বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি পর্ব ৩৮+৩৯+৪০

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৮

সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া প্রকৃতির সতেজ ধোঁয়ার সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে।দূর আকাশে থালার মত চাঁদটার এক ফালি জ্যোৎস্না বারান্দার মেঝেতে আছড়ে পড়ছে ।সিগারেটের ফিল্টার গুলো বারান্দার মাটিতে শিউলি ফুলের মত বিছিয়ে আছে।রুমের ভেতর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে আওয়াজ আরো গাঢ় হচ্ছে।আর নিজেকে অনেকবার আটকাতে চাইলো কিন্তু পারল না। সেহেরের চাপা কান্নার আওয়াজে আরহামের হৃদ মাঝারের আসমানে ঘন কালো মেঘ জমেছে। বুকে হাজার মন ভারী ব্যথা অনুভব করছে। এই বুঝি নিশ্বাস আটকে আসবে।আরহাম সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মাটিতে ফেলে পায়ের নিচে পিষিয়ে ফেলে।তারপর দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হয়।দরজা ভিড়ানো । আরহাম সজোরে দরজায় ধাক্কা দিলো ।কাঠের দরজাটা দেয়ালে বাড়ি লেগে বিকট শব্দ হয়। শান্তি নিরিবিলি ঘরটা বিকট শব্দে কেঁপে উঠে।কিন্তু এই প্রখর শব্দটা সেহেরের কান অবধি যেন পৌঁছাল না। সেহের সেই আগের মত বিছানায় মুখ গুজে কান্না করছে।আরহাম বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে বিছানার দিকে তাকিয়ে থাকে।সেহেরের কান্নার আওয়াজ আরহামের ভেতর আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ভেতরটা জ্বলে পুঁড়ে ছারখার হচ্ছে।আরহাম আচমকা বিছানায় উঠে সেহেরকে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয়।সেহেরের পিঠে মুখ গুজে বেশ শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে।কোন এক অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে সেহেরের কান্না থেমে যায়।পুরোপুরি নিথর শক্ত হয়ে শুয়ে থাকে।খানিকের জন্য দুনিয়াদারি সব কিছু ভুলে গেছে। মাথা পুরোপুরি শূন্য ।কিছুক্ষণ পর পিঠে কামিজের অংশটা ভেজা ভেজা অনুভব করে। উনি কি তবে কাঁদছে? সেহের ভাবনা জগত থেকে বেরিয়ে পেছন ফিরতে চাইল। কিন্তু কোন কাজ হলো না । আরহাম বেশ শক্ত করে সেহেরের সাথে লেপটে আছে। সেহের জোর খাটাল কিন্তু আরহামের শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারল না। এক সময় আর মেনে জানালার বাহিরের চোখ ফিরে চাইল। দূর আকাশে চাঁদটা যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে । আচ্ছা ,চাঁদটা ড্যাবড্যাব করে কি এমন দেখছে? আকাশের পানে তাকিয়ে সেহের বেশ কিছুক্ষণ ভাবল ।ফলাফল প্রত্যেকবারের মত শূন্য । কোনো উত্তর মিলল না।বাহিরের হিম শীতল ঠান্ডা হাওয়া দুজনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে শীতও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।সেহেরের গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠেছে।উড়না দিয়ে কোনরকম নিজেকে ঢাকতে চাইলে, আরহাম হুট করেই সেহেরকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়।নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে বুকের উষ্ণতায় জড়িয়ে নেয়।সেহের তখনো ঠকঠক কাঁপছে।আরহামের স্পর্শ যেন কাঁপুনির মাত্রা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।আরহাম সবটাই আঁচ করতে পারছে । সেহের চোখ নামিয়ে রেখেছে । একবারের জন্যও মাথা উঁচু করে আরহামের মুখের দিকে তাকাচ্ছে না।চোখ গুলো আরহামের হালকা লোমশ বুকে আটকে।পাঞ্জাবির উপরের দু বোতাম খোলা থাকায় বুকের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে।কিছু একটা মনে করে সেহের অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।আচকা কপালে আরহামে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ অনুভব করে।একটা ,দুটো করে আস্তে আস্তে চুমুর সংখ্যা বাড়ছে।সেই সাথে তীব্রতাও। আরহাম ধীরে ধীরে সেহেরকে নিজের সাথে আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে।সেহের চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।কপাল ছুঁয়ে আরহামের ওষ্ঠদ্বয় ধীরেধীরে নিচের দিকে নামছে।সেহেরের বন্ধ চোখের পাতায় গভীর করে চুমু খাচ্ছে ।
