#আলো_আঁধার [৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
-” বাবা, আপনি দীপ্তকে কেন বাধা দিলেন না। আপনি ওর এই পাগলামিতেও সায় দিচ্ছেন! ”
-“ইয়াসির মাথা গরম করে কখনোই কোন কাজ আদায় হয়না। রাগারাগি বকাবকি করে তো দীপ্তকে একদমই আটকানো যাবে না। বুদ্ধি দিয়ে ওকে আটকাতে হবে।”
-“কিন্তু সেটা কীভাবে? এবার তো ও মেয়েটাকে বাড়িতে এনে তুলেছে। আমাদের হাতে আর কিছুই করার নেই।”
-“আছে। অনেক কিছুই করার আছে।”
-“ওই মেয়ে আমার ছেলের পিছু ছাড়বে না বাবা। ছোট লোকের বাচ্চাটা আমার ছেলের উপর কোন যাদু করেছে কে জানে। দুই বছর আগেও দীপ্ত এই মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য কী কী না করেছে! ওর জন্য আমাদের দি…
-“পুরোনো কথা মনে করে লাভ নেই। দীপ্তও সেবার তিনমাস কোমায় ছিল। হাসপাতালের বেডে আমার নাতিটা যেভাবে পড়েছিল সেই দৃশ্য আমি পুনরায় দেখতে চাই না। এবার যা করার আমাদের ভেবেচিন্তে করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে মাথা গরম করা যাবে না।’
-“ওই মেয়ের জন্য ইয়াসিন আমাদের সাথে থাকে না। ছোট বউ বেঁচে থেকেও জিন্দা লাশ হয়ে আছে। আমাদের পুরো পরিবারটা ওই মেয়ের জন্যই এলোমেলো হয়ে গেছে। ওই মেয়েকে আমি এত সহজে ছাড়ব না বাবা। আপনি দেখে নিয়েন ওই মেয়ের বেঁচে থাকা মুশকিল করে দেব আমি।’
মেজ চাচী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনলেন। এটাই তো চাইছিলেন তিনি। একটা ভিখারি নাকি এই বাড়ির বউ হবে! উনার সমানে সমানে আসবে। ছোটলোকের কত বড় স্বপ্ন। মেজ চাচী রহস্যময় হাসলেন।
-” বাবা, এবার দেখবেন আপনার মেজ বউমা কত কাজের। আপনাদের কাজ আমি সহজ করে দেব।”
-__________________________________________________
–” আমার বাকি টাকাটা কবে হাতে পাব? আপনি কিন্তু বলেছিলেন কাজ শেষ হলেই টাকাটা আমি পেয়ে যাব।’
দীপ্তর গলায় সামান্য রহস্যভাব। সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল,
-“পাবে, পাবে। অবশ্যই পাবে। এই দীপ্ত ইয়াসির খান কখনো কথার বরখেলাফ করে না। তুমি ঠিক সময়ে তোমার প্রাপ্য সম্মাননা পেয়ে যাবে। আমি তোমার কাজে খুশি হয়ে হয়তো বকশিশও দিতে পারি।’
-” সত্যি! সত্যি বলছেন আপনি? আমার কাজে আপনি খুশি হয়েছেন! আমি জানতাম, তাই তো এমন কঠিন চাল চেলেছি যে, আলোর কথা কেউ এক পয়সা দিয়েও বিশ্বাস করেনি। আমি যা বুঝিয়েছি ওর স্বামী তা-ই বুঝেছে।’
-” দেখলাম।’
-“টাকাটা কি আজ দিবেন মিস্টার দীপ্ত? ‘
-” হ্যাঁ অবশ্যই। টাকা আমি রেডি করেই রেখেছি। কিন্তু প্রবলেম হলো, টাকা তোমাকে নিজে এসে নিতে হবে।’
-“আমি? কিন্তু…
-” আজ রাতে আমার লোকেরা তোমার বাড়ির সামনে টাকা নিয়ে অপেক্ষা করবে। তুমি কিছু একটা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে টাকা নিয়ে যেও।’
আলোর জা(লিজা) খুশিতে গদগদ করে রাজি হয়ে গেল।
-“ঠিক আছে। আমি যাব। আমি গিয়ে টাকা নিয়ে আসব। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব।’
-“ধন্যবাদ দিতে হবে না। তুমি আমার কাজ করেছ। তাই আমি তোমাকে খুশি করার জন্য সামান্য ক’টা টাকা… যাক বাদ দাও। এবার তাহলে আমাদের একে অপরকে আর প্রয়োজন পড়বে না।’
-“না,না। কী যে বলেন। আপনার যেকোনো দরকারে যদি আমি কাজে লাগি তাহলে বিনা দ্বিধায় আমাকে ডাকতে পারেন।’
-“ওকে। রাখি তাহলে। গুড বাই।’
ফোন রেখে লিজা লাফাতে লাগল। লোকটা গাধা নাকি হ্যাঁ?
