#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১৭তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িম নীরব হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চাহনি আজ বড়োই অদ্ভুৎ, তবে এই চাহনির বেড়াজাল ভেদ করে এই চাহনির অর্থ কারোরই বোধগম্য হলো না কারো। নীরবতা কাটিয়ে উঠানোর দায়িত্ব আবারও অনিমেষই পালন করল।
“নায়িম?”
“হ-হ্যাঁ?” ঘোর ভাঙল নায়িমের। চোখ নামিয়ে কিছু একটা ভেবে পুনরায় গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তিন জোড়া জিজ্ঞেসু আঁখির দিকে।
“আমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলব না, কারণ তোমাদের কাছে লুকানোর কিছু নেই। জানলেও বলার উপায় তোমাদের কারোরই নেই। তা সম্পর্কে তোমরাও জ্ঞাত।
আমি ভদ্র সমাজে গায়ক, অভদ্র সমাজে রাজনীতিবিদের সাথে মাফিয়াও বলা যায়, বড় বড় গুন্ডা আমার হাতের মুঠোয় থাকে, লোকালয়ের আড়ালে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মোস্তফা সাহেবের নাতি তার পার্টির চেয়ারপার্সন নাহিবা খানের বাবা।”
নায়িমের বাস্তবতার উন্মেচনটা যেন একটু বেশিই স্বাভাবিকতার সহিত হলো। বাংলা সিনেমা বা হিন্দি নাটকের মতোন বিদ্যুৎ চমকালো না, গম্ভীরতার সুর ধরা মিউজিক বাজলো না। সকলে বিস্মিত হলো, স্তব্ধ হলো, তবুও যেন কিছুই হলো না।
“হয়েছে তো এবার? অনিমেষ আমার এক জায়গায় যেতে হবে। আমি যতক্ষণ না আসি ততক্ষণ সবার খেয়াল রাখিস। আর কোনো বিপদের আভাস পাওয়া মাত্রই আমাকে কল দিবি।”
অত্যন্ত খাপছাড়া ভঙ্গি নায়িমের। অথবা, খামখেয়ালির আড়ালে অনুভূতি লুকানোর প্রচেষ্টা।
অনিমেষ নিজেকে সামলে শুধায়,
“তুই তো বললি না এই লোকগুলো কারা।”
“নুসরাত মোস্তফার সাবেক প্রেমিক, তার সৎ ফুপির ছেলে। ধরতে গেলে আমার দূরসম্পর্কের মামা।” স্পষ্টতার সাথে কথাটা বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল নায়িম।
এদিকে সবাই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। যা জানা ছিল, তাও অগোছালো হয়ে গেল। আর বাসন্তী…? সে তো বাক্যহারা। এতটা শঙ্কিত, কঠিন, জটিল জীবন তো তার কাঙ্ক্ষিত নয়। সে তো আর কিছু চায়নি আল্লাহর কাছে। কম অর্থে থাকলেও প্রিয় মানুষের বুকে দু বেলার খাবার খেয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে চেয়েছে।
___
নায়িম লোকজন নিয়ে মোস্তফা ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তার চোখে-মুখে ক্রূরতা ছেয়ে আছে। জীবনের কত সময় সে ব্যয় করেছে এই মুহূর্তটি পাওয়ার জন্য তা একমাত্র আল্লাহ আর সে জানে।
গাড়ি নির্ধারিত স্থানে এসে থামল। নায়িম তার লোকদের নিয়ে এগিয়ে গেল মোস্তফা ভিলার দিকে। কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই এ কী অবস্থা! সারা বাড়ি জুড়ে শূণ্যতা।
“হোয়াদ্দা হেল! সাদিকের বাচ্চা কই গেল!” আক্রোশে ফেটে পড়ছে নায়িমের কণ্ঠ। তার সাথের লোকগুলো ভয়ে কম্পিত হচ্ছে।
