টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ১৮

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১৮তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“চৈতালির মায়ের থেকে চাচ্চু আমাকে নিয়ে যায়। আমার ইচ্ছে অনুযায়ীই হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে। অবশ্য হোস্টেল নয়, তুই তো গিয়েছিসই। এক কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট। কিন্তু সেখানে রেখে আসার আগে কোনো শোধন ছাড়াই জানা সত্যি আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে আমার সামনে।”

থামে নায়িম। কথা বলতে আজ এত কেন কষ্ট হচ্ছে বোধগম্য হচ্ছে নায়িমের। গলাটাও ভার ভার লাগছে। কেমন বিরক্ত বোধ হচ্ছে নিজের অনুভূতির প্রতিই! মুখশ্রী গম্ভীর রেখেই অতীতে হারিয়ে গেল সে।

অতীত,
নায়িম একদম চুপচাপ, গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল সম্পর্কের এই টানাপোড়নের পরে। নায়িমের দুঃসম্পর্কের চাচা তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। তার থাকার জন্য নির্ধারিত স্থানে দিয়ে আসার পূর্বে একটা নামীদামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়।

“চিকেন ফ্রাই আর সাব স্যান্ডউইচটা খুব ভালো এখানকার। খাবে?”

বিনয়ী বাণীতেও নায়িমের কণ্ঠ শোনা যায় না। ছেলেটার এমন খামখেয়ালি আচারণ যে একদম অস্বাভাবিক নয় তা খুব করে জানা তার চাচার। সেও আর জোর দেয় না, বরং খাবার অর্ডার করে।

“তুমি কি জানো তোমার মায়ের সাথে আসা ঐ লোকটা কে? প্রশ্ন উঠে না তোমার মনে যদি নুসরাত ভাবী যদি ঐ লোকটাকেই ভালোবাসতো তাহলে তোমার বাবাকে কেন বিয়ে করলে?”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায় জন্মদাত্রীর বেঁচে থাকাতে সর্বহারা হওয়া কিশোরটি।

“তোমার মা নুসরাত মোস্তফা হলেন খানদানি জমিদার বংশের মেয়ে, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বনি মোস্তফা তার বাবা। বনি মোস্তফার বাবা যে কি না তোমার নানার বন্ধু ছিলেন, তিনি বিয়ের বাহিরেও অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ছিলেন এক যাত্রাপালার মেয়ের সাথে। সেই ঘরেই জন্ম হয় তোমার নানা বনি মোস্তফার একমাত্র সৎ বোন বাতাসী। প্যাঁচের শুরুয়াতটা এখান থেকেই।

বাতাসীকে ঐ মেয়ে মোস্তফা বাড়িতে দিয়ে গেলে বনি মোস্তফার মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তা নিজ চোখেই দেখেছিল তোমার নানা বনি মোস্তফা। সেই থেকে তাঁর বাতাসীর প্রতি তিক্ততা। তবে খারাপ আচারণ করেনি কখনো শুনা যায়, বন্ধ দরজার আড়ালে কী হতো কে জানে? যাকগে বাতাসীকে বিয়ে দেওয়া হয় মোস্তফা বাড়িরই এক কর্মচারী শামসুর মিয়ার সাথে। তিনি স্বভাবে ছিলেন লোভী, নজর ছিল বংশের সহায়-সম্পদ আর পার্টির চেয়ারপার্সনের কুরসিটার দিকে।

বনি মোস্তফা খুব ভালোভাবেই জ্ঞাত ছিলেন এ নিয়ে। তাই নিজের বাবাকে পটিয়ে সকল সম্পত্তি আগেই নিজের নামে করিয়ে নিয়েছিলেন। তাতে যেন আরও ক্ষুব্ধ হন শামসুর মিয়া। নিজের ছেলে সাদিককে লেলিয়ে দেন নুসরাত মোস্তফার পিছনে। নুসরাত মোস্তফাও প্রেমে পড়েন সৎ ফুপাতে ভাইয়ের। কিন্তু এ বিষয়টি এক কান দু’কান হয়ে বনি মোস্তফার কানে যেতেই বাতাসী মোস্তফার বাসায় যেয়ে তাকে এবং শামসুর মিয়াকে জঘন্য ভাবে অপমান করেন তিনি। তারপর তোমার মায়ের বিয়ে দেন তোর মায়ের দাদার মানে তোমার নানুর ঠিক করা পাত্র তোমার বাবার সাথে।

