#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#চতুর্থ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে আমার পরিবারের প্রত্যেকের কাছে খুবই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলো। আমার ছোট বোন দুইটা তাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। তাদের কাছে ছেলেটা ছিলো ‘দি গ্রেইট আরজু !’ এমন অভদ্র একটা ছেলে কি করে ওদের কাছে ‘দি গ্রেইট’ উপাধি পেলো আমি জানি না। অবশ্য এর পেছনে একটা শক্তপোক্ত কারন ছিলো। ওদের সব সমস্যা সমাধান সে কিভাবে যেন করে ফেলতো। এত বড় একটা ছেলে, অথচ রোজ বিকেলে ওদের সাথে খেলতো! নেহা আর নয়না কে দুইটা নামে ডাকতো সে। নেহাকে ডাকতো নীহারিকা আর নয়নাকে ডাকতো ময়না। মেয়ে দুইটাও বেশ উপভোগ করতো।
রাতবিরেতে এসে চিল্লাতো ‘নীহারিকা বুড়ি, ময়না পাখি’ কই? এদিকে আসো, এদিকে আসো। ডাকটা তাদের কানে যেতে দেরি, লাফিয়ে তার কাছে চলে যেতে দেরি নেই। ঘুমিয়ে থাকলেও কিভাবে যেন আলাপ পেয়ে যেত। তার এই রাতবিরেতে ডাকার কারন খুঁজতে গেলে দেখা যেত, চটপটি, ফুসকা, পানিপুরি হাবিজাবি নিয়ে আসতো। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়ে যেতো মেয়েগুলো।
আমার সহ্য হতো না। এমন একটা ছেলে কেন কারো প্রিয় হবে? আমার কাছে তার সুনাম করতে আসলে যখন ধমকাতাম তখন ওরা বলতো, আমি হিংসুটে, ঝগড়ুটে, খারাপ তাই তাকে সহ্য করতে পারি না। ওদের মতে, তার মতো ‘দি গ্রেইট ধোয়া তুলসিপাতাকে’ অপছন্দ করা শুধু অপরাধ না, ভয়াবহ অপরাধ!
আমার পরিবারের আমি বাদে সবার চোখের মনি হয়ে উঠলো সে।
আমার পরিক্ষার আগে থেকে তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে পড়ানোর। আমার আম্মু আব্বুর ধারনা, তার মতো ব্রিলিয়েন্ট ছেলের সংস্পর্শে থাকলেই নাকি আমার রেজাল্ট মারাক্তক ভালো হয়ে যাবে। আমি মানলাম না। তার কাছে কিছুতেই পড়বো না বলে জিদ ধরলাম। কেউ না জানুক, আমি তো জানি সে কেমন! ওই ছেলে আমার ধারে কাছে আসলেও আমার পড়াশোনা চান্দের দেশে চলে যাবে। আমি আম্মুর সাথে চিল্লামিল্লি করে জানালাম, তার কাছে পড়া, আমার পক্ষে সম্ভব না, কখনো না, কিছুতেই না। হায় কষ্ট! আমার আম্মাজান আমাকে এক গাদা কথা শুনালেন। চিল্লাতে চিল্লাতে বললেন, আমি হচ্ছি পৃথীবির সবচাইতে বড় ফাঁকিবাজ। আমার থেকে বড় ফাঁকিবাজ আর একটিও নেই। পরিক্ষা নিশ্চিত ফেইল মারবো। ফেইল করার নাকি খুব ইচ্ছে! যার ফলে তার কাছে পড়তে চাচ্ছি না!
শেষমেশ বাধ্য হয়েই তার কাছে পড়তে রাজি হতে হলো। এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ছেলেটা আসলেই ভালো পড়ায়। আরো বেশি অবাক হলাম, পড়ানোর সময় তার ভিন্নরূপ দেখে। একটা বারের জন্য আমার দিকে তাকায়ও না। অন্য কোনো কথাও বলে না। এই জিনিসটা ভালো লেগেছে খুব।
একদিন পড়া শেষে তাকে বললাম,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
সে হাসলো। একটু ভাব নিয়ে বলল,
“উমম, একটাই? বেশি জিজ্ঞেস করবা না তো?”
