সুখের পাখি পর্ব -১৫+১৬

#সুখের_পাখি

১৫
ফুপু আম্মার নাকি দুই ছেলে! তনু এই কথাটা আজ প্রথম শুনেছে। ইহান ভাইরা দুই ভাই! আজব কাণ্ড! এতদিনেও তনু এটা জানতো না। আজ ফুপু আম্মার মুখে দুই ছেলে কথাটা শুনে তনু আকাশ থেকে পড়েছে। অবিশ্বাস্য গলায় তনু সাবিনাকে জিজ্ঞেস করল,

–‘সত্যিই ফুপু আম্মা! তোমার দুই ছেলে!’

–‘হ্যাঁ রে বাবা। আমার দুইটাই ছেলে। বড় ছেলে আহান। চার বছর ধরে আমেরিকায় আছে। সে ডাক্তারি পড়তে গেছে। পড়া শেষর দিকে। আসবে তো ও। তখন দেখতে পারবি। ছোটটাকে তো তুই দেখছিসই। ইহান। ইহানটা তো ইঞ্জিনিয়ারিং না করে গানবাজনা নিয়ে পড়েছে।’

–‘আমি এখানে আসার পর তোমার বড় ছেলের কথা একদিনও শুনিনি।’

–‘আমার তো ওর সাথে রোজই কথা হচ্ছে। তুই কথা বলবি?’

তনু তাড়াতাড়ি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে না করে।

–‘না না। আমি কী কথা বলব? আমি তো উনাকে দেখিওনি। আমার কথা বলতে লজ্জা করবে।’

–‘ওরে লজ্জাবতীরে আমার। আহান কিন্তু ইহানের মতো রাগী না। অনেক মিশুক ও। তুই ওর সাথে দুই মিনিটেই মিশে যেতে পারবি।’

তনু মনে মনে বলল,

–‘ভাসুরের সাথে আর মিশামিশি ফুপু আম্মা! উনাকে আমার সম্মান দিয়ে চলতে হবে।’

মুখে বলল,

–‘বাড়ি জুড়ে আহান ভাইয়ের তো কোন ছবি দেখলাম না।’

–‘আছে তো। এইতো বসার ঘরেই আছে। দেখ, ওই যে আহান, ইহান ছবিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।’

–‘উনাদের দু’জনকে তো এক রকমই লাগছে। কত বছরের বড় ছোট ওরা?’

–‘দুই বছরের। তবে বোঝা যায় না। ইহানকেই আহানের থেকে বড় মনে হয়। দু’জনই বডি সডি বানিয়েছে। তবে ইহান আহানের থেকে একটু লম্বা। ফর্সা দুই ভাই একই রকম।’

–‘তোমার মতো। তুমিও তো এমন সুন্দর। ফুপাকে তো দেখিনি। আহান ভাইকেও না। ইহান ভাই কিন্তু তোমার থেকেই গায়ের রঙ পেয়েছে।’

সাবিনা হাসল। ছেলে দু’টা কবে যে একসাথে চোখের সামনে থাকবে। আহানটা হয়েছে ওর বাবার মতো। বাড়িতে থাকতে চায় না। আর ইহান বাড়ি থেকে নড়তে চায় না। দুই ছেলের চরিত্রে কত পার্থক্য!

তনুর টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত এই কয়দিন শান্তি। পরীক্ষা তনু ভালো দিয়েছে। সব সাবজেক্টে পাস করে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু রেজাল্ট হয়নি। তাই তনু ইহানের কাছে পড়া আপাতত বন্ধ রেখেছে। তনু এখন শুধু ঘুমিয়ে দিন কাটায়। আজ তো দুপুর সময়েই ইহানের পাগলামি দেখা দিয়েছে। গলা ছেড়ে খালি গলায় গান গাইছে সে।

—তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি? তুমি কি আমায় বন্ধু, কাল ভালোবাসোনি—