নুসরাত মোস্তফা বাঙালি নারী, বিয়ের পর স্বামীই সব, এ যুক্তিতেই সংসার করে যাচ্ছিলেন। বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু হঠাৎ করে উনার কী যে হলো! সাদিক কীভাবে তোমার মায়ের জীবনে ফিরে এলো জানি না। তবে তোমার নানা মোস্তফা সাহেব বেঁচে থাকলে সব ঠিক রাখতেন। তোমার বাবা খুব ভালোবাসতেন তোমার মাকে। এত বড় ধাক্কা সামলে নিতে পারেননি। তোমার কষ্ট লাগবে জেনে, কিন্তু তিনি তোমার অস্তিত্ব নিয়েও স্বন্দেহ পোষণ করতেন। এজন্যই তুমি তার জীবনের বিষ হয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু মৃত্যুর আগের দিন তোমার ডিএনএ টেস্ট করেই ফেলেন। আর রিপোর্ট দেখে অনুতাপে আরও বেশি ড্রিংক করেন। এত চাপ নিতে না পেরে… উনি নেই, উনার দোষ আর নাই বলি।

যাকগে এবার সবই তোমার জানা হলো। খান বংশের ছেলে তুমি, মুক্তিযোদ্ধার বংশধর, বিচারক বাড়ির ছেলে, মোস্তফা সাহেবের নাতি। তোমার এমন শিকারীর ছোট্ট আঘাতেই হরিণ বনে গেলে হবে না, ওসব কিছু তোমার। তোমাকে সবকিছুর অধিকার নিতে হবে। সিংহের মতোন, বাঘের মতোন গর্জনে কাঁপিয়ে রাখতে হবে সবাইকে। মনের মধ্যে কষ্ট পুষলে হবে না, কষ্টকে রাগ বানাও, রাগকে অগ্নি। সেই রোষানলে তোমার অপরাধীদের ঝলসে দিতে হবে, যা তোমার তা তোমার করতে হবে। তুমি রাজা, এই হিংস্র বনের রাজার পদবি তোমায় ঠিক রাখতে হবে ছেলে।”

ক্রোধানল তো আগে থেকে জ্বলছিল নায়িমের হৃদয়ে, চাচার শেষের কথাগুলোতে অগ্নি যেন আরও তীব্রতর হলো। অস্বাভাবিকতা ছেড়ে বেশ আয়েশের সাথে পায়ে পা তুলে চিকেন ফ্রাইটা হাতে তুলে নিয়ে খেতে লাগল সে।

বর্তমানে,
নায়িমের মুখ থেকে নুসরাত মোস্তফা ও তার শত্রু সাদিক সম্পর্কিত সব শুনে শুকনো ঢোক গিলল অনিমেষ। তার কাছে শুনতেই কতটা জটিল লাগছে। আর এই ছেলেটা কেমন নির্বিঘ্নতার সাথে সব বলে যাচ্ছে।

“তোর মা…” এই শব্দ উচ্চারণ করতে নায়িমের আঁখি জোড়ার রোষানলে পড়ল সে। নিজেকে শুধরে নিল।

“আই মিন নুসরাত মোস্তফা আর সাদিক মিলে তো তোর থেকে খান এম্পায়ারের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল, ফিরে পেলি কী করে? আর নুসরাত মোস্তফা কোথায় এখন? উনিও কী মিলে আছে সাদিকের সাথে?”

“একদিন হুট করেই চাচ্চু কল করে জানায় নুসরাত মোস্তফার জানাজা আমাকে আসতে হবে এখানে। কিন্তু চাচ্চু বলে নিজের জিনিস নিজের অধীনে করতে বাঘকে শত্রুর আস্তানায় যেতেই হয়, নিজ গুহায় থাকলেই হয় না। রাজি হলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনক লাগল যখন চাচ্চু আমাকে সবার চোখের আড়াল করে নিয়ে যায়। একদম নিজের আর আমার মুখ-টুখ ঢেকে।

না, জানাজায় যাওয়া হয় না আমাদের। গোপণ এক জায়গায় নিয়ে যায় চাচ্চু। আমার বাবার উকিল উইল মোতাবেক আমাকে সব বুঝিয়ে দেয় সেখানে। তারপর আসে বনি মোস্তফার বিশ্বস্ত লোক জামশেদ আলী আঙ্কেল এবং মোস্তফাদের পারিবারিক উকিল। উইলে এমন কিছু ছিল যা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। যা চাচ্চুর আমাকে আড়াল করার কারণটিও ব্যাখ্যা করে।”

“কী?”