আরহাম সেহেরের যতটা কাছে আসছে ধীরেধীরে সেহেরের ভয় ভীতি লজ্জা ততটা প্রখর হচ্ছে।কোন এক অজানা ভয়ে বুকটা ধুকধুক করছে।মনে কোণে কোথাও এক অপরাধবোধ কাজ করছে।ভালোবাসাহীন আরহামের এতোটা গভীরের যাওয়া ঠিক হচ্ছে? যদি এটা খানিকের মোহ হয়? ভোরের আলো ফুটতেই যদি আরহামে মত ঘুরে যায়? মিহির প্রতি প্রেম জেগে উঠে? মোহে খানিকের জন্য আটকানো গেলেও চিরকালের জন্য বেঁধে রাখা যায় না! সেহের দূরে সরে যেতে চাইলে মন সাই দেয় না।আরহামের এতোটা কাছে এসে দূরে সরে যাওয়ার জোর সেহেরের ভেতর নেই।মন অদূর থেকে এক চাপা চিৎকার ভেসে আসছে।চাপা আওয়াজে বলছে,”সেহের আরহাম তোর স্বামী ,নিজের স্বামীর মাঝে ডুবে যাওয়া অপরাধের কিছু নয় ।এখনি সময় নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার! ” মনের মাঝে আরহামকে নিজের করার তীব্র এক লালসা কাজ করছে।কিন্তু বিবেক বারবার বাঁধা দিচ্ছে।সেহেরের ভেতর অন্ত রণ চলছে।মন আর বিবেকের যুদ্ধে সেহের ক্লান্ত হয়ে পড়ে।বুক চিড়ে এক ভারী কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে আসে। আরহাম মাত্রই সেহেরের ওষ্ঠদ্বয় নিজের আয়ত্তাধীন করবে এরই মাঝে সেহেরের কান্নার আওয়াজে আরহামের হুস ফিরে। চোখ খুলে সেহেরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।সত্যিই কি ,আরহামের স্পর্শ সেহেরকে যন্ত্রণা দেয়? আরহাম স্থির চোখে তাকিয়ে ভাবল। হাতের বাঁধন হালকা হতেই সেহের বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। জানালার দিকে ফিরে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাউ মাউ চিৎকার করে কাঁদতে লাগে। বুকের লুকানো কষ্ট গুলো চোখের পানির রূপ নিয়ে যেন বেরিয়ে আসছে! আরহাম পেছন থেকে সেহেরের দিকে স্তব্ধ পাথর চোখে তাকিয়ে থাকে।নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।ভীষণ রাগ।সেহেরের কষ্ট কমাতে এসে উল্টো বাড়িয়ে দিয়েছে।হাত শক্ত করে মুষ্টি বদ্ধ করে দক্ষিণের জানালার কাচে সজোরে বাড়ি দেয়।সেহের ভয়ে কেঁপে উঠে। আরহামের হাতে জানালার টুকরো টুকরো কাচ গুলো বিঁধে আছে।হাত থেকে টপটপ রক্ত পড়ছে।সেহের রক্ত দেখে থরথর কাঁপতে থাকে।রক্ত থামানোর জন্য দিশাহারা হয়ে রুমে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত কাপড় খুঁজতে লাগে। কোন কিছু না পেয়ে নিজের গায়ের উড়না আরহামের চোটে ঠেসে ধরে। অশ্রুধারা গাল বেয়ে বেয়ে ঝরছে।যেন চোট আরহামের না তার লেগেছে।সেহের কান্না জড়িত তেজি স্বরে বলে,”আপনার সমস্যা কি? এতো রাগ কেন আপনার? সব সময় সব কিছুতে রাগ দেখাতে হবে?…কত খানি লেগেছে….কতোটা রক্ত ঝরেছে…এর পর থেকে এমন কিছু করলে…আমি …আমি ….সত্যি সত্যি আপনার থেকে অনেক দূরে চলে যাবো …অনেক দূর”
সেহের থেমে থেমে কান্না জড়িত গলায় বলছে।কান্নায় বার বার গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। আরহাম শান্ত চোখে সেহেরকে দেখছে। বাধ্য ছেলের মত সেহেরের প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনছে।সেহেরের এভাবে বউদের মত অধিকার নিয়ে শাসানটা ভীষণ ভালো লাগছে।সেহের আরহামের সামনে নিজের কান্না লুকানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।সেহেরের চোখের জল আরহামের চোখ এড়ায় না।নিচ থেকে টান দিয়ে তুলে সেহেরকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়।সেহেরও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।শব্দ করে কান্না করতে লাগে।আরহাম চোট লাগা হাত সেহেরের পিঠে বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”সরি ,আর কখনো এমন রাগ দেখাবো না। সরি লাভ। প্লিজ ডোন্ট ক্রাই ”
