আলো_আঁধার পর্ব ১৪

#আলো_আঁধার[১৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

রাহা শুভ্রদের বাড়িতে এসে ওকে ডাকতে লাগল। আজ তাকে অনেকটা উত্তেজিত লাগছে।

-“শুভ্র! শুভ্র। বেরিয়ে এসো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।’

রাহার গলা শুনে মিসেস আমিনা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। রাহার চিৎকার করার মানে সে বুঝতে পারছে। শুভ্র নিশ্চয় রাহার বাবা মা’কে বলে দিয়েছে। আর তার জন্যই রাহা আজ এসেছে।
রাহা আমিনাকে দেখে বলল,

-“আন্টি শুভ্র কোথায়? ওকে ডাকো না প্লিজ। শুভ্রর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ও আমার বাবা মা’কে উল্টাপাল্টা কীসব বলেছে। আমি বাবার কথা বিশ্বাস করতে পারিনি। তুমি শুভ্রকে ডাকো। ওর সাথে সরাসরি কথা বলব আমি।’

-“রাহা মা তুমি শান্ত হও।’

-“না আন্টি৷ আমি শান্ত হতে পারব না। শুভ্র আমার বাবা মা’কে কী বলেছে তা জানলে তুমিও আমাকে শান্ত হতে বলতে পারতে না। তোমার ছেলে কেন এরকম করছে? আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শুভ্র আমাকে বিয়ের শপিংও করে দিয়েছে। এখন ও বলছে আমাকে ও বিয়ে করতে পারবে না!’

এতক্ষণে শুভ্রও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল সে। রাহার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে বেরিয়ে আসে। রাহা শুভ্রকে দেখেই তেতে উঠে।

-“শুভ্র তুমি আমার বাবাকে ওসব কেন বলেছ?’

বেশ শান্ত ভাবে শুভ্র জবাব দেয়,

-“যা সত্যি তা-ই বলেছি রাহা।’

-“সত্যি মানে? এসব তোমার কাছে ফান মনে হচ্ছে? মজা করছো তুমি আমার সাথে?’

-“না। বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে সবটা শেষ করে দেওয়া ভালো। সম্পর্ক অনেকদূর গড়িয়ে গেলে তা শেষ করা সহজ হবে না। তাই সম্পর্ক তৈরি হবার আগেই আমি আমার মনের কথা জানিয়ে দিয়েছি।’

রাহা অবিশ্বাস্য চোখে শুভ্রকে দেখে। আমিনার দিকে চেয়ে বিস্মিত গলায় বলে,

-“শুনলে আন্টি তোমার ছেলে কী বলছে! সম্পর্ক শুরু হবার আগেই শেষ করে দিতে চায় ও। সম্পর্ক তৈরি হতেই দিবে না। তাহলে আমাকে কেন অত বড় স্বপ্ন দেখালে? কেন আমার ইমোশন নিয়ে খেলা করলে? আমার মন ভেঙে খুব ভালো লাগছে তোমার?’

-“রাহা তুমি রেগে আছো। তাই আমার কথা বুঝতে পারছ না। ‘

-“আমি সব বুঝতে পারছি। তুমিই বরং বুঝতে পারছ না, তুমি কীসব গাঁজাখুরি কথা বলছো৷ বিয়ের সব আয়োজন শেষ করে, এমনকি বিয়ের শাড়ি লেহেঙ্গা পর্যন্ত কিনে দিয়ে এখন বলছো বিয়ে করতে পারব না। তোমার কথাতেই সব হবে নাকি?’

আলো নিজের ঘরে ছিল। অত মানুষের গলা পেয়ে সে-ও বেরিয়ে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাহার সব কথা শুনল সে। শুনে ঘৃণার চোখে শুভ্রকে দেখল। পৃথিবীর সব ছেলেরাই কি মেয়েদের নিজের হাতের পুতুল ভাবে? মেয়েটাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে এখন মন পাল্টে নিয়েছে। সব একরকম। নাসির, দীপ্ত এই ছেলে ওরা কেউ আলাদা না। আলো ঘরে চলে এলো। মাথা ঢিপঢিপ করছে। মিসেস আমিনা এবার কথা বললেন,

-“রাহা মাথা গরম করে চেঁচামেচি করলে তো কোন সমস্যার সমাধান হবে না। শুভ্র যদি তার এই সিদ্ধান্ত এখন না জানিয়ে বিয়ের পর জানাত তখন তুমি ডিভোর্সি হতে। কিন্তু এখন সেটা হবে না। তুমি কষ্ট পেলেও এক সময় সব ভুলে গিয়ে নতুন কাউকে নিয়ে জীবন শুরু করতে পারবে।’

-“আন্টি তুমিও! তুমিও শুভ্রর পক্ষে কথা বলছো! তোমার ছেলে ঠিক কাজ করেছে বলে মনে করছো?’

