বর্ষার_এক_রাতে পর্ব ১০

#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া

পর্ব : ১০
তূবা বের হয়েছে নিজের গন্তব্যে। আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হয়েছে। কারণ তুসির ঔষধ কিনে নিতে হবে। সকালের ঔষধ শেষ। তাই তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ল সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রনি কে খুঁজে চলছে। যদি পেয়ে যায়। হাটতে হাটতে খলির মুখের চার দোকানে রনি কে পেয়েই গেল। গলায় রুমাল ঝুলছে, প্যান্ট হাটু পর্যন্ত, শার্টের তিনটা বোতাম খোলা। ক্যারাম খেলছিল বন্ধুদের সাথে। তূবা দৌড়ে গেল। রনির কলার টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠাস করে একটা চর মেরে দিল। হঠাৎ এমন ঘটনায় রনি সামলাতে পারল না। রাগে তূবার দিকে তাকায়। তূবার চোখ দিয়েও আগুন জ্বলছে। বড় বড় করে শ্বাস টানছে হাপিয়ে।

রনি সবাই কে চলে যেতে বলল।
“তুই থাপ্পড় কেরে মারছোস তূবা?”
“সত্যি করে বলতো রনি সেদিন ঠিক কি করেছিলি আমার সাথে।”
“সবাই জানে তোর সাথে কি হইছে আর তুই জানোস না?”
রনি কে হাসতে দেখে তূবা তার কলার চেঁপে ধরল।
“তোর সাথে আমি মজা করতে না সত্যিটা জানতে এসেছি। এখন বল সবটা বলবি।”
“ছাড় মানুষ দেখলে তোরই অসুবিধা হইব। আর তুই জানোস না আমি তোরে করছি কি?”
“রনি আল্লাহর দোহাই লাগে বল আমায়।”

রনি একটু চুপ থেকে বলল
“আমি তোরে রেপ করছিলাম এইডাই।”
তূবা আরেকটা চর বসিয়ে দিল রনির গালে। এবার রনি রেগে যায়। গরগর করে বলে,
“আমি হেইদিন তোর নামে দুর্নাম ছড়াইছি। তোর বিয়া করনের শখ হইছে আমারে কইতি। আমি তোরে বিয়া করতাম। কিন্তু তুই তো আরেক বেডার লগে বিয়া করতে চাইছোস তাই একেবারে তোর বিয়া বন্ধ কইরা দিলাম। আর কোনো বেডা তোরে বিয়া করতে আইতো না।”
“….
“তোর এই শইলের (শরীর) দিকে আমার নজর না রে তূবা। আমি তোরে পছন্দ করি। চাইলে হেইদিন হাচাহাচি আমি তোরে ধর্ষণ করতে পারতাম কিন্তু করছি না। কারণ তোরে আমি বিয়া করতে চাই।”

তূবা কি বলবে কি করবে তা জানে না সে। পাথরের মতো তাকিয়ে আছে রনির দিকে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে।

“তোর মনে নাই তোরে অজ্ঞান কইরা আমি তুইলা নিছিলাম। পরে উইঠা কি দেখছোস? তোর জামা কাপড় ছিঁড়া, শইলে রক্ত, হাতে রক্ত। আমি চাইতাম তুই শুধু আমার হইবি। তোরে সারা দুনিয়াতে খারাপ বানাইয়া আমি আমার কাছে লইয়া আইয়াম। দেখ এহন তুই অসহায়। ওহন বিয়া করবি আমারে?”

তূবা রনি কে এলোপাথাড়ি চর দিতে দিতে বলল
“কুত্তার বাচ্চা আমার জীবনটারে একদম শেষ করে দিছোস তুই। তোর জন্যে আমার জীবন আজ এত অন্ধকারে। আমার জীবন টা নষ্ট করে দিয়েছিস রনি।”
রনি কিছু বলল না। তূবা কে থামালও না। হেসে হেসে জবাব দিল।
“ওহন আমারে বিয়া কর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাইব।”
“তোর জন্যে আমি পবিত্র থেকেও পবিত্র না। আমার শরীরে একটা মানুষের ছুঁয়া ধেয়ে গেছে। রনি আমার জীবন টা নষ্ট করে দিলি তুই।”

রনির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল
“তূবা এই তূবা কি কছ এইগুলা?”
“….
“তূবা। কথা কো।”
“….
“তূবা তুই মাত্র কি কইলি।”
“…
তূবা আর কিছু না বলে দৌড়ে চলে যায়। রনি তূবা কে অনেক ডাকে কিন্তু সে চলে গেছে। ধপ করে সে মাটিতে বসে পড়ল। বিড়বিড় করল
“তূবা কি কইয়া গেলি তুই?”

