চন্দ্ররঙা_প্রেম_২ পর্ব ১৫

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৫
#আর্শিয়া_সেহের

শান কোনো বন্ধুকেই বলেনি বিথীকে পেয়েছে সে কথা। রুমঝুম আর শান মিলে প্লান করেছে বাকিদেরকে সারপ্রাইজ দিবে। সিন্থিয়া যেহেতু হসপিটালে আছে এখনো তাই মাহিম সুস্থ হওয়ার পরই ওদের সবাইকে বাড়িতে ইনভাইট করবে। তিহান দেশের বাইরে থাকায় ওকে আগে থেকেই ইনভাইট করে রাখা উচিত ভেবে শান তিহানকে কল করলো। তিহানও বছর খানেক আগে বিয়ে করেছে। মেয়েটা ভিনদেশী হলেও তিহানের সংস্পর্শে এসে তার চলাফেরা বেশ মার্জিত হয়ে গেছে। রুমঝুমের সাথে তার ভীষণ খাতির। মেয়েটার নাম অ্যামেলিয়া। তবে ওরা সবাই লিয়া বলে ডাকে। শানকে তিহানের সাথে কথা বলতে দেখে রুমঝুম বেরিয়ে পড়লো বিথীর কাছে যাওয়ার জন্য। মেয়েটা এতো বছরেও কি ভুলতে পেরেছে তিহান নামক তার প্রিয় বন্ধু, প্রিয়জন, ভালোবাসার মানুষটিকে?

-“দশ দিনের মধ্যেই দেশে আসবি। কিভাবে আসবি, আই ডোন্ট নো। তোকে আসতে হবে মানে হবে। ”
-“আরে ইয়ার এভাবে হয় নাকি? এখানে কত দরকারি কাজ আছে আমার । এগুলা ফেলে কিভাবে আসবো?”

শান বুঝলো এভাবে বললে হবে না। তিহান এমনিতেও দেশে আসতে চায় না। তাই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“আসলেই তো,কিভাবে আসবি? বড় কথা হলো আসার দরকারটা কি? এখানে আছে কে যে আসতে হবে? আচ্ছা শোন, তোর আসতে হবে না। রাখছি।”
তিহান তাড়াহুড়া করে বললো,
-“শোন শোন, শান শোন না। আমি সরি রে। আচ্ছা আমি আসবো। দশ দিনের মধ্যেই আসবো। রাগ করিস না তুই,প্লিজ।”

শান নিঃশব্দে হাসলো। কন্ঠটা যথাসম্ভব গম্ভীর রেখেই বললো,
-“আসবি কি আসবি না সম্পূর্ণ তোর ইচ্ছা।”
তিহান কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“আরে বাবা আসবো তো।‌ কবে আসবো জানিয়ে দিবো। রাগ করিস না দোস্ত।”
শান ঠোঁট কামড়ে হাঁসি আটকালো। পেট ফেটে হাসি আসছে তার । কিন্তু এখন হাসা যাবে না একদমই। হাসলেই সব শেষ।

সাঁঝ বিন্দুর সাথে খেলছে। আজকে সে স্কুলে যায়নি। রুমঝুম আর বিথী গেস্ট রুমে বসে আছে। রুশান আপাতত শান্তর রুমে আছে।
রুমঝুম বিথীর কাছে এগিয়ে এসে বসলো। বিথী মুচকি হেঁসে বললো,
-“আমি জানি তুমি কি চাও এখন।‌ ”
রুমঝুম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“কি চাই বলো তো?”
-“জানতে চাও। আমার সাথে কি কি হয়েছে সবটা জানতে চাও।”
রুমঝুম অবাক হয়ে বললো,
-“কিভাবে বুঝলে আমি এটা জানতে চাই?”
বিথী হাসলো। কোনো উত্তর দিলো না। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর বললো,

