#অনপেখিত
#পর্ব_২৪
লিখা: Sidratul Muntaz
উর্মি মেহেকের কাছে এসে তার একহাত ধরে টেনে খিটখিটে গলায় বলতে লাগল,” আপা, এইদিকে আসেন। গরমের মধ্যে এইখানে দাঁড়ায় কি করেন? আমার সাথে বিছানায় গিয়া শুয়া থাকবেন, চলেন। আপনার শরীরটাও তো ভালো না।”
মেহেককে অসহায়ের মতো মুখ করে উর্মির সাথে চলে যেতে হচ্ছিল। একবার মন চাইল উর্মিকে ধমক মেরে বলতে,” আমি যদি গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি তাহলে তোর সমস্যা কি? আর এই ভোরবেলা টইটই করে সারাবাড়ি ঘুরছিস কেন তুই? ঘুম নেই? ভেলকি জানি একটা! যা এখান থেকে, আমি তোর সাথে যাবো না কোথাও। ”
কিন্তু মেহেক বলতে পারল না কিছু। একটু আগে উর্মির জন্যই মেহেকের জীবনের অনেক বড় একটি ফাঁড়া কেটেছে। তাছাড়া এই ছোট্ট মেয়েটি যে তাকে অনেক ভালোবাসে এতে তো কোনো সন্দেহ নেই। তাই এক প্রকার কৃতজ্ঞতা ও মায়া থেকে হলেও উর্মির সাথে ওমন কঠোর আচরণ করতে বাঁধল মেহেকের। কারণ এতে হয়তো উর্মি মনে কষ্ট পেতো। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে উর্মির সাথে চলে যায় মেহেক। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে ফারদিনের দিকে তাকিয়েছিল সে। ফারদিনও তাকিয়ে ছিল তার দিকেই। মেহেক ফারদিনের চোখ দু’টি দেখে বুঝেই ফেলল, সেই দৃষ্টিতে সুক্ষ্ম আক্ষেপ লেগে আছে। আরও লেগে আছে তীব্র ব্যাকুলতাপূর্ণ এক তৃষ্ণা!
উর্মির সাথে রুমে এসে বসতেই হঠাৎ হোসনেয়ারা চাচী হাজির হলেন। তাঁর চোখ-মুখ কি অস্থির! যেন ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। মেহেকের দুই বাহু জড়িয়ে ধরে বললেন,” তুমি নাকি শরীরে আগুন দিসিলা?”
মেহেক থতমত খেয়ে গেল। হোসনেয়ারা চাচী জিহ্বা কামড়ে বিলাপ শুরু করলেন,” ও আল্লাহ,ও আল্লাহ! কি সাহস তোমার মাইয়া! যদি কোনো সর্বনাশ হয়া যাইতো? আমার মাইয়া হইলে এতোক্ষণে ধইরা ছেঁচতাম তোমারে আমি। এমন বেকুবের মতো কাম কেউ করে? আইচ্ছা ক্যান করসো? জামাইয়ের লগে ঝগড়া কইরা এমন করসো নাকি? ”
মেহেক ইতস্তত বোধ করে বলল,” তেমন কিছু না।তাছাড়া আমি এখন ঠিকাছি চাচী। ভয়ের কিছু হয়নি।”
মেহেক আলোচনা শেষ করার উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছিল। হোসনেয়ারা চাচী বুকে হাত দিয়ে প্রলাপ বকে যেতে লাগলেন।
” এসব ভালো না বুঝছো মাইয়া! আমি তো কিছুই জানতাম না। উর্মি যখন আমারে আইসা এই কথা কইলো আমি তখন মাত্র ঘুম থেকা উঠসি৷ শুইন্নাই আমার বুক ধড়ফড়ানি শুরু হইসে। দৌড়ায়া যে আমি কেমন আইসি সেটা খালি আমিই জানি। এখনও আমার বুকটা কাঁপতেসে। তোমার ডর লাগে নাই? আমারই মাথা ঘুরাইতাসে। কেমনে যে করো তোমরা এইসব?অবশ্য অল্পবয়সী মাইয়াগো আবেগ থাকে বেশি৷ তারা সব করতে পারে। আমাগো গ্রামেই তো একজন ছিল। আমগাছে উইঠা গলায় ফাঁস লাগাইতে গেসিল। দেখো কিরুম সাহস…”
হোসনেয়ারা চাচী গল্প করেই যাচ্ছেন। মেহেক অপ্রস্তুত করছিল। চাচীর এই একটা খারাপ স্বভাব। যেকোনো বিষয় নিয়ে ওভার রিয়েক্ট শুরু করেন। এজন্য তাকে কেউ কিছু বলতে চায় না। উর্মি যে কোন আক্কেলে চাচীকে বলতে গেল! এখন টানা একঘণ্টা বকবক শুনতে হবে। মেহেক মাথা নিচু করে মুখে আগলা হাসি রেখে কথা শুনে যাচ্ছিল। একটু পর ফারদিন ভেতরে প্রবেশ করল। সাথে সাথেই চাচী মাথায় ঘোমটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আবার ফারদিনকে দেখলেই লজ্জায় কেমন যেন করেন! সামনে দাঁড়াতে চান না। এবারও দাঁড়ালেন না। উর্মিকে সাথে নিয়েই দ্রুত চলে গেলেন ঘর থেকে। মেহেক যেন হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচল। আরেকটু হলেই মাথা ধরে যেতো তার। ফারদিন মেহেকের দিকে চেয়ে মুচকি করে একবার হাসল। তারপর খাবারের প্লেটটা নিয়ে খাটের সাথে লাগোয়া ছোট্ট টেবিলের উপর রাখল। মেহেক তাকিয়ে দেখল, খুব সুন্দর করে খাবারের উপর ডেকোরেশন করা হয়েছে। একটা টমেটোর টুকরো ডিজাইন করে ডিমের উপর রাখা। ডিমের ভেতরে পাউরুটির পুর। অদ্ভুত রেসিপি তো! এবার খেতে কেমন হয় সেটাই দেখার পালা। ফারদিন বলল,” নাও টেস্ট করো। তারপর রেটিং করো।”
মেহেক হেসে বলল,” দেখেই রেটিং দিয়ে দিলাম। দশে দশ!”
