেখা আমার শখ ছিলো এখন সেই শখ টা নেশায় পরিণত হয়েছে,আপনাদের থেকে অফুরন্ত ভালোবাসার জন্য। আমি আশা করিনি এতোটা ভালোবাসা পাবো আপনাদের থেকে।
শেষের দিকে এসে আমি অনেক পাঠক হারিয়েছি তা অবশ্য আমারই দোষে।আমি রেগুলার গল্প দিতে পারিনি আবার মন দিয়ে গল্প লিখতে পারনি তাই গল্পে অনেকটাই রেসপন্স কমে গেছে শেষের দিকে।খুব প্রবলেম এর ভিতর ছিলাম এবং আছি তাই এতোটা সমস্যা হচ্ছে।
যাইহোক আপনাদের থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি এই গল্পটার মাধ্যমে। খুব তারাতাড়িই নতুন গল্প নতুন চরিত্র নিয়ে হাজির হবো ইনশাআল্লাহ। ততোদিন সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন এই কামনাই রইলো।আর আমাকে ভুলে যাবেন না কিন্তু।খোদা হাফেজ। ]