তনুর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলেও এত জ্বলতো না সে। ইহান ভাই কার জন্য গান গায়? আশেপাশের ফ্ল্যাটে কোন মেয়ে আছে নাকি? নিশ্চয় আছে। গানে গানে কথা হয় তাহলে! কী চালাক, কী চালাক! তনুর মন পুড়তে লাগল। সে ঠিক করল যা কিছুই হয়ে যাক, ইহানকে মনের কথা বলে দিবে সে। ইহান বকুক বা মারুক। ইহানের জন্য দিন দিন তার অনুভূতি বেড়েই যাচ্ছে। কমার তো কোন নাম নেই। তনু জানে এটা তার সত্যিকারের ভালোবাসা।
দেখতে দেখতে রেজাল্ট দিয়ে দেয়। পুরো ক্লাসে তনু চার নাম্বার হয়েছে। সবাই তো অবাক। তুহিন গাধাটা দ্বিতীয় স্থান থেকে সরার নাম নিচ্ছে না। এবারও গাধাটা দ্বিতীয় হয়েছে। তুহিন এসে তনুকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

–‘কংগ্রাচুলেশনস তনু। তুমি চতুর্থ হয়েছে।’

–‘তুমি পরীক্ষার খাতায় একটু কম লিখলেই আমি তৃতীয় হয়ে যেতাম। শুধু তোমার জন্য আমি তৃতীয় হতে পারলাম না তুহিন।’

তনু মুখের চেহারা এমন করল যেম তুহিন কাউকে খুন করে ফেলার মতো অপরাধ করেছে। গাধাটাও অপরাধী মুখে মাথা নীচু করে রেখেছে। যেন দ্বিতীয় হয়ে সত্যিই সে অপরাধ করেছে। মিতা ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপছে। তনুটা গাধাটাকে নাকে দড়ি দিয়ে যেভাবে ঘোরাচ্ছে। মজাই লাগে মিতার।

–‘শোনো পরের বার থেকে যদি তোমার জন্য আমি তৃতীয় না হই না, তাহলে তোমার খবর আছে।’

তনু ইহানকে রেজাল্ট জানানোর জন্য সবকিছু ফেলে আগে বাড়ি আসে। বাড়ি এসে দেখে ইহান বাড়িতে নেই। মন খারাপ হয় তনুর।

–‘দূর! যাকে জানানোর জন্য ছুটে এলাম। সে-ই নাকি বাড়িতে নেই। ভাল্লাগে না ছাতা।’

তনু বাবার কাছে গেল। বাবাকেও জানাতে হবে। কত ভালো রেজাল্ট করেছে সে। ক্লাসের এতগুলো ছেলেমেয়ে থেকে তনু চার নম্বর হয়েছে। তার খুশি প্রকাশ করতে পারছে না। অবশ্য সবই ইহানের জন্য। ইহান তনুকে পড়াশোনা নিয়ে অত চাপ না দিলে তনু এবারও গোল্লা খেত।
বাবার শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। অসুখবিসুখ লেগেই থাকছে। তনু বাবার পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বাবা চোখ মেলে তনুকে দেখে ফ্যাকাশে হাসে। বাবার হাসিতেও যেন অসুখ লেগে গেছে। আগে বাবার হাসি কত প্রাণবন্ত ছিল। এখন যেন কেমন হয়ে গেছে। তনুর কান্না পায়। বাবার কিছু হলে সে কীভাবে থাকবে? বাবাকে ছাড়া তনুর বাঁচা সম্ভব না। বাবার কিছু হলে সে-ও মরে যাবে। বাবার সামনে কাঁদতে চায় না তনু। কান্না গিলে বলল,

–‘বাবা তোমার কী হয়েছে?’

