#আলো_আঁধার [৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
-“আমি আলোকেই বিয়ে করব। ও-ই আমার বউ হবে। এতে যদি কারো কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আমাকে বলো। আমি আলোকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
ছেলের কথা শুনে ইয়াসির খান রাগ সামলাতে না পেরে কাঁপা গলায় বললেন,
-“দীপ্ত তুমি কিন্তু অসভ্যতা করছো।”
-“করলে করছি বাবা। কোনোকালেই তো আমি তোমাদের চোখে সভ্য ছিলাম না।”
-“দীপ্ত! ”
বাবা ছেলের মাঝে গুরুতর ঝগড়া লেগে যাবার আগে আব্দুর রহমান খান ওদের দু’জনকেই থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
-“বিয়ে তোমার যাকে খুশি তুমি তাকেই করতে পারো। এতে আমাদের আপত্তি থাকার কিছু নেই। দুই বছর আগেও আমি তোমাকে বাধা দেইনি। এবারো দেব না। কিন্তু যে মেয়ে তোমাকে দুই বছর আগে ফিরিয়ে দিয়েছে। এবার কি সে তোমাকে গ্রহণ করবে? এবারো যে এই মেয়ে নিজের বাবা মা’র কথা শুনে তোমার হাত ছেড়ে দিবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে তোমার কাছে।”
দাদুর কথা শুনে দীপ্তর ঠোঁটের কোণে মুহূর্তের জন্য হাসির রেখা ফুটে ওঠে মিলিয়ে গেল।
-“এবার আলো পিছিয়ে যাবে না দাদু। সেই নিশ্চয়তা এবার আমার হাতেই।”
-“না গেলেই ভালো। তবে আর একটা কথা। তুমি আমার নাতি। তোমার সুখের কথা ভেবে তোমার সব আবদার, সব পাগলামি, সব জেদ মেনে নিলেও যদি কখনও এমন সময় আসে যে, তোমার জেদের জন্য আমার বংশের মাথা নিচু হয়েছে। তাহলে তুমি আমার যত আদরেরই হও না কেন? আমি তোমাকেও ছেড়ে কথা বলব না।”
-“তেমন কিছুই হবে না দাদু। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।”
সব ঝামেলা এত সহজে মিটে যাচ্ছে দেখে মাঝখান থেকে মেজ চাচী বলে উঠলেন,
-“কিন্তু বাবা, এই মেয়ের স্ট্যাস্টাস আর আমাদের স্টাস্টাসে রাত-দিন, আকাশ-পাতাল তফাৎ। এই মেয়ে কীভাবে এই বংশের বউ হবে বাবা! তার উপর ওর আগেও একবার বিয়ে হয়েছে।”
দাদু কিছু বলার আগেই দীপ্ত হুংকার ছেড়ে বলল,
-” অহ! স্ট্যাস্টাসের কথা তুমি বলছো মেজো মা!’ হাসছে দীপ্ত, তোমার মুখে না এসব কথা ঠিক মানায় না। তোমার বাবা তার দুই নাম্বারি কাজের দায়ে মাসে কয়বার জেলে যায় হিসেবে আছে তো তোমার কাছে? নাকি আমি আবার একবার বলে মনে করিয়ে দেব? আচ্ছা, এইতো তিনদিন আগের একটা ঘটনা মনে করিয়ে দেই। তোমার বাবা নাকি মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করে, এমন একটা গুজব বেরিয়েছিল। আমার কাছে গুজব বলে মন হয়না অবশ্য। তুমিও ভালো করেই জানো সত্যিই তোমার বাবা এই কাণ্ড করেছে। সেজন্য উনাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে। খবরটা নিতান্তই গুজব। এতে সত্যতা নেই প্রমাণ করিয়ে উনি রাতারাতিই বেরিয়েও আসেন।”
সবার সামনে দীপ্তর করা এই অপমানে মেজো চাচী থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। চোখ আগুন করে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললেন,
-” তোমার এতবড় সাহস। তুমি আমার বাবাকে…
রাগে কাঁপতে কাঁপতে কথা শেষ করতে পারলেন না উনি। দীপ্ত চাচীর এই বেহাল অবস্থা দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছে। ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে সে বলল,
-“এ বাবা! না,না। তোমার বাবা আমার নানা হন। নানার সম্পর্কে এই কঠিন সত্য আমি কোনো অবস্থাতেই উচ্চারণ করতে পারি না।”
জিভে কামড় দিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে বলতে থাকল, “উনি মদ,গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মেয়ে নিয়ে… যা খুশি তা করুন। আমি কিছু বলতে পারব না। কারণ উনি আমাদের আত্মীয়। তার থেকে বড় কথা, সমাজে তোমাদের স্ট্যাস্টাস কত উপরে দেখতে হবে না!”
