দ্বিতীয় বাসর পর্ব ৫৯+৬০+৬১

দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৫৯
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

পাগলের মতো হন্য হয়ে বন্ধন রক্ত খুঁজছে,সরকারি,বেসরকারি হসপিটাল মোটামুটি সবজায়গাতেই ফোনের পর ফোন দিয়ে রেখেছে।
ওর সাংবাদিক এক বন্ধু আছে কাজল,তাকে জানালো,
টিভিপর্দায় জরুরী ভিত্তিতে ও নেগেটিভ রক্তের জন্যে বিজ্ঞপ্তি দিতে।
“হ্যালো দোস্ত।’
“হ্যা বন্ধু বলো,এতদিন পর?’ওপাশ থেকে কাজল বলে ওঠে।
“প্লিজ হেল্প।’
“কি হয়েছে বন্ধু হাঁপাচ্ছিস কেন?এনি প্রবেলেম।’
“নাউ আই এম ফেইসিং উইথ মাই ফরচুন,আমার সব শেষ দোস্ত।আই হেভ লষ্ট মাই বেবী,নাও গোয়িং টু লষ্ট হার।’
“কি বলছিস, কি হয়েছে ভাবীর?সেদিন না খুশীর নিউজটা দিলি?’
“সব বলবো,আগে আমার ও নেগেটিভ ব্লাড ডোনেটের ব্যবস্থা করে দে,প্লিজ,তোর চ্যানেলে নিউজটা সার্কুলার কর।’
“হ্যা শিউর বাট কিভাবে হলো,ভাবী কি এক্সিডেন্ট করেছে?’
“না বাট সামওয়ান এলস ট্রাই টু কিল হার,অলরেডী কিল মাই বেবী,নাউ কিলিং মাই লাইফ,এভরিথিং।’
“ওয়াট?হুজ দিস কার্লপিট?’
“পাঁপিয়া,,,বিচ!’
“ও নো,ও এখনো তোর পিছু ছাড়েনি?থানায় জিডি করেছিস? ‘
” নো,সুযোগ পাইনি।আমি নিজেই ওকে খুন করতাম বাট লাকিলি সে ছাড়া পেয়ে গেছে, তবে ওকে আমি ছাড়বো না,তোর ভাবীর কিছু হলে ওর মরন ডেফিনেটলি আমার হাতে।’
“দোস্ত মাথা ঠান্ডা কর,ব্লাড কি কিছুই যোগাড় হয়নি?
“না,ও নেগেটিভ ব্লাডগ্রূপ,খুবই রেয়ার রক্ত।আচ্ছা তোদের চ্যানেলে দিলে কতক্ষনে ব্লাড পাওয়া যেতে পারে?’
“রেয়ার ব্লাড তো খুব দ্রুত কিছু বলা যাচ্ছে না,তবে তুই চিন্তা করিস না,তুই তোর মতো খোঁজ, আর আমি যত দ্রুত বিজ্ঞপ্তি করে দিচ্ছি।’
“থ্যাংকস দোস্ত বাট জলদি কর ওকে?’
“ওকে নট টু ওরি,,,।’ফের বন্ধনকে বলে কাজল,
“আচ্ছা পাঁপিয়াতো মেম্বার অফ পার্লামেন্ট তুই চাইলে এখানে এসে ক্যামেরার সামনে সব খুলে বলতে পারিস,ওর এগেংস্টে আমাদের ইউনিট হসপিটালে সরাসরি গিয়ে নিউজটা দিয়ে দিলে পাঁপিয়া উইল বি ফিনিশড।’
“কাজল প্লিজ এখন এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না,তুই নোটিশটা দে এস সুন এস পসিবল।’
বন্ধন তার দুইটা ফোন নাম্বার,মুহিনের নাম্বারও দিয়ে দিল,মিতু কোন হসপিটালে কোথাশ,সব ডিটেইলস জানিয়ে দিল।
কাজলের সাথে যখন বন্ধন কথা বলছিল,তখন প্রায় দুইঘন্টার মতো হয়েছিল মিতুকে সি এম এইচে আনা হয়েছে।ওর শরীর বেয়ে প্রচুর রক্ত ঝরেছে,পাঁপিয়ার ধাক্কায় ওর কপাল ফেঁটেও ব্লেডিং হয়েছে প্রচুর।
তাছাড়া শরীর ভীষন রকম দূর্বল,ডকটর প্রথমে পালসই খুঁজে পাচ্ছিলো না মিতালীর।হসপিটালের বেডে নামানোর সাথে সাথে চোখমুখ বড় বড় করে তাকিয়ে, কয়েকবার বাবু বাবু বলে লাফিয়ে ওঠে, ফের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।চিকিৎসক রা এরপর তাকে আই সি ইউ তে নীবিড় পর্যবেক্ষণ এর জন্য রাখার নিদের্শ দেয়।
তার কিছু পরেই জানানো হয় প্রচুর ব্লাড লাগবে,বাচ্চার সাথে সাথে অনেক ব্লাড গেছে।
“সি ইজ নাউ ইন ক্রিটিক্যাল স্টেজ।’
