#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
‘আফজাল কুটুরি’এর বসার ঘর জুড়ে এই মুহূর্তে পিনপতন নীরবতা। মাটিতে একটা সুঁচ পড়লে, তারও আওয়াজ কানে বেজে উঠবে, ততটাই নীরব ঘরটা। সোফায় বৃত্তের বাবা, আফজাল হোসেন থমথমে মুখে বসে আছেন। উনার পাশে বৃত্তের মা। বড় সোফায় বসে আছেন, মেঘার বাবা-মা। মেঘার বাবার মুখ থেকে যেনো লাভা বের হচ্ছে। রাগে রীতিমত ফুস-ফুস করছেন তিনি। একবার রাগ নিয়ে মেঘার দিকে তাকাচ্ছেন তো আরেকবার বৃত্তের দিকে। মেঘা বাবার এমন রাগ দেখে ভয়ে একদম সিঁটিয়ে যাচ্ছে। কাঁচুমাঁচু মুখে ও বৃত্তের পিছনে লুকালো। বৃত্ত নিজেও মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। বৃত্তের মুখে তাদের বিয়ের কথা শুনে সবার রক্ত রীতিমত ছলকে উঠছে। নীরবতা ভাঙলেন বৃত্তের বাবা। বলে উঠলেন,
— কেনো করলে এমন?
বৃত্ত চুপ। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে প্রচণ্ড রকম ভয় পায় বৃত্ত। এমন না যে, আফজাল হোসেন ছেলের প্রতি কড়া।তবে, সন্তানদের সামনে নিজেকে সর্বদা এক শক্ত খোলসের মধ্যে আবৃত করে রাখতেই তিনি ভালোবাসেন। তাই জন্যেই, বৃত্তের এত ভয়!
— বৃত্ত? আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর দাও!
বৃত্তের বাবা এবার গর্জন করে উঠলেন। ধমক শুনে, বৃত্তসহ মেঘা নিজেও কেঁপে উঠলো। মেঘা তুমুল ভয়ে পিছন থেকে বৃত্তের কোমরের শার্ট মুচড়ে ধরলো। বৃত্ত আমতা আমতা করে বলল,
— আমি মেঘাকে ভালোবাসি। তাই বিয়ে করেছি।
— তা, এই কথা আমাকে বলা যেত না? আমাকে না বলতে পারলেও তোমার মাকে বলতে। সেটাও তো তুমি করো নি। নিজে নিজেই পণ্ডিত হয়ে গেছিলে? ”
বৃত্ত ত্যাড়াচোখে মায়ের দিকে তাকালো। বৃত্তের মায়ের মুখখানা পাংশুটে আকার ধারণ করেছে। বৃত্ত পুনরায় মাথা নত করে উত্তর করলো,
— মাকে বলেছিলাম।
বৃত্তের বাবা এবার নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বৃত্তের মা চোখের ইশারায় সম্মতি দিলেন। বৃত্তের বাবা এবার খানিক দমলেন। সবার সামনে স্ত্রীকে ধমক দিবেন, এটা তার বংশ শিক্ষা দেয়নি। তাই, তিনি নিচু গলায় স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— তুমি জানতে এসব?
বৃত্তের মা আস্তে করে বললেন,
— হুম।
— তাহলে, আমাকে বলো নি কেনো এসব?
— আসলে, আমি..
— থামো। আর বলা লাগবে না। যা বুঝার আমি বুঝে গেছি।
বৃত্তের মা চুপ করে গেলেন। খুব হঠাৎ করেই বৃত্তের বাবা উপলব্ধি করলেন, ‘এক ছাদের নিচে থাকা সত্বেও নিজ স্ত্রী ও ছেলের কাছে কতটা দূরে তিনি। শরীরের দিক থেকে এত কাছাকাছি থাকা সত্বেও, মনের দিক থেকে মাইল-মাইলের দূরত্ব তাদের মধ্যে। এর কারণ কি? এটা নিছকই তার প্রতি সবার ভয়? নাকি, অন্য?’
বৃত্তের বাবা এবার মেঘার বাবা-মায়ের দিকে তাকালেন। মেঘার বাবা মাথা নত করে বসে আছেন। মুখে ‘রা’ নেই। চোখে-মুখে ভয়ংকর রকম কাঠিন্য! বৃত্তের বাবা এবার গলা খাঁকারি দিলেন। মেঘার বাবার ধ্যান ভাঙলো। বৃত্তের বাবার দিকে তিনি শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বৃত্তের বাবা সুধালেন,
— বিয়েটা যখন হয়েই গেছে। তখন আমাদের এই বিয়ে মেনে নেওয়া উচিৎ। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এসবের উপর তো আমাদের হাত নেই। সবই উপরওয়ালার খেল। আমরা তো ওসিলা মাত্র। আর আমার মতে, আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা উচিত। কি বলেন?
