তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:৬+৭

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ৬

সকাল থেকে কলে পানি নেই, চুলায় গ্যাস নেই। এমন অবস্থায় সামিয়া কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। পানি ছাড়া, গ্যাস ছাড়া, কারেন্ট ছাড়া, সারাদিন কিভাবে কাটাবে সেটাই ভাবছে সে। নিলয় সকালে খালি পেটে অফিসে গিয়েছে। পানি আর গ্যাস না থাকায় সামিয়া কোন নাস্তা তৈরি করতে পারেনি।

এমনটা ঢাকা শহরে প্রায়সই হয়। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে সামিয়ার আগে কোন চিন্তা করতে হতো না। নিলয়ই সমস্তটা দেখতো। সকালে সামিয়ার জন্য নাস্তা এনে তবেই সে অফিসে যেতো। দুপুরে আবার সামিয়াকে নিয়ে বাইরে খেতে যেতো। আজ তার কোন কিছুই হলো না। নিলয় এখন প্রচুর ব্যস্ত। কাজের প্রেশার বহুত। অফিসে রিসেন্টলি তার প্রমোশন হয়েছে। সে এখন অফিসের জিএম। তার পক্ষে সামিয়াকে সময় দেবার মত সময় কই!

সামিয়া মনমরা হয়ে ব্যালকনিতে বসে আছে। গোসল করতে পারেনি পানি নেই বলে। তার উপর এই গরমে কারেন্ট নেই। শরীরটা গরমে জ্বলছে। সেই সাথে মন মেজাজও খিটখিটে হয়ে আছে। বেশি রাগ লাগছে নিলয়ের উপর। রাগের থেকেও খুব বেশি অভিমান হচ্ছে। সকালে তবুও বিস্কিট খেয়ে পার করেছে, এখন কী খাবে সে? দুপুরে ভাত ছাড়া অন্য খাবার সামিয়ার একদম পছন্দ না। ফ্রিজে কিছু ভাত আর মাছের ঝোল আছে। সেটা এখন খেতেও ইচ্ছে করছে না তার। গরম না করে এই খাবার খাওয়া যায়?

ফোনটা পাশে রেখেই ব্যালকনির ফ্লোরের উপর বসে আছে সে। নিলয় ফোন করবে, বলবে রেডি হও আমি আসছি। এই আশাতেই বুক বেঁধে রেখেছে সে। কিন্তু, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও নিলয়ের কোন ফোন এলো না।
কারেন্ট আসতে সন্ধ্যা হবে। খানিক আগে ফেসবুকের একটা নিউজে দেখেছে সামিয়া। ততক্ষণ না খেয়ে থাকাও কষ্টদায়ক। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বসে আছে সে। বসা থাকা ছাড়া আর কিছু করারও নেই এই মুহূর্তে।

এরই মধ্যে বিকট আওয়াজে মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। সামিয়া অনেকটা আশা নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আরো বেশি বিব্রত হলো। সুমন কল করেছে। সে মোবাইল ফোন আবারও নিচে রেখে সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকাশটা কেমন হীরের মত চকচক করছে। রোদের ঝিলিকে সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা দায়। ফোন থেমে গিয়ে আবারও বেজে উঠলো। এবার অনেকটা রাগ নিয়ে ফোন রিসিভ করলো সামিয়া। সামিয়া কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে বললো,
“দরজাটা একটু খুলবে? একটা পার্সেল ছিল।”

সামিয়া কোন কিছু না বলে কান থেকে ফোনটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সুমন দাঁড়িয়ে আছে। সামিয়াকে দেখে সুমন একটা হাসি দিল। সেই হাসি সামিয়ার বক্ষ ভেদ করে একদম কোমল হৃদয় স্পর্শ করলো মুহুর্তের মধ্যেই। সে ফোন কেটে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই একটা প্যাকেট পেলো। প্যাকেটটা নিয়ে আবারও ব্যালকনিতে এলো সামিয়া। কিন্তু সেখানে আর সুমনকে দেখতে পেলো না সে। সামিয়া আবারও বসার ঘরের দিকে এগিয়ে এলো। প্যাকেটটা টেবিলে রেখে, প্যাকেটের ভেতরকার জিনিস গুলো বের করলো। এক প্যাকেট বিরিয়ানি, চিকেন তন্দুরি, কোক আর আইস্ক্রিম পেলো তাতে।