সময়মতো ব্লাড দেয়া না হলে রোগীর অবস্থা আরো বিপদজনক হবে,তাছাড়া ভ্রুনটা বের হয়ে গেলেও ভিতরে এর কোন অংশ থাকলে সেটাও মারাত্মক ক্ষতি।
কাজেই সেগুলো ওয়াশ করতে হলে প্রচুর ব্লাড লাগবে।
এসব শুনে বন্ধন,মুহিন ভীষনভাবে স্নায়ুচাপে পড়ে যায়।
মিতুর এক্সিডেন্ট এর পর তাকে নিয়ে দৌড়াদুড়ি,মিতুর জন্যে রক্ত খোঁজা আবার এরই ভেতর বৈরী আবহাওয়ায় মুহিন,মিতুর আব্বু অর্থাৎ বন্ধনের শ্বশুরের দাফন সপন্ন করতে হয়।
হঠাৎ বন্ধনের মনে হচ্ছিল,সবকিছু সে ঝাপসা দেখছে,বাচ্চাটা নেই,মিতুর এই অবস্থা একই সাথে এসব ভেবে হাত পা, সব অবশ হয়ে আসছে,পড়ে যাচ্ছিল বন্ধন।পেছন থেকে দৌড়ে খোচাখোচা দাঁড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক ধরে ফেলে বন্ধনকে প্রায় সাথে সাথে।
ঠিকভাবে কথাও হয়নি তার সাথে,পড়ে মুহিনের কাছ থেকে জেনেছে ভদ্রলোক তাদের মামাতো ভাই।নাম হীমেল।বি সি এস ইঞ্জিনিয়ার,নামটা কেমন যেন পরিচিত লাগছে বন্ধনের কাছে।কিন্তু কোথায় শুনেছিল সে মুহুর্তে আর মনে নেই।
মিতুর বাবা ভোর রাতেই মারা যান।তারপর থেকে তুমুল বৃষ্টি।হাজতে বসে মুহিনের বুকটা একনাগাড়ে লাফিয়েছিল,একটা সেকেন্ডও থামেনি সে স্পন্দন।
একই অবস্থা বন্ধনেরও হয়েছিল।তবে বন্ধনের পদবীর গুনে,এবং পুলিশ প্রশাসনের বড় অফিসারদের সাথে বন্ধনের ভাল সম্পর্কের কারনে মুহিন ছাড়াতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
সেদিক দিয়ে ভাগ্যবান হলেও তারা তখনও জানতো না যে আর কি কি দূর্ভাগ্য তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
বন্ধন যদিও জেনেছিল তার শ্বশুর মারা গেছেন,কিন্তু মুহিনকে দেখামাত্রই তা জানায়নি।
মুহিন ও মিতু জানতো তাদের আব্বু নাজুক অবস্থায় আছে,আর সেতারাকে পারুল ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে জানিয়ে মৃত্য সংবাদ।
মুহিন ছাড়া পাবার পর বন্ধন মুহিনের ঘাড়ে আলতো হাত রেখে মন শক্ত হবার জন্য বলে।তাতেই মুহিন বুঝে ফেলে।আদাবরের বাসায় যাওয়ার পথে ফোঁটা বৃষ্টি।
ডিসেম্বর মাসে এই অসময়ে বৃষ্টি দেখে মিতুর কথা মনে পড়ে মুহিনের।
মুহিনের মামা, তারপর মেঝো ফুপু যখন মারা গিয়েছিল তখন মিতু বলতো,
“যখনই কেউ মারা যায় তখনই বৃষ্টি নামে।এক ফোঁটা হলেও নামে। মনে আছে মুহিন আম্মু যেদিন মারা গেলেন সেদিন কি ঝুম বৃষ্টি আর তুই কতো ছোট আমার কোলে তোর সে কি কান্না?’
মুহিন এসব ভেবে জাপটে, বন্ধনকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে,
“আব্বু চলে গেল,আপু কি জানে দুলাভাই?এমনই আপু নরম মনের। এই অবস্থায় কিভাবে জানাবেন?আমরা যে এতীম হয়ে গেলাম….! ‘
বন্ধনও কেঁদে ফেলে,মুহিন বুকে জড়িয়ে শান্ত করতে থাকে বন্ধন।
“আমিও এতীম মুহিন।আমি বুঝি রে,,, আর নিজেকে এতীম ভাববি না আমরা আছি না?’
মিতুকে ফোন করে জানাবে কিনা,সে সাহসে বন্ধন বা মুহিনের কারোরই কুলাচ্ছিল না।
অবশ্য একসাথে এমন ভাবে প্রলয় নেমে পড়েছিল কেউই সুযোগ পাচ্ছিলনা,বড় চাচা বল্লেন মিতুকে পরে জানাতে।চাচী অবশ্য বলেছিলেন,
“কি কও এগুলা? মিতুকে না জানায়া দাফন করে ফেলবা?বাপের মুখখান শেষবারের মতো দেখবো না?’