দাঁতে দাঁত চেপে মেজ চাচী বললেন,
-“দীপ্ত! আমি তোমার বাড়াবাড়ি একদম সহ্য করব না। এক্ষুনি আমি তোমার চাচ্চুকে বলছি দাঁড়াও।”
দীপ্ত যেন চাচার কাছে বিচার দেওয়ার চাচীর এই হুমকিতে ভীষণ ভয় পেয়েছে এমন মুখ ভঙ্গি করে বলল,
-“আমি ভীষণ ভয় পেলাম।”
দীপ্তর বাবাও মেজ বউয়ের বাবা লোকটাকে বিশেষ পছন্দ করেন না। কারণ উনারা আলাদা পার্টির লোক। তাই তিনি ছেলেকে বাধা দেওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলেন না। বরং তিনি এই মুহূর্তে ছেলের করা প্রতিটা আচরণে মজা পাচ্ছেন। তার ছেলে মেজ ভাইয়ের অতি আধুনিক এই বউটিকে ঘোলের পর ঘোল খাইয়ে যাচ্ছে দেখে আনন্দ অনুভব করছেন। দীপ্তিটা যা অ্যাক্টিং করতে পারে! মনে মনে উনি বললেন,
-” বাপকা ব্যাটা! আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ মাই সান। এগিয়ে যাও। ওই মুখোশধারী সাপের সব বিষ বের করে দাও।”
আব্দুর রহমান খান এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে সবটা দেখে যাচ্ছিলেন। উনার মেজ ছেলের বউ দীপ্তকে মনে মনে হিংসে করে এটা উনি জানতেন। কিন্তু দীপ্ত কবে থেকে এতটা অভদ্র হয়ে গেল ভেবে উনি স্তম্ভিত। দীপ্ত তো আগে এমন ছিল না। হ্যাঁ, একটু রাগী ছিল এটা তিনি অস্বীকার করবেন না। বাইরের মানুষের সাথে যা-ই করুক। কিন্তু পরিবারের কেউ তাকে একটা চড় মারলেও চুপ করে থাকার স্বভাব ছিল তার। আজ সেই স্বভাবের দীপ্তর সাথে উনার সামনে দাঁড়ানো দীপ্তর কোন মিল খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। দীপ্ত কবে উনার অজান্তে এভাবে পুরোপুরি পাল্টে গেল!
-“অনেক হয়েছে। আমি যে এখানে আছি তা হয়তো কারো মনে নেই। তোমরা থামো এবার। নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে অমন লেগে পড়লে তোমরা?”