এই মুহূর্তে সামিয়া ভীষণ ক্ষুধার্থ। এই খাবারগুলো পেয়ে সে ভীষণ ভাবে খুশি হলো। সাথে সাথেই সে প্লেট এনে খেতে শুরু করে দিলো। বিরিয়ানি মুখে তুলতেই হালকা করে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। সামিয়া আড় চোখে দেখলো মেসেজ এসেছে। সুমন মেসেজ দিয়েছে। সে বাম হাত দিয়ে ফোনের লক খুলে মেসেজ পড়তে শুরু করলো।
অল্প কয়েকটা কথা লেখা আছে তাতে।
“আমার অফিসে আজকে ভীষণ কাজের চাপ। কাজ করছিলাম পিসিতে, রিফ্রেশ হতে একটু ফেসবুকে গেলাম।
হুট করে দেখলাম তোমাদের এলাকায় আজ সকাল থেকে কারেন্ট নেই। তাই আরকি এগুলো আনা। সকাল থেকে নিশ্চই না খেয়ে আছো? দেরি না করে খেয়ে নাও। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না, অফিসে যাচ্ছি। টেক কেয়ার।”

মেসেজটা পড়ে একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ধরলো সামিয়াকে। সে না চাইতেও কী করে যেন সুমনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। কিন্তু, সামিয়া এমনটা হোক সেটা কিছুতেই চাইছে না। তবুও তার এমনটাই হচ্ছে। মনের উপর তো আর কারো হাত নেই! মন কখন কর প্রতি, কিভাবে আকৃষ্ট হবে; সেটা কেউ কী বলতে পারে!
দুজন মানুষই অফিসে। অথচ যার এই কাজটা করার কথা ছিল, সে বেমালুম ভুলে গেছে। আর যার এই কাজটা করার কথা কখনোই ছিল না, সে’ই করলো!
সামিয়া বারংবার এই বিষয়টা নিয়েই ভাবছে। যার কোন সমাধান সে পাচ্ছে না। আদৌ পাবে কি-না সেটাও সে জানে না।

সন্ধ্যার মাথায় কারেন্ট, গ্যাস দুটোই এলো। কারেন্ট আসার সাথে সাথেই সামিয়া গোসল করতে চলে গেল। গোসল সেরে রান্নার জোগাড় করতে করতেই রাত আট’টা বেজে গেল। সামিয়া চট জলদি রান্না বসিয়ে দিলো। রান্না শেষ না হতেই নিলয় বাসায় এসে হাজির। সে বাড়ি এসেই সামিয়াকে বললো এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে। দুটো চুলা বন্ধ থাকায় সামিয়া বললো,
“একটু অপেক্ষা করতে হবে, চুলায় রান্না বসিয়েছি। এখন তো চুলা থেকে তরকারির হাড়ি নামানো যাবে না। তরকারি নষ্ট হয়ে যাবে।”
কথাটা শেষ না হতেই নিলয় ধমকের সুরে বললো,
“সারাদিন বাসায় কী করো? এত দেরিতে রান্না করছো কেন? জানো না আমি এখন আসবো! আমার মাথা ধরেছে, কফি এনে দাও জলদি।”