আহফিন আজ অফিস থেকে ফিরে এসেছে তাড়াতাড়ি। মাথার ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। এত চিন্তা ভাবনা মস্তিষ্ক নিতে চাইছে না। আসার পর থেকেই রুমে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। কলিংবেলের আওয়াজে আহফিন ঘড়ি দেখল। এটা তূবার আসার সময় নয়। আর ও তো রাতে আসবে। আহফিন নেমে নিচে গেল। দরজা খুলে বিধ্বস্ত অবস্থায় তূবা কে দেখে চমকে উঠল সে। বুকটা মুচড় দিয়ে উঠেছে তার। তূবার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, অদ্ভুত চাউনি, এলোমেলো চুল, নিস্তেজ দেহ আহফিন কে হতবাক করে দিল। সে দ্রুত তূবার বাহুতে ধরল। জিজ্ঞেস করল “কি হয়েছে?”
তূবা নীরব। আহফিন আবার আস্তে করে বলল
“কি হয়েছে তূবা?”
এবার তূবা বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আহফিন টেনে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

তূবা শূন্য শরীর ছেড়ে দিয়ে আহফিনের টিশার্ট খামছে হুহু করে কাঁদছে। আহফিন তূবা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেও তূবা নিচে বসে হাটু গুটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। আহফিন কিছুই বুঝতে পারছিল তূবা হঠাৎ এত করে কাঁদছে কেন। সে তূবা কে পাজোকোলে তুলে নিয়ে উপরে গেল। বিছানায় বসিয়ে তূবার সামনে এক গ্লাস পানি দিল। তূবা আপন মনে কাঁদতেই থাকে। আহফিন তূবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুখের সামনে পানি ধরল। তূবা অল্প পানি খেয়ে চুপ হলো। শুধু শব্দটা বন্ধ হয়েছে চোখের পানি নয়।

আহফিন তূবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল
“কি হয়েছে তূবা? তোমার প্রতিটা চোখের পানি আমাকে অধৈর্য করে তুলছে। প্লিজ আর কান্না না করে বলো আমায় কি হয়ছে।”
“র.রনি..”
“রনি? কি করেছে সে?”
“…
“তূবা বলো।”
“রনির সাথে আজ দেখা হয়েছে।”
“কি বলো?”
“…
“তারপর কি হয়েছে তূবা?”

সে আহফিনের চোখের দিকে তাকিয়ে পানি ছেড়ে দিল। ঠোঁট উল্টে করুণ মুখে বলল “সে স্বীকার করেছে সেদিন রাতে আমার সাথে বাজে কিছু করনি। শুধু দুর্নাম ছড়িয়ে আমার জীবন টা শেষ করে দিল।” চোখে পানি নিয়েই পাগলের মতো হেসে উঠল তূবা। তার এই কথাতে আহফিন তেমন অবাক হয় নি। কারণ সে এ ব্যাপারে জানে।

আহফিন শুধু তূবার গালে হাত রাখল।
“তূবা আমার দিকে তাকাও।”
“রনি আমার জীবন টা শেষ করে দিলো।”
“তূবা শান্ত হোও তুমি। আমার দিকে তাকাও।”
সে নিজের মতোই বিলাপ পারছিল। আহফিন যখন ধমক দিলো তখন সে তার চোখের দিকে তাকায়। আহফিন শান্ত স্বরে বলল
“তূবা প্রতিটা শেষ থেকে আবার নতুন কিছু শুরু হয়। কেন এতো ভেঙ্গে পড়ছো? হতে পারে এটাতে তোমার জীবন নতুন এক আলো পেল।”
“জীবন আলো নয় অন্ধকার পেয়েছে আহফিন। আমার জীবন টা রনির দুর্নাম আর আপনার ছুঁয়ায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
আহফিন কি বলবে তা জানে না। তূবা কে একলা একটু সময় দিয়ে সে চলে গেল। তার ভেতরেও দহন চলে।

রনি পাগলের মতো গেল তূবার বাসায়। গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল তূবা কে। শিরিন বেগম বের হয়ে বললেন
“তুই এই নে আইছোস কে?”
“খালা তূবা কই? আমার তূবা কই?”
“তোর তূবা? কাওলা কইরা রাখছিলি নাকি?”
“খালা আমি তোমার সাথে লাগতে আইছি না। আমারে কোও তূবা কই।”
“তুই কইলেই আমার কওন লাগব হেই কই গেছে?”
“খালা আমার মাথা গরম হইয়া যাইতাছে কিন্তু।”
“তাইলে রাখা আমি ঘর থেইকা বডি(দা) ডা লইয়া আই। এক কুপে তোর ঘাড় থেইকা কল্লা(মাথা) ডা আলোগ কইরা দেই।”

সাপের মতো রেগে উঠল রনি। চোখ লাল হয়ে উঠেছে তার। বৃষ্টির দিনেও ঘামছে। পারলে শিরিন বেগম কে এখানেই ধরে ফেলে সে। দুজনের খুব তর্কা তর্কি হয়। একসময় তিনি বললেন,
“তূবা চাকরিতে গেছে। রাইতের চাকরিতে গেছে।”
“রাইতের চাকরি মানে? কি কইতাছো তুমি?”
“বুঝোস না? তুই যেইটা জোর কইরা করছোস হে হেইডা টাকার বদলে করতে গেছে। এহন বুঝছোস তুই? জীবনডা একবারে নষ্ট কইরা দিলি তুই। আমারে তূবা পাইছোস না যে তোরে কিছু করতাম না। যা এইত থে নাইলে হাচাহাচি তোর মাথা আলোগ কইরা ফালবাম। যা কইতাছি।”
রনি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। শিরিনের কথা গুলি বারবার কানে লাগছে। “হাছাই কি বড় ভুল কইরা ফাললাম?”

