#চন্দ্রপুকুর
||৩৬তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
বেগম লুৎফুন্নেসা কঠোর মুখশ্রী নিয়ে বসে আছেন তাঁর আসনে বসে চা পান করছেন। প্রায় মিনিট দশেক ধরে মেহমাদ শাহ তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। সে বোধগম্য করতে পারছে না দাদীজানের হুটহাট এমন ক্রোধের কারণ।
“দাদীজান, আপনি কি আমাকে ডাকিয়েছিলেন?”
“এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন মেহমাদ? একটু অপেক্ষা করো। না কি এতোটাই মতিভ্রষ্ট হয়েছে দাদীজানের সম্মান করাও ভুলে বসেছো।”
“দুঃখিত দাদীজানক, আমার তেমন কোনো উদ্দেশ্য বা নিয়ত ছিল না।”
“হু” বোধক ধ্বনি উচ্চারিত হয় বেগম লুৎফুন্নেসার মুখ হতে। শূন্য চায়ের পানপাত্র খানা হাত হতে রেখে দিয়ে পৌত্রের দিকে দৃষ্টি স্থির করে।
“এখন আমাকে জানাও, সন্তান নিচ্ছো না ক্যানো এখনও? আর কবে নিবে?”
“এটা কী ধরনের প্রশ্ন দাদীজান? যখন আল্লাহ এই রহমত দান করবেন এবং আমাদের মনে হবে আমরা পিতা-মাতা হতে প্রস্তুত তখনই…”
“বাচ্চা বা কিশোর নয় তোমরা মেহমাদ। ত্রিশের কোঠা পেড়িয়েছো তুমি বহু পূর্বেই, চন্দ্রমল্লিকাও এখন পূর্ণাঙ্গ যুবতী। এসব মিথ্যে বাহানা না দিয়ে সত্য প্রকাশ করো।”
ভ্রু কুঞ্চিত হয় যুবকের।
“কীসের বাহানা, দাদীজান? আমি তো সত্যই ব্যক্ত করছি। চন্দ্রমল্লিকার বয়স আর কতোই বা, তবুও কন্যাটি এতো দ্রুতো সকল যোগ্যতা অর্জন করে সামলে নিয়েছে। এখন আবার সন্তান নিলে আরেকটা দায় কাঁধে চাপবে…”
হাতের ইশারায় থামিয়ে দেন বৃদ্ধা প্রিয় পৌত্রকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করেন,
“তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছো না চন্দ্রমল্লিকা তোমাকে, আমি জানি না। তবে এখানে যে কোনো গড়মিল আছে তা খুব ভালো ভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছি আমি।
তোমার স্ত্রী সন্তান গর্ভে ধারণ করতে ইচ্ছুক নয় তা আমি মানলাম। তবে প্রতিনিয়ত সে বৈদ্য কাছে কেন যাচ্ছে নিজের শারীরিক অনস্থা পরীক্ষা করে দেখতে ও দ্রুতো গর্ভধারণের ঔষধ নিতে? আবার কোনো ঔষধিও নিচ্ছে না গর্ভধারণ রোধে”
যুবক শাহ নিজেই এবার বিড়ম্বনায় পড়ে। যামিনীর এমন করার কারণ সে ভেবে পাচ্ছে না। আবার দাদীজান ঠিকভাবে না জেনে দোষারোপও যে করবে না তা সম্পর্কেও সে জ্ঞাত।
তার হৃদয়ে প্রশ্ন উদয় হয়। ভাবে,
– তবে কি সত্যিই যামিনী মিথ্যে কথায় ভুলাচ্ছে তাকে?
মেহমাদ শাহকে নিঃশ্চুপ থাকতে দেখে গলা খাঁকারি দেন বেগম লুৎফুন্নেসা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন করেন,
“চন্দ্রমল্লিকাকে বিবাহ করার পর আমাকে কী ওয়াদা করেছিলে মনে আছে?”