-“তোমার জন্মদিনের দিনটা মনে আছে রুমঝুম? যেটা আমাদের সাথে কাটিয়েছিলে?”
-“হ্যাঁ আছে তো।”
-“সেই দিনটাই আমার কাল ছিলো। রেস্টুরেন্টে গিয়ে যখন আমরা চারপাশ সাজাচ্ছিলাম তখন কয়েকটা বাচ্চা ছিলো ওখানে। সিন্থিয়া কাজে মগ্ন থাকায় বাচ্চাগুলোর সাথে বেশি কথা বলেনি। আমি কাজে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে ওদের সাথে গল্প, হাসাহাসি করছিলাম। তখনই ওই বদমাইশটা দেখেছিলো আমাকে। ওর আমাকে ভালো লাগেনি,ওর ভালো লেগেছিলো অচেনা বাচ্চাদের সাথে আমার মিশে যাওয়ার স্বভাবটা। ওদের‌ এই বাচ্চা পাচার করা কাজে এমন একজন দুজন মানুষ দরকার হয় যারা বাচ্চাদের সাথে খুব ভালো মিশতে পারবে, তাদের সামলাতে পারবে।
রাশেদ আমাকে ওই কাজের জন্যই বেছে নিয়েছিলো। আমার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ওর এই কালো অধ্যায় সেখানে অপ্রকাশিত ছিলো। রাশেদের আরেকটা ভাই আছে। ওর ব্যাপারে আমি বা কেউই তেমন কিছু জানি না। শুধু একবার দেখেছিলাম ওকে। সে দেশে খুবই কম থাকে। তবে এই কাজে সেও জড়িয়ে আছে এই ব্যাপারটা আমি জানি।

ওর আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তারাও ভাবে ওরা দুই ভাই খুব সৎ। ওদের এই জঘন্য রুপটা কেউই দেখেনি। আমার পরিবারের সবাই এতো ভালো আর প্রতিষ্ঠিত ছেলে পেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি হয়ে যায়। রাজি ছিলাম না শুধু আমিই। তোমাদের বিয়ের পরেরদিন তিহানের একটা কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম এই বাড়ি থেকে। সেটাই আমার স্বাভাবিক জীবনের শেষ দিন ছিলো রুমঝুম।
সেদিন ঝোঁকের বশে নিয়ে নিয়েছিলাম জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। রাজি হয়ে গিয়েছিলাম বিয়েতে। পরে আবার আমার মত পাল্টে যাবে ভেবে আমার পরিবার তাড়া দিলেন বিয়ের জন্য। কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিলেন আমার।

ততদিনে আমার রাগ পানি হয়ে গিয়েছিলো। আমি চেয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে আবার যোগাযোগ করতে‌। ওদের না বলে বিয়ে করেছি এটার জন্য আফসোস হচ্ছিলো খুব। আমি ওদের কথা শেয়ার করেছিলাম রাশেদের সাথে। যখন আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলাম তখন রাশেদ বারন করলো। বললো সারপ্রাইজ দিবে সবাইকে।”

-“সত্যিই আমি সারপ্রাইজড হয়েছি বিথী।”
বিথীর কথার মাঝেই শান বললো। শান এতোক্ষণ ধরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনছিলো যা ওরা খেয়াল করেনি। শানের কথা শুনে বিথী ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।
শান‌ ভেতরে এসে রুমঝুমের পাশে বসলো। বিথীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তারপর কি হয়েছিলো?”