–‘কিছু হয়নি রে মা। আমি তো ভালোই আছি।’

–‘ভালো নেই তুমি। তোমার চোখ যেন কেমন হয়ে গেছে।’

বাবা জোর করে মুখে হাসি আনে।

–‘কেমন হয়েছে? অসুখ হলে এমন হয়। সেরে গেলে দেখবি আবার ঠিক হয়ে যাবে।’

–‘তুমি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাও বাবা। আজ আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে। টেস্ট পরীক্ষায় আমি চতুর্থ হয়েছি। স্যার ম্যাম কী বলেছে জানো? বলেছে তনুও এবার এ’প্লাস পাবে।’

–‘দোয়া করি রে মা, তুই পড়াশোনা করে একদিন অনেক বড় হবি। তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। অন্যের উপর কতদিন নির্ভরশীল থাকবি বল। সাবিনা তোর আপন ফুপু না। আবার আপনের থেকে কমও না। শুধু রক্তের সম্পর্ক হলেই মানুষ আপন হয় না। তোর ফুপুর কথা তুই কখনও ভুলিস না। জীবনে যতই বড় হোস, যা কিছুই করিস। তোর এই ফুপুটার মুখে হাসি ফোটাস মা। কখনও সাবিনার কথার বাইরে যাস না। ও কষ্ট পাবে এমন কিছু করিস না। আমাদের উপর ওর অনেক ঋণ। এই ঋণ হয়তো আমি বেঁচে থাকতে শোধ করতে পারব না। কিন্তু তুই পারবি। তুই তো আমার সোনা মা।’

তনু এবার কেঁদেই ফেলল। বাবাটা যে কী! খালি তাকে কাঁদায়। এসব কথা কেন বলছে?

–‘ইহান ভাই, আমার রেজাল্ট দিয়েছে।’

মাথা নুইয়ে কাচুমাচু হরে কথাটা ইহানের সামনে বলল তনু। সে চতুর্থ হয়েছে যেনেও ইহান তাকে বকবে। প্রথম, দ্বিতীয় কেন হতে পারেনি। ইহান শার্ট খুলতে খুলতে পেছন ফিরে তনুর দিকে তাকাল। তনুর রেজাল্ট আগেই জানে সে। খবর নিয়েই এসেছে।

–‘অনেক গরম। ফ্যানটা চালিয়ে দাও তো তনু।’

আজব মানুষ! রেজাল্টের কথা না শুনে ফ্যান চালাতে বলে। তনু ফ্যান চালিয়ে দেয়। ইহান শার্ট আলনায় রাখতে রাখতে বলে,

–‘ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি নিয়ে আসো।’

ইহান ভাইকে তনুর তার রেজাল্ট জানাতে ইচ্ছে করছে। এই মানুষটার জন্যই তো দিনরাত এক করে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছে সে। দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে আসে তনু। ইহান পানি খেতে খেতে তনুকে আড়চোখে দেখে। মনে মনে হাসে। এতগুলো দিনেও তনুর বাচ্চামি যায়নি। কবে বড় হবে মেয়েটা? ইহান বুঝে সে তনুকে যতই বকুক। যতই ইগনোর করুক। তনুর মনে তার জন্য ভালোবাসা একটুও কমেনি। সময়ের সাথে বাড়ছে বরং। তনু একটু তো বুঝদার হয়েছে। তার ভালোবাসার ধরণও পাল্টেছে। একা একাই ভালোবেসে যাচ্ছে সে। এখন আর ইহানের কাছ থেকেও ভালোবাসা পাওয়ার আশা করে না।

–‘রেজাল্ট কী? পাস না ফেল? প্রথম বারের মত বত্রিশ!’

লজ্জায়, অপমানে, কষ্টে তনুর চোখে পানি এসে যায়। এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়! ইহান তনুর ছলছল করা চোখ দু’টোর দিকে গভীর ভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কিছুটা নরম গলায় ডাকে।

–‘তনু!’

–‘আমি পাস করেছি ইহান ভাই। পুরো ক্লাসে চতুর্থ হয়েছি।’

–‘প্রথম, দ্বিতীয় হতে কেউ নিষেধ করেছিল?’

