অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ৪

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_৪
#সুলতানা_পারভীন

-তুমি জানো নীল? তোমার দুষ্টুমি মাখা হাসি, ছেলেমানুষিভরা আচরণ, অল্পতেই এতো খুশি হয়ে যাওয়া, কারো কষ্টে তোমার চোখ জোড়ার ছলছলানি, সবই আমার দারুণ লাগে জানো? শুধু এই অবুঝের মতো রাগ?! উফ! এটা একদমই নিতে পারি না আমি জানো? রাগ করো ভালো কথা, লজিক থাকা তো উচিত রাগের নাকি? আর সবসময় চোখের সামনে যা দেখছ তাই যে সত্যি এমনটাও তে না রাইট? তাহলে সামনের মানুষটাকে নিজের সাফাই দেয়ার অন্তত একটাবারের জন্য সুযোগ তো দিবে নাকি? কিন্তু নাহ। আপনার তো নাকের ডগায় রাগ। বাপরে বাপ! এতো রাগ করলে ভবিষ্যতে একসাথে সংসারটা করবো কি করে? দু মিনিট পর পরই তো ঝগড়া বাঁধিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তখন কি না খেয়ে থাকবো সপ্তাহে সাতদিনই? কি মুশকিল রে বাবা!

জিহান হালকা হাতে নীলাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে নিজের মনেই বকবক করে চলেছে। মেয়েটা যে ঘুমিয়ে কাদা সেদিকে ছেলেটার যেন খেয়ালই নেই। জিহান আরেকবার নীলার দিকে তাকিয়ে নীলার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে নীলার মাথাটা আলতো করে নিজের বুকের উপরে টেনে নিল। ওর বুকের মধ্যে করা ঢিপঢিপ শব্দগুলো নীলার কান পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছে কি না কে জানে! জিহানের ভিষণ ইচ্ছে করছে নীলাকে ঘুম থেকে ডেকে তু্লে কতোগুলো বকা দিতে। কিন্তু মেয়েটার ক্লান্ত মুখটা দেখে প্ল্যানটা এই মূহুর্তে বাদ দিল মাথা থেকে জিহান।

-তোমার মনে পড়ে নীল? আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটার কথা? কয় বছর হলো বলো তো? চার বছর হয়ে গেছে না ঘটনাটার? অথচ জানো এখনও মনে হয় এইতো গতকালের ঘটনা। তুমি প্রথমবার প্রথমদিন কলেজে এসেছ। এসেই ওই বখাটেগুলোর র‍্যাগের শিকার হলে। আচ্ছা বলো তো নীল? তোমার এই যে বাঘিনী রূপটা কি শুধু আমার সামনেই দেখানোর জন্য? নইলে এতো পাওয়ারফুল বিজনেসম্যানের মেয়ে, সফল বিজনেস আইকন মিস্টার আবরার খন্দকারের একমাত্র কলিজার টুকরো বোন? সে কিনা ওই সামান্য সিনিয়ারদের সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো ঘাবড়ে যায়? এটা কোনো কথা হলো বলো? অবশ্য এক দিক থেকে ভালোই করেছিলে। তোমার ভীত হরিণীর মতো কাঁপা কাঁপা ঠোঁটজোড়া, ছলছল করা কাজল কালো চোখের চাহনিতে এক নিমিষেই ঘায়েল হয়ে গেছি। পাগলি একটা!

জিহান কথাগুলো বলতে বলতে ঠোঁট কামড়ে হেসে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলো নীলার কপালে।

-তুমি ছেলেগুলোর সামনে কাঁপা কাঁপা এসে দাঁড়াতেই যখন আমি এসে যখন সবগুলোকে ধরে ইচ্ছে মতো চড় থাপ্পড় মেরেছিলাম নিউ কামারদের র‍্যাগিঙ্গ করার অপরাধে, তখন ওদের চেয়ে বোধ হয় তুমিই আমাকে ভয় পেয়েছিলে বেশি, তাই না নীল? এমন কেন হয় বলো তো নীল? তুমি যত আমার থেকে দূরে পালাতে চাইছিলে, আমি ততই তোমার দিকে পাগলের মতো খিঁচে চলে আসছিলাম? যেন কোনো চুম্বকের অদৃশ্য টানে ছোটো ছোটো লোহার টুকরোগুলো তার দিকে ছুটে আসে তেমন। কি অদ্ভুত জানো নীল? বাবা মা বোনকে হারিয়ে জীবনটা একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। মামা আর মামনি ভালোবাসলেও সেটাকেও পাত্তা দেইনি কখনো। রাজনীতি, মারামারি, স্মোকিং আর প্রতিশোধের নেশা, এসবই জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল আমার। ভেবেছিলাম স্টুডেন্ট লাইফটা এভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে। কোথাও বিরোধী পার্টির কারো গুলির বুলেটে বা ছুরির ঘায়ে মরে পড়ে থাকবো রাস্তার কোনো এক কোণে। ভেবেছিলাম কেউ কোনোদিন এই গুন্ডা ছেলেটার জন্য চোখের পানি ফেলবে না। অথচ সব আশা যখন ছেড়ে দিয়েছি সেই সময়টায় আমার জীবনে তুমি এলে নীল। আমার সুখের দূত হয়ে। তোমার এক কথায় সব ছেড়ে স্বাভাবিক একটা জীবনে এসেছি আমি। তুমিও আমার এক কথাতেই কোনো আপত্তি ছাড়াই ম্যারিজ রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিয়েটাও করে নিলে। আর এখন? এখন চাইছ আমি তোমাকে ভুলে যাই? এটা কি আধো সম্ভব? আমার জীবন থেকে তোমার নামটা মুছে দিবে এমন সাধ্য কার আছে? তোমার বাবার? নাকি তোমার ভাইয়ের? কারো নেই নীল। কারো না।

