“ঝরা_পাতার_দিনগুলি পর্ব:৮(২য় অংশ)&পর্ব৯

#ঝরা_পাতার_দিনগুলি
#হাবিব
পর্ব:৮(২য় অংশ)&পর্ব৯
ভাইয়া বাড়িতে আসলে আপু এখন ঘর ছেড়েই বের হয়ে অন্য কোথাও চলে যায়।
তারপর একদিন ছোট ফুপি আর মেজো ফুপি আমাদের বাড়িতে এলো।
বড়দের কথার মাঝে থাকতে নেই এই বলে আম্মু আমাদের ছোট দুই ভাইবোনকে বের করে দিয়েছিলো ঘর থেকে।
সেদিন কি হয়েছিলো বাসায় জানি না কিন্তু বাসায় এসে দেখেছিলাম মেহনাজ আপু চোখে মুখে প্রচন্ড রাগ নিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। আর আম্মু আঁচলেে বার বার চোখ মুছতেছিলো।
এর পর থেকে আব্বু বাদে আমাদের কোনো ভাই বোন অনেক বছর যাবত ফুপিদের বাসায় যাইনি।
ক্লাস এইটে পড়ার সময় সেদিনকার ফুপিদের বলা কথাগুলোর মধ্যে দুইটা কথা শুনেছিলাম তার মধ্যে একটা ছিলো আমার বাবা সব কুকুর বেড়ালের ছাও নাকি পয়দা করছে, সে জন্য আমদেরকে পালতে নাকি ফুপিদের কাছে বার বার হাত পাতা লাগে!!! আর একটা ছিলো আমাদের নিজেদের শহরে যাওয়ার সামর্থ নেই তাই বড়লোক ফুপির ছেলের পিছনে আপুকে লাগিয়ে দিয়ে দিয়েছে!!!!!
বাকি কথা গুলো শোনার ইচ্ছেটা তখন মরে গিয়েছিলো।
সেদিনের পর রিশাদ ভাইয়া একবার এসেছিলো। ততোদিনে ভাইয়ার উল্টো পালটা কাজ কর্ম শুরু হয়েছে। আমার আম্মু আপুরা অনেক ধার্মিক ছিলো। স্কুলে পড়া সত্তেও খুব স্ট্রিক্টলি পর্দা করতো।
ভাইয়া এসেছিলো আম্মুকে জিজ্ঞেস করতে ভাইয়া যদি আরবি নিয়ে পড়াশোনা করে তাহলে আম্মু ভাইয়ার কাছে আপুকে বিয়ে দিবে কিনা!!!!
আম্মু সেদিন ভাইয়াকে কি বলেছিলো জানি না কারণ সেদিনের পর ভাইয়া এই বাড়িতে আসেনি। আর ভাইয়া পরের বছর বুয়েট ছেড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ডবার এডমিশন টেষ্ট দিয়ে আরবিতে ভর্তি হয়েছে!!!
প্রতি ইয়ারে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ভাইয়া ফাইনাল ইয়ারে এসে যখন বুঝতে পারলো যে আপুর সাথে ভাইয়ার বিয়েটা হবে না আর সেটার জন্যে দায়ি তার ফ্যামিলি তখন থেকেই ভাইয়া পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি বিগড়ে গেল!!!!
আর আপু অনার্সে সকল জাতীয় বিশ্বাব্বিদ্যালয়ের সম্মিলিত মেধা তালিকায় সেকেন্ড হলো!!!
মাস্টার্সেও সেইম রেজাল্ট!!
আর এর পরের বছর লন্ডনের এক নামকরা বিশ্বাব্বিদ্যালয়ের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসররের সাথে আপুর বিয়ে হয়ে আপু লন্ডন পাড়ি জমালো।
আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠি মেজো ভাইয়া আমাকে সাইন্সে ভর্তি করালো সেটা নিয়ে ছোট ফুপির কি হাসাহাসি!! কি টিটকারি মার্কা কথা!!
মেজো ফুপি ততোদিনে নিজের করা ভুল বুঝতে পেরে গিয়েছে। বার বার আমাদের বাড়ি আসে যেনো আম্মু আব্বুর মন গলে আপুকে ভাইয়ার সাথে বিয়ে দেয়। কিন্তু আব্বু অনেক কস্ট পেয়েছিলো ফুপিদের সেদিনের কথায়। তাই এই বিয়ে আর হয়নি আর রিশাদ ভাইয়ার অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছিলো।
ফুপির সাথে যখন সাব্বির ভাইয়া আসতো, তখন ভাইয়ার হাব ভাব দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম একি কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে!!!!
সেদিন ছোট ফুপি আমাকে সাব্বিরের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে বলেছিলো এক মেয়ে দিয়ে পারে নাই তাই আর এক মেয়েকে পিছে লাগাই দিছে!!!!!!!
তাও আবার মেজো ফুপির সামনে আর ফুপি কিছুই বলেনি এর বিরুদ্ধে!!!!!
ভেবেছিলো হয়তো আমি কথাটা শুনতে পাইনি, কিন্তু সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য ক্রমে আমার কানেই কথাটা চলে এসেছে!!!
সাব্বিরের সাথে এর পর থেকে আর একটা কথাও বলিনি। যখন চিটাগং এ দুজনেই ভর্তি হলাম তখনও না। ওকে মাথা আর লাইফ থেকে দূরে রাখার জন্য ফয়সালের সাথে রিলেশনে জড়াই।
এর মাঝখানে অনেক বার ফুপিকে দিয়ে সাব্বির বাসায় বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে। কিন্তু আম্মু আব্বু কেউ রাজি হয়নি।
প্রিমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম,
বলতো প্রিমা আমার সাব্বিরকে বিয়ে কিংবা প্রেম করতে না চাওয়াটা কি অনেক বড় কোন দোষ ছিলো???