অবশ্য বন্ধন নিজে গিয়ে মিতুকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল,মুহিনকে ছাড়াতে গিয়েই ফেসে গেল।বাসায় নানুকে আগে ফোন করে যখন পেল না তখন ল্যান্ডফোনেফোন করে বুয়ার কাছ থেকে জানলো সারারাত নাকি মিতু ঘুমায় নি।একটু আগে নাকি ঘুমিয়েছে।
চাচা,বন্ধন,মুহিন মিতুর প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কেউই ওর বাবার লাশ দেখানো নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।বন্ধন সিদ্ধান্ত নিল,সেই মিতুকে বুঝিয়ে সাথে করে এখানে নিয়ে আসবে,আর কোন পথ নেই।
ঠিক তখনই নানুর ফোনটা এলো,পাঁপিয়া এসে বাসায় তান্ডব করছিল,সেটা ফোনেও কিছুটা টের পাচ্ছিল,পাঁপিয়ার কর্কশ আওয়াজে।
খুন চেপে গিয়েছিল বন্ধনের মাথায় ঠিক তক্ষুনী।মিতুকে যখন সে আনতে বের হয়েছে,নানুকে আবারও ফোন করে,রাস্তায় প্রচুর জ্যাম তার উপর বৃষ্টি থেমে থেমে নামছে।আর তখুনি জানলো,পাঁপিয়া হামলা করেছে মিতুকে,তাড়াতাড়ি তাকে আসার জন্যে তাগাদা দেয় নানু।
যে ভয়টা পাচ্ছিল বন্ধন হলোও তাই।দ্রুত আর্মি এম্বুলেন্স এর খবর দেয় বন্ধন।তার সৈনিক ড্রাইভারও খুব ভোরে জানালো তার মা অসুস্থ জরুরী ভিত্তিতে দেশে যেতে হবে।অনুমুতি না দিয়েও উপায় ছিল না বন্ধনের।মুহিন তার বন্ধু,কানন অন্যসব হসপিটালে,ব্লাডব্যাংক গুলোতেও ছুটছে রক্ত যোগাড়ের জন্যে।রানু এক ব্যাগ রক্ত দেয়ার পর,বন্ধন ও আর এক ব্যাগ রক্তের খোঁজ পায় তারপর দ্রুত সেটা সি এম এইচে পাঠায়।
রক্ত যতটুকু সরবারহ হয়েছে সেটা দেয়ার ব্যবস্থা চলতে থাকে।চাচী ও ভাবীকে হসপিটালে যেতে বলে বন্ধন। তার ভিতর মিতুর বাবাকেও দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে।অগত্যা সেটাও করে করে যত দ্রুত।
বন্ধনের ফোনটা ফের বেজে ওঠে।আননোন একটা নাম্বার।বন্ধনের মনে হলো,এই বুঝি কেউ ব্লাড ডোনেট করতে তাকে ফোন করেছে।
গাড়ী ড্রাইভিং অবস্থায় বন্ধন ফোন ধরে না,তবু ধরলো এই আশায়।
“হ্যালো?’
“হ্যালো আমি হীমেল বলছি।’
“হীমেল?কোন হীমেল?’
“জ্বী, আমি মুহিনের মামাতো ভাই,হীমেল।ঐ যে তখন আপনাকে ধরলাম।’
“ও আচ্ছা বলুন?’
“আপনি কি একা?মুহিন ওরা বল্ল আমাকে আপনার সাথে থাকতে।’
“ও শিউর?’
“কোথায় আছেন আপনি?’
“স্কয়ার হসপিটাল থেকে বের হলাম,পাহ্নপথে আছি এখন।’
“ওকে গ্রেইট।আমিও কাছাকাছি….।’
বসুন্ধরা সিটি সংলগ্ন গলির ভিতর থেকে তুলে নেয় হীমেলকে বন্ধন।
হীমেল খেয়াল করলো, বন্ধনের হাতগুলি কাঁপছে,তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে ড্রাইভ করতে গিয়ে।এর ভিতর আরও দু তিনটা কল আসে তার।
কক্সবাজার থেকে প্লেনে যোগে ক্যাপ্টেন জামান আসছে।বন্ধন তার আত্মীয় স্বজন তেমন নেই,ভাইয়েরাও একেকজন দেশের বাইরে।তারপরও ফোনে কাছে,দূরে আপন যাকে পেয়েছে,ফোন করে জানিয়েছে।এরপর জামানই তাকে ফোন করে।বন্ধনের কোন এক বন্ধু তার ফেইসবুকে পোষ্টে জরুরী ভিত্তিতে রক্ত লাগবে বলে বন্ধনের সাথে ট্যাগ করে।জামান এটা দেখা মাত্রই বন্ধনকে ফোন করে।জামানের ব্লাডগ্রুপ ও যে ও নেগেটিভ সেটা বন্ধন ভুলে গিয়েছিল।জামান পোষট পড়া মাত্র দেরী করেনি দ্রুত রক্ত দেবার জন্য ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নেয়।
তাছাড়া কাজল তার চ্যানেলে নিউজ করার পর আরও দুজন ফোন করে কোথায় ব্লাড দিতে হবে জানায়।মুহিনও তার বন্ধুরা দু ব্যাগ রক্ত যোগাড় করে হসপিটালে যাচ্ছে এখন।বাট বন্ধনের মাথাটা ফের চক্কর দিয়ে উঠছে।এতদূর জার্নী করে সকাল থেকে নানা ধকল সহ্য করে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটছে একনাগাড়ে।তবু নিজেকে নিজে সাহস দেয় সে,
“বি স্ট্রং বন্ধন,ইউ আর এ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি,ইউ হেভ টু ডেয়ার টু ফেইস দিস…..।’
বন্ধনের শরীর থেকে ঘাম বেরোচ্ছে,হীমেল এবার তাকে বল্ল,
“গাড়ীটা কিছু সময়ের জন্য সাইড করেন বন্ধন।’
“কেন আপনি নামবেন? ‘
“আমার জন্যে বলছি না,আপনার হাত কাঁপছে,বেশ উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।কিছু সময়ের জন্যে ব্রেক নিতে বলছি।’
“না না আমি ঠিক আছি,তাছাড়া হসপিটালে যেয়ে ওখানেই ব্রেক নিবো।’
কিন্তু আসলেই বন্ধনের চোখমুখ আবছা হতে থাকে,সত্যি এখন অন্ধকার লাগছে তার।
“দেখুন আমি জানি হসপিটালে যাওয়াটা জরুরী কিন্তু আপনি কিন্তু কাঁপছেন, তাছাড়া মুহিন এতক্ষনে পৌঁছে গেছে।আল্লাহর রহমতে আরও দু ব্যাগ রক্তও পাওয়া গেছে।রাস্তায় দেখেন কি অবস্থা এই অবস্থায় চাইলেও আপনি দ্রুত পৌঁছাতে পারবেন না।আপনি বড় জোর পাঁচ থেকে দশমিনিট গাড়ীটা সাইড করেন….।কোথাও একটু জিরিয়ে দেন ড্রাইভ করেন।এভাবে এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।না হলে আমাকে দিন আমি ড্রাইভ করছি।’
“আপনি জানেন ড্রাইভ করতে।’
“ওতো ভালো না তবে চলে।তবে আপনার একটু ব্রেক এর দরকার।’
“কিন্তু এখানে কোথায় ব্রেক করবো?’