নীলাকে এবারে বালিশে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে জিহান নীলার মুখের দিকেই ঝুঁকে এলো কিছুটা। নিজে নিজে বকবক করতে করতে নীলার চেহারাটা না দেখেও ভালো লাগছে না ছেলেটার।

-আর কি যে বলেছিলে তুমি? অসময়ে চলে এসে খুব অন্যায় করে ফেলেছ। দুদিন ধরে আমি কাজের দোহাই দিয়ে এসবই চলছিল তাহলে ফার্মহাউজে তাই না? আগামী সপ্তাহে বিয়ে আর আমি অন্য মেয়ের সাথে সময় কাটাচ্ছি?! মেয়েবাজি করে বেড়াচ্ছি? তোমার হাতের থাপ্পড় আমার বুকে এতোটা লাগে না, যতটা ক্ষত বিক্ষত করেছে তোমার এই কথাগুলো। তোমাকে ইচ্ছে করেই ভুল বোঝানো হয়েছিল, মানছি। তাই বলে এই বিশ্বাস তোমার আমার প্রতি? এর যোগ্য শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে ম্যাডাম। শাস্তির আগে নিজের সাফাই ও হয়তো দিতাম, যদি তুমি বলে দিতে ফার্মহাউজের এড্রেসটা তোমাকে কে দিয়েছে। আমার অফিসেরই কেউ পিঠ পিঠে ধোঁকাবাজি করছে সেটা টের পেয়ে রানিং প্রোজেক্টটা আমি একাই করছিলাম। কাউকে না জানিয়ে ফার্মহাউজের বাড়িটাতেই সব ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্ট, সেইভ করছিলাম। সারা রাত টানা কাজ করে প্রোজেক্টটা রেডি করে বের হবে এমন সময় বুঝলাম কেউ একজন আছে ফার্মহাউজে। মেয়েটা আমার অফিস স্টাফ। তাই ওকে কয়েক ঘা দিতেই সব সত্যিটা উগড়ে দেয় মেয়েটা। সেটা ভেবেই হাসি পাচ্ছিল আমার। বাট তুমি ওই মূহুর্তে কোথা থেকে এলে সেটাই বুঝতে পারলাম না আমি। তোমাকে সবটা তখনই বলেও দিতাম। বাট তোমার পিছুপিছু তোমার ড্রাইভারও এসে জানালার আড়ালে লুকিয়ে আমাদের কথাগুলো শুনছিল। এতো কিছু তো কো ইন্সিডেন্ট হতে পারে না বলো? কে গন্ডগোল করছে সেটা বের করে তোমার সামনে আনা পর্যন্ত তুমিও যে বিয়েতে রাজি হবে না এটা তো বুঝতেই পারলাম। আর কি বুঝলাম জানো? আমার চেয়েও তুমি ওদেরকেই বেশি বিশ্বাস করো। ভরসা করো। আমার মুখের কথা মানবে? নাহ নিশ্চয়ই। দ্যাটস হোয়াই আই বোরো সাম টাইম ফ্রম ইউ। দেখা যাক সব সত্যি সামনে এলে তুমি কাকে সাপোর্ট করো। আমাকে? নাকি তোমার নিজের পরিবারকে?