তনুর সত্যিই এবার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই জীবন বাঁচিয়ে রেখে কোন লাভ নেই। মনে মনে তনু বলে,

–‘আপনি ভীষণ নিষ্ঠুর, ইহান ভাই। অনেক পাষাণ। আপনার বুকের ভেতর মন নেই। আমাকে এতো কেন কষ্ট দেন আপনি? অন্তত আজকের দিনটা হাসি মুখে বলতেন, তনু ভালো করেছ তুমি। পরের বার আরও ভালো করতে হবে, কেমন?’ তাহলেই তো আমার উৎসাহ আরও দ্বিগুণ হতো। আপনি কখনও বুঝতে চান না আমাকে।’

তনু চলে গেলে ইহান লম্বা করে দম ফেলে। হেসে বলে,

–‘আমাকে তুমি অনেক নিষ্ঠুর ভাবো, তাই না তনু? কিন্তু আমি তো এসব তোমার ভালোর জন্য করি। তুমি এখন টেন এ পড়ো। টেস্ট পরীক্ষায় পাস করেছ মাত্র। তুমি এসএসসি দিবে। এইচএসসি দিবে। অনার্স করবে। মাস্টার্স করবে। সামনে পুরো জীবনটাই পড়ে আছে তোমার। এখন যদি আমি তোমার মন রাখতে গিয়ে তোমাকে লাই দেই, তাহলে ক্ষতি তোমারই হবে। তুমি এখন যেই দিনগুলো পার করছো তা ভীষণ রঙিন। আমিও ওসব দিন পার করে এসেছি। তাই আমি জানি। জীবনের সবথেকে বড় ও ভয়ঙ্কর ভুল গুলো এই বয়সেই হয়। যার কারণে বাকিটা জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে হবে। তোমার বাবার দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তোমার সুন্দর ভবিষ্যত কীভাবে নষ্ট হতে দিই বলো?’

আজ তনু ইহানকে মনের কথা বলে দিবে। যা আছে কপালে। ইহান রাগ করবে? করুক। তনু ভয় পায় না। বকবে? বকুক। ইহানের বকা শুনে তনু অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ইহান তাকে মারবে? মারলে মারুক। আজ তনু মার খেতেও রাজি আছে। তবুও মনের কথা আর চেপে রাখা সম্ভব না। ইহানকে হারানোর কথা ভাবলে দম বন্ধ হয়ে যায় তনুর। এত অস্থির লাগে! অনেক সাহস নিয়ে তনুর ইহানের সামনে এসে বসলো। ভয়কে মনে জায়গা দিতে চাইছে না। ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে ওর।
তনুর কপাল ঘামছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাত পা কাঁপছে। ঠোঁট নড়ছে না। গলা দিয়ে কথা বের করতে পারছে না। ইহান তনুর দিকে তাকাল। কিছুই বলল না সে। তনু কথাগুলো কীভাবে বলবে গুছিয়ে নিচ্ছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে এই কয়টা কথা কীভাবে বলা যায় তা নিয়েই ভেবেছে। গুছিয়েও এসেছিল। কিন্তু এখন ইহানের সামনে সব গোলমাল লেগে যাচ্ছে। সাজানো কথা এলোমেলো হয়ে গেছে। তনু বলতেই যেত তখনই ইহান বলল,

–‘আজ পাঠ্যবই পড়াব না। প্রতিদিন এক বোরিং জিনিস ভালো লাগে না। আজ তোমাকে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জীবন সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দেব।’

তনু দমে যায়। সে যা বলতে নিচ্ছিল তা কি আজও বলতে পারবে না!

–‘ই-ইহান ভাই। আ-আম…

–‘শোনো তনু, মনোযোগ দিয়ে শুনবে কিন্তু। এই কথাগুলো আমার না। আমার স্যারের।
স্কুলে থাকতে আমাদের বাংলা স্যার প্রায়ই একটা কথা বলতেন।
‘শোন রে গাধার দলেরা, তোদের বয়সের ছেলেমেয়েদের চোখে রঙিন চশমা পরানো থাকে। ওই চশমা পরে যা দেখবি তা-ই ভালো লাগবে। যাকে দেখবি তাকেই পছন্দ হয়ে যাবে। এতে তোদের দোষ নেই। দোষ হলো তোদের বয়সের। তোদের বয়সটাই খারাপ।’

