অপেক্ষার শেষ প্রহর পর্ব -০৯

#অপেক্ষার_শেষ_প্রহর
#পর্বঃ৯
#লেখনীতেঃহৃদিতা_ইসলাম_কথা

হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব হতেই ধ্যান ভাঙলো আমার।এ অনুভুতি আমার খুব চেনা।শুধু সে মানুষটার উপস্থিতিতেই এমন অনুভব হয় আমার।চট করে ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকাতেই বলিষ্ঠ কারো উপস্থিতি টের পেলাম।সে আমার পাশেই খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখে বসেছে।আমার মনের মনি কোঠরে আগেই তার অস্তিত্ব জানা দিয়েছে।আমি মৌনতা বজায় রেখে সামনের দিকেই তাকালাম।এখন সাঝের বেলা।আলোর অস্তিত্ব মুছে অন্ধকারকে অন্ধকারকে বরন করে নিবে সময়।এখন সুর্যাস্তের অন্তিম সময়। আমার পাশেই বসা বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী মানুষটি এক ধ্যানে সে সুর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করাতে মশগুল।আমিও সেদিক পানে তাকিয়ে। ধীরে ধীরে পুরো সুর্য অস্ত গেলো চারপাশে আধারের ঘনঘটা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।কিন্তু কৃত্রিম আলোর জোরে আধার যেনো হার মানলে।আশেপাশের দোকান, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট গুলোতে আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে।রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট ও জ্বলছে।আমি নিশ্চুপ।সেভাবে বসে থেকেই আমার দিকে না ঘুড়েই উনি বললেন,

— এভাবে এখানে বসে আছেন যে? কারো অপেক্ষা করছিলেন?

— আমার #অপেক্ষার_প্রহর_শেষ মিষ্টার ফয়সাল । অপেক্ষা করার মত জীবনে কেউ নেই।আর না এখন কারো প্রয়োজন আছে।তাই কারো জন্য অপেক্ষা করার প্রশ্নই উঠে না।

সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে একরাশ অভিমান আর একবুক কষ্ট নিয়ে শক্ত গলায় কথাগুলো বললাম।

প্রতিদিন নিজের কষ্টগুলোকে নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি।আজ কেনো যেনো সেগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে।তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কেনো করলো সে আমার সাথে এমন।তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম।কিন্তু সে কি আমায় বাধ্য করেনি তাকে ভালোবাসাতে। কেনো এসেছিল সে আমার এত কাছাকাছি। কি প্রয়োজন ছিল আমার মনে তার প্রতি সুপ্ত অনুভূতির জন্ম দেওয়ার। কথা যদি সেদিন আমায় রাস্তা থেকে তুলে বাড়িতে আনা পর্যন্ত হতো তাহলেও ঠিক ছিলো। কিন্তু সে তো সেখানে থামেনি বার বার কাছে এসেছে আমার।বার বার তার কেয়ার আর আমার জন্য এত এত ভালোবাসা আর চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছে আমার মনে।আমার ছোট্ট মন সেগুলোকেই ভালোবাসার নামকরন দিয়েছিল।তার মাঝে নিজেকে বিলীন করেছিল।এতটাই যে সে মনে আর কারো জায়গা হয় নি।কাউকে বসাতে পারিনি।বড্ড অভিমান হচ্ছে আজ আমার। কষ্টগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।বেরিয়ে আসতে চাইছে।কিন্তু এটা তো হতে দেওয়া যাবে না।তাহলে আমি দুর্বল হয়ে যাবো ধরা পড়ে যাবো।আমার না বলা অনুভূতি গুলো প্রকাশ পাবে।তাই বুকে পাথর বেধে খুব কষ্টে সামলালাম নিজেকে।

— সত্যি #অপেক্ষার_শেষ_প্রহর একদিন শেষ শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু তা সুমিষ্ট হবে কিনা তা আমাদের জানা নেই।কিছু কিছু মানুষের জন্য অপেক্ষা করতেও ভালো লকগে জানেন তো।সেখানে এক আকাশ সমান ভালোবাসা খুজে নেওয়া যায়।কারন মনের মাঝে একটা আশা থাকে একদিন অপেক্ষা শেষ হবে।

–আপনি কার জন্য অপেক্ষা করছেন? আপনি তো আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন। হ্যাঁ এটা অনেক দুঃখের বিষয় যে আপনাদের জীবনের বাকি পথ একসাথে চলা হলো না।কিন্তু সবার ভাগ্যে তো তাও থাকে না।সবার ভাগ্যে ভালোবাসা থাকে না মিষ্টার ফয়সাল। সবাই আপনার মত ভাগ্যবান হয় না।

— হুম ঠিকই বলেছেন। সবাই ভাগ্যবান হয় না।ভালোবাসার মানুষটিকে এক মহাকাশ সমান ভালোবেসে তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় রোজ জ্বলতে হয়।তাকে হারানোর দহনে রোজ পুড়তে হয়।সে এতোটা কাছে থেকেও নিজেদের মাঝের দুরত্ব বড্ড অসহায় করে দেয়।যেটা সবাই বোঝে না আর না সবার বোঝার ক্ষমতা আছে।