অগত্যা হীমেলের কথা মতো পাহ্নপথের মোড়ে একটা ফুড কর্নারে গাড়ী সাইড করে বন্ধন।
হীমেল, মুহিনকে ফোন করে জানতে পারে মুহিন পৌঁছে গেছে দুব্যাগ রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।আরো একব্যাগও এসে গেছে।
বন্ধন গাড়ীটা কোনরকম সাইড করে।তার গায়ে একটা পোশাকই ছিল সেই তখন থেকে।গাড়ীর সিটে মাথা রেখে টাই এর নটের বাঁধনটা হালকা করে।
হীমেল দেখছে, বন্ধনেরও অবস্থা খারাপ।অনবরত ঘেমেই চলেছে সে,চোখমুখ উল্টাচ্ছে বন্ধন।
হীমেল ফের বন্ধনকে ধরে নামায়।
বন্ধন এবার একটু বাঁধা দেয়,
“থ্যাংকস আর লাগবে না আমি পারবো।’
“আর ইউ শিউর?’
“ইয়েস।’
ফুড কর্নারে এসি সংলগ্ন জায়গা দেখে হীমেল বন্ধনকে বসার জন্য ইশারা করে।
টাইটা খুলে গাড়ীতে রেখে আসে।শার্টের বুকের দুতিনটা সামনের বোতাম খুলে চেয়ারটায় বসে।
হীমেল ততক্ষণে দু কাপ কফির অর্ডার করে।
“আর কিছু খাবেন?হালকা স্নেকস?’
“নো প্লিজ।’
বন্ধন টেবিলের উপর হাতদুটো ভাজ করে মাথাটা ভর দেয় এবার।কিছুক্ষণ চোখদুটো বন্ধ করে শক্তি সঞ্চয় করতে চায়।
মাথা ওঠানোর পর হীমেল খেয়াল করে,বন্ধন ভালো সুদর্শন।
ফিগার,কপ্লেক্সন, চুল সবই দেখার মতো।দেখে বোঝার উপায় নেই,তার বয়স পঁয়তাল্লিশ।অথচ দেখে হীমেলের এইজ বা বড়জোর পঁয়ত্রিশ,আটত্রিশ মনে হয়।শার্ট এর ফাঁক দিয়ে বন্ধনের রোমশ বুক দেখে হীমেলের মনে পড়ল মিতুর একটা কথা।
“রোমশ বুক দেখে বিয়ে করা উচিত।যাদের বুকে লোম নাই তারা সিমার।’
“আমি সিমার?’
“আমি কি করে বলবো? আমি কি দেখেছি নাকি?’
“ঠিক আছে এখন দেখাই।’
“জ্বী না…..।’মিতালী তবে তার মনের মতো মানুষই পেয়েছে।

“আপনি খাবেন কিছু?’বন্ধন এবার জানতে চায় হীমেলের কাছ থেকে।
“জ্বী না।’
বন্ধন ও হীমেলের সৌজন্য আলাপ হয়।এবার বন্ধন বলে ওঠে,
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, কেন আই আসক ইউ সামথিং।’
“ইয়া শিউর?’
“আপনি কি সেই,যার সাথে মিতালী বাগদান হয়েছিল?তারপর ভেংগে যায়…..।’
এরকম একটা প্রশ্নের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে যায় হীমেল।
তাৎক্ষণিক কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না….(চলবে)নিয়মিত গল্প পড়তে ভিজিট করুন গল্পের ঠিকানা ওয়েবসাইট এবং গল্পের শহর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন যাতে করে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই নোটিফিকেশন পান দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৬০
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

বন্ধনের প্রশ্নবাণে কিছুটা শংকিত হীমেল।
কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।একেবারেই অপ্রস্তুত সে,যদিও হীমেল অনুমান করেছিল,বন্ধন এরকম কিছু জানতে চাইলেও চাইতে পারে।তবে সেটা নিয়েও এত মাথা ঘামায়নি হীমেল।
সামান্য কেশে গলাটা কিঞ্চিৎ পরিষ্কার করে হীমেল প্রতু্্যত্তর করে বন্ধনকে,
“জ্বী, আপনি ঠিকই শুনেছেন।আমিই সেই হতভাগা।’
“আপনি হতভাগা?’ফের বন্ধনের জিজ্ঞাসা।
“মিতালীর মতো মেয়ের সাথে বিয়ে ভেংগে যাওয়া মানে তো তাই…? ‘
বন্ধন চুপ করে থাকে। শোনে, কিছু বলে না।
কফি সামনে এসে গেছে।ফেনায় ছেয়ে যাওয়া কফির,গরম ধোয়া উড়ছে পেয়ালা থেকে।
চিনির কিউবগুলো দুজনের সামনে।
বন্ধন,হীমেল দুজনে পেয়ালায় নিয়ে চামিচ দিয়ে নাড়া দেয় তাতে।হীমেল একের অধিক সুগার কিউব নিলেও বন্ধন মাত্র একটি কিউবই নিয়েছে।
“যেমন সুপুরুষ, তেমনি স্বাস্থ্যসচেতন ভদ্রলোক।না হলে এই বয়সে এমন আকর্ষনীয় ফিগার ধরে রাখা,বয়সের চেয়ে অনন্ত দশ বছর কম দেখতে লাগা,এসব তো ব্যক্তিত্ববান পুরুষেরই বৈশিষ্ট্য।’
মনে মনে আওরায় হীমেল।
হীমেল যে সুদর্শন নয়,তাও নয়।একটা সময় ছিল তার গায়ের রং,উচ্চতা নিয়ে নিজের ভেতর অতি আত্মবিশ্বাসী মনোভাব গড়ে উঠেছিল।হীমেলের ক্ষেত্রেও বহু মেয়ের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়ার ইতিহাসও কম নয়।আর তাতে পোয়া বারো হয়ে গিয়েছিল তার, অধিক অহমিকায় মিতুকেও সে এসব নিয়ে গল্প শোনাতো।
আজ ঐ মেয়ে বিরক্ত করে,কাল ঐ মেয়ে,এসব শুনে শুনে মিতু অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল তবু মুখ ফুটে কোন জবাব সে দিত না।
সহজ সরল,অথচ প্রচণ্ড রকম মায়াবী মুখখানা যার সে, মিতালী শুধু ভালোই বেসেছিল নিঃস্বার্থভাবে।
রূপ আর গুনের অহমিকায় নিজেকে কখনো জাহির করার চেষ্টা করেনি।করতে পারতো কিন্তু করেনি।
কিন্তু ফল তো পেলই,হীমেলকে এখন আর হৃদয়কাড়া পুরুষ মনে হয় না,বরং বয়সের চাইতে ভারী মনে হয়।
গায়ের রং সে তো কবেই তাম্র বর্ন ধারণ করেছে?