ইহান দার্শনিকের মতো অনেক বছর আগে বাংলা স্যারের ক্লাসে তার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলো আজ সে তার ছাত্রীকে শোনাচ্ছে।
তনু দীর্ঘশ্বাস চেপে ইহানকে দেখতে দেখতে মনে মনে বলল,

–‘রঙিন চশমা হোক বা সাদাকালো। আমার তো আপনাকেই ভালো লাগে। শুধু এই বয়সে কেন? আমি বুড়ি হয়ে গেলেও আমার শুধু আপনাকেই ভালো লাগবে ইহান ভাই। রঙিন চশমা খুলে পাওয়ারি চশমা লাগালেও এই তনুর শুধু ইহানকেই ভালো লাগবে। অন্য কাউকে না।’#সুখের_পাখি

১৬
মনের কথা মনে রেখে তনুর দিন কাটে। তনুর এক সময় মনে হয় ইহান ভাই যেন তার কথা শুনতেই চায় না। তনু কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতবারই সে বলতে গেছে ততবারই ইহান ভাই ইচ্ছে করে নানান কথা বলে তাকে নার্ভাস করে দিয়েছে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়নি।

–‘আপনি এমন কেন ইহান ভাই? আমাকে একটু ভালোবাসলে আপনার কী হয়? একটু ভালোবাসুন না আমাকে। একটু, বেশি না।’

গুনগুন করে তনু গান গায়। আজ একবার আহানের ঘর থেকে ঘুরে আসে। বেশ বড় গোছালো সুন্দর ঘর। এই বাড়ির সবথেকে বড় ঘরটাই আহান ভাই দখল করে বসে আছে। কিন্তু থাকতে পারছে না বেচারা।

–ফুলি আপা! ও ফুলি আপা।’

–‘ডাকো কেন?’

–‘কই তুমি? এদিকে আসো না একটু গল্প করি।’

–‘এখন আমার গল্প করার সময় নাই তনু। কাজ করতাছি।’

–‘রাখো তো তোমার কাজ। কাজ কাজ করেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছ।’

–‘আমারে অহন বিরক্ত কইরো না তো। যাও, তুমি ভাইজানের চা-টা নিয়া যাও। দুইটা ধমক খাইয়া আসো।’

–‘তোমার ভাইজানের চা আমি কেন নিয়ে যাব।’

–‘যাও না গো একটু। আম্মাজান বাড়িত না। রান্নাবান্না করতে হইব আমার। রাতে খাইবা না?’

–‘ফুপু আম্মা আবার কোথায় গেছে?’

–‘বাপের বাড়ি। আজ ফিরব না।’

–‘অহ।’

ফুলি তনুর হাতে চা ধরিয়ে দেয়। না চাইতেও তনুকে ইহানের ঘরে যেতে হয়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তনু ডাকে,

–‘ইহান ভাই আসব?’

–‘কে তনু? এসো।’

তনু ঘরে গিয়ে দেখে ইহান ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট পরছে। শার্টের বোতাম লাগানো হয়নি। আয়নার ওর খালি বুক দেখা যাচ্ছে। তনু তাকাবে না তবুও বারবার চোখ চলে যাচ্ছে। কোথাও বেরুচ্ছে নাকি? এই সাঁঝ সন্ধ্যাবেলা ইহান ভাই কোথায় যাচ্ছে? ইহান তনুর দিকে ফিরল না। আয়নায় তনুকে দেখল। তনু যে চোখ দিয়ে তাকে গিলছে বেশ বুঝতে পারল ইহান।

–‘ইহান ভাই, আপনার চা।’

–‘ফুলি তোমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে! ফুলিটা দিনদিন কাজ চোর হয়ে যাচ্ছে। ওর চাকরি খেতে হবে।’