ঘন্টা দুই এক পর যখন আহফিন ফিরে এলো তখন পরিবেশ ঠান্ডা। একটু আগেই বর্ষণ হয়ে গিয়েছে। আহফিন গিয়ে দেখল তূবা বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। হাতের ট্রে টা টেবিলের উপর রেখে তূবার পাশে বসল সে। মাথায় আহফিনের স্পর্শ পেয়ে তূবা উঠে বসল।

“পরিবেশ তো দেখছি ভীষণ শীতল। একটু আগে শ্রাবণ ধারার পরের থমথমে অবস্থা। কি স্নিগ্ধ সতেজ।”
আহফিনের কথায় তূবা কিছু বলল না।

“এদিকে আসো ডিনার করবে।”
“খিদে নেই, খাবো না আমি।”
“আসো আমি খায়িয়ে দিচ্ছি।”
আহফিনের মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইল তূবা। এমন কথা কখনো আশা করে না সে। কিন্তু..!

“কি হলো আসো।”
“….
আহফিন আর ডাকল না তূবা কে। ভাতের প্লেট টা হাতে নিয়ে এক লোকমা খাবার তুলে দিল তূবার মুখে। তূবা তখনো বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিল তাকে। ভেতরে কিছু একটা চলছে তার। এই অনুভূতি, এই ছুটে চলার নাম কি?

“হা করো।”

দুই বার বলার পর তূবা মুখ খুলল। আহফিন হাসি দিয়ে তূবার মুখে ভাত তুলে দিল। তূবা লোকমা মুখে নিচ্ছে আর অবাক হয়ে তাকিয়ে আহফিন কে দেখছে। তূবার এমন তাকানো যে আহফিন বুঝতে পারছে না এমন নয়। সে মনে মনে হাসছে।
“আমাকে তোমার পছন্দ?”
“…
আহফিন তূবার উত্তরের আশা করল না।

“তূবা তুমি এখনো বাচ্চাটি আছো। তোমার মাঝে শিশুর মতো আরেকটা মানবী আছে। এমনিতেও মেয়েদের অনেক রূপ দেখা যায়। তবে এই তূবা কেও ভালো লাগে আমার।”
তূবা হা করে দেখছে তাকে। তূবা কে খায়িয়ে দিতে দিতে আহফিনের অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। অতীত মনে হতেই ভেতরটা কেমন জ্বলে উঠল তার। ভারি কিছু অনুভব করছে আহফিন।

একবার ভাবল উঠে যাবে তাকে না খায়িয়ে। কিন্তু কি ভেবে যেন তূবা কে সব গুলি ভাত খায়িয়ে হাত ধুয়ে নিল। তূবা কে আজ সে বিরক্ত করতে চায় না। তাই ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল সোফায়। তূবা আড়চোখে দেখল তাকে। বুঝতে পারল না লোকটার হয়েছে কি? লোকটার এমন অদ্ভুত আচারনের কারণে তাকে চিনতে অসুবিধা হয় তার। সেও আর কিছু না বলে শুয়ে পড়ল পাশ ফিরে। চোখ গুলিতে রাজ্যের ঘুম দেখা দিচ্ছে।

বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রনি রাস্তায় বসে আছে। বৃষ্টির সাথে সাথে চোখের পানিও ঝরছে তার। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। হাতে থাকা মদের বোতলটায় আমার চুমুক লাগল। মাতাল কন্ঠে বলল
“তূবা রে আমি তোরে ভালোবাসি। তূবা কই তুই? আমার বুকটা জ্বইলা যাইতাছে রে। আমার কষ্টডা তুই দেখলি না। তূবা।”
জোরে চিৎকার করে রনি আবার মদের বোতল মুখে ধরল।
“আল্লাহ, আল্লাহ গো এত বড় ভুল আমারে দিয়া কি কইরা করাইলা? আল্লাহ আমারে আটকাইলা না কেরে? কেরে আমার রাগ ডা কমাইলা না? কেরে আল্লাহ কেরে?”

রাস্তায় হাত বারি দিতে দিতে কেঁদে উঠল রনি। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল
“তূবা… তূবা রে..!”

রাত ১২ টা বেজে ১৭ মিনিট। আহফিন অফিসের কাজ শেষ করে ল্যাপটপ রাখল। বিছানায় তাকিয়ে দেখল তূবা ঘুমিয়ে গেছে। আহফিন স্লান হেসে ল্যাপটপ রেখে এগিয়ে গেল বিছানায়। ঘুমন্ত তূবার মুখটা তার বুকে খিলখিল করা ঢেউ তুলে দিচ্ছে। আহফিন তূবার গায়ের চাদর টেনে দিয়ে কপালে চুমু দিল। তূবার পাশে এক হাত রেখে নিজেই বিড়বিড় করল।
“আমার প্রশান্তি হবে তূবা?”

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here