“প্রমত্ততা তুই পর্ব ৩

#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||৩য় পর্ব ||

ভার্সিটির ভর্তির সময় শেষ হয়ে ক্লাসও শুরু হয়েগিয়েছে। জারিফ আর তাঁর ডিপার্টমেন্টের কিছু ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত হয়েছে প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষের সামনে। প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে সেই বিষয়ে কথা বলতে।

– প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা, তোমাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে আগামী সপ্তাহে আমরা নতুনদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাচ্ছি। প্রতিবারের মতোই তোমাদের উপর সব দায়িত্ব দিতে চাই। নবীনদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিভাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব জারিফ, মোনালিসা আর শিহাবের উপর। আর বাকিদের সমস্ত কিছু বলে দিবে যার যার ডিপার্টমেন্টের টিচাররা। জারিফ আশা করি সবকিছু সামলে নিবে তুমি।
– জি স্যার, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো যেন কোন ত্রুটি না থাকে।

প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষ থেকে বের হতেই ভার্সিটির মাঠে আয়নাকে দেখতে পায় জারিফ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর এই কথা সেই কথা বলে পাশে থাকা ছেলের পিঠে থাপ্পড় দিচ্ছে। মুহূর্তেই সকালের করা অপমানের কথা মনে পড়ে যায়। কিছুএকটা ভেবে জারিফের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে শিহাবের কানের কাছে গিয়ে কিছু বললো। জারিফের কথা শুনে শিহাব চোখ বড় করে তাকালো,

– তোর মাথা ঠিক আছে জারিফ? মেয়েটার সাথে এমন করতে গিয়ে না জানি তোর জীবনই পাল্টে যায়।

– আরে ইয়ার কিছু হবে না। এই জারিফ কখনোও কোন ভুল পদক্ষেপ নেয় না।

যথাসময়ে দশটায় ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠে। সকল ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসরুমে। ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম ক্লাসেই জারিফ আর তাঁর দলবলরা হাজির হয়। ক্লাসের স্যারের অনুমতি নিয়ে বলতে শুরু করে,

– আগামী সপ্তাহে আমাদের ভার্সিটিতে নবীনবরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে তো সেখানে সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে যে যে নাম দিতে চাও দিতে পারো।

জারিফ এতক্ষণ সবার উদ্দেশ্যে কথা বলছিলো ঠিকই কিন্তু পুরোটা সময় নজর ছিলো আয়নার উপর। আর আয়না সে তো অন্য জগতে বিরাজ করছে জারিফের কথা তাঁর কানে গিয়েছে নাকি সন্দেহ। জারিফ এবার তীক্ষ্ম চাহনি দিয়ে আয়নার উদ্দেশ্যে বলল,

– আয়না কে এখানে?

জারিফের মুখে আয়না নিজের নাম শুনে কপাল কুঁচকে ফেলল খানিকটা বিরক্তি নিয়ে নিজের হাতখানা উপরে তুলল,

– তোমাদের মধ্যে থেকে আমরা কয়েকজনকে সিলেক্ট করেছি যাদের কাজ হচ্ছে আমাদের কথা মতো চলা তাদের মধ্যে মিস আয়না, আপনি আমার সহায়তা করবেন। আর বাকিদের দায়িত্ব শিহাব বুঝিয়ে দিবে।

– আমি আপনার সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক নই সিনিয়র ভাইয়া।

– এটা প্রিন্সিপাল স্যারের আদেশ নয়তো আমারও সখ নেই আপনাকে সাথে রাখার।

আয়না সবার সাথে যেমনই হোক না কেন স্যারদের খুব সম্মান করে। প্রিন্সিপাল স্যারের আদেশ তাই চুপ করে রইলো।

– তো মিস আয়না, পাঁচ মিনিটের মধ্যে হল রুমে চলে আসুন আপনার কাজ আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

জারিফরা যেতেই আয়না কটমট চোখে জারিফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। জারিফ যে ইচ্ছে করেই আয়নাকে শায়েস্তা করার জন্য সহায়ক বানিয়েছে তা আয়নার অজানা না। আয়না কি যেন ভেবে বাঁকা হেসে জারিফের পেছনে এগিয়ে যায়।