“আমার নানাজানের উইল অনুযায়ী, পুরো মোস্তফা বংশের সম্পত্তির মালিক তার একমাত্র নাতি নায়িম ফাজ খানের স্ত্রী হবে। মানে আমার স্ত্রী, বাসন্তী। আর পার্টির চেয়ারপার্সনের উত্তরাধিকারী হলো একমাত্র নাতি নায়িম ফাজ খানের সন্তান। মানে আমার মেয়ে নাহিবা।

জমশেদ আঙ্কেল আমাদের বলেন, ‘নুসরাতের মৃত্যুতে কোনো ঘাপলা তো আছে, বাবা। আমার মনে হয় উইলের কথা জানতে পাইরাই সাদিক আর সাদিকের বাপে তোমার মাকে… যেহেতু বুঝতে পারছিল সে কোনো কাজেই আসবে না। তোমার নানাজান আগেই আঁচ করেছিল এমন কিছু একটা হতে পারে, তাই মৃত্যুর আগেই এমন উইল তৈরি করে যায়। বাবা, তোমাকে তোমার শত্রুগো মতো শক্তিশালী, দমদার আর ক্ষমতাশীল হওয়া অবধি সাবধানে নয়, সবার আড়ালে পরিচয় গোপণ করে থাকতে হবে। কারণ তাগো চোখ তোমার আর তোমার স্ত্রী-সন্তানের জানের দিকেই।’

সেদিন যা বুঝার বুঝে নিয়েছিলাম। বুঝে নিয়েছিলাম স্ত্রী করা মানে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, তার উপর আবার নারী জাতি এত সহায়-সম্পদ পেলে মাথায় উঠে বসবে, ঠিক-বেঠিক ভুলে যাবে। বুঝতে পেরেছিলাম আমার সন্তানের জীবন আমার চেয়েও জটিল, পাষণ্ড, ক্রূর হবে। তবে দৈহিক, মানসিক চাহিদা তো ছিল? এর জন্যই এমন মেয়ের খোঁজ করি যে দিন-দুনিয়ার জ্ঞানহীন, মোহ-মায়া থেকে পবিত্র। ঠিক যেমনটা আমার বসন্ত কুমারী।”

অনিমেষ একটা ব্যাপার খেয়াল করে শেষ বাক্যটি বলার সময় নায়িমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছিল, যা অতি দ্রুততার সাথেই গম্ভীরতায় মুছিয়ে ফেলে সে। আবার ভাবছে এই ছেলেটা সব কিছুর মাঝেও কত স্বাভাবিক! কিন্তু এতটা স্বাভাবিক কী অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মাঝে স্বাভাবিক মানুষের হওয়া উচিত? অসম্ভব প্রায়, তাহলে এই ছেলেটি কেন?

নিজের তিক্ত ভাবনাগুলো গলাধঃকরণ করে পুনরায় মুখ খুলে সে।

“কিন্তু মাফিয়া-টাফিয়া এসব? আবার রাজনীতি এগুলোতে কী করে বা কখনই জড়ালি তুই?”

“একদিনে সারা মাসের ভোজন করত্ব হয় না রে পাগল। আজ এটুকুই জেনে রাখ, পরে আবার যা জানার জানা যাবে।”

___

ঘুম থেকে উঠেই এত সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পাবে বাসন্তী ভাবেনি কখনো। চোখ মেলতেই দেখতে পায় নায়িম নাহিবাকে কোলে নিয়ে খেলছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নাহিবাকে নায়িমের কোল থেকে তুলে নেয়।

নায়িম প্রথমে রাগ হলেও কী একটা ভেবে যেন বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। বাসন্তী আনমনেই ভাবে,

“লোকটার মাথায় কুবুদ্ধি থেকে এত সুবুদ্ধি হলো কবে?”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here