কথাগুলো বলেই ফ্রেশ হতে চলে গেল নিলয়। সামিয়া ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখদুটো ছলছল করছে। ভরা নদীর মত উছলে পড়ছে পানি। যখন তখন সেই পানি বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে চলে আসতে পারে। সমস্তটা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে এক মুহুর্তে।
সামিয়া একদৌড়ে চলে গেল রান্নাঘরে। চুলা থেকে তরকারি নামিয়ে কফির পানি ফুটাতে দিলো। ওড়না দিয়ে বারংবার চোখ মুচলেও কোন লাভ হচ্ছে না। চোখের পানি অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। কফি বানিয়ে নিলয়ের সামনে রেখে আবারও রান্নাঘরে এলো সামিয়া। এই মুহূর্তে নিলয়ের পাশে কিছুতেই বসতে মন চাইছে না ওর। কই সারাদিন কারেন্ট, গ্যাস না থাকায় সে কিভাবে কি করলো জিজ্ঞেস করবে! সেটা না করে উল্টো ধমক দিচ্ছে! সামিয়া সারাদিন কী খেলো, সেটাও একবারও জিজ্ঞেস করলো না নিলয়। এই কথাটা যতবারই মনে আসছে ততবারই বুকটা হুহু করছে সামিয়ার।

রান্না শেষ করে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো সামিয়া। নিলয় তখন ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে। সামিয়া তখনও থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে। মেয়েটা বড্ড অভিমানী। এই অভিমান কখন ভাঙবে কে জানে!
সে আনমনে আকাশ দেখছে। ফোনে মেসেজ আসতেই সে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। সুমন মেসেজ দিয়েছে। সুমন নামটা দেখেই সামিয়া মৃদু হাসলো। সে দ্রুত মেসেজ পড়তে শুরু করলো,
“হাই সুইটি, কী করছো? বর এসেছে নিশ্চই! এই জন্যেই কল করতে পারলাম না, ধুর! যাইহোক, নাস্তা করেছো? ডিনার কখন করবে? শরীর কেমন আছে? যে গরম ছিল আজ, শরীর খারাপ করেনি তো আবার!”

মেসেজটা পড়ে আবারও ডুকরে উঠলো সামিয়া। কথাগুলো কার বলার কথা ছিল আর কে বলছে এই ভেবে সে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর ছোট্ট করে একটা রিপ্লাই করলো। এই প্রথম সে সুমনকে মেসেজের রিপ্লাই করছে।
সামিয়া লিখলো,
“জি, আমি ভালো আছি। শরীর খারাপ করেনি, চিন্তা করবেন না। আর, নাস্তাও করিনি। তখন অতগুলো খাবার খেয়ে আর খাওয়া যায় এখন?”
মেসেজ সেন্ড করে ফোন হাতের মুঠোয় রেখে আবারও আকাশ পানে তাকালো সামিয়া। পেছন থেকে নিলয় সামিয়াকে জড়িয়ে ধরতেই সামিয়া একটু সরে গেল। নিলয় জোর করেই সামিয়াকে ধরে রাখলো। আলতো করে সামিয়ার গালে একটা চুমু দিলো সে। সামিয়া নিজেকে কেমন গুটিয়ে রাখছে। নিলয়ের স্পর্শ তার ভালো লাগছে না। প্রচণ্ড অভিমানে শরীর ঢেঁকে আছে যে!

সামিয়া নিলয়কে ছাড়িয়ে দিয়ে টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে গেল। নিলয় বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে, সামিয়া পাশেই বসে আছে। নিলয় খেতে খেতেই বললো,
“তুমি খাবে না?”
সামিয়া অভিমানী সুরে বললো,
“আমি খেলাম কী খেলাম না, তাতে তোমার কী?”
নিলয় একটু অবাক হয়ে বললো,
“এ আবার কেমন কথা! কী হয়েছে?”
সামিয়া হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখদুটো মুছে বললো,
“কী আবার হবে? কিছু হয়নি, তুমি খাও।”
নিলয় আবারও খাওয়া শুরু করলো। খেতে খেতেই বললো,
“ওহহো, আজ তো বাসায় কারেন্ট, গ্যাস কিছুই ছিল না। কথাটা আমার মাথায় একদমই ছিল না। এমন একটা কথা কী করে মাথায় এলো না! ধুর!
অফিসে এত কাজের চাপ, কী বলবো। বুঝেছি এবার তোমার রাগের কারণ। এসব নিয়ে রাগ করতে নেই। রাগ করো না, খেয়ে নাও।”