সেহের থামল না। কান্নার বেগ আরো বাড়ল। কান্নারত অবস্থা বলল,”কেন এমন করেন? কেন সব সময় এতোটা কষ্ট দেন। আপনার এসব কাজে আমার কষ্ট হয়।আপনাকে হারানোর ভয় আমাকে ভীষণ পুড়ায়। আমি পারবো না আপনাকে অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে। পারবো না আমি আপনার চোখে আমি ব্যতীত অন্য কারো জন্য ভালোবাসা দেখতে।কজ ,আই লাভ ইউ।অনেক ভালোবাসি আপনাকে।অনেক! ”
সেহেরের কথা গুলো আরহামের বুকে তীরের মত বিঁধল।মুহূর্তেই শরীরটা অদ্ভুত এক ঝিমুনিতে কেঁপে উঠে।হুট করে সেহেরের কোমড় ছেড়ে দুগাল নিজের দুহাতের ভাজে নিয়ে নেয়। শক্ত করে চেপে ধরে কিছু বুঝে উঠার আগেই সেহেরের ওষ্ঠদ্বয় নিজের রুক্ষ ওষ্ঠে মিলিয়ে নেয়।গাঢ় করে চুমু এঁকে দিতে থাকে। অদ্ভুত ভালো লাগার আবেশে সেহের চোখ বুঝে নিলো।চোখের কোণ বেয়ে দু ফোটা অশ্রু ঝরে।সুখের অশ্রু।বেশ সময় নিয়ে আরহাম সেহেরের ঠোঁট ছাড়ল।সেহেরের কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে।সেহেরের ও একই হাল। চোখ বুঝে আছে বুকটাও ধুকধুক করছে। ঠোঁট জোড়া টকটকে লাল হয়ে আছে।ভীষণরকম জ্বলছে ।নাকে ডগা লাল হয়ে আছে। গাল গুলোও লজ্জায় ভারী । আরহাম নেশাপ্রবণ চোখে সেহেরের দিকে তাকায়।সেহেরের দু গলায় নিজের দুহাত রেখে সেহেরকে আরো কাছে টেনে আনে। সেহের তখনো চোখ বুঝে।ঠকঠক কাঁপছে।আরহাম এক দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে তাকিয়ে।ধীরে ধীরে অদৃশ্য এক মায়্য জড়িয়ে যাচ্ছে।মাথা কেমন জানো ঝিমঝিম করছে।চোখে অদ্ভুত এক ঘোর।সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক কম্পন।প্রত্যেকটা রক্তবিন্দু তড়িৎ বেগে ছুটছে।আরহাম ধীরে ধীরে সেহেরের আরো কাছে এগিয়ে যায়।সেহেরের নাকের ডগায় প্রগাঢ় চুমু দেয়।এভাবেই আলতো করে চুমু দিতে দিতে সেহেরের কান অবধি পৌঁছায়।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”মেরে ফেলবে কি? বুক তোলপাড় করার জন্য তোমার ম্যাজিকাল থ্রি ওয়ার্ড- ই যথেষ্ট ।এই লজ্জা মাখা মুখ দেখিয়ে কি মেরে ফেলবে? এই দেখো ,হার্ট কতটা ফাস্ট চলছে।”
আরহাম সেহেরের নরম হাত বুকের বাঁ পাশে রাখল । সেহের লজ্জায় দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো।এখনো কাঁপছে । জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো । মন এখনো খচখচ করছে। আবেগপ্রবণ হয়ে তো নিজের মনের কথা আরহামকে বলে দিলো । কিন্তু আরহামের মনে কি সে আছে? এসব ভেবেই সেহের দূরে সরতে চাইল।কিন্তু পারল না।তার পূর্বেই আরহাম আটকে ফেলে।আরহাম ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে।সেহেরের হাতে নিজের হাতে নিয়ে মাথানত করে গভীর এক চুমু খায়। সেহের আরহামের কাণ্ডে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।আরহাম মাথা তুলে সেহেরের চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট স্বরে বলে,”আমার জীবনে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। আমার সবটাই শুধুই তুমি। আমি বারে বারে বলেছি ,আবারো বলছি মিহি আর আমি জাস্ট গুড ফ্রেন্ড । সেদিন রাতে আমি ড্রাংক ছিলাম না।অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলাম ।তুমি টেনশন করবে বলে মিহি কিছু জানায়নি । আমার জীবনের প্রথম আর শেষ প্রেম শুধুই তুমি ।যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছি সেদিন থেকেই তোমার প্রেমে মায়ায় বেঁধে গেছি। তুমিহীন প্রত্যেকটা প্রহর বিষাদময় ।
আই লাভ ইউ সেহের ,লাভ ইউ মোর দ্যান এনিথিং! ”
সেহেরের চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝোরছে।বোকাসোকা মুখ করে দ্রুত স্বরে বলল,” তবে লিয়া যে বলল ,আপনি অন্যকাউকে ভালোবাসেন।আপনার বাচ্চা গার্লফ্রেন্ড আছে? ”