-“না। শুভ্র যা করেছে তা কখনো ঠিক হতে পারে না। শুভ্র অন্যায় করেছে। এর জন্য ওকে আমি কখনও ক্ষমা করব না। কিন্তু মা শুভ্র যদি তোমাকে ভালোই না বাসে তাহলে কি ওকে বিয়ে করে তুমি সুখী হবে?’

-“আমি তো ওকে ভালোবাসি আন্টি।’

বলতে বলতেই রাহা কেঁদে ফেলল। শুভ্র নিজের উপরই বিরক্ত হলো। বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। রাহা তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। সে কেন বিয়ে ঠিক হবার আগেই বুঝতে পারেনি। ওর ভুলে অন্য কেউ কেন কষ্ট পাবে।

-“রাহা তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। এর বেশি তোমাকে নিয়ে আমি কিছু ভাবতে পারি না। বিয়ে করলে আমরা কেউই সুখী হব না। তুমি খুব ভালো মেয়ে। তোমার ফিউচার নষ্ট করতে চাই না আমি।’
___________________________
আলো এই বাড়ির ছেলেটার উপর মানে শুভ্রর উপর রেগে আছে। ছেলেটা নাকি ডাক্তার। তাহলে তার চরিত্র এমন কেন? ডাক্তাররা তো মানুষের কষ্ট দূর করে থাকে। এই ছেলে মেয়েটাকে কতটা কষ্ট দিল। মিসেস আমিনা আলোর কাছে এলে আলো তাকে এখানে থাকবে না জানায়। এটা শুনে আমিনা বলেন,

-“এই অবস্থায় তুমি কোথায় যাবে মা?’

-‘যেখানেই যাই। এখানে আর থাকব না আমি। আপনারা আমাকে চেনেন না। আমি আপনাদের কেউ হই না। তাহলে কেন আমাকে জায়গা দেবেন।’

-“মানুষ হিসেবে। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। আমি তোমাকে এই অবস্থায় ছাড়তে পারি না। তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যাবার প্রশ্নই আসে না। আর ওই ছেলে দীপ্ত। ও তো একটা অমানুষ। ওর কাছেও যাবে না তুমি।’

-‘আপনার কাছে কেন থাকব? আপনার ছেলেও তো ওদের থেকে কম না।’

মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছে আলো। বলেও সে অনুতপ্ত না। ঠিক কথাই তো বলেছে।

-“কে শুভ্র! আমার ছেলে শুভ্রর কথা বলছো তুমি?’

মিসেস আমিনা হাসতে লাগলেন। উনাকে হাসতে দেখে আলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

-“তুমি আমার শুভ্রকে ভুল বুঝছো মা। শুভ্র বাকি সবার মত না। ও একটু অন্যরকম।’

-“ওই মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলেও করলো না কেন? ওই মেয়ের সব কথা আমি শুনেছি। ওর কোন দোষই ছিল না। আপনার ছেলের ওর সাথে অন্যায় করেছে।’

-“এখানে শুভ্ররও কোন দোষ ছিল না। রাহাকে শুভ্রর জন্য আমি পছন্দ করেছিলাম। শুভ্র আমার কথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। আমি একবারও ওর মনের কথা জিজ্ঞেস করিনি। শুভ্র কোন মেয়েকে ভালোবাসে না তা আমি জানতাম। কিন্তু ওর কেমন মেয়ে পছন্দ সেটা জেনে নিইনি। তবুও শুভ্র তো ওর বাবার থেকে ভালো। বিয়ের আগেই রাহার মন ভেঙেছে। ওর বাবা তো আমাদের বিয়ের ষোল বছর পর বুঝতে পেরেছে ও আসলে আমাকে ভালোবাসে না। শুভ্রর যখন চৌদ্দ বছর বয়স তখন ওর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। সে থেকেই শুভ্র সম্পর্ক বানাতে ভয় পায়। আমি তো ওর মা। ওকে আমি বুঝি। বাকিরা হয়তো তোমার মত শুভ্রকে বুঝতে ভুল করে।’

আলো এবার নিজের কাজেই লজ্জা পেল। না জেনে কারো সম্পর্কে ধারণা করে নেওয়া ঠিক হয়নি। হয়তো সে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর যদি ছেড়ে দিত তাহলে মেয়েটা ডিভোর্সি হতো।

-“আমি দুঃখিত। না জেনেই উনাকে আমি খারাপ ভেবে নিয়েছি।”