শেষ যখন মিতু তাকে দেখেছে, মিতু তো চিনতেই পারেনি!

যে ফুড কর্নারে তারা কফি খাচ্ছিল সেখান থেকে হাবিব ওয়াহিদের কন্ঠে ভেসে আসে এমন একটা গান।যে গানে ডুবে যায় বন্ধন ও হীমেল দুজনে,,,,,পুরনো সেই স্মৃতিতে তাদের প্রেয়সীকে ঘিরে।
“ক্লান্ত আমি শুন্য হৃদয়
পারি না সইতে যে হায়,
এসো ফিরে, এসো গো তুমি
ভালোবাসার গভীরে
পারবো বা তোমায় ছাড়া বাঁচতে
তুমি আমার…
জীবনে কি খেলা খেলেছো যে হায়,
এর শেষ বলো কোথায়?
ঢেউ এ ভাঙ্গে দুকূল
ভাংগে স্বপ্ন হায়
আমি আঁধারে হারাই….!’
বন্ধনের ভীষনরকম খারাপ লাগতে থাকে।কি নিঃসীম শুন্যতা ওর বুকটার ভেতরে! বন্ধনের কাছে মনে হচ্ছিল,ওর বুকের পাঁজরটা যেন ভেংগে চুরমার হয়ে যাচ্ছে,সে খবর পৃথিবীর কেউ জানে না। হীমেলকে জানায় ও, ওয়াশরুম থেকে আসছে।
ফুড শপের ওয়াশরুমে যেয়ে,পিঠ লাগিয়ে বসে পড়ে বন্ধন।দুহাত মুখে চেপে শিশুর মতে ডুঁকরে ডুঁকরে কেঁদে ফেলে।
পকেটথেকে কিছু একটা বের করে। পাগলের মতো চুমু খায় ছবিটাতে।
“জান, আমাকে ছেড়ে যেও না জান,আমার সত্যি ভুল হয়ে গেছে,এত বড় শাস্তি আমায় দিও না,,,, আমাকে ছেড়ে তুমি চলে গেলে আমি যে বাঁচবো না?সত্যি এবার মরে যাবে তোমার বাবু!’
চোখে মুখে ফের কয়েকবার পানির ঝাপটা দিতে থাকে।জোরে বুক ভরে শ্বাস নেয়।
নিজেকে বোঝায়,
“মিতু এখন হসপিটালে আমাকে ভেঙ্গে পড়লে হবে না,বি এ স্ট্রোং ম্যান।’
ফ্রেশ হয়ে রুমাল বের করে মুখ মোছে বন্ধন।
সন্ধ্যা ছটার মতো বেজে গেছে।হীমেল মিতুর বাবার বাসা থেকেই কিছু খেয়ে এসেছিল।মিতুর চাচী,ভাবী তারা রান্না করে এনেছিল।কিন্তু বন্ধন সারাদিনে কিচ্ছু মুখে দেয়নি।তবে পানি খেয়েছে প্রচুর।খালিপেটে কফি খেয়েছে কোনক্রমে।
হীমেলের অনুরোধক্রমে একটা সেন্ডউইচের অর্ডার দেয়।
তার ভেতর মুহিন ফোন করে বন্ধনকে,
বন্ধন প্রায় সাথে সাথে জিজ্ঞেস করে,
“কি খবর মুহিন?মিতুর জ্ঞান ফিরেছে ?’
“না দুলাভাই, হসপিটালে আসার পর একবারই জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল,ঐসময় আপু বাবু বাবু বলে কয়েকবার চিৎকার করে ডেকে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।’
স্যান্ডউইচ এ এক কামড় দিয়ে বাকিটা আর খায় না বন্ধন।

বেশ তাড়াহুড়ো শুরু করে বন্ধন,ওয়ালেটটা বের করে খাবারের বিল দিতে উদ্যোত হয়।ওয়ালেট খোলার পর তার বুক পকেটে একটা ছবি দেখে হীমেল।
মিতালীর মৃদু হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গীমায় খুব সুন্দর একটা ছবি।
যে ছবিটি বিয়ের জন্যে বন্ধনকে দেখিয়েছিল নানু কত শখ করে….?
