আলো_আঁধার পর্ব ২

#আলো_আঁধার [২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আলো এখনও চোখে হাত দিয়ে রেখেছে। তীব্র আলোয় চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে তার। সে ভেবে পাচ্ছে না, এই রাতের বেলা একটা গাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? হঠাৎ তার মনে একটা ভয় ঢুকে গেল। গাড়িতে যারা আছে তাদের মনে খারাপ কোন উদেশ্য নেই তো? আলো নিজের পেটের দিকে তাকাল। এই অবস্থায় আল্লাহ যেন তাকে কোন বাজে পরিস্থিতিতে না ফেলে। এই মুহূর্তে কোন বাজে লোকের পাল্লায় পড়লে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। মনে মনে দোয়া দরূদ পড়তে শুরু করল আলো। তখনই সশব্দে গাড়ির দরজা খুলে একটা লোক নেমে এলো। অন্ধকার থাকায় লোকটাকে চিনতে পারল না সে। কয়েক পা হেঁটে এসে লোকটা আলোর সামনে দাঁড়ালে আলো তাকে ভালো করে দেখে চেনার চেষ্টা করল। স্মৃতিতে একটু চাপ দেওয়ার পর আলো লোকটাকে চিনে ফেলল। আলো ভেবে পাচ্ছে না, এই লোক এখানে কী করছে?
দীপ্ত পলকহীন দৃষ্টিতে আলোকে দেখছে। আলোর মুখের উপর থেকে চোখ সরে সবার আগে ওর উঁচু পেটটার দিকে দীপ্তর চোখ গেল। আলো সেটা বুঝতে পেরে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালোভাবে পেট ঢেকে নিল। দীপ্ত সেটা দেখে হাসল। দীপ্তই আগে কথা বলল,

-“কেমন আছো, আলো?”

-“আপনি এখানে কোত্থেকে এলেন?”

দীপ্ত আবারও হেসে বলল,

-“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। দেখলাম কেউ একজন ব্রিজের নিচে উঁকি দিয়ে দেখছে। ভাবলাম সুইসাইড করতে যাচ্ছে হয়তো। মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এলাম। কাছে এসে দেখলাম মানুষটা একজন নারী।
আর এখন সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি সেই নারী আর কেউ না তুমি।”

আলো দীপ্তকে দেখছে। মানুষটাকে সে দুই বছর আগে থেকে চিনে। তেমন বিশেষ কোনো চেনা না। তবুও মানুষটাকে সে মনে রেখেছে একটা বিশেষ কারণে। দীপ্তকে এতটা সহজ হতে দেখে আলো মনে মনে ভাবল, এই মানুষটা কি সেই মানুষ! যে দুই বছর আগে তার জন্য কেমন একটা পাগলামি কাণ্ড করেছিল! এখনও ভাবলে বিশ্বাস হতে চায়না তার। দীপ্ত কি এই দুই বছরে সবকিছু ভুলে গেছে? নইলে আলোর সামনে এতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারছে কীভাবে? আলো নিজের পরিস্থিতির উপরই মনে মনে হাসল। দীপ্ত তার আজকের এই অবস্থার কথা জানতে পারলে নিশ্চয়ই একচোট হাসবে। তার সামনে প্রকাশ্যে না হাসলেও মনে মনে তো অবশ্যই হাসবে। হাসারই কথা। আলো তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বাবা মা’র পছন্দে ওই লোকটাকে বিয়ে করেছিল সেদিন। আলোর ভাবনায় ছেদ ফেলে দীপ্ত বলল,

-“তুমি এত রাতে এই ব্রিজের উপর কী করছো?”

আলো কোন উত্তর দিল না। দীপ্ত তার উত্তরের অপেক্ষা করে আবার বলল,

-“উঁকি দিয়ে যে দেখছিলে, তুমি জানো নিচে কত গভীর খাদ। বাই চান্স মাথা ঘুরে যদি নিচে পড়ে যেতে! তখন তোমার কী অবস্থা হতো ভেবে দেখেছ একবার?”