কথাটা বলে সে আবারও খাওয়া শুরু করলো। সামিয়া শুকনো একটা হাসি দিয়ে নিলয়ের পাশেই বসে রইলো। নিলয়ের খাওয়া শেষে টেবিলের সমস্ত কিছু গুছিয়ে বিছানায় গেল সামিয়া।
নিলয় ততক্ষণে ঘুমে তলিয়ে গেছে। সামিয়া আবারও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজলো। কিন্তু, কিছুতেই চোখে ঘুম এলো না। সময় পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের পরিবর্তন করতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু, নিলয়ের এই পরিবর্তন যেন সামিয়া কিছুতে মেনে নিতে পারছে না। সমস্ত বুকের পাঁজর কেমন ভেঙে যাচ্ছে, গুড়িয়ে যাচ্ছে।

সামিয়ার এই কষ্টের মুহূর্তে সুমন ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। সামিয়া বুঝতে পারছে, সুমন এই সময়টার সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু, সব কিছু বুঝেও সে কেমন ভাবলেশহীন হয়ে যাচ্ছে। সুমনের কেয়ার, সারপ্রাইজ, কথা, হাসি, সামিয়াকে বোঝার ক্ষমতা, সবকিছুই সামিয়াকে সুমনের দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য করছে। সামিয়া না চাইতেও সুমনের ডাকে সাড়া দিচ্ছে।
আর নিলয় তার ক্যারিয়ার গড়তে ছুটে চলেছে। নিলয়ের এই ছুটে চলাই যেন সামিয়ার জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির পদার্পণ ঘটাচ্ছে। এর শেষ কোথায় সে কেই-বা বলতে পারে!

চলবে….

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ৭

আজ পুরো শহর কেমন থমকে আছে। চারপাশে কোন কোলাহল নেই। একদম নিঃশ্চুপ নিস্তব্দতা। ঘড়ির কাঁটাও বুঝি থেমে গেছে। টিকটিকিরাও আর ঠিকঠিক করছে না। সবকিছুই থমকে গেছে এক নিমিষে।

সামিয়া ফ্লোরের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। সামিয়ার সারা শরীর জুড়ে রক্ত। কিছু রক্তের ছিটা ওর মুখেও লেগে আছে। সামিয়ার সামনেই দু’দুটো নিথর দেহ পড়ে আছে। গলগল করে সেই দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। সামিয়া পলকহীন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
সামিয়ার চারপাশে কিছু পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করছে। কিছু সাংবাদিক ক্যামেরায় সেসব দৃশ্য ধারণ করছে।

সামিয়ার পাশেই বসা সামিয়ার বাবা-মা। তারা বিলাপ করে কাঁদছে। নিলয়ের বাবা-মা’ও ইতোমধ্যে এসে পড়েছে। সকলেই হতভম্ব, হতবিহ্বল হয়ে গেছে। সামিয়া যে এই কাজটা করতে পারে সেটা তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সকলেই যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

এরই মধ্যে দুজন নারী কনস্টেবল এসে সামিয়াকে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। সামিয়াকে টানতে লাগলো উঠে দাঁড়ানোর জন্য। সামিয়া নিঃশ্চুপ, তাকে যেভাবে নাড়ানো হচ্ছে সে সেভাবেই নড়ছে। ঠিক যেন চাবি দেওয়া কোন পুতুল!

নিলয়ের বাবা-মা, সামিয়ার বাবা-মা, সকলেই সাংবাদিকের সামনে। তারা কোন কথা বলতে পারছে না। থেকে থেকে মূর্ছা যাচ্ছে চারজনই। সামিয়াকে পুলিশ ভ্যানে উঠানো হলো। শত শত মানুষ ভিড় করেছে ওদের বাড়ির সামনে। সকলেই উৎসুক জনতার মত হা করে আছে। যদি কোনভাবে কিছু জানা যায়!