মাথায় চিরুনি চালিয়ে। বডি স্প্রে লাগিয়ে ঘর উজাড় করে ফেলে, শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে তনুর সামনে এসে দাঁড়াল। তনুর চোখ ইহানের উপর আটকে আছে। বুকের ভেতর কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ইহান এতটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তনু দম নিতেও ভুলে গেল। ইহান তনুর চোখের দিকে তাকিয়ে ওর হাত থেকে চা নিল। তনুর চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই চায়ে চুমুক দিল। পরপর কয়েক চুমুক দিয়ে চা শেষ না করেই রেখে দিল। তনুকে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ইহান চলে যাবার আরও অনেক পর তনুর নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়। বুক ভরে দম নেয়, শব্দ করে দম ফেলে। ইহানকে তনু বুঝতে পারে না। এখন আর বোঝার চেষ্টাও করে না।
ইহানের অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ থেকে তনু চা খায়। ইহান যে পাশ দিয়ে খেয়েছে ঠিক সেই জায়গায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। তনুর দেহ, মন, শিরা উপশিরা শিহরিত হয়। ভেতর থেকে কেঁপে ওঠে সে।

–‘তনু! এই তনু! শুনছো?’

তুহিনের ডাকে তনুকে দাঁড়াতে হয়। পরীক্ষার আগের এই সময়টাতে তনু কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। যেভাবেই হোক ভালো রেজাল্ট করতে হবে তাকে। সাইন্সের গ্রুপের সবার একসাথে ক্লাস হয়। যার সুবাদে এই গাধাটার মুখ রোজ দেখতে হয় তনুকে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যায় তনুর। পেছন থেকে ডাকে কেন হ্যাঁ!

–‘কী হয়েছে?’

–‘একটু দাঁড়াও। তোমার সাথে আমার কথা আছে।’

–‘দাঁড়িয়েই তো আছি। আর কীভাবে দাঁড়াব?’

–‘তনু অনেকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলবো ভাবছিলাম।’

–‘তোমার কোন কথা শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই তুহিন। সামনে পরীক্ষা দয়া করে আমার মেজাজ খারাপ করো না। পরীক্ষা ভালো না হলে বাড়ি থেকে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে।’

–‘বিয়ে!’ তনুর বিয়ের কথা শুনে তুহিন যেন কেঁদে ফেলবে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলায় সে।

–‘আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো করে পড়ো তুমি। পরীক্ষায় ভালো করো। আমি নাহয় কথাগুলো পরীক্ষার পরেই বলব।’

–‘হুম। এখন কি বাড়ি যাবে তুমি?’

–‘হ্যাঁ।’

–‘গাড়ি এসেছে তোমার?’

–‘না। কেন বলো তো?’

তনু মনে মনে নিজেকে গালি দেয়। গাধাটার প্রতি দরদ উথলে উঠছে তার মনে। সে জানে পছন্দের মানুষের থেকে এরকম ব্যবহার পেলে কতটা কষ্ট হয়৷ এই কষ্ট তো রোজ রোজই পাচ্ছে সে। ইহান ভাইয়ের মতো পাষাণকে ভালোবেসে সে কষ্ট পাচ্ছে। আর তার মতো গাধীকে ভালোবেসে তুহিন গাধাটা কষ্ট পাচ্ছে। ভালোবাসা এমন কেন? শুধু কষ্টই পেতে হয়। ভালোবাসায় সুখ নেই কেন?

–‘তোমার গাড়ি না এলে চলো আজ হেঁটে যাই।’

তুহিন বিশ্বাস করতে পারল না। চোখ বড় করে তনুর দিকে চেয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

–‘আমার সাথে যাবে তুমি?’

–‘হ্যাঁ। যতটুকু পথ যাওয়া যায়। তোমার বাড়ি আর আমার বাড়ি তো আলাদা রাস্তা।’

ওরা হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। তুহিন বুঝতে পারছে না তনু আজ তার সাথে এতো ভালো ব্যবহার করছে কেন? তনু নামের এই মেয়েটা বছরের মাঝামাঝি সময় এসে তাদের স্কুলে ভর্তি হয়। ক্লাসে ওকে প্রথম দিন দেখেই তুহিন তনুকে মন দিয়ে ফেলে। তারপর তো এই বছরটাই কেটে গেল। তনু কখনও তার সাথে ভালো করে কথা বলেনি। তবু সে হাল ছাড়েনি। তুহিনের বিশ্বাস তনু একদিন ঠিক তাকে পছন্দ করবে। সেই দিনের অপেক্ষায় আছে সে।

–‘তুহিন আমি তোমার সাথে কেন খারাপ ব্যবহার করি জানো?’