হুহ্, যার কপালে দুঃখ লেখা আছে, সে দুঃখ গুলো ভোগ না করে অত সহজে মরবে কী করে? আলোর উপর দিয়ে যে ঝড় যাচ্ছে তার থেকে মৃত্যুই তার কাছে সহজ মনে হয়। বেঁচে থেকে আলো প্রতিটা মুহূর্তে আর এই যুদ্ধ করতে পারছে না। তার সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে এসেছে। তাচ্ছিল্যের সুরে আলো বলল,

-“আমার কিছু হবে না। আমি এত সহজে দুনিয়া থেকে বিদায় নেব না।”

দীপ্ত কপাল কোঁচকাল। বলল,

-“ধরো যদি কিছু হয়ে যায়। নিজের জন্য না ভাবো’ দীপ্ত আলোর পেটের দিকে ইশারা করে বলল, ওর কথা তো ভাবতে পারো।”

আলো মনে মনে বলল,

-“ওর কপাল আর আমার থেকে ভালো কোন দিক দিয়ে! জন্মের আগেই নিজের বাপ তাকে অন্যের ‘পাপ’ বলেছে। নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকার করছে না। দুনিয়াতে এলে তার কপাল ভালো হয়ে যাবে না। তাকেও আমার মতই সারাজীবন দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে হবে।”

দীপ্ত হঠাৎ তাড়া দেওয়া গলায় বলল,

-“এত রাতে কোথায় যাচ্ছিলে বলো তো। আমি তোমাকে নামিয়ে দিই।”

-“তাহলে আর বাকি থাকবে না কিছু। কলঙ্কের ষোল কলা পূর্ণ হবে।”

-“কিছু বললে? আমি ঠিক শুনতে পাইনি।”

-“না। আপনাকে কিছু বলিনি।”

-“তাহলে চলো। তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। এই সময় একা যাওয়া তোমার জন্য সেফ হবে না।”

-“আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না। আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন, যেতে পারেন। আমি একা একাই যেতে পারব। আমার কোন সমস্যা হবে না।”

-“জেদ কোরো না তো। বলছি নামিয়ে দিয়ে আসি। চলো, গাড়িতে আসো।”

এত বলার পরও যখন দীপ্ত ওর কথা শুনছে না, তখন আলোর রাগ উঠে গেল। লোকটা কেন তার সমস্যা বুঝতে চাইছে না? কেন জেদ করছে? এখন উনার সাথে কোথাও গেলে বদনাম তারই হবে। এমনিতেই তো কত বদনামের ভাগিদার হয়েছে সে। লোকের চোখে তার কলঙ্কের শেষ নেই। নতুন করে আর কোন কলঙ্ক সহ্য করতে পারবে না সে। তাই আলো রেগে গিয়ে বলল,

-“আমি বলছি তো, আমি একা যেতে পারব। শুধু শুধু আপনি কেন জেদ করছেন? নিজের কাজে যান না আপনি। আমাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজের ভালো আমি নিজেই বুঝে নেব।”

দীপ্ত থতমত খেয়ে গেলেও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে আবার বলল,

-“আলো, কিছু হয়েছে তোমার? এনিথিং রং? তুমি এমন বিহেইভ করছো কেন?”

আলোর মাথা ফেটে যাচ্ছে। সে আর সহ্য করতে পারছে না। এমনিতেই ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। চোখ ভরে ঘুম আসছে। এদিকে এই ছেলে তার পিছুই ছাড়তে চাইছে না। তার জীবনে যা ইচ্ছা তা হোক, ধ্বংস হয়ে যাক সব। তাতে ওই ছেলের কী? সে কেন আলোর জন্য এত চিন্তা করছে! নাকি দুই বছর আগে তার সেই সিদ্ধান্তের জন্য এখন ওর বর্তমান অবস্থার উপর হাসছে! মজা নিতে এসেছে। আলো চেঁচিয়ে বলল,

-“আপনাকে বলেছি না, আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমার জন্য কেন অত দরদ দেখাচ্ছেন? আমি আপনার কে হই? যেখানে নিজের আপনজনেরা আমাকে নিয়ে ভাবে না। সেখানে আপনি কে? কেন আমার জন্য ব্যস্ত হচ্ছেন?”