আরহাম সেহের কথায় কিঞ্চিত হাসে।পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারী থেকে একটি ছবি সেহেরের সামনে ধরে।ফোনে ভেসে উঠা ছবির দিকে তাকিয়ে সেহের বিষম খায়। এটাতো পাঁচ বছর আগের সেই প্রতিযোগিতার ছবি ।সেহের মুখে চকলেট কামড়ে ধরে পায়ের ঘুঙুর বাঁধছে। আরহামের কাছে এই ছবি এলো কি করে? মা দিয়েছে? এসব ভেবে সেহের গোল গোল চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম সেহেরের প্রশ্নসূচক দৃষ্টি দেখে মুচকি হেসে উত্তর দিলো ,”সেই প্রতিযোগিতায় গেস্ট হিসাবে আমিও ছিলাম ।হাজার হাজার মানুষের মাঝে আমার চোখ আটকায় তোমাতে ।কেন জানো মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে চিনি , এর আগেও আমি তোমাকে দেখেছি । তোমার সেই সরল চাহনী আমাকে অগোছালো করে দিয়েছিল।প্রথম দেখায় তোমার প্রেমে ডুবে গিয়েছিলাম। আমার পিচ্ছি গার্লফেন্ড মিহি না তুমি! ”
“তারমানে এখানে আসার পর আপনি আমার সাথে যা করেছেন জেনেশুনে ইচ্ছে করে করেছেন? ইচ্ছে করে অপরিচিতদের মত এম আচরণ করেছেন? রাগ দেখিয়েছেন? ”
সেহের কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল।আরহাম সেহেরের গাল টেনে বলল,” পাঁচবছর নির্ঘুম রাত শত শত রাত কাটিয়াছি ,এর শাস্তি তো তোমাকে দেওয়ার ছিল তাই না? ”
সেহের আরহামের হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বলে,”ছুঁবেন না আমাকে! আপনি কি করে আমার সাথে এমন করতে পারলেন? এসব করার আগে আপনার একটু দয়া মায়া হয়নি? হার্টলেস লোক কোথাকার! ”
সেহের রাগে বির বির করতে করতে আরহামের সামনের থেকে উঠে যেতে চাইলে আরহাম টান দিয়ে সেহেরকে বিছানায় ফেলে।চেপে ধরে নেশাপ্রবণ গাঢ় স্বরে বলে,” কি চাও এক্ষুনি মরে যাই? পাঁচ বছর তোমাকে কাছে পাবার অপেক্ষা করেছি।বিয়ের পর এতোদিন তোমার অনুমতি পাবার অপেক্ষা করেছি।আজ যখন তোমার অনুমতি পেয়েছি দূরে সরে যাবো ? উহু ,ইম্পসিবল ! আই কান্ট ওয়েট এনি মোর! আই নিড ইউ রাইট নাও। ”
আরহামের ধারাল চাহনি আর মোহিত কথার ঘোরে সেহের আটকে গেছে।আরহাম থেকে দূরে সরার মত সাধ্যি সেহেরের নেই।ফ্যালফ্যাল চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে । আরহাম ঘোরলাগা চোখে চেয়ে।সেহের কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার পূর্বেই আরহাম তার ঠোঁটের ভাজে সেহেরের ঠোঁট মিলিয়ে নেয়।জানালা দিয়ে আকাশে চাঁদটা উঁকি দিয়ে আছে।প্রণয়পাখিদের মিলন তিথি যেন অদূর আকাশের চাঁদটাকেও লজ্জায় ফেলছে। তাই তো মুখ লুকাতে মেঘেদের আড়াল হচ্ছে।
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৯

নতুন এক প্রদীপ্ত দিনের সূচনা।কুয়াশার চাদর কাটিয়ে সোনালী আলোরা উপচে পড়ছে ।দূর দিগন্তে অরূণ মাথা তুলে দাড়িয়েছে।অদূরে ঘাসের উপর শিশির কণা গুলো মুক্তদানার মত চকচক করছে। ভোরের পাখিরা অনেক আগে জেগে গেছে। আদুরে আলতো রোদ গুলো ভাঙা জানালার ফাঁকে হুড় মুড় করে প্রবেশ করছে।পুরো কামড়া এলোমেলো হয়ে আছে। চারদিকে ফুলদানী জানালার কাঁচের ভাঙা অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে।রোদের ঝিলিক আরহামের চোখে পড়তেই আরহাম বিরক্তির সাথে কপাল কুঁচকে নেয়।সেহেরের খোলা চুলে আরো গভীর করে মুখ ডোবায়।এতে বিশেষ লাভ হয় না,রোদের তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে সেই সাথে আরহামের ঘুমটাও ছুটছে ।সেহেরের চুলের মিষ্টি ঘ্রাণে আরহামের ঘুম কাটে।চুল থেকে মুখ তুলে ঘোলাটে ঘুম ঘুম চোখে সামনের দিকে তাকায়।সেহের বাচ্চাদের মত ঘুমিয়ে আছে।খোলা চুল গুলো কপাল ছুঁয়ে বারে বারে সেহেরের মুখের উপর পড়ছে। নিচের ঠোঁটের কিছুটা অংশ মুখের ভিতরের দিকে। দেখতে ভীষণ কিউট লাগছে । আরহাম আনমনে মুচকি হাসে।আলতো হাতে সেহেরের মুখের উপর পড়ন্ত চুল গুলো সরিয়ে দিলো ।আরহামের স্পর্শে সেহের ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে আরহামের বুকে মুখ গুজল ।আরহাম খুব সাবধানতার সাথে চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল ।সেহের আবারো গভীর ঘুমে ডুবে গেল।যেন হাজার বছর নিঘুম রাত কাটিয়ে অবশেষে প্রশান্তির ঘুমে মগ্ন! আরহাম এক নজরে সেহেরের দিকে তাকিয়ে।মনে এক তীব্র ইচ্ছা জাগল । সময়টাকে যদি এখানেই আটকে রাখা যেত? জীবনের প্রতিটা সকাল যদি এমনি মধুময় হতো! জীবনের প্রতিটা বিষাদময় কালো রাতের পর এমন এক সুন্দর সকাল চাই।চোখ মেলেই মোহনীয় মায়াবী চেহারাটার দর্শন চাই! আরহাম একমনে কথা গুলো ভাবল ।