-“তারপর? তারপর আমি বিশ্বাস করেছিলাম রাশেদকে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ও আমার পরিবারকে বললো আমাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে। আমার পরিবারও রাজি হয়ে গেলো। মেয়ে জামাইয়ের উপরে কথা বলা তো ঘোর অপরাধ। আমার পরিবারকে ঢাকায় শিফট করে দিলো রাশেদ। বাবাকে ওখানে চাকরি দিয়ে দিলো। আর আমাকে নিয়ে আটকালো অন্ধকার এক কুঠুরিতে। আমার পরিবার জানে কোনো এক এক্সিডেন্টে মারা গেছি আমি। তাদের মেয়েটা মৃত।
বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমার ছেলে বৃত্তের জন্ম হয়। ততদিনে আমি রাশেদের সব খারাপ কাজ সম্পর্কে জেনে গেছি। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না। আমি পালাতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হয়েছি। বৃত্ত ওর নিজের ছেলে ছিলো। ভেবেছিলাম ছেলেটাকে হয়তো ছেড়ে দিবে। কিন্তু না! ছাড়েনি। ওকে বাঁচানোর জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম আমি। ছেলেটাও আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে ছিলো। টেনে হিচড়ে নিয়ে গেছে আমার বুক থেকে ওকে। এরপর একটা পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গিয়েছিলাম আমি। ও আমাকে ছুঁতে এলেও নড়াচড়া করতাম না। যখন মেয়েটা পেটে এলো তখন থেকে আবার একটু একটু করে স্বাভাবিক হলাম। ওকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে নামলাম। তারপরেই তো শানদের সাথে দেখা। ”

রুমঝুম আর শান মনোযোগ সহকারে সবটা শুনলো। তারা সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু এটুকুই ভাবছে যে বাবা কিভাবে সন্তানকে মরনপথে ঠেলে দেয়? কিভাবে? সত্যিই এমন হয়?

দু’দিন ধরেই পুনমের সাথে তেমন কথা হচ্ছে না রুশানের। ব্যস্ত থাকার জন্য শুধুমাত্র খোঁজ খবর নেওয়ার মতই কথা হয়েছে দু’জনের। এখন আবার পুনম কে কল করবে তখনই তধিম এসে হাজির। সে এসেছে রুশানকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রুশানও না বলার মতো কোনো কারন পেলো না। অগত্যা তধিমের সাথেই যেতে হলো।

দু’দিন ধরেই তনিম আর পিহু পুনমকে বলছে তার বিয়ে ঠিক হওয়ার ব্যাপারটা রুশানকে জানাতে। কিন্তু পুনম বারবার না বলছে। সে সরাসরি বলে দিয়েছে এই বিয়েতে সে রাজি। পিহু জানে এটার পেছনে কোনো কারন আছে। তবে পুনম মুখ খুলছে না বলেই জানা যাচ্ছে না। তাই আজ পুনমকেও সে নিয়ে এসেছে তার বাড়িতে।

তনিম আর রুশান সদর দরজায় এসেই শুনতে পেলো পুনম আর পিহুর কথা। পুনম কেঁদে কেঁদে বলছে,
-“আমাকে এই বিয়ে করতেই হবে আপু।তোরা কেউ বারন করিস না প্লিজ।”

রুশান তঝিমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ইশারাতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কার বিয়ের কথা বলছে? আর পুনম কাঁদছে কেন?”
তনিম চোখের ইশারায় বললো,
-“আগে সবটা শুনুন।”

-“কেন বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিস তুই? আমাকে বুঝিয়ে বল। মনে একজনকে রেখে অন্যজনের সাথে কেন সংসার করবি তুই? রুশান ভাইয়াও তোকে ভালোবাসে। তাদের অবস্থাও ভালো। তাহলে এই ছেলেমানুষী কেন পুনম?”
পিহু নরম কন্ঠে বললো।

পুনম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“আগেরদিন মা আর মামা আমার বিয়ের কথা বলছিলো। ছেলেটা একবছর আগে মামার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। তার নাকি অনেক টাকা। বেশিরভাগ সময় সে দেশের বাইরে কাটায়। আমাকে তার সাথে বিয়ে দিতে পারলে মামার অনেক লাভ বুঝলি আপু? মামার দুই ছেলেকেই ভালো চাকরি পাইয়ে দিবে। মামার হাত ভরে টাকা দিবে। এসব তো রুশান দিবে না।
মামা আমার পেছনে এই একবছর যা যা খরচ করেছে সব ওই ছেলের দেওয়া। আমি যদি বিয়ে না করি তাহলে সারাজীবন মামা মা’কে কথা শুনিয়ে যাবে আপু।”