ফারদিন ভ্রু কুচকালো,” কেন? খেতে ভয় পাচ্ছো নাকি? ভাবছো এমন অখাদ্য মুখে তোলার চেয়ে ভালো আগে-ভাগেই দশে-দশ বলে দিই? ”
” আরে না, না, এরকম কেন হবে? আপনি শুধু শুধুই উল্টা ভাবছেন। আমি তো আপনার প্রেজেন্টেশনের প্রশংসা করতে কথাটা বলেছি। খাবো না সেটা তো একবারও বলিনি। তাছাড়া যে জিনিস আপনি হাত কেটে আমার জন্য রান্না করেছেন সেটা কি আমার কাছে অখাদ্য হতে পারে? এটা যেমনই হোক, আমার কাছে অবশ্যই অমৃত!”
” তাই?”
” হুম।”
” তাহলে দরজাটা বন্ধ করে আসি?”
মেহেক ভ্রু কুচকালো। খাবার খাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করতে হবে কেন? একটু পরেই দরজা বন্ধ করার কারণ সম্পর্কে অবগত হলো সে। ফারদিন খুব শান্তভাবেই তার পাশে এসে বসলো। তারপর আচমকাই দু’হাতে মেহেকের গাল চেপে ধরে ঠোঁটে গাঢ় সেই স্পর্শটা দিয়ে ফেলল। যে স্পর্শ পেতে একটু আগেও মেহেক আকুল অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন আক্রমণে সে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল। কারণ এখন সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগে যেন এক ভয়ংকর অনুভূতির তীক্ষ্ণ আবেশ তাকে চারিপাশ থেকে জাপটে ধরল। মেহেকের কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে কোনো সুখ সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। এমন ভালোলাগা আগে কখনও অনুভব করেনি সে। এইভাবে আগে কখনও কেউ তাকে স্পর্শ করেনি। এতোটা মায়া,যত্ন,সুখানুভূতি,আদরমাখা মোহনীয় স্পর্শ যেন মেহেকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ তুলে দিচ্ছিল। ভালোবাসার স্পর্শ বুঝি এমনই হয়! মেহেকের জন্য পুরো পৃথিবীটা এখন নতুন। অনুভূতিগুলো একদম নতুন! ভীষণ তাজা! যেন সে মাত্র জন্ম নিয়েছে। কিন্তু আগের জন্মের সেই জরাজীর্ণ বিছরি স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই ডুঁকরে কেঁদে ফেলল সে। সত্যিই কি এতো ভালোবাসার যোগ্য সে? না, নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। ধর্ষিতা হওয়ার এই হীনমন্যতা তাকে ভেতর থেকে যেন সম্পূর্ণ খুঁড়ে খেয়ে নিচ্ছে। মেহেকের কান্না দেখে ফারদিন স্তব্ধ হয়ে গেল। অদ্ভুত, মেয়েটা কেন কাঁদছে? ফারদিন ভয় পেয়ে গেল। সে কি তাহলে ভুল করেছে? মেহেক কি তার আচরণে আবার কষ্ট পেয়েছে? অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ফারদিন,
” তুমি কাঁদছো কেন মেহেক?”
মেহেক দুইহাতে চোখের জল মুছল। ফারদিন অপরাধে ক্লিষ্ট হয়ে বলল,” স্যরি। আমার হঠাৎ করে এটা করা উচিৎ হয়নি। তোমার কি খারাপ লেগেছে?”
ইশশ, ফারদিনের আদুরে প্রশ্নে মেহেকের আরও কান্না পাচ্ছিল। এইভাবে কেউ কখনও তার কাছে জানতে চায়নি, তার খারাপ লেগেছে কিনা! মেহেক নিজেকে সামলাতেই পারছিল না। কাঁদতে কাঁদতেই দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল। খট করে দরজা আটকে দিল। ওর এহেন আচরণে ফারদিন অবাক! নিজেকে অত্যাচারী মনে হলো তার। অপরাধে আড়ষ্ট হয়ে গেল।
মেহেক শুকনো টাইলসের মেঝেতে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগল। তার জীবনটা হঠাৎ এতো বেশি আলোকিত হয়ে যাচ্ছে কেন? আর এতো আলোর মাঝেও সে কেন কালো আঁধারের স্মৃতিগুলো ভুলতে পারছে না! কেন!
চলবে
( গতপর্ব আর আজকের পর্ব মিলে একটা পর্ব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একবারে লেখার সময় পাচ্ছি না। তাই অর্ধেক করে দিতে হলো।)