সেহেরের ঘুম কাটল বেশ বেলা করে।সূর্য্যি মামা তখন সম্পূর্ন উদয় হয়েছে। নিজের আলোর তীর চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে।সেহের পাশ ফিরে অপর দিকে ফিরল ।ঝাপসা চোখে আয়নার সামনে এক পুরুষালি প্রতিবিম্ব দেখে মুচকি হাসল ।বেশ বুঝতে পারল আরহাম দাড়িয়ে।ধীর স্বরে আধো আধো গলায় বলল ,”গুড মর্নিং ”
আরহাম হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে পিছনে ফিরে উত্তর দিলো ,”গুড মর্নিং লাভ, অবশেষে রাজকন্যার ঘুম কাটল তবে? ”
সেহের হাই তুলে মজার স্বরে বলল,”কি আর করার? রাজকুমার তো আর চুমু দিয়ে ঘুম ভাঙাবে না, তাই ঘুমন্ত রাজকন্যাকে নিজের থেকে জাগতে হলো। ”
আরহাম দুষ্টু হেসে বলল,”আহা মিস হয়ে গেল যে ! তাতে কি? তখন হয়নি এখন হবে কি বলো! ”
আরহাম ঠোঁটের দুষ্টু হাসি রেখে এক পা এক পা করে সেহেরের দিকে আসতে লাগল।সেহের বিছানা থেকে বালিশ তুলে আরহামের দিকে ছুঁড়ে বলল,”একদম না।আর এক পা ও সামনে বাড়াবেন নাহ। যেখানে আছেন সেখানেই থামেন ।অনেক বেলা হয়েছে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে! ঐ দিকে না জানি কি হাল।বাড়ি ফিরতে ভয় করছে সবাই কি বলবে । ”
“তা বাড়ি ছাড়বার আগে ভাবা উঠিত ছিল! ”
সেহের মুখ ভার করে উত্তর দিল ,”আমি কি আর জানতাম আমাকে আবার ঐবাড়িতে ফিরতে হবে,আমি তো ঐপথ কে চিরবিদায় জানিয়ে এসেছিলাম! ”
“আমি জানতাম তোমাকে আবার আমার কাছে ফিরতে হবে,তুমি না মানলে জোর করে নিজের কাছে আটকে রাখতাম! ”
“পারতেন আমাকে আটকাতে? ”
“তোমাকে আমার কাছে রাখার জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো ,সব! ”
আরহামের রাশভারী কথা সেহের হেসে উড়িয়ে দিলো।আরহাম বাঁকা হেসে সেহেরের দিকে তাকাল।বলল,”তোমার ঠান্ডা পানিতে এলার্জি ,ওয়াশরুমে গরম পানি রাখা আছে ফ্রেশ হয়ে নেও।”
সেহের মুচকি হাসল।বলল,”বাহ! আপনি তো দেখি সব জানেন।আমার উপর পিএইচডি করে ফেলেছেন দেখছি! ”
” হুম বলতে পারো ।তোমাকে আমি এতোটা চিনি যতটা তুমি নিজেও নিজেকে চিনো না।কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নেও ,না হয় পানি ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
সেহের কাপড় ঘুছিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হয়।শান্তি নীড়ের সবার কাছে বিদায় নিয়ে আরহাম সেহের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে।গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে।আরহাম ড্রাইভিং সিটে।সামনের কাঁচ মাড়িয়ে আদুরে রোদ গুলো আরহামের মুখের উপর পরছে।চোখ সানগ্লাসে ঢাকা । হালকা বাদামি দাড়ি গুলো চকচক করছে।সেহের পাশের সিটে হেলান দিয়ে অলস চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে । রোদের হালকা তাপে ঘুম ঘুম ভাব এসে গেছে। চোখ বার বার লেগে আসছে।অনেক কষ্টে কোনরকম মেলে রেখেছে।আদো ঘুমে মাথায় এলোমেলো সব চিন্তাভাবনা ভর করছে।কখনো আরহামের দাড়ি গুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।আবার কখনো আরহামে গালে শক্ত এক চুমুতে লাল করে দিতে ইচ্ছে করছে।আবার খানিক পর এমন উদ্ভট চিন্তাভাবনা করায় আপন মনে বির বির করে নিজেকেই বকছে।সে কি দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে? সেহের নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে। এমন সময় আরহামের কথায় ঘোর কাটে।আরহাম ড্রাইভ করতে করতে বলল,”ঘুমন্ত রাজকন্যা ঘুম কি এখনো কাটেনি? সারারাত ঘুমিয়ে এখনো ঝিমাচ্ছ? ”
“সারারাত ঘুমাতে পারলাম কই? আপনি ঘুমাতে দিয়েছেন? ”
আরহাম দুষ্টু হেসে বলল,”কেন আমি আবার কি করলাম,শুনি ? “”
আরহাম বেশ কিছুক্ষণ উত্তরের আশা করল।কিন্তু উত্তর মিলল না।পিনপতন নীরবতায় ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সেহের গভীর ঘুমে তলিয়ে।আরহাম মুচকি হেসে বিরবির করে বলে,”স্লিপিং বিউটি ”

বর্তমান…….