হীমেল যত বন্ধনকে দেখছে ততো বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে।
যে গানটা শুনে থমকে গিয়েছিল হীমেল ও বন্ধন,তাদের সে প্রেয়সী আর কেউ নয়।সে হচ্ছে মিতালী।তবে হীমেল এবার পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করে,মিতু শুধু বন্ধনের প্রেয়সী তার নয়।তাকে হীমেল তো হারিয়ে ফেলেছে তার ভুলের কারনে,তার দেয়া ধোঁকার কারনে।
“কিন্তু বন্ধন তো মিতুকে ধোঁকা দেয়নি?তবে বন্ধন কেন শাস্তি পাচ্ছে?আর বেচারি মিতু,কত ভালো না বাসলে জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে বাবু নামটা ডেকেছে কতখানি অসীম ভরসায়, হে প্রভু মিতুর সোহাগের উপর প্রসন্ন হও,বন্ধনের মিতুকে বন্ধনের কাছে ফিরিয়ে দাও।’
হীমেলও প্রার্থনা করে এবার মনে মনে।

মিতুকে পর্যায়ক্রমে রক্ত দেয়া হচ্ছে।বেলা বারোটা সময় তাকে গুরুতর রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা সি এম এইচে ভর্তি করানো হয়েছে।রাত বারোটার মতো বেজে গেছে,এ পর্যন্ত প্রায় চার ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে।
আরও কিছু রক্ত যোগাড় হয়েছে যা হসপিটালের রক্ত সরবরাহ নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয়েছে।
ক্যাপ্টেন জামান দুপুর তিনটা নাগাদ হসপিটালে এসে রক্ত দিয়েছে মিতালীকে।পারুল খেয়াল করে বেশ অবাক হয়,
“মিতু আপুর দেবর তো বেশ ভালো লোক,আপুকে রক্ত দিতে কক্সবাজার থেকে ছুটে এসেছে?বন্ধন দুলাভাই এর আবার কেমন ভাই কে জানে?আগে তো কখনও দেখিনি….? ‘
মিতুকে ভর্তি করানোর পরপর মিতুর পালস বারবার ফল করছিল,পালস ঠিকমতো পাওয়াই যাচ্ছিল না।ভ্রুনের বয়স তিন মাসের অধিক।কাজেই তার শরীর থেকে যত দ্রুত ভ্রুনের অবশিষ্টাংশ বের করে ফেলতে হবে, এমনি ও নেগেটিভ রেয়ার ব্লাড তার উপর এ অবস্থা।কাজেই ওয়াশ করার পরও ব্লাড সরবরাহে থাকা জরুরী।
মিতুকে সি এম এইচের ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে নীবিড় পর্যবেক্ষনে রাখা হয়েছে।
মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।তার বেডের পাশে হৃদযন্ত্র এর অবস্থা জানার জন্য হৃদস্পন্দন পরিমাপের মেশিন কার্যকর করা হয়েছে। আধুনিক হৃদযন্ত্র কার্যক্রম জানার জন্য একে বলা হয় ই সি জি ব্যবস্থা।
টেলিভিশনের মতো মনিটরে রক্তের অবস্থা,হালচাল,রক্তে অক্সিজেন এর মাত্রা, নাড়ির গতি ইত্যাদি রিডিং হতে থাকে যা দেখে রোগীর অবস্থা বোঝেন বা মনিটরিং করে চিকিৎসক ও সেবিকারা।
হৃদযন্ত্রের প্রত্যেক মুহুর্ত তাৎক্ষণিক রূপে বোঝার জন্যে একে Ociloscopic Electrocardiographic ম্যাশিনও বলা হয় যা Closed Circuit Television এর মাধ্যমে পর্দায় ভেসে ওঠে।
হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে গেলে বা থেমে গেলে কার্ডিয়াক এরেস্ট এর মাধ্যমে এর্লাম দিয়ে সতর্কীকরণ করা হয়।
আই সি ইউ এর ভেতর যাওয়ার অনুমতি চিকিৎসকরা দেন না,তবে মিতুর চিকিৎসক বড় চাচা,মুহিন ও পারুল সে সুযোগ পায়,তবে খুব কম সময়ের জন্যে।এরা সবাই যন্ত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করে মিতুর অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে।তবে বড় চাচা ছাড়া কেউ সেভাবে বুঝতে পারেনা।
এরপর বন্ধন মিতুর বেডের পাশে মাথাটা নুইয়ে বসে মিতুর একপাশে।ওর হাতগুলো ধরে বেশ অনেকক্ষন বসে থাক।অসহায় দৃষ্টিতে মিতুর জ্ঞান ফিরে আসার অপেক্ষায় চেয়ে রয় ওর মুখপানে।
মনিটরে ওঠা মিতুর হৃদযন্ত্রের প্রতিটি স্পন্দন বোঝার অপরিমেয় চেষ্টা করে সে।
ডকটর এসে বেশীক্ষন থাকা যাবে না বলে নির্দেশ দেয়।
অনিচ্ছা সহ বাইরে আসে বন্ধন।সকাল থেকে বিরামহীন অমানুষিক ধকল যাচ্ছে মুহিন ও বন্ধনের।