কিন্তু কিছুতেই কিছু জানা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে, দুটো মার্ডার হয়েছে। কিভাবে মার্ডার হলো সেটাও বোঝা যায়নি। তবে, এটা নিশ্চিত সামিয়া খুনগুলো করেছে। কারণ, সামিয়া ছাড়া ওই ফ্ল্যাটে আর অবশিষ্ট কেউ ছিল না। খুনের চব্বিশ ঘণ্টা পর পুলিশ খবর পেয়েছে। সামিয়া লাশ দুটোর পাশেই ঠায় বসে ছিল। যে চাকু দিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটাও সেখানেই পড়ে আছে। সামিয়াও সেখানেই আছে, যেমন ছিল ঠিক তেমন অবস্থাতেই। শরীরের রক্তমাখা কাপড়গুলো পরিষ্কার করেনি পর্যন্ত।
এসব দেখেই পুলিশ সন্দেহ করছে খুনটা সামিয়া করেছে। কী কারনে করল সেটা বোঝা যাবে জিজ্ঞাসা বাদের পর।

সামিয়া যেহেতু কোন কথা বলছে না, সেহেতু ওকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হবে না। পুলিশ লাশদুটো সহ সামিয়াকে নিয়ে গেল। লাশগুলো ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে সামিয়াকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো।

মুহুর্তের মধ্যেই সারাদেশে হেডলাইন হয়ে গেল খবরটি। রীতিমত চাঞ্চল্যকর একটি খবর!
প্রতিটি টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলছে এই খবরে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ভাইরাল হয়ে গেল খবরটি।
সকলেই উৎসুক হয়ে আছে লাশগুলোর পরিচয় জানার জন্য। কী কারণে খুন করা হয়েছে সেসব ঘটনা জানার জন্য।
তবে, সামিয়ার পারিবারের মারফতে শুধুমাত্র একজনের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। নিলয়কে চিহ্নিত করতে পারলেও বাকি আরেকজনের পরিচয় এখনও চিহ্নিত করা হয় নি।

সামিয়াকে নিয়ে হাজতে রাখা হলো। আজ আর কোন জিজ্ঞাসাবাদ হবে না। আগামীকাল তাকে কোর্টে চালান করা হবে। তারপরই কেইস ওপেন হবে। নিলয়ের বাবা-মা বাদী হয়ে সামিয়ার নামে কেইস করেছে। সামিয়ার বাবা-মায়ের দাবী, তাদের সন্দেহ হচ্ছে সামিয়ার সাথে আরো কেউ জড়িত আছে। সামিয়ার পক্ষে একা এসব করা কিছুতেই সম্ভব না। সামিয়া অত্যন্ত ভীত প্রকৃতির একজন মেয়ে। সে কিভাবে দু’দুটো মার্ডার করবে!
তারা এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে অনুরোধ করছে।
ভালোভাবে তদন্ত করতে বলছে।

থানার ওসি চেষ্টা করেও সামিয়ার মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন কোর্টে চালান করার আগে ঘটনা কী ঘটেছিল সেটা একবার জানবেন। কিন্তু, কোনভাবেই তিনি সামিয়াকে দিয়ে কোন কথা বলাতে পারলেন না।
শেষমেষ বিরক্ত হয়ে তিনি নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। কোর্টের অর্ডার না আসা পর্যন্ত তিনি সামিয়াকে জোর করতে পারবেন না। বা সামিয়ার উপর নির্যাতনও করতে পারবেন না।

ওসি ভেবেছিলেন অন্তত বাকি আরেকটা লাশের তথ্য পাওয়া যায় যদি। কিন্তু, সেটাও কিছুতেই সম্ভব হলো না।
নিলয়ের বাবা-মা তখনও থানায় বসে। মানুষ দুটো পাগলের মত করছেন। তাদের একটাই দাবি,যে ভাবেই হোক এই ঘটনার আসল রহস্য বের হোক। প্রয়োজন বোধে সামিয়াকে রিমান্ডে নেয়া হোক। তবুও যেন সত্যতা বেড়িয়ে আসে।

