মেঘের পরে মেঘ -৩১
এই মুহূর্তে “দি লাস্ট চয়েস” কোম্পানির এম ডির সামনে বসে আছে রুপসা।এই কোম্পানিতেই প্রলয় গত তিন বছর আগে কাজ করতো।যদি কোন ইনফরমেশন পাওয়া যায়।কিন্তু এম ডি সাহেব তো ফাইল দেখা থেকে ফুরসতই পাচ্ছেন না।এম ডির বয়স কম।মোটামুটি ধাঁচের সুদর্শন।কিন্তু গম্ভীর প্রকৃতির। নয়তো বেশি রকম ভাব।এই যে এতোটা সময় যাবত রুপসা এখানে বসে আছে, তার কোন হেলদোল নেই।সে নিজের কাজে ডুবে আছে।যেন এখানে রুপসা নামের কোন মানবী বসে নেই।রুপসা মনে মনে বকছে ব্যাটাকে।
“শালা,কিসের এতো ভাব রে তোর?সেই কখন থেকে বসে আছি।মানুষ তো এক গ্লাস পানি অন্তত অফার করে।আর তুই?শালা,ম্যানারলেস একটা।”
মনে মনে বকেই যায় রুপসা।
আরো কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর লোকটা চোখ তুলে তাকায়।হাতের ফাইলটা সরিয়ে রেখে রুপসা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ ম্যাম?”
“একচুয়েলি,আই নিড সাম ইনফরমেশন। ”
“ওয়ান মিনিট।”
বলেই লোকটা রুপসাকে ভালো ভাবে দেখতে থাকে।তারপর বলে,
“আর ইউ আ ইন্ডিয়ান? ”
“নো স্যার।আই এম ফ্রম বাংলাদেশ। ”
” থ্যাংকস্ গড।বহুদিন পর বাংলায় কিছুক্ষন কথা বলার মানুষ পেলাম।তো বলুন ম্যাডাম, আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”
আমতা আমতা করে রুপসা শুরু করলো।
“আসলে আপনাদের এ কোম্পানি তে কি মোঃ শেহজাদ আহমেদ নামে কেউ কাজ করে?আমার তাকে একটু দরকার ছিলো। ”
“মিঃ শেহজাদ নামে কেউ কাজ করে কি না……
বলে একটু ভেবে নেয় লোকটা।তারপর বলে,
“আমার জানা মতে না।তারপরও যদি আপনার বিশেষ দরকার হয় তো আমি খোঁজ নেবো।”
” আমার খুবই দরকার স্যার। উনি তো আপনাদের এখানে প্রায় ছ’সাত বছর যাবত কাজ করছেন।আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই আপনার কোম্পানির লোকদের বায়োডাটা আছে।উনার ইনফরমেশন ও নিশ্চয়ই থাকবে।”
“থাকবে তো অবশ্যই।কিন্তু কথা হলো পুরোনো লোকদের এবং চাকরিচ্যুত লোকদের কোন ইনফরমেশন আমরা রাখি না।”
“চাকুরিচ্যুত লোকদের বায়ো রাখেন না সেটা না হয় ঠিক আছে, কিন্তু পুরনো লোকদের বায়ো কেনো রাখেন না সেটা তো বুঝলাম না।একটু ক্লিয়ার করুন প্লিজ। ”
“আসলে মিস, হয়েছে কি,আমাদের এই কোম্পানি টা নতুন।বছর দুই আগে এটা হাত বদল হয়েছে।এই কোম্পানির নাম টা বাদে আর সব কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। ইভেন কি এই কোম্পানির কাজ পর্যন্তও।পুরাতন লোক ছাটাই করে নতুনদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাও প্রায় দেড় বছর।তাই এর আগে কারা এখানে কাজ করতেন তার ডিটেইলস এখন আমাদের কাছে নেই।থাকলে আমি অবশ্যই আপনাকে হেল্প করতাম।সরি মিস।”
মন খারাপ হলো রুপসার। কতোটা বলে বুঝানো যাবে না।ভেতর টা খাঁ খাঁ করছে।যে আশায় এতোদুরের পথ পাড়ি দিলো তা পূরন হলো না।এই একটা আশা ছিলো।এখন সেটাও শেষ।কোথায় খুঁজবে এখন প্রলয়কে?
রুপসার মন খারাপ ভাব টা লোকটা বুঝলো।
“সরি মিস।আপনি এতোদুর থেকে এসেছেন অথচ আপনাকে নুন্যতম সাহায্য ও করতে পারলাম না।”
শুরুতে এই লোকটাকেই অত্যন্ত মুডি মনে হচ্ছিলো রুপসার কাছে।কিন্তু এখন তেমন লাগছে না।মনে হচ্ছে আগাগোড়া আন্তরিকতা সম্পন্ন একজন মানুষ। রুপসা হাসলো।
“ইট,স ওকে।”
“আপনি এক কাজ করুন না ম্যাম,”
“কি কাজ ভাইয়া?”