হল রুমের প্রবেশ করতেই একগাদা কাগজ এসে পড়ে আয়নার সামনে। ভ্রূ কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখে ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে জারিফ তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে আর তাঁর পেছনে কয়েকজন টিচার কি নিয়ে আলোচনা করছেন।

– আরে মোনালিসা, তুই শুধু শুধু সময় নষ্ট করে কাগজগুলো তুলতে যাবি কেন? মিস গয়না এখন ফ্রি আছে সেই-ই তোর কাজটা করে দিক। তুই আর শিহাব বরং লাঞ্চটা করে আয় ক্যান্টিন থেকে। ততক্ষণে মিস গয়নাকে তার কাজ আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।

জারিফের কথায় আয়না এবার মুচকি হেসে কাগজগুলো তুলতে শুরু করে। আয়নার ব্যাপারটা জারিফের পছন্দ হলো না সে চেয়েছিল সকালের মতো আয়না সিনক্রিয়েট করুক আর তাকে টিচাররা খারাপ জানুক কিন্তু তা আয়না হতে দিলো না।
– ভাইয়া কাগজগুলো কোথায় রাখবো?

পরনের ওরনাটা কাঁধ থেকে সামনে ঝুলিয়ে এনে সুইটভাবে জারিফকে প্রশ্ন করছে আয়না। একটু আগের দেখা সেই অগোছালো আয়না এটা না। জারিফের সামনে এখন অত্যন্ত ভদ্র পরিপাটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে যাকে টিচাররা দেখলে চোখ বন্ধ করে ভাইবাতে দশে দশ দিয়ে দিবে ভদ্রতার জন্য।

– ঐখানে টেবিলের উপর রাখো।

জারিফ দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলল যা আয়না বুঝতে পেরেছে।

– ভাইয়া আমায় কাজ দিবেন বলেছিলেন।

আয়নার কথায় জারিফ এবার বাঁকা হেসে বলে,

– লাঞ্চের শেষে প্রিন্সিপাল স্যার সহ অন্যান্য কয়েকজন স্যারের কাছ থেকে এই কাগজগুলোতে স্বাক্ষর নিয়ে আসবে ইটস্ আর্জেন্ট। ততক্ষণে আমি কালচারাল প্রোগ্রামের লিস্ট তৈরি করে ফেলি।

জারিফ কিছু কাগজ আয়নার হাতে দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। বর্তমানে জারিফের ভাবসাব এমন যে সে খুবই নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছে আর খুবই ব্যস্ত। জারিফের হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে আয়না ভাবছে যে এত সহজে জারিফ আয়নাকে ছেড়ে দিলো? আয়না আর না ভেবে প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। এদিকে আয়না যাওয়ার পর জারিফ শয়তানি হাসি দিয়ে বলতে শুরু করল,

– মিস আয়না, আমার সাথে পাঙ্গা নিয়ে খুব ভুল করেছো। এই তাযিন জারিফ যে আসলে কি
তা আজ হারে হারে টের পাবে।

মধ্যদুপুর। মাথার উপর সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়না এখন কোমড়ে হাত রেখে ভার্সিটির মাঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাপাচ্ছে। তখন জারিফের এত ব্যস্ততা দেখে আয়না একটুও বুঝতে পারেনি যে জারিফ এত বড় একটা কাজ করাবে আয়নাকে দিয়ে। পুরো ভার্সিটিতে দৌঁড়ে দৌঁড়ে জারিফের দেয়া কাগজগুলোতে এখন পর্যন্ত ষাট জন শিক্ষকদের স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এখনও আরো চল্লিশজন শিক্ষকদের স্বাক্ষর নেয়া বাকি। আয়না বুঝে গেছে জারিফ তাকে জব্দ করার জন্য এই কাজ দিয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে হল রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে জারিফ হাসছে। হাতের এক আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় আয়না। মাথার খোলা চুলগুলো দুহাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করে আবারও দৌঁড়ে কাজ শুরু করলো। আর এদিকে জারিফ আয়নার এই অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে চলে যায় নিজের কাজে।

একশত শিক্ষকদের স্বাক্ষর নিয়ে হল রুমে ফেরার পথে আয়নার ফোনে কল আসে। কলটা রিসিভ করার পর আয়নার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শুধু এই কথা বলে আমি আসছি। কথাটি বলে হল রুমের দিকে অগ্রসর হয়।
জারিফ আর তাঁর বন্ধুরা কি এক বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিল ঠিক তখনই সেখানে আয়নার আগমন ঘটে। আয়নাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়। আয়না সবার সামনে এসে কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