প্রিমা চুপ করে চোখে পানি নিয়ে অপরাধির মতো তাকিয়ে আছে।
তাহলে তুই এই কাজটা কিভাবে কর‍তে পারলি রে!!!!
“আমি কিছুই করিনি বিশ্বাস কর মেহের।” কম করে হলেও এই কথাটা প্রিমা বিশবার বলেছে আর কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ওকে বললাম,
-তুই কি বলবি কি করছিস না সরি কি বলছিস নাকি আমি চলে যাবো? আর তোর এই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কান্না দয়া করে বন্ধ কর। কি বলছিস সাব্বিরকে, একটু বল নারে ভাই প্লিজ……প্রিমা।
-আমি তো ঐরকম কিছুই বলি নাই। তোকে তো একবার বলছিলাম যে কি কথা হয়েছিলো।
-সব বলিস নাই তুই। যেগুলো বাদ গিয়েছে সেগুলো বল। আর এর আগে দয়া করে বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে আয়। কি করেছিস নাকের পানি বের করে!!! ছি…
আমি একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছি। লাস্ট আর একটা আছে।
-যা তো, তোর বাবার কাছ থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা নিয়ে আয়।
প্রিমা বাথরুমের দরজার সামনে হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-মুখ বন্ধ কর। মশা ঢুকবে মুখে। খালি মশা না আস্তো একটা তেলাপোকাও ঢুকতে পারবে।
ওয়াক ওয়াক করতে করতে প্রিমা বাথরুমে আবার ঢুকে গেলো।
মুচকি হেসে লাস্ট সিগারেটটা ধরালাম।
-কি হলো বাথরুমে আর কয়বার ঢুকবি? যা সিগারেট নিয়ে আয়। আমার গুলো সব শেষ।
“তুই এক প্যাকেট খেয়ে শেষ করে ফেলছিস!!!!” প্রিমার মুখ এবার শুধু হা না মস্ত বড়ো হা হয়ে গেলো।
-এবার কি মুখে ডায়নোসর ঢুকানোর চেষ্টা করছিস নাকি? তারাতাড়ি নিয়ে আয়।
-বাবা তো জেগে আছে। কিভাবে নিয়ে আসবো এখন? একটু পরে নিয়ে আসি?
-না। এখনি নিয়ে আসবি। এটা তোর শাস্তি। আরেকটা শাস্তি আছে। সেটা একটু পরে দিবো। আপাতত এটাই। পুরো প্যাকেট আনবি না। প্যাকেট খুলে দুইটা নিয়ে আসবি।
প্রিমা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারি ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। কিছু করতে পারছে না। অবশেষে রুম থেকে ও বের হয়ে গেলো।
টাকার বেপারে কি করবো মাথায় ঢুকছে না। সব মিলিয়ে ৮০ টাকার মতো আর আছে। ভালো লাগছে না আর এই প্যারা। সব ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে মনে চাইছে। এইরকম কারো লাইফ হয় কখনো!!! বিবাহিত মেয়েদের নাকফুল নাকি পড়তে হয়। শুধুমাত্র কবুল বললেই কি সব কিছু চ্যাঞ্জ করতে হয়? কবুল বলা ছাড়া আর তো কিছুই হয় নি। বিয়ের তিন মাসে সাব্বির হাতে গোনা দুএকদিন ছাড়া কথা পর্যন্ত বলেনি আমার সাথে। কিসের এতো জেদ ওর? ফালতু ছেলে একটা। হুদাই আমি ওর জন্য কস্ট পাই। তুই আমাকে কি দিবি, তোকেই আমি ডিভোর্স দিব। টাকা থাকলে ডিভোর্স পেপার এক সপ্তাহেই পাওয়া যাবে। সাব্বিরের বাচ্চা চার কোনাইচ্চা দাঁড়া, তোরে এর পরের বারই এসে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।
“বিরবির করে কথা বলার স্বভাবটা এখনো যাইনি। আচ্ছা তুই কি সারাদিনই বিরবির করিস?”
তাকিয়ে দেখি প্রিমা হাসিমুখে রুমে ঢুকছে। কি ব্যাপার!!
-আব্বু রুমে নাই, হি হি হি। এই নে তোর সিগারেটের প্যাকেট। তোর যে কয়টা লাগে নে বইন।
কিছু না বলে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম।
-সাব্বির ভাইয়া তো তোকে অনেক ভালোবাসে।
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম, কে বললো এই ঢাহা মিথ্যা কথা?
-সাব্বির ভাইয়াইতো বললো।
-কবে বললো?
মুখ কালো করে প্রিমা বললো, “ঐতো যেদিন ভাইয়ার সাথে কথা বললাম আরকি।”
-আর কি বলছে? আর কিভাবে কথা বলেছে?
-না মানে, আমাকে আগে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দিয়েছিলো, সাথে একটা ম্যাসেজও। বলেছিলো আমার সাথে নাকি তার ইমারজেন্সি কথা আছে আর এই ব্যাপারে যেনো তুই না জানিস।
“আর তাই তুইও আমাকে বলিসনি” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।
-আমি কি আর জানতাম এমন যে হবে।
জানিস প্রিমা গতকালকে আমি আমাদের পুরো বাড়িতে একা ছিলাম।
-কি বলিস!!!!! কিন্তু কেনো?
চিটাগং যাওয়া থেকে শুরু করে আজকে পর্যন্ত সব কাহিনী ওকে বললাম।
সব শুনে ও আবার কাদতে শুরু করলো, উফ!!! এই মেয়েটা এমন কেনো!!! বিরক্তিকর পুরো।
-আব্বুকে কালকেই বলবো এই মাসের মধ্যে যেনো আমাকে তাদের পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।
আমি হেসে দিয়ে বললাম তাহলে শিশিরের কি হবে?