পারুল,বড় চাচী,জামান সবাই ওদের খাবারের জন্যে ও কিছুক্ষন বিশ্রামের জন্যে বলে।এর ভেতর বহুবার ফোন করতে থাকে সেতারা।এই দূর্যোগে সে বাংলাদেশে নেই।তাদের বাবাকে দাফন করার মুহুর্তে শেষ দেখাও হলো না মিতু ও সেতারা হতভাগী দুবোনের।
মুহিন হসপিটালের কেবিনে কান্নায় ভেংগে পড়ে,মিতুকে নিয়ে এখন তার টেনশনের শেষ নেই।এভাবে ভাগ্নে বা ভাগ্নি হারালো,ছিনতাই ঘটনায় গত দিনে ফেঁসে গেল,আর তাদের বাবার অকস্মাত মৃত্যু এগুলো কোনটা যে একসাথে ঘটে যাবে কল্পনাই করেনি কোনদিন।
আঁখি অনেকক্ষন ধরে মুহিনের সাথে ছিল। বিপদে পরম বন্ধুর মতো ছায়া দেয় সে।পারুল তাকে বলে চলে যেতে ধন্যবাদ জানায় তাকে।
বন্ধনকে সবাই খাবারের জন্যে বলে,বন্ধন শুধু বলে “পরে,যখন সময় হবে তখন।’
যা সে হারিয়েছে আর হারাতে পারে এমন গুরুগম্ভীর ভাবনায় বাকরূদ্ধ সে।
মাথাটা অবিরামভাবে ঘুরছে সত্যি এবার।শরীর ও মন প্রচণ্ড রকম অবসন্ন।হসপিটালের এমন একটা ওয়াশরুমে ঢুকেছে যে কারো অনুমান হবার উপায় নেই, কোথায় বন্ধন।অথচ প্রায় আধঘন্টার উপরে তাকে কেউ দেখছে না।
শরীর ফ্লাকচুয়েড হয়েছে বন্ধনের। মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে ওয়াশরুমের ফ্লোরে।

প্রায় বারো ঘন্টা পর মিতালীর জ্ঞান ফিরে।চোখটা খুলতেই অস্ফুট আওয়াজে বাবু বলে ডাকতে চায়।
কিন্তু কি যেনো হয় ওর।কি ভেবে মিতু,বাবু শব্দটা যেন উচ্চারন করে না আর…..।(চলবে)নিয়মিত গল্প পড়তে ভিজিট করুন গল্পের ঠিকানা ওয়েবসাইট এবং গল্পের শহর চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন যাতে করে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই নোটিফিকেশন পান দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৬১
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

“বন্ধন স্যার,,, স্যার চোখ খোলেন।’
বন্ধনকে সেন্সলেস অবস্থায় পাওয়া যায়, হসপিটালের ওয়াশরুমে।
অনেকক্ষন ধরে বন্ধনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
বড় চাচা,মুহিন,কানন ভাইও দেখেনি বন্ধনকে।মিতুর জ্ঞান ফেরে রাত বারোটার কিছু পড়ে।ডকটর জানানোর পর চাচী ও পারুল বন্ধনকে জানানোর জন্য বলে।
মুহিন শোনা মাত্রই ফোন দেয়া হয় তাকে,
যখন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না,জামানের সন্দেহ হয়।
যেখান দিয়ে বন্ধন ওয়াশরুমে যায়, জামান সেটা দেখেছিল।
ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।জামান ফোন করে বন্ধনকে।ভেতর থেকে ফোন বাজার পর,আর বুঝতে বাকি রইল না জামানের, একটা কিছু হয়েছে।
কারন ফোন তো সে ধরছিল না,আর দেরী না করে পেশীশক্তি দিয়ে দরজায় সজোরে আঘাত করে জামান।
সৈনিকও এগিয়ে আসে।
ধরজা খোলার পর বেহুশ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সে।
মাথাটা কোলের কাছে নিয়ে,বন্ধনের মুখের দুপাশে হাত দিয়ে দেখে।নাকের কাছে হাত দিয়ে বন্ধনের নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করে।পালস চেক করে তার।
সৈনিককে বলে পানি আনতে।
পানির ঝাপটা দিতে থাকে জামান,বন্ধনের মুখে।

চোখ খোলে বন্ধন।তবু তার কাছে,অস্পষ্ট আর ঝাপসা
মনে হতে থাকে।
“স্যার ঠিক আছেন তো?কিভাবে পড়লেন?কোথাও লেগেছে?’
বন্ধন উঠে বসে,
হাত দিয়ে বাধা দেয় জামানকে,
“আস্তে জামান আমি ঠিক আছি।’
কিন্তু বন্ধনের ক্লান্তিকর চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল,কতটা অপ্রকৃতস্থ ও দুর্দশা অবস্থায় আছে সে।
জামানের ভীষন খারাপ লাগে বন্ধনের এই অবস্থা দেখে।
বন্ধনকে তুলে ওঠার জন্যে এগিয়ে আসলে,ফের বারন করে বন্ধন।
নিজেই উঠে দাঁড়ায়।
“মিতুর কি অবস্থা জামান?’