–‘উঁহু।’

–‘কারণ আমি চাই না তুমি আমার ভালো ব্যবহারকে তোমার প্রতি আমার দূর্বলতা ভেবে নাও। আমি কিন্তু মোটেও তোমার প্রতি দুর্বল না। আর না কখনও হবো।’

–‘তনু!’

–‘আমাকে বলতে দাও আগে। কথার মাঝে কথা বলে মেজাজ খারাপ করবে না।’

–‘আচ্ছা বলো।’

–‘এখন আমাদের বয়স কম। এসএসসিও দিইনি আমরা। স্কুল পার করব। কলেজে যাব। তারপর ভার্সিটি। অনেকটা সময় তাই না? তোমার কি মনে হয় এই বয়সে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব? আমাদের বয়স যতটা কাঁচা, এই বয়সে নেওয়া সিদ্ধান্ত তার থেকেও বেশি কাঁচা হবে। আমি কী বলছি বুঝতে পারছো তো তুমি?’

–‘হুম।’

–‘আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি। এর থেকে বেশি কিছু না। তুমি আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে হয়তো আমার ব্যবহারও তোমার প্রতি পালটে যাবে।’

–‘তনু আমি তোমাকে…

–‘আমার বাড়ির পথ এসে গেছে। আজ তোমাকে ভালো ভাবে বুঝালাম তুহিন। এর পরও যদি তুমি বুঝতে না পরো তাহলে কিন্তু এই তনুর আসল রূপ দেখতে পারবে। আমাকে তুমি কিছুই চেনো না।’

তনু বাঁক নিয়ে বাড়ির রাস্তায় হাঁটতে লাগল। তুহিন দাঁড়িয়ে আছে নাকি চলে গেছে তনু পেছন ফিরে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না।

–‘ইহান ভাই, আপনি আমাকে জীবন সম্পর্কে কতকিছু শিখিয়ে ফেলেছেন। যে কথাগুলো আপনি আমাকে বলেন আজ আমি তা অন্য একজনকে শুনিয়ে দিলাম। কেমন হয়েছে বলুন তো? গাধাটা হয়তো ভাবছে আমি অমন পাকা পাকা কথা কোত্থেকে শিখলাম। আমার সব কিছুই তো আপনার থেকে শেখা। আপনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কথাগুলোই আমাকে বারংবার বলেছেন। আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। আপনি হয়তো এটা ভেবে বলেছেন যে, স্কুলে কোন ছেলে আমাকে পছন্দ করলে আমি যেন তার সাথে সম্পর্কে না যাই। আপনি না বললেও আমি কারো সাথে ওরকম সম্পর্কে যাব না। আমি যে শুধুই আপনার। এই কথাটা আপনি জানেন না। আমার বয়স কম। এটাই সমস্যা তো? আচ্ছা, আমি যখন বড় হবো। ইউনিভার্সিটিতে পড়ব তখনও যদি আপনাকে আমি এমন ভাবেই ভালোবাসি তাহলে কিন্তু আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। তখন আপনাকেও আমায় ভালোবাসতে হবে।’

পরের দিন তুহিন তনুকে না জানিয়ে একটা কাজ করে বসে। তনুর বইয়ের ভেতর সে একটা চিঠি রেখে দেয়। যে কথাগুলো তনুর সামনাসামনি বলার সাহস নেই তার, সেসবই চিঠিতে লিখে দিয়েছে। তনু বাড়ি গিয়ে যখন পড়বে তখন যদি তার রাগও হয় তবুও সে তুহিনকে কিছু করতে পারবে না। সময় গেলে রাগ কমবে। কিন্তু তনুর সামনে গিয়ে বলা মানে তনুর হাতে মার খাওয়া।
বাড়ি গিয়েও তনু চিঠি দেখে না। ব্যাগ খুললে তো চিঠি পাবার সম্ভাবনা আছে। সে যে স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা ছুড়ে রেখেছে তারপর আর ওতে হাত লাগায়নি।

–‘ফুলি আপা, কখনও কাউকে ভালোবেসেছ তুমি?’