আরে গাধি কার কপালে কি আছে তা আমরা কেউই জানিনা। দেখনা, এই গত কোরবানি ঈদে এই সময়ে আমাদের বাসায় আমরা আব্বু আম্মু সহ ছয় ভাইবোন ছিলাম সাথে তাদের দুই হালি অানডা বাচ্চা। আর আমি ছোট ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করতেছিলাম বেলা ১০টার সময়ে ওর জন্যে চালের রুটি বানানো লাগতেছে সে জন্য। আর আজকে দেখ, সব ভাইবোন থাকবে দূরে থাক, আমি সারা বাড়িতে একা ছিলাম!!!
একজনের কস্ট আর একজন কখনো বুঝতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঐ কস্টটা ফিল করে।
আর সাব্বিরও তো আমাদের সবার জানাশোনার মধ্যেই ছিলো।
শিশির অনেক ভালো একটা ছেলে। অন্তত ফয়সালের মতো কথায় কথায় গালি দেওয়া আর সন্দেহ তো করে না।
-সাব্বির ভাইয়াকে এইগুলোই বলেছি আমি।
-থাক প্রিমা আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছে না। শুনেইবা কি আর করবো বল। তার থেকে এখন তুই আমার জন্যে এক কাপ চা করে নিয়ে আয়। আর যদি পারিস তাহলে ঝাল করে একটু ভর্তা টর্তা বানা। বেশি করে ভাত খাবো। সকালে ভদ্রতা করে বেশি খেতে পারি নাই। আবার ক্ষুধা লাগছে আমার। এখন সব ভদ্রতা ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আনটিকে বল একগাদা ভাত খাবো দুপুরে। অনেকদিন পেট ভরে খাইনা।
আমার কথা শেষ না হতেই প্রিমা চোখ মুছতে মুছতে আমায় এসে জরিয়ে ধরলো।
-ছাড় আমায়, তোর নাকের পানি দিয়ে ভরাই দিচ্ছিস আমায়!!!! ছি!!
আর তোর চোখের সাথে কি পদ্মা নদীর কানেকশন আছে? এতো পানি কই থেকে আসে রে!!!
আমি কেন কাঁদতে পারি না তোর মতো!! এইরকম করে হাউ মাউ কাঁদতে পারলেও তো অনেক শান্তি পেতাম। জানিস আমার সব অনুভূতিগুলো মনে হয় মরে গেছে!!
অনেক ঢং দেখাইছিস। যা এখন, চা নিয়ে আয়। গতকালকে সারারাত ঘুমাইনি।
প্রিমা চলে যাওয়ার পর শুয়ে পরলাম। টাকার ব্যাপারটা কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।
প্রিমা চা নিয়ে আসার আগেই আমি ঘুম।
আম্মুকে আব্বুকে সপ্নে দেখলাম প্রথম বার!
কি সুন্দর তারা একটা দোলনায় বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে !! আমি দূর থেকে ঘুরে ঘুরে তাদেরকে দেখছি। এতো সুন্দর লাগছে তাদের দুজনকে!!
আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকলো। আমি কাছে যেতেই আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,” আল্লাহকে ভুলে গিয়েছ কেনো মামনি!! আল্লাহের উপর ভরসা করো। দেখবে সব কিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে। জোহরের নামাজের সময় চলে যাচ্ছে, নামাজ পড়ো মামনি।”
তারা আবার নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল হয়ে গেলো।
ঘুম ভাংতেই দেখি দুপুর ৩.৩০ বেজে গিয়েছে।
সত্যিই তো, বিয়ের পর নামাজ পড়ার কথা আমি ভুলেই গিয়েছি!!!
অনেক সময় নিয়ে নামাজ শেষ করলাম অনেকদিন পর!! দুহাত তুলতেই চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পরা শুরু হলো!!! চোখের পানি যেনো শেষই হচ্ছে না!!
এতো শান্তি লাগছে নামাজ পড়ে!!!
সত্যিই তো আল্লাহই সকল সমস্যার সমাধানকারি।
প্রিমা খাওয়ার জন্যে ডাকতে এলো।
-তুই যেই ঘুম দিয়েছিস!! তাই খাওয়ার জন্য আর ডাকিনি। আর লেট করিস না, আমি খাইনি এখনো। আর একজন অপেক্ষা করছে তোর জন্য।
মলিন মুখে বললো ও।
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করার আগেই ও বেরিয়ে গেলো।
কে অপেক্ষা করছে!!! আজব ব্যাপার!!
ডাইনিং টেবিলে হাসিমুখে সাব্বির অাংকেল অান্টির সাথে গল্প করছে!!!!
আমি এইখানে আছি সেটা কিভাবে জানলো নাকি প্রিমার বাসা কিভাবে চিনতে পারলো, কোনটা নিয়ে আগে চিন্তা করবো বুঝতে পারছি না!!!