“স্যার ভাবীর জ্ঞান ফিরেছে,,সে খবরটা দিতেই এসেছি। আপনাকে সবাই খুঁজছে স্যার।’
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। ‘
বেসিনের কল ছেড়ে এবার ভালো করে মুখটা ধোয়,গোসল করাটা খুব দরকার ভাবে বন্ধন।
“স্যার আপনাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে কিছু খাবেন চলুন।’
বন্ধন এবার খানিকটা বিরক্ত হয়,
“আহ্ জামান, কি খালি তখন থেকে আমাকে খেতে বলছো তোমরা,,,আমি খাবো,,যখন ইচ্ছে করবে তখন,প্লিজ এখন খাবার দাবারের কথা বলো না।’
“স্যার, না খেলে আপনার শরীর তো এভাবে ভেঙে পড়বে।’
জামানের কথা শেষ না হতেই ফের মাথাটা চক্কর দেয় বন্ধনের।পড়ার মতো অবস্থা হলে, প্রায় সাথে সাথে জামান ধরে ফেলে।
“স্যার এ জন্যেই বারবার আপনাকে খেতে বলা হচ্ছে স্যার। ‘
“ঠিক আছে,মিতুর কাছে চলো আগে।’

বাবাই,রানু,মৌভাবী চলে যায়।নানু একবার এসেছিল হসপিটালে,তার শরীরটাও খারাপ লাগে এসব দেখে।
বন্ধন তাকে চলে যেতে বলে বাসায় আর নামাজ পড়ে দোয়া করতে বলে।
হীমেলও রয়ে যায় হসপিটালে,মিতু,বন্ধনের এত বিপদ দেখে বাসায় আর ফিরে যায় না।মিতু, মুহিনের মামী অর্থাৎ হীমেলের মা মিতালীর বাসায় এসেছিল, যখন তাদের বাবা মারা যায়।
জুঁই ও এসেছিল।মিতালীর মামাতো বোন।পালিয়ে গিয়েছিল তার ভাবীর কাজিনের হাত ধরে।এখন ফিরে এসেছে।
মিতুর মামী বারবার ফোন করে তার ছেলেকে,
হীমেল জানায়,
“আম্মা ঘুমিয়ে পড়ো,মুহিন এখানে একা,মিতুটারও জ্ঞান ফেরেনি।আমি সময়মতো চলে আসবো…..।’
“তোর শরীর খারাপ করবে তো বাবা,খেয়েছিস তুই?আর মিতুর স্বামী আছে,আরও আত্মীয়স্বজন আছে ওরা দেখবে,তুই বাবা এদের মাঝে থেকে কি করবি?তোকে তো সবাই ভুল বুঝে আছে….?’হীমেলের মায়ের উৎকন্ঠা।
“আম্মা তুমি যে কি বলো না,ওদের বিপদে ফেলে আমি চলে আসবো? সেতারা আপু নেই,ফুপা মারা গেছেন,তাছাড়া কে আমাকে ভুল বুঝলো না বুঝলো এসব এখন ভাবার বিষয় না।তুমি প্লিজ এভাবে চিন্তা করো না,আর বেশী বেশী দোয়া করো মিতুর জন্য।’
“মিতুর জন্যে তোর এত চিন্তা?বউমা জানলে কষ্ট পাবে বাবা?’
“এখানে বউমা কোথায় পেলে তুমি আবার?কষ্ট পেলে পাবে,,,আচ্ছা ছাড়ছি পরে কথা হবে, আর আম্মা শোন এসব ছাইপাশ চিন্তাভাবনা করো না তো এখন?ভুলে যেও না আমি মুহিনেরও ভাই।আমার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের পাশে থাকা,সেটা মিতালীর স্বামী থাকলেও।’
হীমেলের ফোনালাপটা কিছু বন্ধনের কানে যায়।ঐসময় বন্ধনও সেখানে উপস্থিত হয়। বন্ধন হীমেলকে এখনও হসপিটালে দেখে খানিকটা চমকে যায়।
চমকে যায় হীমেলও বন্ধনের এ অবস্থা দেখে।জামান ধরে ধরে বন্ধনকে আনতে দেখে হীমেল ফোনটা রেখে জিজ্ঞেস করে,
“একি আপনার এই অবস্থা কেন?কি হয়েছে আপনার?’
“তেমন কিছুনা এই একটু মাথা ঘুরে গিয়েছিল।’
“কি বলছেন আবার?ডকটরকে দেখিয়েছেন?আর আপনি তো বোধহয় সারাদিনে কিছু খাননি?’
“স্যারকে আমিও বলেছি সেকথা,না খেলে শরীর আরও ফ্লাকচুয়েড হয়ে পড়বে,বাট স্যার শুনছেন না।’জামানও বলে ওঠে।
“এভাবে সবার কথা না শুনলে হবে বলুন?’
“শুনবো,কিন্তু আপনি এখনও জাননি?’
“যাবো,মিতুর জ্ঞান ফিরুক।’
“সেকি আমি তো শুনলাম জ্ঞান ফিরেছে?’ফের উৎকন্ঠা বন্ধনের।
“স্যার আপনি ঠিকই শুনেছেন।’আশ্বস্ত করে জামান।
“ও আচ্ছা আমি আবার একটু বাইরে ছিলাম,যাক এইবার তো আপনি নিশ্চিন্ত বন্ধন সাহেব? ‘বন্ধনের কাঁধের পাশে উপরের দিকের হাতটাতে হীমেলের হাতটা বাড়িয়ে সান্তনা জানায় তাকে।
“এত সহজে নিশ্চিন্ত হই কি করে?আগে ওকে দেখে আসি তারপর বুঝবো,,,,। ‘

জ্ঞান ফেরার পরও মিতু সেভাবে সজাগ হতে পারেনি।এর মাঝে বন্ধন দেখে আসে তাকে,কিন্তু মিতুকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে কেবিনে ফিরে আসতে হয়।
শরীরের উপর ধকল যাচ্ছে তার, নার্স এসে লিকুইড খাবার দেয় তাকে।সবধরনের খাবার এখনই দেয়া যাচ্ছে না।বেবীটাকে পুরো ওয়াশ করানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।বন্ধনের কাছ থেকে পারমিশন নেয়া হয়।
বন্ধন শেষবারের মতো আবারও জানতে চায় ডকটরের কাছ থেকে,
“বাচ্চাটাকে কি বাঁচানো গেলো না?’
” সরি বন্ধন,বেবী অলরেডী নো মোর,,,নাউ ইটস টাইম টু ওয়াশ এস সুন এস পসিবল,আদারওয়াইজ,ইট ক্রিয়েট কমপ্লিকেশন ফর মাদার, প্লিজ কয়াপারেটিভ আস। ‘
পারমিশন পেপারটায় সাইন করতে গিয়ে বন্ধনের বুকটা শুন্য হয়ে যেতে থাকে।
মিতু ব্যাপারটা জানে কিনা,আর ওয়াশ করানোর সময় ব্যাথা পাবে কিনা এসব নিয়ে ফের ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে বন্ধন।
কাগজটায় সাইন করে এবার,চোখের কোণাটায় লেগে থাকা বিন্দু ফোঁটা পড়ে কাগজটায়।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here