“আপনার কাছে যদি উনার কোন ছবি থেকে থাকে তবে সেটা সমেত উনার বায়োডাটা টা আমার কাছে দিয়ে যান।সিডনিতে আমার অনেক পরিচিত জনেরা থাকে।দেখি কোন ভাবে খোঁজ পাওয়া যায় কিনা।”
রুপসার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
“সো কাইন্ড অফ ইউ স্যার।”
বলেই নিজের পার্সে রাখা প্রলয়ের একটা ছবি আর ওর
কিছু তথ্য একটা কাগজে লিখে লোকটাকে দিলো।
“যদি খুঁজে দিতে পারেন তবে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।”
“একটা প্রশ্ন করতে পারি কি মিস?খুব কৌতুহল হচ্ছে বিষয় টা নিয়ে। ”
“বলুন।”
“যাকে খুঁজছেন,কে হন উনি আপনার?হাসবেন্ড? ”
“না।হাসবেন্ড না।তবে একসময় আমার এ ছোট্ট জীবনের সবকিছুই ছিলেন উনি।এখন আর কেউ হন না।”
মৃদুস্বরে বললো রুপসা।
“তাহলে?”
“আমার ও কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন।যার উত্তর শুধুমাত্র সে ই দিতে পারে।”
“ও।আমি দেখছি কি করা যায়।আমার কার্ডটা রাখুন।আর আপনার ফোন নম্বর টাও আমাকে দিয়ে যান।”
রুপসা একটা কাগজে ফোন নম্বর তুলে দিলো।
“এখানে আমার কোন সিম নেই।পি সি ও থেকেই কথা বলছি।আমিই আপনাকে কল করবো প্রতিদিন।এটা আমার বাংলাদেশী নম্বর। আমি এখানে আর বারো দিনের মতো আছি।তারপর চলে যাবো।যদি এর মধ্যে কোন খবর পান তাহলে তো ভালোই।আর যদি এমন হয়,আমি দেশে ফিরে যাওয়ার পর ওনার কোন খোঁজ পেলেন তাহলেও আমাকে জানাবেন।”
“ওকে মিস।আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।”
“থ্যাংক ইউ।আসি।”
জবাবে লোকটা মৃদু হাসলো।
গাড়িতে উঠে লোকটার দেয়া ভিজিটিং কার্ডে আর একবার নজর বুলালো রুপসা।
“মিঃ আবির হোসাইন।”
“ম্যানেজিং ডিরেক্টর অফ দি লাস্ট চয়েস। ”
“ফোন নম্বর ঃ **********”
এরপর ভিজিটিং কার্ডটা নিজের পার্সে ঢুকিয়ে নিলো।
________
একবুক হতাশা নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখলো রুপসা।প্রলয়কে খুঁজে পায় নি।গত পনেরো দিনে সিডনির অলিতে গলিতে খুঁজেছে ওকে।কিন্তু নেই।নিজের প্রশ্নের উত্তর গুলো আর পাওয়া হলো না রুপসা র।মিঃ আবির ওকে নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন প্রলয়কে খোঁজার ব্যাপারে।কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
সিডনির বাঙালি কম্যুনিউটিতেও খোঁজ করেছে ওরা।সেখানে একসময় প্রলয় এটাচড থাকলেও এখনকার কোন খোঁজ নেই।
ওর পরিচিত কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি।যেন ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেছে প্রলয়।
তবে একজনের কাছে একটু খোঁজ পেয়েছিলো আবির।সে লোকটা প্রলয়ের আগের অফিসের বসের পরিচিত।তার জানামতে প্রলয় তার বসকে বিয়ে করে আমেরিকায় স্যাটেল্ড হয়েছে।সেই জন্যই নাকি তার বস তনিমা এই কোম্পানি বিক্রি করে দিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছেন।
ভাবতে ভাবতেই এয়ারপোর্টের সমস্ত নিয়মকানুন শেষ করে বাইরে বেরোয় রুপসা।
মা -বাবা দাঁড়িয়ে আছে। পাশে নুর।
এই একটা ছেলে,এমন মানুষ দুনিয়াতে এখনো আছে বিশ্বাস হয় না রুপসার।বন্ধুর খবর নেই, সে দিব্যি অন্য মেয়েকে নিয়ে সংসার করছে।আর এই মানুষ টা এখনো ছায়ার মতো ওর পাশে আছে।
মন খারাপ ভাব টা লুকিয়ে সামনে এগোলো রুপসা।
এখন থেকে আর পিছু তাকালে চলবে না।বাবাকে মাকে ও কথা দিয়েছে।এখন শুধু নতুন পথে চলার অপেক্ষা।
চলবে……..
মুনিরা মেহজাবিন।