চলবে
গল্পঃ ঝরা পাতার দিনগুলো
হাবিব
পর্ব -০৯
“দেখছো আম্মু বলছিলাম না মনে কস্ট নিবা না। জামাই কি সুন্দর চলে আসছে শশুরবাড়িতে তোমাকে নিতে। বোকা মেয়ে একটা, জামাই আসবে আগে বলবে না আমাকে!!! কিছুই তো আপ্যায়ন করতে পারিনি ভালো ভাবে। জামাই তো মাশাল্লাহ।
প্রিমা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আন্টির কথা শুনে। আমার রিয়াকশন বোঝার চেষ্টা করছে।
আন্টির হাসিমাখা মুখ দেখে অন্তর থেকে চাইছিলাম আরও অসংখবার উনাদের বাড়িতে সাব্বির কে নিয়ে আসি। এই বাসার ছাদে আমার আর প্রিমার বানানো মিনি উদ্যানে সাব্বিরকে জরিয়ে ধরে জোছনাবিলস করি।
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাম। জানালার বাইরে দিয়ে আসা হালকা রোদে সাব্বির থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না। আমি ভয়ংকর ভাবে সাব্বিরের প্রেমে পড়ে গিয়েছি!!! বুকের ভেতর কেমন চাপা একটা কস্ট তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কারণ এখন অক্টোবর মাস, জানুয়ারি থেকে আমার মার্স্টারস শুরু হবে।
কোনো ফ্রেন্ডের বাড়িতে এইভাবে কেউ জামাই আদর পেয়েছে বলে মনে হয়না। আমার সাথে কি কি দিয়ে দিবে শশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে সেটা নিয়ে দুই মা মেয়ে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে আছে!!! একটু পর পর এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আমার শশুর শাশুড়ী কি কি খেতে পছন্দ করেন!!!! আঙ্কেল বাজারে গিয়েছেন মৌসুমি সব ফ্রুটস কিনবেন বলে!! গতকালকের জন্য মন খারাপ করবো নাকি আজকের জন্যে খুশি হবো বুঝতে পারছি না।
ঝামেলার ব্যাপার হলো সাব্বির আমাকে এক মিনিটের জন্যেও ওর চোখের সামনে থেকে যেতে দিচ্ছে না। বিরক্ত চোখমুখ নিয়ে গেস্টরুমে ওর সামনে বসে আছি। কোনো কথাও বলছে না আমার সাথে। মিটিমিটি করে হাসছে শুধু। এই হাসি আর কিছুক্ষণ দেখলে নির্ঘাত উল্টো পালটা কিছু করে ফেলবো!!
ছি! কেমন হয়ে গিয়েছি আমি!! পাচ বছরের রিলেশনের কথা সব ভুলে গিয়েছি আমি!! বাট হোয়াই??
নাহ এইভাবে ভাবলে চলবে না। এই মায়ায় পরে গেলে ওকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না। মায়া বড্ড খারাপ জিনিস। একবার এই বাধনে জড়িয়ে গেলে পা পিছলে আবার পিছনে পড়ে যাবো!!
“আম্মু,এখন থেকে আমার দুই মেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, আর একটা বাকি। এই বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে যেনো তার বুড়ো বাবা মাকে দেখতে না ভুলে। পরের বার এসে এক সপ্তাহ জামাইকে নিয়ে থাকা চাই। এর কম হলে কথা বলবো না আমি। কেউ যেনো এই কথা মনে রাখে।” বিদায়বেলায় কান্নাভেজা চোখে আন্টির এমন কথায় উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আবার আসবো ওকে নিয়ে, ইনশাআল্লাহ।
হাসি মুখে উনাদের বিদায় দিলাম। শুধু প্রিমার মুখে হাসি নেই। আমার মনে মনে করা টেনশন করা গুলো ওর চোখেমুখে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ।
সাব্বির নিজেই ড্রাইভ করছে। গাড়িতে উঠেই আমি ঘুম। সাব্বির আর ফয়সালকে নিয়ে কয়েকটা সপ্নও দেখে ফেলছি!!!! কিন্তু কি দেখেছি ভুলে গিয়েছি।
চোখে লাইটের আলোতে ঘুম ভাঙতেই দেখি তিনশো স্কয়ার ফিটের আর একটু সামনে কোথাও খুব সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা নরমালি ঢাকায় কাচপুর দিয়ে ঢুকি। এদিক দিয়ে কেনো আসলাম কে জানে!!
সাব্বির চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-কিছু বলবা?
-নামো।
– আমি হিজাব পরিনি। নামতে পারবো না। মাগরিবের নামাজ মিস করে ফেলেছি, ডাকো নাই কেনো?
-তুমি কখন আমাকে ডাকতে বললে?
-ও বলি নাই!
এই প্রথম সাব্বির নরমালি কথা বলছে আমার সাথে!! খুশিতে কি কথা বলবো ওর সাথে বুঝতে পারছি না!!
-হিজাব লাগবে না। ওড়না ভালোভাবে পেচিয়ে বের হও।
নামাজ পরার মতো করে ওড়না দিয়ে বের হলাম। রেস্টুরেন্টটা সত্যিই অনেক সুন্দর। খুশি হওয়ার বদলে ভয় হচ্ছে কেনো জানি। সাব্বিরের সাথে একা কোথাও যাইনি এর আগে। কেমন কেমন জানি লাগছে।
একজন ওয়েটার এসে সাব্বিরকে স্যার স্যার করে টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গেলো। আজব তো!!!
সন্দিহান চোখে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছি। হালকা পিংক কালারের সাথে হলুদ রঙের মিশ্রণের অসাধারণ এক কম্বিনেশনের আলোতে সাব্বিরকে ভয়ংকর রকম সুন্দর লাগছে!!
মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে!! সাব্বির তো আমাকে আমার মতো করে ফিল করে না এই ভেবে দুচোখ হঠাৎ পানিতে ভরে গেলো। কতটা কস্ট হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না। হৃদয় কাঁপানো প্রেমটা তাহলে আমার হয়েই গেলো!!! ফয়সালের জন্যে কখনো আমার এই অনুভূতি হয়নি।
অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি লুকোনোর চেষ্টা করছি।
“কি দোস্তো, ভাবিকে নিয়ে এতো সুন্দর রেস্টুরেন্টে তো ভালোই মজাই আছো”। অপরিচিত কারো গলার স্বর শুনে তাকালাম কিন্তু কে চিনতে পারলাম না। হয়তো সাব্বিরের কোনো ফ্রেন্ড হবে।
-ভাবি…….. আপনার থুতনির খাজে মরে গিয়েছি। আর ঠোঁটের নিচে তিল, ঠোঁটে তিল, ইশ!! ভাবি ইশশশ,,,!! হাসলে দেখি গালে ডিম্পলও পড়ে!!!!! সব প্রেমে পড়ার সাইন একসাথে!!! সাব্বির তো মনে হয় আপনার প্রেমে মরে ডুবে বঙ্গপোসাগরের তলায় চলে গিয়েছে।
কেনো যে আপনার সাথে সাব্বিরের আগে আমার দেখা হয়নি!!! ধুর, কি করলাম জীবনে!!