পিনপতন নীরবতা ।সেহের অনুভূতি শূন্য থমথমে চোখে হসপিটালের সিলিং এর দিকে তাকিয়ে । হাতে ক্যানলা লাগানো ।খানিক পূর্বেই জ্ঞান ফিরেছে।স্যালাইনের ফোটার টিপটিপ শব্দটা পুরো রুম জুড়ে বাজছে।আরহাম সেহেরের বাঁ পাশে বসে।চোখে মুখে অস্থির ভাব।ভারাক্রান্ত মুখ ।একজন মহিলা ডক্টর সেহেরের চেকআপ করছে।চেকআপ শেষ হতেই আরহাম অস্থির স্বরে প্রশ্ন করে,”কি হয়েছে? ইস এভরিথিং অকে? ”
“মি. খাঁন ডোন্ট ওয়ারী । স্যি ইজ ফাইন।শরীর ভীষণ উইক তাই সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।এসময়ে এমনটা স্বাভাবিক! ”
“এসময় মানে? ”
“স্যি ইজ প্রেগন্যান্ট ।”
“আর ইউ সিউর ডক্টর ? ”
“ইয়েজ , হান্ডেট পার্সেন্ট কনফার্ম হওয়ার জন্য কিছু টেস্ট দিয়েছি করিয়ে নিবেন! ”
ডক্টর চলে গেল। আরহাম হাসি হাসি মুখ নিয়ে সেহেরের কাছে যেয়ে। সেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলে,”সেহের আমি কতটা খুশি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।আমাদের বেবি আসছে।তুমি মা হবে ,আমি বাবা হবো! ”
সেহের আরহাম থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।কপাল কুঁচকে বলল,” আমার কাছ থেকে সরুন প্লিজ, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার! ”
আরহাম সরে গেল। সেহেরের চোখে মুখে স্পষ্টভাবে বিরক্তি ফুটে।প্রেগন্যান্সির কথা শুনে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে । ধাক্কাটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি! বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৪০

সেহের রিপোর্ট ফাইলটার দিকে ড্যাবড্যাব অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে।রিপোর্ট পজিটিভ ।সেহের প্রেগন্যান্ট ।মুহূর্তেই চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেল। মানুষ কখনো অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারেনা যতক্ষণ না সেই একই ঘটনা তার সাথে না ঘটে।যতই বলুক আমি তোমার কষ্টটা বুঝছি! সত্যিকার অর্থে তা এক চিরসত্য মিথ্যা।একজন কখনোই অন্যজনের কষ্ট অনুভব করতে পারেনা।যদি না সে সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এতোটা বছর সেহেরের তার মাকে হৃদয়হীন পাষাণ মহিলা ভেবে এসেছে।মাকে চরম ঘৃণা করেছে। কিন্তু আজ এতোবছর পর মায়ের মত সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সেহের এই যন্ত্রণাকে অনুভব করছে!
না পারছে এই বাচ্চাটাকে নিজের গর্ভ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে না পারছে মেনে নিতে।আরহামের উপর চরম ঘৃণায় কোন ভাবেই এই বাচ্চাটাকে সেহেরের মন মেনে নিতে চাইছে না।মনের কোন এক কোণা থেকে নীরব এক ডাক ভেসে আসছে।ফিসফিস করে বলছে”এটা একটা খুনির বাচ্চা।খুনির অংশ তোর গর্ভে বেড়ে উঠছে । ”
সেহের ধপ করে ফাইলটা বন্ধ করে শান্ত স্বরে বলল ,”এবরশন করবো ,আমার এই বাচ্চা চাইনা । ”
সেহেরের কথায় আরহামের রাগ মাথায় চড়ে বসল।রাগে চিৎকার করে বলল,”তোমার রাগ জেদ আমাদের বাচ্চার উপর ঝাড়বে? এতোটা পাষাণ তুমি? মায়া মমতার ছিটাফোঁটা নেই তোমার মাঝে ? ”
সেহের বাঁকা হাসল।ধীর গলায় বলল,”মায়া মমতার কথা আপনার মত খুনির মুখে মানায় না।আমি একজন খুনির অংশ নিজের মধ্যে কোন দিন পালবো না। আমাকে আপনার কাছে আটকানোর এটা আপনার নতুন ঠাট ।আমার এই বাচ্চা চাই না। একটা খুনির অংশ চাই না। আমি এবরশন করবো ,যদি আপনি বাঁধা দেন তাহলে আমি নিজের জান দিবো ”
সেহের অস্থির উত্তেজিত স্বরে কথা গুলো বলল ।আরহামের রাগ এবার পুরোপুরিভাবে আউট অফ কন্ট্রোল। নিজের ভেতর নেই। আরহামের ভেতর তার অপর সত্তা জেগে গেছে।চোখ মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। অগোছালো এলোমেলো চুল। হুট করে সেহেরের কাছে যেয়ে শক্ত করে তার গাল চেপে ধরল।চিৎকার করে বলল,”তুই মান আর না মান এই বাচ্চা এই দুনিয়ায় আসবে। আমার অংশ তোর গর্ভে বাড়বে। তোকে আমার সাথেই থাকতে হবে।তুই যদি আমার কথা খেলাপ করিস তবে তোর বাবা মা ভাই বোন কেউ আমার থেকে রেহাই পাবে না। সবাইকে শেষ হতে হবে! শুনেছিস! ”
আরহামের জোর ধমকে সেহের কেঁপে উঠে। চোখ থেকে গাল বেয়ে ঝরঝর করে পানি ঝোরছে।থরথর করে কাঁপছে সেহের।আচমকা আরহাম নিজের মাঝে ফিরে এলো ।সেহেরকে কাঁদতে দেখে চট করে গাল ছেড়ে দিলো ।সেহেরের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে ভীতু স্বরে বলল ,”কি হয়েছে তোমার? এভাবে তুমি কাঁদছ কেন? জান আর ইউ ওকে? কেউ কিছু বলেছে ‘”
আরহামের হুট করে এমন পাল্টে যাওয়ায় সেহের ভয় পেয়ে গেল। এই প্রথম না এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে।আরহাম,হুট করে অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। নিজেকে “আর্বিন্দ” নামে দাবী করে। সেহের কাঁপা কাঁপা হাতে আরহামের হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বলে,” ছুঁবেন না আমাকে। আপনি একটা পাগল ,সাইকো মেন্টালি সিক! চলে যান এখান থেকে চলে যান! ”
সেহের চিৎকার করে কথা গুলা বলল। আরহাম স্থির চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে । সেহের আস্তে আস্তে ভীষণ হাইপার হচ্ছে।আরহাম ঝামেলা না বাড়াতে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আরহাম যেতেই সেহের বেডে বালিশে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।হুট করে তার জীবন কি থেকে কি হয়ে গেল! আরহামের বিষাক্ত প্রেমে আজ নিজের গর্ভের সন্তানকেও বিষাক্ত মনে হচ্ছে! যদি সেদিন এসব না হতো।যদি সত্যটা কোন দিন তার সামনে না আসত । তাহলে আজকের দিন হয়তো অন্যরকম হতো!