-“এক লাখ টাকা নাকি সামান্য টাকা! আলো এমনিতেই আমার রাস্তার কাটা ছিল। নিজের রাস্তার কাটা সরিয়ে এক লাখ টাকা! আল্লাহ এতদিন পর আমার দিকে মুখ তুলে তাকালে তুমি।’
কল কেটে দীপ্ত মুচকি হাসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে গা ছেড়ে শুয়ে পড়ল। সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ভাবছে সে। এই অতিলোভী বোকা মহিলা তাকে সাহায্য না করলে আলোকে নিজের করে পেতে আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হতো তাকে।
___________________________________________
রাতে আলোর ঘুম হয়নি। ঘুম না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে যাদের ভালো করে চেনে না, জানে না তাদের বাড়িতেই আছে। এবাড়ির সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। বাড়ির মানুষ গুলো তাকে কীভাবে গ্রহণ করেছে কে জানে? আদোও মানুষ গুলো তাকে গ্রহণ করেছে কিনা সেটাও জানে না সে। আলো পেটে হাত ধরে পায়চারি করতে করতে ভাবছে,
-” না, না। দীপ্ত বন্ধু হয়ে আমাকে সাহায্য করতে চাইলে তবুও আমি তার সাহায্য নিতে পারব না। আমার জন্য মানুষটার জীবনে নতুন করে কোন ঝামেলা তৈরি হোক তা আমি চাই না। আর তাছাড়া এখানে থাকলে এ বাড়ির মানুষগুলো আমাকে কী ভাববে! ওদের ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। এখন সমস্যায় পড়ে আবার ওদের বাড়িতেই উঠেছি! না, আমি চলে যাব।”
পেটে হালকা ব্যথা অনুভব করল আলো। সে তার বাচ্চার সাথে কথা বলছে,
-” বাবারে কবে আসবি তুই? তোর মায়ের এই কষ্ট যে শেষ হবার নয়। পৃথিবীতে এসে তোকেও তো এই কষ্টের ভাগিদার হতে হবে। তোকে কি আমি সুন্দর একটা জীবন দিতে পারব?”
আলো মনে মনে হাসল। তার নামের মধ্যেই যা আলো নিয়ে ঘুরছে সে। অথচ তার জীবনে এতটুকু আলো নেই। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।
-“উনি কি আমায় খুঁজছেন? রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বের করে দিলেও রাগ কমলে উনি ঠিক নিজের ভুল বুঝতে পারবেন।”
হঠাৎ আলোর নিজের উপরই রাগ হলো। এখনও সে ওই লোকটার ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে! যার কাছে তার কথার কোন মূল্য নেই। বাবা, মা, ভাবীর কথা শুনে তাকে অবিশ্বাস করে। নিজের সন্তানকে অস্বীকার করে। স্ত্রীর চরিত্রে কলঙ্ক লাগায়। স্ত্রীকে দুশ্চরিত্রা অপবাদ দেয়। সাত মাসের গর্ভবতী স্ত্রীর উপর অমানবিক নির্যাতন করে, তার কাছে আবার ফিরে যাবে সে! দুইটা বছর একসাথে থেকে, সংসার করেও যে মানুষটার বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি, সে মানুষের সাথে বাকি জীবন কাটানো কি সহজ হবে? পৃথিবীর সব সম্পর্ক টিকে থাকার একটাই মূল আর তা হলো বিশ্বাস। যে সম্পর্কে বিশ্বাসই নেই সেই সম্পর্কে ভালোবাসা কতটুকু আছে? একটা সম্পর্কে ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা কিছুই নেই। শুধু কি লোকের কথার ভয়ে সেই সম্পর্ক সারাজীবন বয়ে নিতে পারবে সে। না, আলো এই সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবে। কেন? তার নিজের কি কোন আত্মসম্মানবোধ নেই? মেয়ে হয়েছে বলে কি স্বামীর সব অন্যায়, অত্যাচার মেনে নিতে হবে!
-” ওই লোকের কাছে যাব না আমি। এই বাড়িতেও থাকব না। নিজের পথ আমি নিজে তৈরি করে নেব। মেয়েরা নাকি ছেলেদের থেকে শতগুণ বেশি কষ্ট সহ্য করতে পারে। তাইতো সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের মা হবার সুযোগ দিয়েছেন। মেয়ে জাতি প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে নতুন প্রাণ জন্য দিতে পারে। মেয়েদের দুর্বল ভাবার কোন কারণ নেই। আমার কাউকে লাগবে না। আমার জন্য আমিই যথেষ্ট।”
____________________________________________
আলো এই বাড়িতে আসার পর এখনও একজন মানুষের সামনেও পড়েনি। সে যে এই বাড়িতে আছে এটা কি কেউ জানে না? কেউ তো একবার দীপ্তর খোঁজ নিতেও এঘরে আসছে না। তাহলে কি দীপ্ত সবাইকে বারণ করেছে, কেউ যেন তার কাছে না আসে। এমন সময় দরজায় নক করল কেউ। আলো সেদিকে তাকাল। একজন ভদ্রমহিলা, বেশ সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ভারী গহনা, পাথর বসানো এত পাতলা একটা শাড়ি পরেছেন যে স্পষ্ট পেট দেখা যাচ্ছে। মহিলা যেন এক্ষুনি পার্টি থেকে ফিরেছেন। নয়তো পার্টিতে যাচ্ছে। মহিলা আলোর সামনে এসে দাঁড়াল। আলোকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলল,
-” তুমিই আলো!’