উনার কথায় উনার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম আমি।বুঝতে পারছি না উনার কথার মর্মার্থ।সব মাথার উপর দিয়ে সাই করে উড়ে গেল।তবে একটা জিনিস স্পষ্ট আর সেটা হলো তার মনে বিশাল কষ্টের পাহাড় জমেছে।কিন্তু কেন? সে কেনো এত কষ্ট পাচ্ছে? হয়তো তার স্ত্রীর জন্য। কিন্তু কথাগুলো এভাবে কেনো বললো আর কেনই আমার কাছে অন্য রকম এক স্রোতকে দেখতে পাচ্ছি। উনি সবসময় হাসি খুশি আর প্রানোচ্ছল ছিলেন।আর আজ তার সম্পুর্ণ অন্য রুপ দেখছি।হয়তো সবটাই নিজ স্ত্রীর জন্য। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।কষ্ট গুলো কান্না হয়ে ঝড়ে পড়তে চাইছে।

আমি চুপই ছিলাম।কি বলবো বলার মত কিছু নেই।উনি আবারো নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন,

— কাউকে ভালোবাসতেন?

— আমাকে ভালোবাসার মত কেউ ছিল না।আর আমার কথা না হয় নাই বললাম।ভালোবাসা পেতে ভাগ্য বা যোগ্যতা লাগে সেটা হয়তো আমার ছিল না।তাই আমি একা।আর আমার একাকীত্বেই আমি পরিপূর্ণ।
আমার নির্লিপ্ত জবাব।উনি অবাক চাহনি দিলেন আমার এমন বক্তব্যে।তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,

— ভুল বললেন।একাকীত্ব কািকে পরিপূর্ণ করতে পারে না।ভালোবাসা মানুষকে পরিপূর্ণ করে।আর আপনার মত একটা কিউট ইনোসেন্ট পাগলাটে মেযেকে কে ভালোবাসবে না।আপনাকে যে ভালোবাসবে না সে ভালোবাসার মানেই বোঝে না।আর তা হলে আপনি হয়তো তার ভালোবাসা বুঝতে পারেন নি।বুঝলে হয়তো সবটা অন্য রকম ই হতো।

— ভালোবাসা শুধু আঘাত কষ্ট আর এক পৃথিবী সমান যন্ত্রণা দিতে জানে। তাই ওসব প্রানঘাতি অসুখ থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রেখেছি।

— ভালোবাসা শুধু মানুষকে কষ্ট আঘাত আর যন্ত্রণা দেয় না।এক সীমাহীন সুখের মুহূর্ত দেয়। নাম না জানা কিছু অনুভুতি দেয়।সারাজীবন মনের ঘরে লুকিয়ে রাখার মত কিছু স্মৃতি দেয়।আর এক মহাকাশ সমান ভালোবাসা দেয়।আগলে রাখে যত্নে রাখে সম্মান দেয়।ভালোবাসা যোগ্যতা যাচাই করে হয় না সেটা তো মনের ব্যাপার আর মনের উপর কারো হাত থাকে না।

উনার মুখ থেকে এসব ভালোবাসার কথা শুনে চোখ ফেটে জল যেন বেরিয়েই আসবে।তাই এখানে থাকা অসম্ভব। উনার এসব ভালোবাসার সঙ্গা শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।আমায় এই মরন ব্যাধিতে আক্রান্ত করে উনি তো দিব্যি নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে সুখের সময় পার করেছেন।

আজ কেন জানি না ভিষন রাগ হচ্ছে উনার উপর
আগে কখনো এমন হয়নি।সেদিনও নয় যেদিন আমি আমার মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলোকে উনার কাছে প্রকাশ করতে গিয়ে এক পৃথিবী সমান হতাশা আর এক বুক যন্ত্রণা হৃদয়ে বহন করে ফিরে এসেছিলাম।খুব কেঁদেছিলাম সেদিন খুব করে কেঁদেছিলাম।কিন্তু কাউকে জানতে দেই নি আমার মনের কথা। তারপরের দিন সকালে সবাইকে ঘুমে রেখে শুধু একটা চিরকুট লিখে চলে এসেছিলাম।বাড়িতে এসে পনেরো শুধু চোখের জল বিসর্জন দিয়েছি।আর ভেবেছি কেনো কোনো উনি আমায় একটু ভালো্াসতে পারলো না।যদি ভালো নাই বাসবে তবে কেনো আমার মনে ভালোবাসার অনুভূতির সন্ঞ্চার করেছিল।কেনো এক অজানা অচেনা অনুভুতির সাথে পরিচয় করালেন উনি কেনো?তারপর পরই চলে আসি এত দুরে আমার জেদের কাছে হার মেনে বাবাও রাজি হয়েছিল।যে বাবা তার মেয়েকে নিজের চোখের আড়াল করতো না।সে বাবা বাধ্য হয়ে রাজি হয় আমাকে এতদূর পাঠাতে।কারো সাথে যোগাযোগ ছিল না।এমনকি প্রানপ্রিয় কাজিন বেস্টফ্রেন্ডর সাথে ও না।কেয়াও কোনদিন বুঝতে পারে নি আমার মনে স্রোতের জন্য কিছু আছে।কাউকে জানায়নি আমার মনের খবর নিজের মধ্যে রেখে গুমরে গুমরে মরেছি।আর পারলাম না থাকতে তাই সেখান থেকে কিছু না বলেই উঠে চলে এলাম।স্রোত ছলছল দৃষ্টিতে বেশ খানিকটা কষ্ট আর কিছু না বলা অনুভূতিকে নিজের মাঝেই চেপে কষ্টে ভরা চাহনিতে শুধু দেখে গেল তার প্রেয়সীকে।

–আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।

কথাটি কর্নকুহুরে পৌছুতেি পা থেমে গেল আমার।আ্ার আমাকে উনি তুমি বলে ডেকেছেন।বুকের ভেতরটা খা খা করছে।গলা শুকিয়ে আসছে আমার।উনার মুখে তুমি শব্দটা শুনলেই কেমন এক অনুভূতি হয় আমার ভেতরে।যেনো উনার থেকে বেশি সুমিষ্ট স্বরে কেউ তুমি বলে ডাকতেই পারে না।

— অনেক রাত হয়েছে।একা কি করে যাবে? তোমার তো ডগ ফোবিয়া আছে মনে নেই সেবার কি হয়েছিল!

অবাধ্য অশ্রুকনা গুলো আর বাধ মানলো না গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। না এই অশ্রু উনাকে দেখানো যাবে না।তাই কোনমতে ভেজা গলাড বলে উঠলাম,

— ন্ না প্রয়োজন নেই আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো।
তারপর রিক্সা ডেকে চলে এলাম।

স্রোত সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে রইলো।এতদিন পর প্রেয়সীর দেখা মিললেও মনের কথা আর বলা হলো না।হয়ত আর হবেও না।এখন আর জানিয়ে কি করবে? সেকি মেনে নিবে তাকে? নাকি ফিরিয়ে দেবে? ওর প্রত্যেকটি শব্দ যন্ত্রণামিশ্রিত ছিল।কেন এত কষ্ট ওর? কিসের এত কষ্ট? কাুকে ভালোবেসে ঠকেছে? হয়তো! নয়তো কেনো এত বদলে যাবে ও কেনো এত পরিবর্তন এই হাসিখুশি মেয়েটাকে এভাবে গুমরে গুমরে কষ্ট পেতে দেখতে যে ভিষন কষ্ট হচ্ছে ওর।নিজের উপর ভিষন রাগ হচ্ছে। কেনো ও ওর মনের কথা গুলো ব্যক্ত করার সময় পেল না?কেনো কথা ওকে সময় দিল না?কেনো ও ওর ফিরে আসার আগে সবটা ব্যক্ত করলো না?ওর মনের অব্যক্ত অনুভূতি যা শুধু ওর প্রিয়ার জন্য ছিল।কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে।জোরে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়লো ও।খুব কষ্ট হচ্ছে ওর।যে মানুষটাকে ও এতটা ভালোবাসে তার কষ্ট সহ্য হচ্ছে না ওর।এই সাত বছরের দুরত্ব সহ্য করেছে।নিজের স্ত্রীকে তার প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু দিতে পারে নি।শুধুমাত্র ওর জন্য। এই অবুজ মেয়েটার জন্য। এই নিষ্পাপ পিচ্চির জন্য। যার মনের মাঝে শুধুই আছে রাগ জেদ আর ভালোবাসা।সবাইকে খুব ভালোবাসতে পারে ও।আমি না হয় নিজের ভালোবাসা নাই পেতাম।ও ওর ভালোবাসাকে কেনো পেল না।তাতেও আমি খুশি হতাম।

——————————————–
বাড়িতে এসেই শাওয়ার ছেড়ে বসে পড়লাম। আজ কাদবো খুব করে কাদবো।আর পারছি না এই কষ্ট বয়ে বেড়াতে।অজানাই তার প্রতি ভালোলাগা আর ধীরে ধীরে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম।আর এখনও অবিরাম ভালোবেসে যাচ্ছি।এ ভালোবাসা কখনো ফুরানোর নয়। কখনোই না

বেলকনিতে বসে আছি।ভেজা চুলে আর অপলকে ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে। আমার মনের মত আমার বেলকনিতেও তার রাজত্ব চলে।আগে ফুল গাছ বালো লাগলেও সেভাবে গাছ লাগানোর মত ইচ্ছে হয় নি।আলসেমি যাকে বলে।কিন্তু স্কুল আর বাচ্চারা ছাড়া দিনের বাকিটা সময় ওদের সাথেই কাটে।

স্নোতের পছন্দের সব ফুলের গাছ লাগিয়েছি।গাছগুলোকে দেখেই আনমনে মুচকি হাসলাম।মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। যেদিন স্রোত আমায় রাতে বাইরে বের হওয়ার দুঃসাহস দেখানোতে ওনার পুরো বাগান আমায় একা পরিষ্কার করার শাস্তি দিয়েছিল।

#চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here