সেহের আবার অতীতে ডুব দিলো।

অতীত …….

বাড়ি ফেরার পর অন্যসবাই কিছু না বললেও। দাদাজান দাদীমা সামান্য রাগ ঝেড়েছিল ।গতরাতে বাড়িতে এতো বড় আয়োজন ছিল। আর এদিকে বাড়ির ছেলে বউ- ই বাড়িতে নেই! এনিয়ে সারা পার্টিতে গুঞ্জন ছিল।সবাই আরহামের খোঁজ করেছে। মিথ্যা বলে মিডিয়া সহ অন্যসবাই কে সামাল দিতে হয়েছে।এনিয়ে দাদাজান কিছুটা রেগেছিল কিন্তু আরহাম সবটা সামলে নিয়েছে। সেহেরও নিজের ভুলের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত! যেমন তেমন করে আরহাম বিষয়টা ধামাচাপা দিয়েছে।
দুপুরের শেষ ভাগ।সূর্যের তেজ অনেকটা কমে এসেছে। কোমল রোদ চারদিকে ছড়িয়ে। সেহের আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলে খোপা করে ক্লিপ লাগাতে গিলেও থেমে গেল। খোপা মুক্ত করল। মেঘবরণ লতানো চুল গুলো সুড়সুড় করে মুক্ত পাখির মত কোমড় অবধি ছড়িয়ে পড়ল।সেহের আয়নায় হতাশ চোখে তাকিয়ে। ঘাড়ের কাছে কালো দাগটা ফর্সা চামড়ায় স্পষ্ট ফুটে।যে কারোর দৃষ্টি আকর্ষন করবে।এইতো খাবার টেবিলে লিয়া চোখ টিপে দুষ্টু হেসে কত গুলো কথা শোনাল ।পিঞ্চ করে বলল,”বাহ ,লাভ বাইট? আমাদের আগে বললেই পারতে দুজন হানিমুনে যাচ্ছ ।খামাখা কত চিন্তা হলো। ”
লিয়ার কথা শুনে সেহেরের বিষম কেটে যাই যাই অবস্থা! কোনরকম পানি খেয়ে শান্ত হয়েছে।এ মুহূর্তে আরহামের উপর সেহেরের ভীষণ রাগ হচ্ছে। এক রাতে কি হাল করেছে? এখন সবার সামনে সেহেরকে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে।নিজে তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেশ ঘুরছে । লজ্জায় শুধু সেহেরকে পড়তে হচ্ছে!
সেহের আয়নার সামনে পাকাপোক্ত ভাবে দাড়িয়ে বিরবির করে বলল,”আজ শুধু রুমে আসুন,আপনাকে যদি নাকানিচোবানি না খায়িয়েছি আমার নাম ও সেহের নাহ! হুহ । ”
এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। সেহের আরহাম ভেবে বাজখাঁই গলায় বলে,”ভিতরে আসুন ,আজ আপনার একদিন কি আমার একদি….”
যেই না পিছনে তাকাল অমনি সেহের থমকে যায়। আরহাম না। মিহি এসেছে।মিহিকে দেখে সেহের ভীষণ বিব্রত হলো।গত কিছুদিনের ব্যবহারের জন্য সেহের খুব অনুতপ্ত।ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সৌজন্য স্বরে বলল,” দরজায় দাড়িয়ে কেন? ভিতরে আসো । ”
মিহি ঠোঁটের কোণায় হাসি তুলে ভিতরে এসে ডিভানটায় বসল।সেহেরও মুখোমুখি বসে।মিহির সাথে কিভাবে কথোপকথন শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা । নীরবতা ভেঙে মিহি বলল,”বিদায় নিতে এসেছি ,বাবা গুলশানে ফ্লাট বুক করেছে। সেখানে উঠবো ”
মিহির কথায় সেহের ভীষণরকম চমকাল। তড়িঘড়ি স্বরে বলল,” বাড়ি রেখে সেখানে একা ফ্লাটে উঠবে কেন?”