বলতে বলতে আলো মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলে দীপ্ত এসে ওকে ধরে ফেলে। বেশি উত্তেজিত হওয়ার কারণে আলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সকাল থেকে খাওয়া হয়নি। পেটে একটা দানাপানি পড়েনি। সে তো এখন একা না। এই শরীরে এত ধকল সহ্য হয় এখন! সকাল থেকে না খাওয়া, তার উপর শরীরের উপর এত অত্যাচার। মারের জায়গায় গুলো এখন নীলচে হয়ে শক্ত জমাট বেঁধে গেছে। মা’র ওখান থেকে বেরিয়ে এই অবস্থায় দুই কিলোমিটার হেঁটেছে। যার ফলস্বরূপ আলো এখন জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে নিচ্ছিল। দীপ্ত না থাকলে আলো পড়েই যেত। দীপ্ত আলোকে ধরার পর বুঝতে পারল আলোর গা গরম। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। দীপ্ত আর দেরি করল না। আলোকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসিয়ে দিল। দীপ্ত নিজে ড্রাইভিং সিটে ওঠে বসে আলোর মাথা ওর কাঁধে রেখে গাড়ি স্টার্ট করল। আলো তার পাশে,তার কাঁধে মাথা রেখে, তার বাড়িতে যাচ্ছে ভাবতেই মনটা নেচে উঠছে দীপ্তর। এই মেয়েটাকে এক সময় সে ভালোবেসে ছিল। এখনও বাসে। আলোকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেছিল এক সময়। সেটা সত্যি নাহলেও এখন তো আলো তার পাশে আছে। ইশশ, এই সময়টা যদি এখানেই থেমে যেত।

দীপ্ত অচেতন আলোকে কোলে নিয়ে মেইন ডোর দিয়ে ঢোকার সময় মেজ চাচীর চোখে পড়ে গেল। মেজ চাচী ডাইনিংয়ে পানি খাচ্ছিলেন। দীপ্তকে দেখে হাত থেকে গ্লাস রেখে গলা ফাটিয়ে সবাইকে ডাকতে লাগল,

-“বাবা! বাবা, ভাইজান! ও ছোট কোথায় তোরা? জলদি এদিকে আয়। এসে দেখে যা দীপ্ত কাকে নিয়ে এসেছে। বড় ভাবী এলেন না, আপনার ছেলে কী কাণ্ড করেছে এসে দেখে যান একবার।”

দীপ্ত মেজ চাচীর কথায় কান না দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মেজ চাচীর স্বভাবই ছোট একটা বিষয় নিয়ে চিৎকার চেচাঁমেচি করে তাকে হাতির রূপ দেওয়া। কিন্তু ততক্ষণে মেজ চাচীর ডাকে সবাই হলরুমে এসে গেছে। দীপ্তর দাদা আব্দুর রহমান খান সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে গমগমে গলায় বললেন,

-“কী হয়েছে এখানে? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি? এত চিৎকার চেচাঁমেচি কিসের? সবাই কি ভুলে গেছ এটা ভদ্র লোকের বাড়ি। রাত বিরাতে হৈচৈ আমি একদম সহ্য করব না।”

মেজ চাচী সাথে সাথেই বলে উঠলেন,

-“চিৎকার চেচাঁমেচি কি এমনি করছি বাবা? দেখুন আপনার নাতি রাত বিরাতে কাকে যেন বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ওর দিকেই তাকিয়ে দেখুন না। মেয়েটা ওর কোলে ঘুমিয়ে আছে।”

দীপ্ত আগুন চোখে চাচীর দিকে তাকাল। চাচী আজ দীপ্তর চাওয়ায় ভয় পেল না।
দীপ্তর বাবা গলা চড়িয়ে এগিয়ে এলেন।