কথাগুলো বলতে বলতে নিজের হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠে বসলো জিহান। ঘড়িতে প্রায় তিনটা বাজে। নীলার সাথে দেখা করেই চলে যাবে ভেবে এসেছিল জিহান। এখন এতো রাত হয়ে গেল কি করে সেটা ভেবেই নিজেরই হাসি পাচ্ছে ওর। এই মেয়েটার কাছে এলেই সময়গুলো কোন দিক দিয়ে উড়ে যায় টেরই পায় না ছেলেটা।

-দেখেছ তোমার সাথে বক বক করতে গিয়ে কতো রাত হয়ে গেছে? কাল সকালেই একবার আর্জেন্ট হসপিটালে যেতে হবে আমাকে। কি করে উঠবো ঘুম থেকে বলো তো? আজ তো তুমিও কল করে জাগিয়ে দিবে না? ধ্যাত। গেলাম আমি এখন। বায় বউপাখি। উম্মাহ। তুমি রাগ করে কয়দিন কথা না বলে থাকতে পারো আমিও দেখবো। বায়য়য়।

জিহান আরেকবার ঘুমন্ত নীলার কপালে আর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হতেই রুমের বাইরে নিহারকে করিডোরে পায়চারি করতে দেখে অবাক হয়ে নিহারের দিকে এগিয়ে এলো। নিহারও জিহানকে আসতে দেখে ঠোঁটের কোণে শুকনো একটা হাসি ফুটিয়ে তুললো ধীরে ধীরে।

-ভাবি আপনি ঘুমান নি? আমি তো ভাবলাম আপনাকে ডাকবো কি ডাকবো না। আপনি তো দেখছি জেগেই আছেন। রাত দুপুরে কি জগিং করছেন নাকি?

-জি না ভাইয়া। আসলে ঘুম আসছিল তাই হাঁটছিলাম। আপনি চলে গেলে মেয়েটা রাতে একা থাকবে, অসুস্থ, তার উপরে ব্যথার কমাতে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডক্টর। কি হয় না হয় তাই।

-ওই পাগলিটার আবার ঘুমের ওষুধ লাগে নাকি ঘুমাতে? কি যে ঘুমকাতুরে নীলা!

-হুম। জানি। তাই তো আরো ভয়। দেখা যাবে ঘুমের ঘোরে কোনদিকে ঢলে পড়বে। তাই রাতটা ওকে একা ছাড়তে ভয় করছিল।

-অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাবি। আমার বউটাকে আপনার জিম্মায় দিয়ে গেলাম। একটু খেয়াল রাখবেন। পরে কিন্তু আপনার কাছেই ওর খবর নিবো। ওকে?

-জি ঠিক আছে। এখন আবরার চলে আসার আগে বিদায় হন। ও হুট করে এসে দেখে ফেললে মহা সর্বনাশ হবে।

-ভাইয়া বাড়িতে ফিরে নি এখনো?

-ওর বাড়িতে ফিরতে লেইট হয় প্রতিদিনই। কাজ থাকে তো অফিসে।

-কিসের এতে কাজ যে ওয়াইফকে জাগিয়ে রেখে রাত তিনটে বাজাতে হবে বাসায় আসতে? আমি তো রোজ দশটার মধ্যে বাসায় এসে হাজির হবো। শুধু আপনার ননদটা আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসুক।

-জি আচ্ছা। তখন দেখবো কেমন দশটায় বাড়িতে আসেন, নাকি বউয়ের অত্যাচারে বিবাগি হয়ে যান। এখন যান। আমারও ঘুম আসছে।

-বাহ রে ভাবি! বাড়ির জামাইকে এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছেন? আপনার ননদকে নিয়ে যাই একবার। আর এদিকের পথ মাড়াবো না প্রমিস।

-আগে তো আমার ননদকে বিয়ে করে ঘরে তুলুন। বাকিটা আমার ননদ সামলে নিবে। সেই ভরসা আমার আছে।

-বাহ! কি ভরসা। ওকে ভাবি। আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। এখন আসছি। অনেক রাত হচ্ছে। বায়। গুড নাইট। হ্যাভ এ সুইট ড্রিমস।

-হ্যাভ এ সেইফ জার্নি।

নিহার নীলার রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই জিহানও সতর্ক দৃষ্টিতে একবার চারদিকে তাকিয়ে বাড়ির পিছনে গার্ডেনের দিকে চলে গেল। এই রাস্তাতেই দেয়ালটা টপকে এসেছিল জিহান। দেয়ালের অপর প্রান্তেই জিহানের রাখি রাখা আছে। জাস্ট দেয়াল টপকানোর অপেক্ষা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা দেয়ালের দিকে এগিয়ে যেতেই কেউ একজন পিছন থেকে জাপটে ধরলো জিহানকে। অতর্কিত হামলায় জিহান চমকে উঠলেও হামলাকারীর দৃঢ় বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারলো না। এদিকে নীলার কাছে এসেছে বলে কোনো প্রস্তুতিই নিয়ে আসে নি জিহান। এভাবে শত্রুর ঘাঁটিতে ঢুকে কি বোকামি করলো ছেলেটা? তবে কি আজ এখানেই নীলা জিহানের প্রেম কাহিনীটার ইতি ঘটবে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here