-“বাবা দীপ্ত আমার বাবাকে…
-“দাদু আমি রুমে যাচ্ছি। ওকে নিয়ে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। ওর জ্ঞান ফেরাতে হবে।”
বলেই দীপ্ত কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে, কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগল। আব্দুর রহমান খান সবার উদেশ্যে বললেন,
-“তোমরা সবাই নিজেদের ঘরে যাও। আজকের পর যেন এই বিষয় নিয়ে কারো মুখে আর একটা কথা না শুনি। এটা আমার হুকুম।”
_________________________________________
দীপ্ত আলোকে ওর রুমে নিয়ে গেল। এখনও আলোর জ্ঞান ফিরেনি। সে এখনো দীপ্তর বুকে মিশে আছে। দীপ্তর ইচ্ছে করছে না আলোকে নিজের থেকে দূর করতে। এভাবেই যুগের পর যুগ পার করে দিতে চায় সে। কিন্তু এখন আলোর জ্ঞান ফেরানো সবথেকে বেশি জরুরি। দীপ্ত আলোকে নিয়ে ওর বেডে শুইয়ে দিল। আলোর মুখের দিকে কতক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। পাশের টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আলোর চোখে মুখে পানির ছিটা দিল। আলো একটু নড়ে উঠল।
জ্ঞান ফিরছে আলোর। দীপ্তর মুখে হাসি ফুটে উঠল। আলোর চোখ পিটপিট করতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।
চোখের পাতা যেন ভারী পাথরে পরিনত হয়েছে। আলো চেষ্টা করেও চোখ মেলতে পারছে না। কোথায় এখন সে? তার বাচ্চাটা! সে কি বেঁচে আছে? নাকি ওরা দু’জন মৃত্যুর পরের জগতে এসে পড়েছে?
অনেক কষ্টে আলো চোখ মেলল। এত আলো! এত আলো কিসের? সে কোথায় আছে এখন। চোখ মেলেই সবার আগে দীপ্তকে দেখতে পেল সে। দীপ্ত আলোকে তাকাতে দেখে মৃদু হেসে বলল,
-“ঠিক আছো তুমি? এখন কেমন লাগছে? ”
-“কোথায় আছি আমি? আপনি…
-” আমার বাড়িতে আছো তুমি। তখন রাস্তায় তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে। আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি।”
আঁতকে উঠল আলো। এই পাগল লোক তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে কেন? আলোকে অপমান করা, লজ্জা দেয়াই কি এই লোকের আসল উদেশ্য? আলোকে লোকটা বুঝাতে চাইছে, সেদিন আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে তুমি ঠিক কাজ করোনি। আমাকে বিয়ে করলে আজ তোমার এই অবস্থা হত না। আমাকে বিয়ে করলে তুমি খুশি থাকতে পারতে। এত বড় বাড়ি,ব্যাংক ব্যালেন্স, গাড়ি, সম্মান মর্যাদা সব পেতে তুমি। তোমার একটা সিদ্ধান্তে এই সবকিছু তোমার হতে পারত। তোমার নিজের ভুলের জন্য আজ তোমাকে আশ্রয়হীন হয়ে রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে। সব ভুল তোমার আলো…
আলো নিজের অজান্তেই বলে উঠল।
-“না।”
ভ্রু কুঁচকে দীপ্ত বলল,
-“কী না আলো?”