-“দীপ্ত, এসব কী হ্যাঁ? কাকে নিয়ে এসেছ তুমি? তুমি এভাবে যাকে তাকে যখন তখন এই বাড়িতে নিয়ে আসতে পারো না। এই বাড়ির কিছু নিয়ম আছে। তুমি সেসব নিয়ম অমান্য করতে পারো না।”

দীপ্ত শক্ত অথচ শান্ত গলায় বলল,

-“আমি যাকে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসিনি বাবা। আর এ বাড়ির কোন নিয়মও ভাঙিনি।”

মেজ চাচী আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। দীপ্ত চোখ পাকিয়ে উনার দিকে তাকালে উনি দমে গেলেন। তবুও মিনমিনিয়ে বললেন,

-“যাকে তাকে নিয়ে না আসলে এই মেয়েটা কে? মেয়েটা তো নিজের পায়েও হেঁটে আসছে না। সোজা কোলে ওঠে আসছে! বাবা!”

দীপ্তর মা এবার কথা না বলে থাকতে পারলেন না।

-“মেজ তুই চুপ করবি? আমার ছেলেকে নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না। তুই তোর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভাব। আমার ছেলের ব্যাপার আমিই ঠিক দেখে নেব।”

-“ভা-ভাবী ও…

দাদা ওদের থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-“আহ্, থামবে তোমরা? দীপ্তর সাথে আমাকে কথা বলতে দেবে? দীপ্ত, কে এই মেয়ে? ওকে এভাবে কেন বাড়িতে নিয়ে এসেছ?”

-“দাদু ওর আপাতত যাবার কোন জায়গা নেই। তাই ও কিছুদিন আমাদের বাড়িতে থাকবে।”

দীপ্তর বাবা অবাক হয়ে বললেন,

-“থাকবে মানে? ওর যাবার জায়গা নেই তাতে আমাদের কি? পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষেরই থাকার জায়গা নেই। তাই বলে কি সবাইকে তুমি আমাদের বাড়িতে এনে তুলবে! অচেনা একটা মেয়েকে আমাদের বাড়িতে কেন থাকতে দেব?”

-“সবার কথা জানি না বাবা। ওকে এই বাড়িতে থাকতে দেবে কারণ আমি ওকে বিয়ে করব। পৃথিবীর সব আশ্রয়হীন মেয়েকে যদি বিয়ে করতাম তাহলে হয়তো তাদের সবাইকেই এই বাড়িতে জায়গা দিতে হতো। সবাইকে যেহেতু করতে পারছি না। তাই আপাতত আলোকেই বাড়ির বউমা মেনে নাও।”

দীপ্তর এসব কথা শুনে সবার মুখ থেকে সমস্বরে একটা কথাই উচ্চারণ হল,

-“বিয়ে!”

-“হ্যাঁ, দুই বছর আগে আমি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। তখন পারিনি। কিন্তু এবার আমি কারো বাধা মানব না।”

বাবা রেগে গিয়ে বললেন,

-“দুই বছর আগে কেউ তোমাকে বাধা দেয়নি। ওই মেয়ে নিজেই তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।”

-“মানুষ মাত্রই ভুল বাবা। তখন সে যে ভুল করেছে তা এখন শুধরে নিবে।”

এতক্ষণে বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে মা বললেন,

-“তুই কি ওকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছিস দীপ্ত! মেয়েটা জেগে নেই কেন? অজ্ঞান করে তুলে এনেছিস! বিয়েতে এই মেয়ের মত আছে!”

দীপ্ত মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে ‘সব ঠিক আছে’ হাসি দিল। ছেলের মুখে এই হাসি দেখলে উনার আর কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু মেজ চাচী বলে উঠলেন,

-“কিন্তু এই মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তুমি একটা বিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে করবে দীপ্ত! ওর স্বামী কি ওকে ডিভোর্স দিয়েছে? নাকি তুমি ভয় দেখিয়ে…

দীপ্তর আগুন চোখের দিকে তাকিয়ে চাচী এর বেশি কিছু বলার সাহস পেলেন না।

চলবে__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here