“হ্যাঁ, দাদীজান। তবে চন্দ্রমল্লিকা তো সকল ক্ষেত্রই নিজ যোগ্যতায় জয় করে নিয়েছে। একজন আদর্শ জমিদারনি সে এখন।”
“শোনো আমার সিংহ, জমিদারিতে জমিদারের উত্তরাধিকার হলো মূল। আর বেগমের সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতাই হলো উত্তরাধিকারকে গর্ভে ধারণ করা।
যদি তা-ই না হয় তবে সকল যোগ্যতাই আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। যদি তোমার বর্তমান স্ত্রী গর্ভধারণ না করতে পারে, তবে তার বেগমের পদ হতে বহিষ্কার হওয়ার অনিবার্য।”
“তবে দাদীজান ত্রুটি আমার মাঝেও তো থাকতে পারে।”
“জিভে লাগাম লাগাও মেহমাদ। তোমাকে শাহাজাদা হিসেবে লোকচক্ষুর সম্মুখে আনার পূর্বেই তোমার সকল ধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে তোমাকে সব ভাবে সক্ষম হিসেবে জানা হয়েছিল। মনে রাখবে আমি তোমার দাদীজান। তুমি আমার রক্ত।
তবে আমার নিকট সবকিছুর পূর্বে এই জমিদারি, তোমার নিকটও তাই হওয়া উচিত। ভুলে যেয়ো জমিদারি পাওয়ার সময় তোমার দাদাজান ও আব্বা হুজুরের সম্মুখে আল্লাহর শপথ নিয়ে কী ওয়াদা করেছিলে।
তোমাকে তা-ই মাথায় রাখতে হবে। প্রথমে জমিদারি, তারপর অন্যকিছু, তা ভালোবাসাই হোক না ক্যানো। অন্যথায় আমার সিংহ আমি নির্দয় হতে বাধ্য হব। খুব বাজে ভাবে ভাঙবে হৃদয়।”
যুবক আলতো হাসে। দাদীজানের চোখে চোখ রাখে।
“যতোটা নির্দয় হয়েছিলেন নিজের পুত্রের মৃত্যুতে ততোটা? জমিদারি বাঁচাতে আপনার পশুত্বের নিদর্শন তো আমি দেখেছিই। তাই তো সন্তানের মৃত্যুতেও মুখে কুলূপ এঁটে ছিলেন।”
“তা আমার প্রয়োজন ছিল যুবক। তুমি বুঝবে না। আমি চারজন সন্তানের মাতা, এক সন্তানের জীবন রক্ষার্থে বাকি তিন সন্তানকে বিপদে ফেলতে পারতাম না।
যদিও রক্ষাও করতে পারিনি ঠিক-ঠাক। যাকগে তুমি যেতে পারো, তবে আমি যা বলেছি তা মস্তিষ্কে রেখো। আমার খুব দ্রুতোই উত্তরাধিকারের আগমনের সংবাদ চাই, নাহলে… বুদ্ধিমান তুমি, নিশ্চয়ই অনুধাবন করে ফেলেছো।”
সায় জানিয়ে বিদায় হয় পৌত্রে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। সিন্দুক থেকে একটি পুরাতন ছবি বের করে বক্ষের মধ্যিখানে জড়িয়ে চোখের জল ফেলার কার্যে নিয়োজিত হন।
___
মেহমাদ শাহ কামরার এক পাশ হতে অন্য পাশে হাটাহাটি করছে। দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা উভয় গ্রাস করছে তার হৃদয় ও মস্তিষ্ক।
মিনার সংশয় বোধ করে। মনিবকে শান্ত করতে শুধায়,
“জমিদার বাবু আপনি অযথা চিন্তার ভার নিবেন না। বেগম নিশ্চয়ই আপনাকে মিথ্যে কথা বলবেন না। বেগম লুৎফুন্নেসা হয়তো বৃথাই সন্দেহ করছেন।”
“দাদীজান গুরত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা ব্যতীত চন্দ্রমল্লিকার উপর এই কালিমা লেপণ করবে না। তাছাড়া তখন দাদীজানকে না বললেও এটা সত্যিই সে যদি কোনো ঔষধি না নেয় বৈদ্যশালা হতে গর্ভধারণ রোধে, তবে সন্তান গর্ভে না আসা ছাড়া উপায় নেই।”
“তবে আপনিও মানছেন বেগম আপনাকে মিথ্যে বলছেন?”