আমি কপাল কুঁচকালাম। উনি চট করে আমার বিরক্তি টা ধরে ফেললেন। বললেন,
“এই ফুল? তোমার কি আগাগোড়া রাগে ভর্তি? ঠুসঠাস রেগে যাও। আমি কিন্তু খুব ভয় পাই। ছোট একটা বাচ্চা মেয়েকে ভয় পাই, এটা যদি কেউ জানতে পারে তবে আমার মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি পরে যাবে। সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার!”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,
“শোনেন? আমি মোটেও বাচ্চা না। চার মাস পর সিক্সটিন শেষ হবে।”
উনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন,
“ওহ শিট! তবে তো তুমি অনেক বড়। বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে তো, না?”
আমি কিড়মিড় করে তাকাতেই বললেন,
“আচ্ছা রাগতে হবে না। বলো কি জানতে চাও?”
আমি মুখ বাঁকালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“আমার জানামতে যারা ব্রিলিয়েন্ট তারা একটু চুপচাপ, নম্রভদ্র হয়। পড়াশোনা ব্যাতিত উল্টাপাল্টা কোনো চিন্তা তাদের ধ্যানজ্ঞানে ঠাঁই পায় না। টাইম ম্যানটেইন করে চলে। কিন্তু আপনি তো আগাগোড়া অভদ্র একটা ছেলে। চিন্তার চাইতে অচিন্তা বেশি ঘোরে আপনার মাথায়। মুখের লাগাম নেই। বেশরম, টাইম-টেবিলহীন মানব! আপনার সাথে ব্রিলিয়েন্ট ট্যাগটা মিলাতে পারছি না। ভুল করে ব্রিলিয়েন্ট হয়ে গিয়েছেন বোধহয়!”
আমার কথা শেষ হতে না হতে সে হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে আমার কাছে ঝুঁকল। নাকের ডগায় আঙুল ছুঁয়িয়ে বলল,
“তবুও ভালোবাসি ফুল।” বলেই সে চলে গেলো।
আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমি বললাম কি আর সে বলল কি! সেদিন-ই কনফার্ম হলাম এই ছেলে যে আসলেই পাগল, সেই সাথে ভয়ংকর বেয়াদপ।
এরপর আসলো আমার পরিক্ষা। আম্মু আব্বুর এতোই আস্থা জন্মালো তার উপর যে, আমাকে হলে নিয়ে যাওয়া ও দিয়ে আসার দায়িত্ব পড়লো তার উপর। সে তো মহাখুশি। সানন্দে গ্রহন করলো তার দায়িত্ব। অন্যদিকে আমি মহাবিরক্ত আম্মু আব্বুর উপর। দুঃখি দুঃখি মন নিয়ে ভাবলাম, আমার আম্মু-আব্বু কি এই অভদ্র ছেলেটার নামে আমায় পার্মানেন্টলি লিখে দিয়ে দিচ্ছে? আমার কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছার মূল্যই দিচ্ছে না, কি আশ্চর্য!
বাইক আমার অপছন্দের। সারাক্ষণ-ই মনে হতে থাকে, ‘এই বুঝি পড়ে যাবো।’
কাঁদো কাঁদো মুখ করেই বাইকে উঠে বসলাম। তাকে সাবধান করে দিলাম, ধীরে ধীরে চালায় যেন। হুটহাট ব্রেক করলে আমি পড়ে যাবো। মরে-টরে ও যেতে পারি। এত জলদি তার কারনে মরে গেলে ‘পেত্নী হয়ে ঘার মটকাবো’ বলেও হুমকি দিলাম। আমার হুমকি সে বরাবরের মতোই হেসে উড়িয়ে দিলো। পেছন ঘুরে বলল,
“তুমি এত ভীতু জানতাম না তো। হেলমেট টা পড় আর আমায় শক্ত করে ধরে বসো ফুলটুসি।”
আমি রেগেমেগে বললাম,
“হেলমেট-টেলমেট পড়তে পারবো না। দম বন্ধ, দম বন্ধ লাগে। শক্ত করে ধরবো মানে কি, হু? অসভ্য!”