মিহি চুপ। সেহেরের মিহির নীরবতার কারণ ধরতে পেরে অনুতপ্ত মলিন স্বরে বলল,”তুমি কি আমার জন্য বাড়ি ছাড়ছ ।মিহি আ’ম সো সরি।নিজের ইনসিকিউরিটির কারণে রাগের মাথায় সেদিন তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছি।আ’ম রিয়েলি রিয়েলি সরি।আমি সত্যি ভীষণ ভীষণ অনুতপ্ত। ”
মিহি সেহেরের হাতের উপর আশ্বস্ত হাত রেখে বলল,” ডোন্ট বি সরি সেহের। তোমার জায়গায় আমি হলেও এমনই করতাম হয়তো এর চেয়ে বেশি। তুমি যথেষ্ট শান্ত আর ভালো মেয়ে।কোন ওয়াইফ নিজের হাসবেন্ডের সাথে অন্য কোন মেয়েকে সহ্য করবে না। ইট’স নরমাল।বাট ট্রাস্ট মি উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ড।”
সেহের লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে নিলো।ঘাড়ের কালচে দাগটা মিহির চোখে পড়ল।মিহি মলিন হাসল। এটা যে আরহামের দেওয়া লাভ বাইট তা বেশ বুঝতে পারছে।মিহি সেহেরের দিকে তাকিয়ে ভেজা ভেজা স্বরে বলল,”নি: সন্দেহে তুমি ভীষণ সুন্দরী। কিন্তু এখন ,আরহামের ভালোবাসা তোমার সৌন্দর্যকে আরো গভীর করেছে । পূর্ন করেছে তোমাকে।”
সেহের মিহির দৃষ্টি দেখে কথা ধরতে পারে চুল দিয়ে দাগ ঢাকতে চাইলে মিহি তা দেখে ফিকে হাসল । বলল ,”আরহাম আমার টিনেজ লাভ।স্কুল লাইফে আরহামের জন্য অনেক পাগলামো করেছি।তখন যদি তোমার সাথে দেখা হতো খুব হিংসে করতাম তোমাকে । হয়তো আরহামকে কেড়ে নিতেও কমতি রাখতাম না।কিন্তু এখন এমনটা হয় না। কারণ আমি বুঝি গেছি ভাগ্যে আর মনের উপর কারো জোর চলে না। ভালোবাসাটা হুট করেই হয়ে যায়। তোমাদের এক সাথে দেখে খুব ভালো লাগে। মন থেকে ব্লেসিং আসে।দুজন একসাথে খুব ভালো থাকবে। ”
বলেই মিহি ডিভান ছেড়ে দাড়ায়।মিহিকে প্রত্যুত্তর করার মত কোন শব্দ সেহের খুঁজে পেল না।মিহি ঠকঠক হিল বাজিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।সেহের সেদিকে তাকিয়ে । মিহি দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল।পিছন ফিরে সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,”আর হ্যাঁ ,একটা কথা আরহাম তোমাকে খুব ভালোবাসে । অনেক বেশি যা কারো কল্পনাতেও তুলনা হয় না। ইউ আর সো লাকি! নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে রেখ। ”
মিহির অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ জলে টপটপ করছে। সেহের মিহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল ,”তুমিও ভালো থেকো! ”
মিহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে মলিন হেসে দরজার বাহিরে পা রাখে।

কনকনে শীতের রাত।তীব্র ঠান্ডা হাওয়া বইছে।। বারান্দার ঝুলন্ত ফুলদানী গুলো তিরতির করে কাঁপছে।উপরের ফেইরি লাইটটা ঘুরছে। ছেড়ে ছেড়ে আলো ছড়াচ্ছে।আরহামের বুকে হেলান দিয়ে সেহের বেতের চেয়ারে বসে। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া চলায় আরহাম পেছন থেকে সেহেরকে চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। পাশের টেবিলে গরম কফির মগ।মগ থেকে ধীর গতিতে ধোঁয়া উড়ছে ।আরহাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেহেরকে পেছন থেকে লক্ষ করছে। সেহের গভীর চিন্তায় মগ্ন।ঘোর কাটাতে টপ করে সেহেরের গালে চুমু খেয়ে বলল,”কি ভাবছ? ”
সেহের নড়েচড়ে উত্তর দিলো ,”মিহির কথা। ”
“আমি তোমার পাশে বসে আর তুমি মিহির কথা ভাবছ? ”
“এমনটা নয় ।আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ”
“হুম বলো”
“আপনার লাইফে যদি আমি না থাকতাম তাহলে আপনি কি মিহিকে বিয়ে করতেন? ”
“এটা কেমন কথা? তোমার মনে কি এখনো এসব নিয়ে সংকোচ আছে? ”
“উহু ,একদম না।মিহি আপনাকে খুব ভালোবাসে ”
“কিন্তু আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি ।মিহি সবসময় আমার ভালো বন্ধু ছিল । আর তুমি আমার আঁধারের আলো ! ”
সেহের আরহামের কথায় তেমন গুরুত্ব দিলো না। একবার জানতেও চাইল না আরহাম কেন এমনটা বলল।সরল মনে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল । হুট করে আরহাম কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,”আই লাভ ইউ ”
প্রত্যুত্তরে সেহের আরহামের দিকে ফিরে টুপ করে আরহামের গালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলল,”আমার একটা বেবি চাই,এখনি! ”
সেহেরের কথায় আরহাম বিষম খায়। হতভম্ব চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। “আই লাভ ইউর ” উত্তর এমন হয় আরহামের জানা ছিল না। আরহাম জড়সড় গলায় বলল,”আর ইউ অলরাইট? ”
সেহের কিটকিটে হেসে উঠে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here