“জানি না আমি। তবে তার যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকতো তার আমাকে জানানো উচিত ছিল। সে যে বিপদের শঙ্কায় বর্তমানে আছে, তাতে যে কোনো মুহূর্তেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটা হতেই পারে।”
“হ্যাঁ, জমিদার বাবু। কারণ বেগম লুৎফুন্নেসা এই ক্ষেত্রে চুপ করে থাকার মানুষ নয়।”
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে মেহমাদ শাহ। পরক্ষণেই নিজেকে কঠোর করে সে।
আনমনে বিড়বিড়ায়,
“সবার পূর্বে জমিদারি, তারপর ভালোবাসা ও দুনিয়াদারি। যে পারবে না হৃদয়ে এ কথা রাখতে, সে পারবে না জমিদারি ও জমিদারের সিংহাসন রক্ষা করতে।”
এ কথাটি তাকে সাত বছর বয়সে বলেছিলেন তার দাদীজান। তখন থেকেই খুব ভালো ভাবে মাথায় এঁটে নিয়েছে সে। যদিও অনুভূতি তাকে দুর্বল করে, তবুও নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা সে রাখে।
“মিনার! আমার জন্য উষ্ণ জলে স্নান করার ব্যবস্থা করো। আর পুদিনার তৈল ছিটিয়ে দিতে বোলো স্নানের জলে। আমার একটু স্বস্তি ও আরাম বোধ করা প্রয়োজন।”
“যথা আজ্ঞা জমিদার বাবু।” মিনার বিদায় নেয়।
মেহমাদ শাহ সেখানে দাঁড়িয়ে আবার গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। যামিনীকে নিয়ে তার হৃদয়ে জাগ্রত বিভিন্ন সংশয়কে ঘুম পাড়ানো কী এতো সহজতর!
___
যামিনী ও দিলরুবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মোহিনীর উদ্দেশ্যে। দিলরুবাকে প্রচণ্ড অশান্ত দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে যুবতী জমিদারনি একদম শান্ত ভাবে চোখ বন্ধ করে মুখ এগিয়ে রেখেছে মুক্ত গগনের দিকে।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম।” মোহিনী ঝুঁকে সালাম জানায়।
রমণী উত্তর দেয় না। একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় বলতে ইশারা করে।
“বেগম, বেশি কিছু তো জানতে পারিনি। কারণ খুব গোপনীয়তার সাথে আলোচনা হয়েছে তাঁদের মাঝে। ওপারের দেয়ালে দাঁড়িয়ে যতোটুকু শুনতে পেরে যতোটুকু বোধগম্য হয়েছে তা হলো উত্তরাধিকারের বিষয়ে কথা হচ্ছিল। এই শব্দটিই স্পষ্ট শুনেছি আমি।”
নির্বিকার যামিনী। যেন সে জানতো এমন কিছুই হয়ে থাকবে।
“বুঝেছি আমি, মোহিনী। তুমি এখন যেতো পারে।”
“বিদায় বেগম।” স্থান ত্যাগ করে মোহিনী।
কক্ষ শূন্য হতেই ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করে দিলরুবা,
“এখন কী হবে বেগম চন্দ্রমল্লিকা? কীভাবে রক্ষা করবেন আপনি নিজেকে এই মহাসংকট হতে?”