তনুর কথা শুনে ফুলি কপালে ভাঁজ ফেলে তনুর দিকে তাকায়। লজ্জা পাওয়া রাঙা মুখে বলে,

–‘ছি! তুমি যে কী শরমের কথা কও না তনু!’

তনুর মজা লাগে। ফুলি আপা প্রেম ভালোবাসার কথা শুনলেই লজ্জায় পাকা টমেটো হয়ে যায়।

–‘শরম কী? বলো না কখনও কাউকে ভালো লাগেনি তোমার?’

–‘আমি জানি না। তোমার লাগছে কাউরে?’

–‘যদি বলি হ্যাঁ। তাহলে কি তুমি আমাকে খারাপ মেয়ে ভাববে?’

–‘তুমি খারাপ হইতেই পারো না তনু। তুমি অনেক ভালো মেয়ে।’

তনু এক ধ্যানে ফুলি আপাকে দেখে। কিছু ভাবে। সে কি সত্যিই ফুলি আপার ধারণার মতো ভালো মেয়ে?

–‘আমার যাকে ভালো লাগে তার আমাকে ভালো লাগে না ফুলি আপা। সে আমাকে পাত্তা দেয় না। আমার মন বুঝে না। সব সময় আমাকে কষ্ট দেয়।’

–‘আল্লাহ! কও কী এইগুলা! কোন বাপের বেডা তোমারে পাত্তা দেয় না! আমি পোলা হইলে তোমাকে বিয়া কইরা নিতাম। কতো সুন্দর তুমি। কত বুদ্ধিমতী। যে তোমারে কষ্ট দেয় সে একটা গাধা। গাধার ছাও গাধা।’

ইহান কী জন্য যেন হলরুমে এসেছিল। পেছন থেকে ফুলির কথা শুনতে পেয়ে কাশি ওঠে যায় ওর। সে গাধা! গাধার ছাও গাধা! ফুলি তার ভাইজানকে গাধা বলছে! যে ভাইজান বলতে সে অন্ধ!

–‘তাকে এসব বোলো না ফুলি আপা। আমার খারাপ লাগে। আমার সামনে তাকে কেউ কিছু বললে আমার ভালো লাগে না।’

–‘কে গো সেই ভাগ্যবান? চান কপাল তার।’

তনু ফোঁস করে দম ফেলে। গালের নিচে বাঁ হাত রেখে সোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে, ডান হাতের আঙুল দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুঁকি করছে সে। পা নাচাতে নাচাতে উদাস গলায় বলল,

–‘বলা যাবে না। আমি নাকি এখনও অনেক ছোট। প্রেম করার বয়স হয়নি আমার। সে তো আর জানে না গ্রামে আমার বয়সী মেয়েরাই দুই বাচ্চার মা হয়ে যায়। তার চোখে আমি অবুঝ শিশু। আমার ভালোবাসার কথা শুনতেই চায় না সে। তাই আমিও ঠিক করেছি। এখন আর কিছুই বলব না। আগে বড় হয়ে নিই। ভার্সিটিতে উঠি, তারপর বলব। তখনও যদি না মানে সে তাহলে…

ইহান আর দাঁড়াল না। হেঁচকি উঠতে লাগল তার। তনু ফুলির সাথে তাকে নিয়ে কথা বলছে!

–‘এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছে নাকি? দুনিয়ার সবার কাছে আমাকে নিয়ে কথা বলছে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিচ্ছে। ভালোবাসিস মনে মনে রাখ না বোন। পাড়াসুদ্ধ লোককে জানানোর কী দরকার। ঝামেলায় না ফেলে দেয় এই মেয়ে আমাকে!’

চলবে🍂

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা

চলবে🌼

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here