আপনি যতগুলো কথা এখন বলেছেন তার সিকিভাগও যদি সাব্বির আমাকে বলতো, হাসিমুখে সারাজীবন ওর মেন্টাল টর্চার গুলো সহ্য করতাম আমি। মনে মনে কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে মুচকি হেসে বললাম ভালো আছেন ভাইয়া?
-ধুর, খেলা শুরুর আগেই আপনি আমাকে ডিস্কোয়ালিফাইড আর সাব্বিরকে উইনার বানাই দিলেন। এটা ঠিক না ভাবি।
“কাজের কথায় আসি। তারাতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।” সাব্বিরের কথায় রাগের আভাস পেয়ে প্রচন্ড ভয় পেলাম আমি।
-বন্ধু তোমার বউ নিয়ে কেউ ভেগে যাবে না আর সেই চিন্তা করার সাহসও কেউ করবে না।
ওয়েটার খাবারের অর্ডার নিয়ে চলে গেলো।
“খাবার আসার আগেই কাজের কথা শেষ করি। শুভ আমরা দুজন ডিভোর্স চাই। যত তারাতাড়ি সম্ভব।”
ওর ফ্রেন্ড অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
আর আমার কথা না হয় নাইবা বললাম। অবচেতন মন হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিলো এমন কিছু একটা হবে, তাইতো আরও বেশি কস্ট পাওয়ার জন্যে এই ধোয়াশাময় গভীর প্রেমে ক্রমান্বয়ে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি
“কেন ডিভোর্স হচ্ছে, আবার চিন্তা কর, আমার মাথা ঠিক আছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি এই টাইপ কোনো প্রশ্ন আমাকে করবি না। আর মেহেরকেও এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবি না।” শুভ ভাইয়া কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আবার সাব্বিরের দিকে তাকাচ্ছে।
থাইগ্লাস ভেদ করে বাইরের আলোতে ময়লা পোশাক পরিহিত একজোড়া বয়স্ক দম্পতিকে দেখতে পাচ্ছি। কি হাস্যজ্জ্বোল ভাবে তারা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে মহিলাটি পুরুষ লোকটিকে খাইয়ে দিচ্ছে!!! লোকটি বার বার মাথা ঝাকিয়ে নিষেধ করছে সে হয়তো খাবে না আর মহিলাটিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মহিলাটি জোর করেই বার বার লোকটির মুখে লোকমা তুলে দিচ্ছে।
আর আমরা মাত্র অর্ধেক জীবন পার করা ভীষন অসুখী মানুষদুটো এই দামী রেস্তোরাঁয় জীবনের হিসাব চুকাতে ব্যস্ত।
ওদের দুজনের কথায় আমার খেয়াল নেই। খেয়াল করেই বা কি করবো, যা কিছু হচ্ছে কোনোটাই তো আর আমার ইচ্ছে মতো হচ্ছে না। আমি ওদের হাতের পুতুল মাত্র। ওদের হাত দিয়ে শুরু হওয়া খেলাটা না হয় ওদের হাতেই শেষ হোক। এর পর এদের কারোরই আমার জীবনে স্থান নেই।
সামনে খাবার আসতেই খুব নরমাল ভাবেই সাব্বির খাওয়া শুরু করলো। শুভ ভাইয়া ইতস্তত করছে। হয়তো কি করবে বুঝতে পারছেন না তিনি। কিছুক্ষণ বাদে তিনিও শুরু করলেন। বেচারার আর কি দোষ, কেউ তো আর কারো জন্য থেমে থাকে না।
“এক্সকিউজ মি, আমার খাবারটা একটু পারসেল করে দেওয়া যাবে ?” আমার কথা শুনে সাব্বির ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো।
“শিউর ম্যাম”। বলেই স্মিত হেসে ওয়েটার চলে গেলো।
“ডিভোর্স হলে তো আমার কাবিনের টাকা টা আমি পেয়ে যাবো তাই না?” এবার সাব্বির বিষম খেলো কথা শুনে। আমি আর একটু ওকে বিষম খাওয়ানোর জন্য বললাম, ক্যাশ দিলেই ভালো হয়। ব্যাংক থেকে চেক ভাঙানো ঝামেলার ব্যাপার।
কাশতে কাশতে সাব্বিরের চোখে পানি চলে আসছে। শুভ ভাইয়া ওর পিঠে চাপর দিয়ে সামলানোর চেষ্টায় আছে।
ইচ্ছে করেই সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করলাম না। কি হতো যদি আজকের সন্ধ্যাটা আমার আর তোমার হতো? খুব তো প্রিমার থেকে আমার রিলেশনের দুর্বল দিক গুলো জেনে ভেঙে দিয়েছো। তোমাকে দেখানোর জন্যে হলেও ফয়সালের সাথে আমি কথা বলবো আবার। এই দুমাসে তোমাকে আমি কি পরিমাণ যন্ত্রণা দিয়ে যাবো, সেটা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
-ভাইয়া, যদি পারেন এই মাসের মধ্যে ডিভোর্স টা যেনো হয়ে যায় সেটার চেষ্টা একটু করে দিয়েন। আমার একটু আরলি দরকার আরকি।
সাব্বির কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুঝতে চেষ্টা করলাম না সেটা। কি হবে আর এতো বুঝে।
-ভাই তোমাদের এসব কান্ড কারখানার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। বিয়ের ৩ মাসের মাথায় যদি ডিভোর্সই লাগে তাহলে বিয়েটা করেছ কেন তোমরা?