– আমার কাজ শেষ। এখানে একশত টিচারদের স্বাক্ষর আছে। আপনারা অনুমতি পেয়েছেন এই কাজটি করার জন্য।

জারিফ গম্ভীরভাবে কাগজগুলো চেক করে নিয়ে দেখলো সত্যি সত্যিই আয়না তাঁর কাজ পূর্ণ করেছে।
জারিফ আবার কিছু বলতে যাবে তখনই আয়না বলে উঠে,

– কতৃপক্ষ থেকে বলা হয়নি যে জুনিয়রদের খাটিয়ে সিনিয়ররা আরাম করবে। আমার কাজ শেষ আপাতত আমি চললাম।

আয়না জারিফের কিছুটা কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

– আমার নাম আয়না পরনের কোন গয়না না। আয়নাকে কখনও দুর্বল ভেবোনা যে একটু টোকা দিলেই ভেঙ্গে যাবে। এই আয়না যেমন স্বচ্ছ তেমন মজবুত এটুকু পরিশ্রমে ভাঙ্গে পড়বে না। আর আজকের বিষয়টা মাথায় রাখলাম সময় বুঝে শোধ করে দিবো।

আয়না আর এক মুহূর্তও জারিফের সামনে দাঁড়ায়নি দৌঁড়ে বের হয়ে যায় ভার্সিটি থেকে।

——–

খান বাড়িতে আজ রমরমা পরিবেশ। বাড়ির সকলে চুপ করে সোফার রুমে বসে আছে। আয়না হন্তদন্ত হয়ে খান বাড়িতে প্রবেশ করে। সোফায় ফারিয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আয়নার ছোট ভাই দর্পণ। দর্পণ আয়নার এক বছরের ছোট ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আর ফারিয়া আয়নার বড় বোন বিবাহিত। আয়নার মা দর্পণকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা যান। তখন থেকেই ফারিয়া একাই দুই ভাইবোনকে বড় করে তোলেন। আয়নার বাবা মিহির বিজনেসম্যান কাজের তাগিদে বছরের অর্ধেক সময় বাহিরেই থাকে।

– আপাই কি হয়েছে দর্পণের?

ফারিয়া ছোট বোনকে দেখে ভীতুস্বরে বলল,

– আয়না বোন আমার আগেই বলে দিলাম তুই কোন ঝামেলা করবি না।

– আপাই আগে বলবে তো কি হয়েছে দর্পণের?

– কলেজ থেকে আসার সময় আব্বাস নেতার ছোট ভাই মাসুম ভাইকে পিটিয়েছে। আর,,,,,

প্রাণের বোনের আওয়াজ পেয়ে দর্পণ ফারিয়ার কোল থেকে উঠে কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বলল,

– বিশ্বাস কর আপাই আমি কিছু করিনি। ওরা তিন চারজন এসে আকস্মিক কিছু বুঝে উঠার আগেই মারা শুরু করে তার জন্য আমি পাল্টা আক্রমণ করতে পারিনি।

দর্পণের কথায় আয়না অগ্নি রুপ ধারণ করে। মাথায় খোঁপা করে দর্পণকে সোজা করে দাড় করিয়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। যারফলে পেছন থেকে ফারিয়ার হাজারো ডাক তাঁদের কানে পৌছেনি।

হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়না বাড়ির পাশের মোড়ের সামনে।এখান দিয়েই নেতা খেতার ভাই মাসুম বাড়ি যাবে। ঠিক আধাঘন্টা পর মাসুম আসে আসার সাথে সাথেই আয়না ইচ্ছে মতো মারা শুরু করে।

– আমার ভাইকে মারা? আজ তোকে মেরেই ফেলবো।

আয়নার মারপিটের মাঝেই জারিফ ঐ রাস্তা দিয়ে রিকশা করে বাসায় যাচ্ছিলো। আয়নার এমন রুপ দেখে চোখ বড় বড় করে বলে,

– এটা কি আসলেই মেয়ে, নাকি বোম্বাইমরিচ?

কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। বাকীটা আগামী পর্বে জানতে পারবেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here