ময়না তদন্তের পর নিলয়ের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলো। এবং অবশিষ্ট লাশটিকে মেডিকেলের ফ্রিজে রেখে দেওয়া হলো অজ্ঞাতনামা হিসেবে। লাশের পরিচয় নিশ্চিত হলেই তাকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
নিলয়ের লাশ তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানেই তাকে তার পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেওয়া হবে।
লাশবাহী গাড়ি গ্রামে পৌঁছতেই উৎসুক জনতার ভিড় লেগে গেল।

কেউ কেউ আফসোস করছে আবার কেউ কেউ সামিয়াকে গালমন্দ করছে। বউ হয়ে স্বামীকে কিভাবে খুন করলো সেটার বিশ্লেষণ করছে অনেকেই। লাশের কফিন গাড়ি থেকে নামানোর সাথে সাথেই আত্মীয়স্বজন এসে ভিড় করলো সেখানে। মুহুর্তের মধ্যেই কান্নার রোল পড়ে গেল। দূর থেকে একজন অল্প বয়সী মেয়ে বিকট শব্দে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে এদিকে আসতে লাগলো। গ্রামের অনেক মহিলা সেই মেয়ের পিছু পিছু আসতে লাগলো। মেয়েটি নিলয়ের একমাত্র ছোটবোন। দিন কয়েক আগেই মেয়েটির বিয়ে হয়েছে।

গ্রামের মানুষের যেন আফসোসের সীমা রইলো না। একমাত্র ছেলের মৃত্যু, বাবা-মায়ের জন্য অসহ্য যন্ত্রণার। এখন এই বাবা-মায়ের কী হবে!
স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু, এটা তো অস্বাভাবিক মৃত্যু। তাকে তার বউ খুন করেছে। এই বিষয়টা কী করে মেনে নেবে? কী করে হজম করবে এতবড় একটা বিষয়!

পাড়ায় পাড়ায়, চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে, বাড়িতে বাড়িতে এখন এই এক গল্প। সকলের মুখে মুখে এক কথা। বউ হয়ে কী করে স্বামীকে এভাবে মেরে ফেললো! এসব তো টিভিতে দেখা যেত! বাস্তবেও যে দেখা যাবে সেটা ভাবনারও অতীত।
সকলেই সামিয়ার ফাঁসি চায়। আবার অনেকেই সামিয়াকে ডিফেন্ড করতে থাকে। বউ হয়ে স্বামীকে মেরেছে যখন, তখন নিশ্চই তেমন মেজর কোন কারণও আছে!
বিনা কারণে কোন বউ তার স্বামীকে কী মারতে পারে!
এই নিয়ে বেধে যায় তর্ক-বিতর্ক। কেউ পক্ষে তো কেউ বিপক্ষে।

নিলয়ের দাফন সম্পন্ন করে জানাজা পড়ানো হয়। তারপর তাকে তার দাদা-দাদীর পাশেই কবরস্ত করা হলো। নিলয়ের লাশ কবরস্থানের উদ্দ্যেশ্যে নিয়ে যাওয়া সময় নিলয়ের মা অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকে নিয়ে আবার বাড়ির লোকজনের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। ডাক্তার আনানো হয় তার চিকিৎসার জন্য। সব মিলিয়েই সেই বাড়ির অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অপরাধী ভিক্টিমের কাছে অপরাধী হলেও, তার পরিবারের কাছে আপনজন, কলিজার টুকরা। রক্তের বাঁধন থাকে তার সাথে পরিবারের বাকিদের।

বাকি মানুষ তাকে ঘৃণা করলেও পরিবারের লোকজন তাকে ঘৃণা করতে পারে না। সামিয়া কোন অপরাধে নিলয়কে খুন করেছে তা কেবলই সামিয়া জানে। নিলয় সামিয়ার কাছে অপরাধী হলেও, পরিবারের কাছে নিরাপরাধ। আবার, সামিয়া নিলয়ের পরিবারের কাছে অপরাধী হলেও; নিজের পরিবারের কাছে নিরপরাধ।
যুগযুগ ধরে এটাই হয়ে আসছে এই দেশে, এই সমাজে।
হয়তোবা ভবিষ্যতেও এটাই হবে। হাজারো হোক, রক্তের বাঁধন তো আর ছিন্ন করা যায় না!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here