এতোই যদি তাড়া থাকে তালাক দিয়ে দে তুই। একমাস কেনো, এই মুহুর্তে সেপারেশন হয়ে যাবে।
“ওয়াও!!!” এইটা তো আমার মাথাই আসে নি!!! একেবারে বাইন তালাক দিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ!!!!
ওকে, ভাইয়া ডান। ডিভোর্স টিভোর্স এইগুলোর ঝামেলা তাহলে বাদ। তালাক হওয়াটাই ব্যাটার। আমি তো আর দিতে পারবো না, আপনার ফ্রেন্ড কে বলেন তারাতাড়ি কাবিনের টাকা সহ তালাক দিয়ে দিতে।”
আমার এতো খুশি হয়ে তালাক চাইতে দেখে শুভ ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আর সাব্বির অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে আছে!!!
“আমার ডিভোর্সই লাগবে। তুই এই মাসের মধ্যেই ব্যবস্থা কর” রাগে দাত কিড়মিড় করে আমার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বললো ও।
আল্লাহই জানে আজকে বাসায় কি আছে কপালে!! জোড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
-ঠিক আছে ভাইয়া, ও যেহেতু চাইছে তাহলে ডিভোর্সই হোক। বাট যেটাই হোক কাবিনের টাকাটা আমার এই মাসেই লাগবে, আপনার ফ্রেন্ডকে বলে দেন এটা।
এর পর আর দুজনের কেউই আর খেতে পারলো না। আহারে!
বাইরে এখনো সেই বৃদ্ধ দম্পতি বসে আছে। খাবার প্লেট হাতে নিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে মহিলাট কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করছে আর লোকটি খুব রাগ দেখাচ্ছে মহিলার প্রতি।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে ওরা দুজন সামনে হাটছে আর আমি একটু পিছনে।
“মা এটা আপনাদের জন্যে। আর একটু দোয়া কইরেন আমার জন্যে ” বৃদ্ধ মহিলার হাতে পারসেল টা দিতেই খুশিতে সবকয়টা দাত বের করে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন
-আইজকা আফনাদের বিবাহ বার্ষিকি বুঝি আম্মা? দোয়া করি আফনেরা ভালা থাকেন।
-না আম্মা আজকে আমাদের আলাদা হওয়ার দিন।
বলেই হনহন করে সামনের দিকে হেটে চলে এলাম। সাব্বির আর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি তখনো বৃদ্ধ মহিলাটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কান্না পাচ্ছে শুধু শুধু। চোখের পানি লুকানোর জন্য গাড়িতে গিয়ে পিছনের সিটে বসে পরলাম।
ওর ফ্রেন্ডকে বিদায় দিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো।
“হয় সামনের সিটে এসে বসো না হয় নেমে যাও।”
একটা মানুষ এমন হতে পারে?
চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে সামনে হাটা ধরলাম।
মরে যেতাম এক্সিডেন্ট করে, খুব ভালো হতো। কালকেই চিটাগং চলে যাবো যেভাবেই হোক। অসহ্য লাগতেছে এইখানে। সাব্বিরের চেহারাটা দেখলেই বুকের ভেতর কেমন যে লাগে বলতে পারবো না কাউকে। বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বালের ভালোবাসা আমার, কুত্তার বাচ্চা একটা, দুনিয়ার যতো গালি আছে সব বিরবির করে দিতে দিতে বিকাশের দোকানে গেলাম।
ভাগ্যিস প্রিমার কাছ থেকে বিকাশে এখহাজার টাকা নিয়েছিলাম।
টাকা উঠিয়ে সিএনজি ঠিক করে বাসার সামনে এসে নামতেই দেখি সাব্বির গাড়িতে বসে আছে।
বাহ্!!!!!!
ওকে দেখে ঘেন্না হচ্ছে কেমন জানি।
বাসায় ঢুকতেই ফুপি জড়িয়ে ধরে বললো, এতো দেরি করলি কেনো? রাত ১১.৩০ বাজে খেয়াল আছে সেটা?
-তোমার ছেলেকে জিগ্যেস করো কেন দেরি হইছে। ফ্রেশ হয়ে আসি বলেই উপরে চলে এলাম।
সেই তিনশো স্কয়ার ফিট এর এইখান থেকে ধানমণ্ডি পাঁচ!!! একা একা সিএনজি তে উঠি নাই কখনো। এই সাব্বিরের জন্যে আরও যে কি কি করতে হবে আল্লাহ মালুম।
ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগানোর আগেই সাব্বির ঢুকে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে শাওয়ার ছেড়ে দিলো!!!
-মা* একটা!! তোর লাজ লজ্জা কিছুই নাই তাই না? সব ফয়সাল কে দিয়ে আসছিস!!!! খুব শখ আজকে তালাক নিয়ে কালকে থেকে ওর সাথে শুবি?? তুই এমন কেনরে!!! আমাকে কোনোদিনই বুঝলি না!!
বলেই ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো!!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই এতো গুলো জিনিস ঘটে গেলো, মনে হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে গেছে!!!