“তোরা দাঁড়ায় আছিস কেন? পুরা বাসা চেক কর! বাগান, গ্যারেজ কেন কোনো আনাচে-কানাচে বাদ রাখবি না।” নায়িমের ধমকিয়ে উঠতে দেরি, কারো আদেশ পালনে।
মোস্তফা ভিলার প্রতিটি কোণা পর্যবেক্ষণ করা হলো। তারপরও একটা কাকপক্ষীরও সাক্ষাৎ মিলল না। সবাই অসহায় মুখ নিয়ে নায়িমের সামনে এসে দাঁড়ালে। নায়িম ব্যর্থতার ক্রোধে লাথি মারে বৈঠক ঘরে থাকা টেবিলে। ছিটকে পড়ে যায় টেবিলে বিদ্যমান সকল কিছু। কিন্তু নায়িমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো।
সে এগিয়ে যেয়ে হাতে তুলে নেয়। পড়তে থাকে কাগজের উপর লিখা বাক্যটি।
“আজ তোমার বর্ষা তুমিই বর্ষণ হও চারিধারে। বেঁচে যেহেতু আছি কাল যে আমার বর্ষণ হবে না তার নিশ্চয়তা নেই৷ তাই এটুকু জয় করেই আবার আনন্দ উদযাপন কোরো না ভাগিনে।”
পড়ে মাথায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠে ক্রোধের আগুন। চেঁচিয়ে উঠে তীব্র রাগে,
“সাদিকের বাচ্চা তোরে একবার খালি হাতে পাই। জাহান্নামের স্বাদ সম্ভব নাহলেও মৃত্যুর চেয়েও তিক্ত স্বাদ আমি তোকে পৃথিবীতে দিব।”
___
নায়িম বাড়ি ফিরে কোনোদিকে না তাকিয়েই বেডরুমে চলে যায়। রাগ কিছুটা শান্ত হলেও একদম মাটিতে মিশেনি। তার উপর সারা গা ঘামে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। গা ঘিনঘিন করছে তার। দরজা লক করে তাড়াতাড়ি শার্টটা খুলে প্যান্টের বাটনে হাত দিবে তখনই ফোন আপন সুরে বেজে উঠেছে।
বেশ বিরক্ত বোধ করে যুবক। হাতে নিয়ে দেখে পরবর্তী গানের প্রযোজকের কল। আর কী অনিচ্ছা সত্যেও তুলতে হয়।
“আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?” কথাতে মাধুর্য বজায় আছে নায়িমের।
“আমি তো ভালোই। তুমি না কি প্রজেক্ট পোস্টপন করতে বলেছো? কী সমস্যা হলো আবার?”
“আপনি তো জানেননই কতটা হ্যাকটিক কেটেছে আমার লাস্ট কিছু সময়। প্রথমে শবনমের কেস, তারপর মিস ললিতা, তারপর মিডিয়ার সাহায্য দুর্নাম করার প্রচেষ্টা। আমি কিছুটা সময় কাটাতে চাচ্ছিলাম, ঝড়-ঝামেলা ছাড়া, বাহিরে ঘুরতে এসে।”
“থাক, থাক, বাবা বুঝেছি আমি। ট্রিপে গেছো আগে বলবে না! তুমি তোমার মতো ট্রিপ ইঞ্জয় করো, হ্যাঁ? আমি রাখলাম।”
“ঠিক, আছে স্যার।”
কলটা ডিসকানেক্ট করে বিরক্তিমাখা এক নিঃশ্বাস ছাড়ে নায়িম। চোখ উঠিয়ে বারান্দার দরজায় বাসন্তী দাঁড়িয়ে, চোখ গোল গোল করে দেখছে তাকে।
“কী হলো? জীবনও দেখো নাই আমারে খালি গায়ে না কি প্যান্ট খোলার অপেক্ষায় আছো?”
চটজলদি চোখ সরিয়ে নেয় বাসন্তী, বারান্দায় ঢুকে পড়ে সে। মূলত বিভিন্ন অনুভূতিময় ভাবনার অথৈ সাগরে ডুবে ছিল সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, দরজা আটকানোর শব্দে এখানে আসে। আর নায়িমকে এত কঠিন ও জটিল মুহূর্তেও একাধারে মিথ্যা বলতে দেখেই বিস্মিত হয় সে।
আনমনেই ভাবে, “লোকটা আস্ত শয়তান! নাহলেও এতও সম্ভব!”