মেঘার বাবা এক সেকেন্ড ‘থ’ হয়ে বসে রইলেন। পুরো ব্যাপারটা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। আসলে, নিজ মেয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তাকে বিশ্বাস করতে বাঁধা দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, ‘এটা নিছকই একটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু, তিনি এই দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছেন। বুক চিঁড়ে কান্নারা দলা পেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তিনি জাগতে চান। এই ভয়ঙ্কর দিবা স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে চান। খুব করে চান!’
— জুয়েল ভাই?
বৃত্তের বাবার ডাক শুনে মেঘার বাবা বাস্তবে ফিরলেন। মনে পড়ে গেলো, এটা কোনো দিবা স্বপ্ন না। বরং, এক জঘন্য বাস্তব। মেঘার বাবা ছোট্ট করে বললেন,
— বলুন!
বৃত্তের বাবা বললেন,
— আপনি জানতে চাইছি, এই বিয়ে নিয়ে আপনার কোনো অমত আছে কিনা? আপনার অমত থাকলে আমরা বিকল্প সিদ্ধান্ত নেবো।
‘বিকল্প সিদ্ধান্ত’ কথাটা শুনে মেঘা, বৃত্ত দুজনেরই গলা শুকিয়ে গেলো। বাবা কি বিকল্প সিদ্ধান্ত নিবেন? এই বিয়ে কি তবে নিরর্থক? বৃত্ত মেঘার দিকে তাকালো। মেঘাও অবাক চোখে বৃত্তের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃত্ত চোখের ইশারায় মেঘাকে আশ্বাস দিলো। তবে, সেই আশ্বাসটা মেঘাকে খুব একটা আশ্বস্থ করতে পারলো না। মেঘার চোখে এখনো ভয়েরা খেলা করছে, নৃত্য করছে। কি বিশ্রী সেই নৃত্য!
মেঘার বাবা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে, সেখানে আমার আর কি বলার? তবে, এখন আমি মেয়ে উঠিয়ে দিতে চাইছি না। বৃত্ত ভার্সিটি শেষ করুক। একটা চাকরী পাক। তখনই নাহয় মেয়ে তুলে দিবো। ততদিন আমি চাইব, মেঘা আর বৃত্ত যেনো পরস্পরের সাথে যোগাযোগ না রাখে। শুধু এটাই আমার বলার ছিল।
এই কথাটা মেঘা আর বৃত্ত দুজনকেই কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। একসাথে না থাকলে বাচ্চার ব্যাপারটা কি করে সামনে আনবে? একটা অজুহাত তো থাকতে হবে? মেঘা চোখ বড়বড় করে বৃত্তের দিকে তাকালো। বৃত্ত নিজেও হতভম্ভ। হুট করে মেঘার বাবা এমন প্রস্তাব তুলে বসবেন, সেটা বৃত্ত ঘুর্নাক্ষরেও টের পায়নি। বৃত্তের বাবা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
— ঠিক আছে। আপনি যেটা ভালো মনে করেন, সেটাই হবে। আমার এতে কোনো আপত্তি নেই।
বৃত্ত এবার কি করবে ভেবে পেল না। অন্তত এক রাত একসাথে থাকলেই বাচ্চার কথাটা বলা যাবে। কিন্তু, কথাটা বলবে কি করে? সেটাই ভেবে পাচ্ছে না বৃত্ত।
বৃত্তের মাথায় হঠাৎ করেই এক চিন্তা এলো। সবাই যখন সোফা ছেড়ে উঠে পড়ছিলেন তখনই বৃত্ত বলে উঠলো,
— আঙ্কেল, রাতের খাবারটা নাহয় আমাদের এখানেই করে নিন। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন বাসায় গিয়ে খাবার গরম করাও আরেক ঝামেলা। তার চেয়ে আমাদের এখানেই নাহয় খাওয়া সেরে নিন। কি বলেন, বাবা?
বৃত্তের বাবা খাওয়ার কথা শুনে ভারী লজ্জায় পড়ে গেলেন। শত হোক, মেঘার বাবা-মা এখন তাদের আত্মীয়। এই কথাটা তো তার বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু, এত এত মানুষিক চাপের মধ্যে বেমালুম ভুলে গিয়েছেন তিনি। বৃত্তের বাবা তাড়াহুড়ো করে বললেন,
— হ্যাঁ, হ্যাঁ। বসুন, জুয়েল ভাই। রাতের খাবারটা অন্তত খেয়ে যান। এত রাত করে আমাদের বাড়ি থেকে না খেয়ে ফিরবেন। বিষয়টা খারাপ দেখায়।
অতঃপর, মেঘার বাবা-মা শত অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। রাতের খাবার খাওয়ার জন্যে রয়ে গেলেন। এদিকে, সবার অগোচরে মেঘা আর বৃত্ত ফুড়ুৎ হয়ে গেল। একসাথে থাকার ব্যাপারটা এখন প্ল্যান করা উচিৎ। আপাতত মেঘা আর বৃত্তের মূল উদ্দেশ্য এটাই।
#চলবে