রাতে সাব্বির আর রুমে আসেনি। ফয়সালের কথা মনে পরছে খুব। গুগল ড্রাইভে রাখা স্মৃতি গুলো ওর আর আমার পাঁচ বছরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। গত ৫ মাসে কতো কিছু বদলে গিয়েছে আমার জীবনে!! প্রথমে আম্মু মারা গেলো, এর দুমাস পর আব্বু, এর তিনদিন পর ফয়সাল ব্রেকাপ করলো আর এর পর এই অসহ্যকর জীবন শুরু।
ফ্লোরে বসে লাগেজ থেকে বের করে ফয়সালের দেয়া কিছু গিফট বের করলাম। ঘড়ি, ব্রেসলেট, পায়েল, চুড়ি, কানের দুল, মালয়শিয়া থেকে নিয়ে আসা কতো মেকাপ, ১৩টা কিটক্যাট,৫টা ডেইরি মিল্ক,। এই সব জিনিস গুলো আব্বু মারা যাওয়ার আগে ঢাকায় আসার সময় দিয়েছিলো। আরও অনেক জিনিস হলের লকারে রাখা আছে। আমার বেশিরভাগ জিনিসই ফয়সালের কিনে দেয়া। শুক্রবার খুব সকালে আমি আর ও মিলে বাজারে যেতাম। দুপুরে নামাজ পড়ে আমার কাছ থেকে খাবার থেকে হলের নিচে আসতো। প্রতি বার আসার সময় একটা করে কিটক্যাট নিয়ে আসতো আর যাওয়ার সময় হাতে অল্প করে চাপ দিয়ে যেতো। বলতো এটা নাকি ভালোবাসা।
কেমন করে পারলে তুমি ফয়সাল??!!!!!!!
জিনিস গুলো বুকে জড়িয়ে ধরতেই দুচোখের নোনা পানির স্রোতের যেনো বাধ ভেঙে গেলো!!!
এতো মায়া ছেড়ে চলে যেতে কিভাবে পারলে ফয়সাল!!!!
কতোক্ষন কেদেছিলাম মনে নেই। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই চোখ মেলে দেখি রিশাদ ভাইয়া চোখে পানি নিয়ে সামনে বসে আছে।
“ভাইয়া জানো, এই সব জিনিস গুলো না ফয়সাল দিয়েছিলো, আমার প্রায় সব জামা কাপড় ওর সাথে গিয়ে কেনা। এইযে আমি পরে আছি সেটাও। হলের লকার পুরোটা ভরা ওর দেয়া জিনিস দিয়ে। এইযে হাতের রিং এটাও না ফয়সালের দেয়া,মালয়শিয়া থেকে কিনে নিতে এসেছিলো। এখনও হাতে আমি এটা পরি।
ও কেন আমার সাথে এমন করলো ভাইয়া!!!???
কেউই আমাকে ভালোবাসে না। ভালো না বাসুক কস্টও না দিতো আমায়!!!”
কাঁদতে কাঁদতে কথা বলে ফ্লোরে শুয়ে পরলাম। আমার কান্না দেখে ভাইয়াও কাঁদছে!!
-তোকে দেখে কোনোদিন তো বুঝতেও পারিনি তুই এতোটা কস্টে আছিস!! তুই তাহলে সাব্বিরকে বিয়ে কেনো করলি!!! ফয়সালের জন্যে অপেক্ষা করতি!!
-ফয়সাল যদি বিয়ের পরে এসেও আমার কাছে এসে সরি চাইতো, আমি হয়তো ওর হাত ধরেই চলে যেতাম। পাঁচ বছর সম্পর্কের পর আমাকে বলে আমি নাকি পছন্দের মানুষের সাথেই নাকি বিয়ে করেছি!!!
আমি মরিচিকার পিছনে ছিলাম ভাইয়া।
আর একজন কেন আমাকে বিয়ে করেছে তাই সে জানে না!!!!
জানো ভাইয়া, আজকে আমাদের পাঁচ বছরের এনিভার্সারি ছিলো!!!
আরও কতো কিছু বলে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পরলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সামনে জিনিস গুলো নেই!! হয়তো লাগেজ অথবা ড্রয়ারে আছে।
কিন্তু কোথাও নেই। সবথেকে অবাক করা ব্যাপার হলো আমার পরনের রাতের ড্রেসটার বদলে এখন অন্য একটা ড্রেস যেটা আমি আগে কখনও দেখি নি!!!
আম্মু ঠিকই বলতো, আমি সত্যিই মরার ঘুম ঘুমাই। ঘুমের মধ্যে কেউ সেক্স করলেও মনে হয় বুঝতে পারবো না। না হলে কি আর কেউ ড্রেস চ্যাঞ্জ করেছে আর আমি টের পাইনি, এটা তো গল্প ছাড়া পসিবল না!!!!
আমি কি এখানেও ঘুমের মধ্যে কান্নাকাটি, চিৎকার কিংবা রুম থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করি!!! সর্বনাশের ডিব্বা !!!
মাঝরাতে কেউ আমার চিৎকার আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুনলে কি ভাববে!!??? আমি তো এইগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম!!! তার থেকে তো ড্রেস চ্যাঞ্জ নরমাল জিনিস!!!
কারোও কাছে তো এসব জিগ্যেসও করা যাবে না!!!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরও কিছুক্ষন বিরবির করে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম।
এলোমেলো ভেজা চুল গুলো ওর কপালের একপাশের অর্ধেকটা ঢেকে দিয়েছে, সাথে নেভি ব্লু টি শার্ট আর চেক ট্রাওজারে এতো স্নিগ্ধ লাগছে!!!!
একটা হার্টবিট মিস করলাম মনে হলো!!
আমি না রাতে ফয়সালের কথা মনে করে কান্নাকাটি করেছি!!! ছি!!!!
মানুষের মন এমন কেন?? যে কস্ট দেয় তাকেই বেশি মনে চায়?
আচ্ছা সাব্বির কি আমার থেকে ফর্সা নাকি সেইম হবে, বোধহয় সেইমই হবে। ধুর, কি সব ভাবছি আমি। ও আমার থেকে ফর্সা হলে কি হবে, আমার যা যা আছে ওর কি তাই তাই আছে নাকি!!
হুমহ্, কয়টা মেয়ের কোমড় অব্দি স্ট্রেইট, লম্বা আর হালকা ব্রাউনিশ কালার চুল আছে? তাও আবার উইদাউট এনি হেয়ার কালার?