উনি হাসলো। জোর করেই হেলমেট পড়িয়ে দিলেন। তারপর খুব স্লো ভাবে বাইক চালাতে চালাতে বললো,
“তোমাকে কেন আমার বেশি ভালো লাগে জানো?”
আমার উত্তরে অপেক্ষা না করেই বললেন,
“কারন তুমি খুব বেশি ম্যাচিউর। ছোট একটা মেয়ে কিন্তু যথেষ্ট ম্যাচিউর। বাগানের সবচেয়ে নজরকাড়া ম্যাচিউর ফুল।”
ভালো লাগলো আমার। যতই রাগ দেখাই, সে তো আর জানেনা তার এই আজব আজব কাজকর্ম আর কথাবার্তা কত ভালোলাগে। জানতে দেয়া যাবেও না। ভাব বেড়ে যাবে না? তার শার্টের কর্নার একটু করে ধরলাম। ‘পড়ে গিয়ে যদি হাত পা ভেঙে ফেলি’ সেই ভয়ে। উনি বললেন,
“এমন ভাবে ধরেছো যেন, আমার শরীরের সাথে তোমার হাত লেগে গেলেই শক খাবা! ডোন্ট ওয়ারি শক খাবা না। ঠিক করে ধরে বসো।”
আমার একটু রাগ হলো। তক্ষুনি একটা ইমম্যাচিউর কাজ করতে ইচ্ছে হলো। তার কাঁধে হাত রেখে অন্য হাত দিয়ে চিমটি কাটলাম। আশ্চর্য! তার কোনো প্রতিক্রিয়াই নাই। পরপর দুই তিনটা চিমটি কাটার পরও যখন তার কোনো প্রতিক্রিয়া পেলাম না তখন আমি বলে উঠলাম,
“এই বাইক থামান, বাইক থামান।”
উনি বাইক থামালেন সাথে সাথেই। আমি বাইক থেকে নেমে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। হেলমেট খুলে কোমড়ে হাত রেখে বললাম,
কি সমস্যা আপনার?”
উনি আকাশ থেকে পড়ার মতো ভান ধরে বললেন,
“কই, কি সমস্যা? কোনো সমস্যা নেই তো!”
“কোনো সমস্যা নেই মানে! ব্যাথা পান না আপনি? লোহার শরীর নাকি, আজব!”
প্রায় সাথে সাথে সে আমার হাত টেনে কাছে নিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,
“এই মুহূর্তে একটা কাজ করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, নেহাৎ ভালো ছেলে তাই বেঁচে গেলা। চুপচাপ উঠে বসো। নয়তো তিনটা চিমটির বদলে ছয়টা…..!”
উনি কথা শেষ করার আগেই আমি চটজলদি বাইকে উঠে বসলাম। এই ছেলের দ্বারা সব সম্ভব! সত্যি উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসতে পারে! একে আমার একটুও বিশ্বাস নেই।
অটোমেটিক মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেড়িয়ে আসলো,
“অসভ্য।”
সে বাইক স্টার্ট দিলো আর গগনবিদারী হাসিতে ফেটে পড়লেন। তার সেই অসহ্যকর হাসি যতবার আমার কানে আসছিলো ততোবারই বাইক থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়ার তুখোড় ইচ্ছে জাগ্রত হচ্ছিল মনে, মস্তিষ্কে। একটা মানুষ এত অসভ্য কি করে হতে পারে? এই অসভ্য, বেয়াদপ ছেলেটার প্রতি-ই বা কেন একটু একটু করে আমার ভালো লাগা বাড়ছে?……….(চলবে)