পিহু চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
-” মা কে কেন কথা শোনাবে?”
পুনম পিহুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” কারন একবছর আগে মা মামাকে কথা দিয়েছিলো ,মামা যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করবে মা তার সাথেই আমার বিয়ে দিবে। মা তখন আমার পড়াশোনা আর ভালো ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করেছিলো। মামা প্ল্যান করেই এটা করেছিলো তখন। একটা বছর আমাকে পড়িয়েছে শুধু দেখানো পড়ানো। মা এখন না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে। আমি তার মুখে অসহায়ত্ব দেখেছি আপু। মা আমার ভালোর জন্য আমাকে আমার ভালোবাসার মানুষটার হাতেই তুলে দিবে আপু,আমি জানি। কিন্তু তারপর? আমি রুশানকে বিয়ে করলে আমরা ভালো‌ থাকবো, মা খুশি হবে কিন্তু মামা চিরকাল মা’কে বলবে তুই কথা দিয়ে কথা রাখিস নি। তোর দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করেছিস তুই ‌।

আপু, মা এসব শুনে শুনে জীবন পার করবে কিভাবে বল? সে তো এই কথাগুলো শুনতে শুনতেই অর্ধেক মরে যাবে। তার চেয়ে ভালো আমিই আমার ভালোবাসাকে শেষ করে দেই। মা নাহয় সুখে থাকুক এবার। সে আর কত কষ্ট করবে বল ? এবারের কষ্টটা না হয় আমিই পেলাম। ”

পিহু থ হয়ে গেছে। তার মামা এতোটা নীচ সে বুঝতেই পারেনি কখনো। পুনম সোফা থেকে নেমে পিহুর পায়ের কাছে বসে পড়লো। পিহুর কোলে মুখ লুকিয়ে বললো,
-“আমি ওকে খুব ভালোবাসি, আপু। মা সেদিন মামাকে কথা না দিলে আমি যেভাবেই হোক রুশানকেই বিয়ে করতাম। আমি কিভাবে বাঁচবো ওকে ছাড়া? কিভাবে? ওকে ছাড়া আমার একটা দিন কাটে না আপু। ওর সাথে কথা বলতে না পারলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি মরে যাবো আপু,মরেই যাবো।”
পিহু মুখ চেপে কাঁদছে। একই আগুনে তারা দু’টো বোনই কেন পুড়লো? তাদের জীবনটাই কেন এমন হলো?

রুশান পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। পুনমের সব কথাই সে শুনেছে,বুঝেছে। মেয়েটা বড় বেশি ভালো। একটু স্বার্থপর হলে কি হতো? মায়ের কথা না ভেবে নিজের কথা কেন ভাবলো না মেয়েটা?
তনিম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুশানের দিকে। সে ভেবেছিলো রুশান কোনো রিঅ্যাক্ট করবে। কিন্তু রুশানকে একদম শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তনিম অবাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালো।

রুশান নিঃশব্দে দরজা থেকে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো। তনিমও এলো পিছু পিছু। রুশানের এলোমেলো ভাবে এগিয়ে চলা তনিমের চোখে পড়লো। সে ভালো করেই বুঝতে পারলো রুশানের মধ্যে কেমন তোলপাড় চলছে। গেটের কাছে এসে তনিম রুশানের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
-“আমি আপনাকে পৌঁছে দেই,স্যার?”
রুশানের হাতের ইশারায় থামতে বললো তনিমকে। বাইকে বসে বললো,
-“মেয়েটাকে বলে দিও ,ওকেও আমি ভীষণ ভালোবাসি।‌ ওকে ছাড়া আমারও দম বন্ধ হয়ে আসে। ওকে ছাড়া আমারও দিন কাটে না।”

রুশান বাইক স্টার্ট দিলো। ঝাপসা চোখে পথঘাট দেখতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও সামনে এগোচ্ছে। জীবন তো এমনই। যাই হয়ে যাক, সামনে এগোতেই হয়।

চলবে……..

( এখন একদল এসে আমাকে বকাঝকা করবে আমি জানি। 😒
রি-চেক দেইনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here