যদিও এই প্রথম চুল এতো লম্বা হলো!!! আমার চুল তো থাকে পিঠ অব্দি। লাস্ট প্রায় ৮ মাস ধরে চুল কাটি না!!!
ইয়া মাবুদ!!! সাব্বির গোসল করেছে কেন? তাহলে কি সব হয়েই গেলো!!!
ধুর, কি ভাবছি আমি, এতোটা গাধি তো আর না যে কিচ্ছুটি টের পাবোনা। রাতে কিছুই হয়নি আমাদের মাঝে এই বলে নিজের মনকে বুঝ দিলাম। কিন্তু ড্রেস চ্যাঞ্জ নিয়ে একটা খুতখুতানি মনে থেকেই গেলো।
সাব্বিরের ফেস টু ফেস না হওয়ার জন্যে ইচ্ছে করেই ওর পাশের চেয়ারে বসে পরলাম।
“এই সব দাগ টাগ বানাই এখনকার পোলাপান যে কি ভালোবাসা বুঝাইতে চায় আল্লাহ তায়ালা ভালো জানে। এই দাগের মধ্যে কিসের এতো ভালোবাসা?”
বিরক্ত মুখে কথা গুলো বলে ফুপি কিচেনে চলে গেলো।
খাবার মুখে তোলার আগেই খাওয়া স্টপ হয়ে গেলো আমার।
কি বলে গেলো ফুপি!!! কোথায় দাগ! কিসের দাগ!!!
এর মধ্যেই ফুপা এসে আবার বেসিনে হাত ধুচ্ছে।
ভালোভাবে ওড়না দিয়ে ঢাকতে গিয়ে আবার ছেড়ে দিলাম।
সাব্বির ছেলেটা এমন কেনো?!!!!
একপাশের পুরো অর্ধেক ওড়না হাতের সাথে পেচিয়ে বসে আছে!!!
বাকি অর্ধেক মাথায় দিতে গেলে গায়ে থাকে না গায়ে দিতে গেলে মাথায়।
আর গলায় ভালো ভাবে দিতে গেলে ও হালকা টান দিয়ে বেসামাল করে দিচ্ছে।
নিচু স্বরে কঠিন কয়েকটা গালি দিলাম।
গালি শুনে কিছুক্ষণের জন্য ওর খাওয়া বন্ধ হলেও ওড়না ছাড়েনি।
“তোর তো লজ্জা শরম সত্যিই চলে গেছে। বলার পরেও বের করে বসে আছিস!!! ” চাপা গলায় ফুপি আবার আমাকে বললো।
তুমি নজর না দিলেই তো পারো, শুনে ফুপি রসগোল্লার মতো চোখ পাকিয়ে কিচ্ছুক্ষন তাকিয়ে ফুপাকে বললো
-এইখানে খেতে হবে না। কিছুক্ষণ পর এইখানে বাংলা সিনেমা শুরু হবে।
“কিসের বাংলা সিনেমা? ঐটা তো সব চ্যানেলে ১০টা থেকে শুরু হবে। আজকে সালমান শাহ এর একটা মুভি হবে এনটিভিতে। সবাই মিলে দেখবো।” হাস্যজ্বল মুখে ফুপা বললো।
-এই সিনেমা সবসময়ই দেখতে পাবা, রুমে চলো।
খাদিজার মা, রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দে। এদের জন্য এখন থেকে রুমেই নাস্তা করতে হবে। যত্তসব আকামের ঢেকি।
“রুমে কেনো নাস্তা করতে হবে? একসাথে সবাই মিলে করি, বাংলা সিনেমা কই হবে… “, আরো নানা রকম প্রশ্ন করতে করতে ফুপা ফুপির পিছন পিছন রুমে চলে গেলো।
গলা দিয়ে খাবার আর নামছে না। কি সব বলে গেলো ফুপি!! তাহলে কি কালকে রাতে সত্যিই কিছু….
সমস্ত শরীরে কেমন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো।
কান্না পাচ্ছে খুব। বাম হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলাম। এবার আর সাব্বির আটকানোর চেষ্টা করলো না।
সবার সামনে আমাকে ছোট করার ভালোই খেলা চলছে!!! এতো কিছুর পর যখন আমাদের ডিভোর্স হওয়ার কথা সবাই জানবে, দোষটা সরাসরি আমার দিকেই তো আসবে!!! কারণ ফয়সালের ব্যাপারটাও ততোদিনে সবাই জেনে যাবে।
ফয়সালের পাগলামি গুলো শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু ওর এই বাসায় আসার অপেক্ষা। সব দিক থেকেই আমাকে ঝামেলায় ফেলার ভালোই চেষ্টা চলছে!!!
ঝামেলায় পরি আর যাই করি, আমি তো সারাজীবনের জন্য তোমার থেকে দূরেই চলে যাচ্ছি!! এই দুইটা মাস কি সহ্য করতে পারলে না!!
ভার্সিটিতে ফয়সাল সবার কাছে উল্টো পালটা কথা বলে আর এই দিকে তুমি এসব করছো, আমি কস্ট পেলে তোমাদের কি লাভ যাওয়ার আগে এই উত্তরটাই আমি জেনে যাবো।
আমি কাউকেই কিছু বলবো না। তোমাদের ভুল গুলো যখন বুঝতে পারবে তখন সরি বলার জন্যেও আমাকে খুজে পাবে না। আজীবনের জন্যে এই শাস্তিটাই তোমাদেরকে দিয়ে যাবো।
গলায় আর ঘাড়ের একটু নিচে মিলিয়ে মোট ৬টা কালচে হয়ে যাওয়া দাগ আছে। গত বিশ মিনিট ধরে ওয়াশরুমে একবার গরম পানি আবার ঠান্ডা পানি দিয়ে এগুলোর উপর ভা?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here