-“তোমারও কোন দোষ নেই। আমি বুঝতে পারছি, জীবনে তুমি এতকিছু দেখেছ যে এখন আর কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে পারো না। সবার মাঝেই ওই মানুষ দু’টাকে খোঁজো। তোমার জীবনটাও সহজ নয়।”

আলোর দিন এই বাড়িতেই কাটতে লাগল। শুভ্র নামের ছেলেটার সাথে তার একবার বা দু’বার দেখা হয়েছে। এর বেশি একটা কথাও হয়নি। ও সকালে বেরোয় রাতে ফিরে। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে দুপুরে খাবার টেবিলে দেখা হয়। তাদের বাড়িতে যে বাড়তি একটা মানুষ এসে থাকছে তাতে যেন ছেলেটার কোন মাথা ব্যথাই নেই। এটাই ভালো ছেলেটা তাকে নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ওর অতীত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে না।
আলো নিজের মত করে থাকতে পারছে। মিসেস আমিনার মত ভালো মানুষ তার জীবনে সে আর একটা দেখেনি। রাস্তা থেকে তুলে তাকে হাসপাতালে নিয়েছে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে তুলেছে। তার দুঃখের কথা শুনে তাকে জোর করে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়েছে। আলোরও যাবার কোন জায়গা ছিল না। অগত্যা তাকে থাকতে হচ্ছে। একদিন শুক্রবার বিকেলে আলো ছাদে গিয়েছিল। এদের ছাদটা বেশ বড়। পরিষ্কারও। টবে কয়েক ধরণের ফুলের চারা। আলো এখানে থাকার পর থেকে ওদের যত্ন নিচ্ছে। রোজ দু’বেলা নিয়ম করে গাছে পানি দিচ্ছে। এতে গাছগুলো আরও তাজা হয়ে উঠেছে। আজ ছাদে এসে আগে থেকেই ছাদে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তার পায়ের শব্দ পেয়েই শুভ্র পেছন ফিরে তাকায়। দু’জনের চোখাচোখি হয়ে যায়। আলো চলে যেতে পা বাড়াতে নিলে শুভ্র ডাকল,

-“যাবেন না। আপনি থাকুন। আমি এখন চলে যাব।”

শুভ্র বুঝতে পেরেছে আলো তাকে দেখেই ছাদে থাকতে চাইছে না। শুভ্র একবার আড়চোখে আলোকে দেখল। আলোর বড় পেটটা প্রথমে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ডেলিভারির আর বেশি দেরি নেই বোঝা যাচ্ছে। সেদিনের ঘটনার পর মা মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে। তারপর থেকে শুভ্র ওকে এখানেই দেখছে। মা মেয়েটাকে বাড়িতে রেখে দিয়েছে কেন? আর ওর পরিবারের কেউ ওকে নিতে আসছে না? ওর খোঁজও নিচ্ছে না? বাবা মা কেউ না আসুক ওর স্বামীর তো অন্তত বউয়ের খোঁজ নেয়া উচিত ছিল।
আলো ইতস্তত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চলে যেতেও পারছে না। ছেলেটাও যাচ্ছে না। কী ভাবছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

-“আপনি এখন কেমন আছেন?”

আলো ঝট করে একবার শুভ্রর দিকে চাইল।

-“হ্যাঁ? জি ভালো।”

-“বেবি?”

-“ভালো।”

শুভ্র কী বলছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না। এতটা নার্ভাস হয়ে পড়ছে কেন? কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলেই ওর গলা কাঁপে। গলায় জোর পায় না। আরও কিছু বাজে বকে ফেলার আগেই সে আলোর সামনে থেকে চলে এলো। আলো শ্বাস ফেলে হাসল। শুভ্রর মা সত্যিই বলেছিলেন, ও সবার থেকে একটু আলাদা। নইলে তার সাথে কথা বলার সময় কপালে ঘাম হতো না। কীরকম ছুটে পালিয়ে যাওয়ার মত চলে গেল। ছেলেরা এরকমও হয়! দীপ্তর সাথে এই ছেলের কোন মিল নেই। শুভ্র আকাশ হলে দীপ্ত মাটি। দু’জনই ছেলে অথচ দু’জনের মাঝে কত পার্থক্য। আলো মনে মনে আবারও বলল, একজন ছেলেকে দিয়ে পুরো পুরুষ জাতিটাকে বিচার করতে পারি না আমি। নাসির একরকম। দীপ্ত আরেক রকম। আর শুভ্র ওদের সবার থেকে ভিন্ন। দু’জনের থেকেই আলাদা।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here