“যত্তসব!” বাসন্তীকে যেতে দেখে রাগের সাথে বিড়বিড়ায় নায়িম। তারপর ব্যস্ত হয়ে পরনের পোশাক ছেড়ে ঘরে পরার পোশাক পরতে।
___
রাত প্রায় নয়টা, খাওয়ার টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে সবাই। বাসন্তীর মনে হচ্ছে সে কোনো রাজপ্রাসাদে এসেছে। কী রাজকীয় সকল বাসন! স্বর্ণের পানি জড়ানো মনে হচ্ছে। আবার কী রাজার ভোজন! গরুর গোশতের কোফতা, মুরগি ভুনা, ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়িমাছের মালাইকারি, পায়েস ও রসমালাই।
এতসব খাবার দেখেও বাসন্তী খেতে পড়ল না। তার গলা যেন সংকুচিত হয়ে খাবার নামতে দিচ্ছে না। কত ধরনের অনুভূতি বোধ হচ্ছে। মনে পড়ছে নানুর বাড়িতে ভালো রান্না হলে খাটনি সে দিলেও এঁটো খাবার ছাড়া কিছুই ভাগে পড়ত না তার। সবচেয়ে বেশি দম আটকে আসছে নাহিবার জন্য। দুধের শিশু দূরে রাখলে কী আর মায়ের মন মানে!
সে শুনেছে আড়াল থেকে নায়িমের শত্রুরা না কি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। সেই কথার রেশ ধরেই এক আবেদন করে বসলো সে।
“বলছিলাম কী, আমরা যখন এখানে আছি আর আপনার শত্রুরাও তো পালিয়েছে। তাহলে নাহিবাকে কি এখানে নিয়ে আসতে পারেন না? এ বয়সী শিশুদের জন্য মায়ের দুধই তো সব। দুধের শিশু কীভাবে…”
“হ্যাঁ, খুব দ্রুতোই ও বাড়ি এসে পড়বে। তবে ভুলেও যেন এক থেকে দুই কান না হয় যে নাহিবা আমার মেয়ে। শুনতে পেরেছো?”
শেষ প্রশ্নটা ধমক দিয়েই বলে নায়িম। বাসন্তী সহ সবুজ শাড়ি পরিহিতা মেয়েগুলো কেঁপে উঠে ভয়ে।
“ছোট বাবু, আমাদের চৌদ্দ জন্ম আপনার বাড়িতে কাজ করেছে, নূন খেয়েছি আমরা এই বাড়ির, বেইমানি করব না। আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না আমাদের।”
একজন অল্প বয়স্কা নারী ভয়ে ভয়ে বলে। নায়িম ভ্রুক্ষেপ করে না। চুপচাপ খাবার খেতে থাকে। খাওয়া শেষে সবাই ধীরে ধীরে উঠে চলে যায়। হাত ধুয়ে নায়িম মোবাইল নিয়ে সোফায় বসে। অনিমেষও ধপ করে এসে তার পাশে বসে। তার দৃষ্টি নায়িমের মাঝে আবদ্ধ।
নায়িম বিষয়টা বুঝতে পেরেও এড়াতে উঠে চলে যেতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু উঠতে নিলেই অনিমেষ হাত ধরে আটকায়।
“জীবনের প্রতিটি কদমে যত দূর সম্ভব তার চেয়েও এগিয়ে যেয়ে তোর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। অথচ, কত কিছু থেকে আমাকেই আড়াল করেছিস তুই। এতটা অবিশ্বাস করিস আমাকে?”
“বাচ্চামো করিস না তো অনিমেষ। তুই নিজেও জানিস আমার জীবনে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ তুই। শুধু তুই।”
“তাহলে বলিসনি বা এখনও বলছিস না কেন? নিজের সত্য শিকার করলি। অথচ, অনেক কিছুই আড়াল করেছিস। নুসরাত মোস্তফার প্রাক্তন যদি তোকে এটাক করে, সে নিজে কই? তোর পিছনে কেন লেগেছে? নাহিবা বা ভাবীর কেন জীবনের ঝুঁকি? এসব আধোআধো কথা বা শুধু তোর বাস্তবতা গোটা অতীত জানতে চাই আমি।”
চলবে…