-“আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? আমাকে এখানে নিয়ে আসতে আপনাকে কে বলেছে। আমি এখানে আসতে চেয়েছি? তাহলে কেন আপনি…
কথাগুলো বলতে বলতে আলো উঠতে যাচ্ছিল। দীপ্ত তাকে বাধা দিল।
-” এই আলো, তুমি এত আনইজি হচ্ছ কেন বলো তো। আমি একজন বন্ধু হয়ে তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। এর বেশি কিছু না। তোমাকে উত্তেজিত হতে হবে না। তোমার শরীর মনে হয় অনেকটাই দুর্বল।”
আলো কোন বাধা মানল না। সে একা একাই উঠে বসল। দীপ্ত তাকে সাহায্য করতে চাইলে হাত দেখিয়ে ওকে থামাল।
-“আমার শরীর অনেক ভালো আছে। আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আমি আপনার সাহায্য চাইনি। আমার রাস্তায় আমি একা।”
আলো হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে তার মাথা ঘুরে উঠল। কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচলটা পড়ে গেল। দীপ্ত বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ শাড়ির আঁচল দিয়ে আলোর শরীর পেঁচানো ছিল বলে দীপ্ত ওর গায়ে মারের দাগগুলো দেখতে পায়নি। আঁচল সরে যাওয়ায় দীপ্ত আলোর হাতে, পিঠে আঘাতের নীলচে দাগ স্পর্শ দেখতে পাচ্ছে। পিঠের কয়েকটা আঘাতে সুঁইয়ের ফোঁটার মত রক্তের ফোঁটা জমাট বেঁধে আছে। দেখতে দেখতে দীপ্তর চোখ মুখের ভাব কঠিন হয়ে উঠছে। আলো তাড়াতাড়ি করে আঁচল পেঁচিয়ে পিঠ,হাত ঢেকে নিল। দীপ্ত উঠে দাঁড়িয়েছে। দুই হাত মুঠো পাকিয়ে জলন্ত চোখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“এসব কীভাবে হয়েছে আলো? কে তোমাকে মেরেছে? তোমার স্বামী তোমার গায়ে হাত তুলেছে? ওই লোকের জন্য তোমার এই অবস্থা? তোমার গায়ে আঘাতের দাগের কারণ তোমার স্বামী তো?”
আলো দীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। দীপ্তকে বোঝার চেষ্টা করছে সে। দীপ্তর চোখ মুখের কঠিন ভাব দেখে আলোর ভয় লাগছে। সবটা জানলে দীপ্ত যদি তার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তার স্বামীকে কিছু বলে! নিজের কলঙ্কের সাথে দীপ্তকে জড়াতে চায়না সে। তাই আলো বলল,
-“এসব জেনে আপনার কাজ কী? আর আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এসব প্রশ্ন করছেন কোন অধিকারে? আপনার কোন প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই আমি। আমাকে যেখান থেকে এনেছেন সেখানে রেখে আসুন। নয়তো আমিই চলে যাচ্ছি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।”
আলো চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালে দীপ্ত পেছন থেকে ডাকল।
-“আলো!”
ওর কন্ঠে এমন কিছু ছিল যে আলো না দাঁড়িয়ে পারল না।
-“তুমি এখন কোথাও যাবে না। যতদিন না পর্যন্ত তুমি সুস্থ হচ্ছ ততদিন এই বাড়িতেই থাকবে। রাত বারোটার পরে কোন প্রেগন্যান্ট মহিলা নিশ্চয়ই মনের সুখে হাওয়া খেতে রাস্তায় বেরোয় না। আর ধরলাম তুমি হাওয়া খেতেই বেরিয়েছ। তাহলে তোমার বাড়ি থেকে এতদূর এসে ব্রিজের নিচে উঁকি দিয়ে নিশ্চয় হাওয়া খাচ্ছিলে না। আমার সামনে তুমি সেন্সলেস হয়েছে। আমি না থাকলে তুমি এই পেট নিয়ে নিচে কীভাবে পড়তে খেয়াল আছে? এতক্ষণে হয়তো তোমার বাচ্চা আর তুমি দু’জনই… তোমার গায়ে জ্বর। মারের দাগ স্পষ্ট। তবুও বলছো তোমার লাইফে সবকিছু ঠিক আছে! কোথাও কোন ঝামেলা নেই! আমাকে এতটা বোকা কেন ভাবছ? তর্ক করো না আলো। আমাকে একজন বন্ধু ভেবে তুমি আমার বাড়িতে থাকতে পারো।”
কথাগুলো বলেই দীপ্ত লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে গিয়ে কিড়মিড় করে উচ্চারণ করল,
-“ওই কুত্তার বাচ্চাকে আমি ছাড়ব না। জানে মেরে ফেলব। শুয়োরের বাচ্চাটা আমার আলোর গায়ে হাত তুলেছে! এত বড় সাহস ওর! ওকে আমি কুঁচিকুঁচি করে কেটে কুকুরকে খাওয়াব। তবেই আমার নাম দীপ্ত ইয়াসির খান।”
চলবে___