-” জি।’
মহিলা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-“এই রূপ নিয়েই এতকিছু! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আরও সুন্দরী। যাকগে, আমি দীপ্তর মেজ চাচী। তা কতদিন আছো এখানে?”
আলো বুঝতে পারছে না এই মহিলা কী উদেশ্য নিয়ে তার কাছে এসেছে।
-” আমি এবাড়িতে থাকব না।”
-” রিয়েলি! অবশ্য না থাকলেই আমাদের দীপ্তর জন্য ভাল। তুমি তো জানতে দীপ্ত তোমাকে পছন্দ করে। তবুও এতবছর পর তার হাত ধরে এখানে থাকতে চলে এলে! আমাদের ছেলেটাকে লাইফে মুভ অন করতে দিবে না, তাই না?’
-” আমি এখানে থাকতে আসিনি। উনিই আমাকে নিয়ে এসেছেন। আমি তো তখন অজ্ঞান…
-” ওসব তো তোমার নাটক। এবাড়িতে ঢোকার একটা প্ল্যান।’
-” আপনি না জেনে আমাকে এসব বলতে পারেন না।”
-“একশোবার পারি। তোমার স্বামী কি তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছে? নাকি পালিয়ে এসেছ?”
মেজ চাচী আলোর উঁচু পেটের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললেন।
-” ওহ মাই গড! তুমি প্রেগন্যান্ট! একজনের বাচ্চা পেটে নিয়ে আরেক জনের সাথে চলে এসেছ! এই অবস্থায় তো তোমার ডিভোর্সও হয়নি। দীপ্ত অন্য একজনের বাচ্চাসহ স্ত্রীকে বাড়িতে এনে তুলেছে। ওহ গড! আমরা তো কিছুই জানতাম না। এই মেয়ে, তোমার লজ্জা করেনি হ্যাঁ? স্বামী সংসার ছেড়ে তুমি কীভাবে এতটা বেহায়া হলে! শেষে কিনা আমাদের দীপ্তকেই ফাঁসালে! তাহলে দুই বছর আগে যখন দীপ্ত তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তখন কেন রাজি হলে না।”
______________________________________
গলির যেদিকটা অন্ধকার সেখানে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
-” আমার টাকা…
লিজা খুশিতে নাচতে নাচতে গাড়িটার দিকে এগোচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ যেমন তাতে বাড়ির বউয়েরা রাতের বেলা বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না। বেরুলে এটা ঘোর অন্যায়। সবার চোখ বাঁচিয়ে টাকাগুলো নিতে বেরিয়েছে সে। লিজার মনে পড়ল, আলোকেও একদিন ভুল বুঝিয়ে রাতের বেলা গলিতে পাঠিয়েছিল। আলো বাইরে থাকা অবস্থায় ঘরের সবাইকে ওর বিরুদ্ধে উসকিয়েছে সে। তার উপর আবার সোনায় সোহাগা হয়ে পাড়ার এক ছেলে নাকি ওকে কোন ছেলের সাথে দেখেছিল। আলোর দুঃখের দিন তো সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল। গাড়ির দরজায় টোকা দিল লিজা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো ইউনিফর্ম পরা একজন দরজা খুলে দিল।
-“আমার টাকা। সব টাকা এনেছেন তো? আপনার মালিকের সাথে কিন্তু আমার কথা হয়েছে। এক লাখ টাকা দিবে বলেছে। ব্যাগে যদি এক লাখ টাকা না থাকে, গুনে যদি এক টাকাও কম পড়ে তাহলে আমি আপনাদের নামে মিস্টার দীপ্তর কাছে নালিশ করে দেব। চুরির দায়ে চাকরি তো যাবেই জান নিয়েও টানাটানি লাগতে পারে। বুঝেছেন? ‘
দু’জন লোক লিজার হাত টেনে ধরে ওকে গাড়িতে তুলে নিল। লিজা চিৎকার করছে,
-“এই, এই… আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? ছাড়ুন। আপনাদের মালিক জানলে খবর আছে। কেউ আছো… বাঁচাও…
লোকগুলো লিজার মুখ চেপে ধরায় আর কোন কথা উচ্চারণ করতে পারল না সে।
লিজাকে নিয়ে গাড়িটা গলির মাথায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। লিজা হয়তো এখন কল্পনাও করতে পারছে না তার কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে। কার ফাঁদে পা দিয়েছে সে।
চলবে___