“জানি না আমি। কিছু জানি না। আমি জানতাম এমন কিছু একটাই হবে, এটাই স্বাভাবিক। এমন সত্য শত চেষ্টাতেও আড়াল করা যায় না। এই পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে আমি জ্ঞাত নই।
শুধু এতোটুকু জানি খুব শিঘ্রই যদি কোনো উপায় না খুঁজে পাই তবে যা যা অর্জন করেছি তা তা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে অন্যকেউ। হয়তো সে হবে মেহনূরই। এখন আল্লাহর দরবারে হাত তোলা ছাড়া উপায় নেই।”
“আপনি দুঃশ্চিন্তা পোষণ করবেন না, বেগম। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আল্লাহ মহান, নিশ্চয়ই তিনি আপনাকে নিজেকে রক্ষার পথ দেখাবেন।”
তাদের আলোচনার মাঝে কক্ষের দ্বার খুলে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে রোহিণী। গত দুই বছরে সে হয়ে উঠেছে যামিনীর ভরসাযোগ্য আরেকজন ভৃত্য। মেয়েটা কিশোরী বলে ছটফটে ধরনের হলেও বেশ বুদ্ধিমতী এবং বিচক্ষণ।
রমণী বেশ ক্রুব্ধ হয় অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করায়। ক্ষিপ্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“এভাবে প্রবেশ করার অর্থ কী রোহিণী? তুমি ছোটো বলে বেগম আদর করি বলে মনে কোরো আদব-কায়দায় ত্রুটি হলে মার্জনা পাবে।”
“দুঃখিত, বেগম। বস্তুত, আড়াল হতে আমি এমন এক দুঃসংবাদ শুনেছি। কোনো কিছু না দেখেই আপনার নিকট ছুটে এসেছি।”
হৃদয় ধড়পড় করে উঠে জমিদারনির। আবার কী অঘটন ঘটলো তার অগোচরে!
“কী হয়েছে রোহিণী? হুট করে কী এমন দুঃসংবাদ শ্রবণ করলে তুমি?”
“বেগম, আমি… আমি আয়েশা খাতুন ও মালিহা খাতুনকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুনেছি। তারা বলেছিলেন শাহাজাদি মেহনূরকে নবাববাড়িতে আগমনের জন্য খবর পাঠিয়েছেন বেগম লুৎফুন্নেসা। আর আমি তো দিলরুবা আপার কাছে শুনেছিলাম শাহাজাদি আপনার প্রধান শত্রু।”
দাঁড়ানো থেকে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নেয় কন্যা রোহিণীর কথা শ্রবণ করে। দিলরুবা “বেগম! বেগম!” বলে আগলে ধরে।
পালঙ্কে শোয়ানো হয় তাকে। যামিনী হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। এতো কষ্ট যে প্রলয়কে নিজ জীবন হতে বের করেছে, সে পুনরায় ফিরে আসলে নিশ্চয়ই আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে ফিরে আসবে। এতো বড়ো এক বোঝা মাথায় নিয়ে কীভাবে পুনরায় লড়াই করবে সে!
___
মেহমাদ শাহের কর্ণগোচর হয় শাহাজাদি মেহনূরের আগমনের সংবাদ। ক্ষুব্ধ হয়ে বেগম লুৎফুন্নেসার কামরায় প্রবেশ করে সে।
“আসসালামু আলাইকুম, দাদীজান। এ কী কথা শুনছি আমি? আপনি মেহনূরকে এই অন্দরমহলে পুনরায় ডাকাচ্ছেন? আপনি কি জ্ঞাত নন তাকে আমার বহিষ্কার করা সম্পর্কে! তাছাড়া আপনি আমাকে সময় দিয়েছিলেন আলোচনার পর।”
“থামো, মেহমাদ। আগে পুরো কথা শুনো, তারপর বলো। প্রথমে জানাও তুমি কি জ্ঞাত আর.কে. হকিংস সমেত কয়েকজন লোক শহর হতে আসছে শেরপুর ভ্রমণ করতে?”
আর.কে. হকিংসের নাম শ্রবণপথে প্রবেশ করলে গা হিম হয়ে যায় যুবকের। আকস্মাৎ এই মানুষগুলোর আগমনের কারণ কী?