সুখের পাখি পর্ব -২৭+২৮

#সুখের_পাখি

২৭
তুহিন চলে যাচ্ছে। তনু চোখ বড় বড় করে ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। আজব ছেলে! ওর ফোন আছে অথচ তনু বলেছে নেই। মিথ্যে বলে সাথে সাথে ধরাও পড়ে গেল। তবুও এই নিয়ে গাধাটা তাকে কিচ্ছু বলল না! আরও বলে গেল, বন্ধু হিসেবে আমাকে সব সময় পাশে পাবে! রাগ হলো না কেন তুহিনের?
ব্যাগের ভেতর এখনও ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। কোন নাছোড়বান্দা কল করেছে কে জানে? ওর জন্য আজ তুহিন তনুকে মিথ্যাবাদী ভাবছে হয়তো। অবশ্য তুহিনের ভাবাতে ওর কিছু আসে যায় না। ফোন বের করে স্ক্রিনে মিতার নাম দেখে রাগে ফেটে পড়ল তনু। শালি কল করার আর সময় পেল না। কী টাইমিং! বাবারে বাবা! একেবারে হাতেনাতে তাকে বাঁশ খাইয়ে ছেড়েছে। যাক একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। তুহিন রাগ করে হলেও আর তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।
কল রিসিভ করেই তনু ঝাঁঝালো গলায় বলল,

–‘কে মরেছে হ্যাঁ? এভাবে কল করে যাচ্ছিস কেন? তোর জন্য আজ লজ্জা পেয়ে মারা যাচ্ছিলাম আমি। হারামির ছাও আর কক্ষনো ফোন দিবি না তুই আমাকে।’

ওপাশে মিতা হতভম্ব। তনুটার হয়েছে কী হ্যাঁ?

–‘কী হয়েছে তোর? অত রেগে যাচ্ছিস কেন তুই? আমি কী করেছি?’

–‘কী করেছিস তুই! তুই-ই তো সব করেছিস। আমার মান ইজ্জতের ইন্না-লিল্লাহ করে দিয়েছিস।’

তনু রেগেমেগেই মিতাকে সব ঘটনা বললে মিতা ফোনের ওপাশে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। কোনোমতেই হাসি থামছে না তার।

–‘উচিত হয়ে। তোর মত গাধীরা এভাবেই হাতেনাতে ধরা খায়। আরে গাধী ভুলভাল কোনো নাম্বার ধরিয়ে দিতি গাধাটাকে। বেচারা খুশি মনে বিদেশ পারি দিত। তারপর যা ইচ্ছা হতো৷ ওর খবর আর কে রাখত হ্যাঁ?’

তনুর রাগ কমে এসেছে। চিন্তিত মুখে সে বলল,

–‘ঠিকই তো। তোর মাথায় এত বুদ্ধি কেন! কিছু বুদ্ধি আল্লাহ আমাকে দিলে কী হতো?’

রাতে মেসেঞ্জারে ইহানের সাথে কথা বলার সময় তনু ইহানকে সব কথাই বলল। মিতার কথা মতো তনু প্রায় একমাত্র ধরে ইহানের সাথে অচেনা সেজে কথা বলে। নিজের পরিচয় সে ইহানকে কখনও দিবে না। ইহান অনেকদিন ঝুলিয়ে রেখে তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। ম্যাসেজও তনুই আগে দিয়েছে তাকে। রিপ্লাই দিতেও এক সপ্তাহ লাগিয়েছে ইহান। তারপর থেকে আস্তে আস্তে টুকিটাকি কথাবার্তা থেকে এখন রোজ কথা হয়। এপর্যন্ত ওরা শুধু ম্যাসেজেই কথা বলেছে। ইহান ফোনে কথা বলতে চাইলেও তনু এড়িয়ে গেছে। নানাভাবে কথা কাটিয়ে নিয়েছে। সামনাসামনি ইহান ভাইয়ের সাথে তার দেখা হয়। দরকারি কোন কথা না থাকলে, কথা তেমন হয়ই না। সামনে সামনে ইহান ভাই এরকম। মেসেঞ্জারে কথা বলার সময় আরেকরকম মনে হয়। তনুর মাঝে মাঝে মন খারাপ লাগে, রাগ হয়। ইহান ভাইয়ের ক্যারেক্টার ভালো না। নইলে কি সে অচেনা একটা মেয়ের সাথে এত কথা বলে! এটা যদি সে না হয়ে অন্য কোন মেয়ে হতো। তার সাথেও তো তাহলে ইহান ভাই এরকম ভাবেই কথা বলত। কেমন মানুষ উনি হ্যাঁ? রাগ হলেও একদিন কথা না বলে থাকতে পারে না তনু। ইহানকে সে নিজের পরিচয় না দিলেও ইহান তাকে সবই সত্যি বলেছে। তনু জানে এটা সে। কিন্তু ইহান তো আর জানে না সে যার সাথে কথা বলছে সে আর কেউ না, তনু।

–‘ওই ছেলের জন্য মন খারাপ হচ্ছে তোমার?’

–‘না। তবে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।’

–‘ছেলেটা তোমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমিও ওকে পছন্দ করো।’

–‘আরে না, না। আমি ওকে পছন্দ করি না। ওকে পছন্দ করার প্রশ্নই আসে না।’

–‘কেন? তোমার পছন্দের অন্য কেউ আছে নাকি?’

তনু ভাবনায় পড়ে গেল। বলবে সে ইহান ভাইকে? বললেই বা সমস্যা কী? ইহান ভাই তো আর জানতে পারবে না তনু কার কথা বলছে।

–‘থাকতে পারে না বুঝি?’

–‘আছে?’

–‘আমার পছন্দের মানুষ থাকতে মানা?’

–‘কে সে?’

–‘বলা যাবে না। সিক্রেট।’

–‘আমরা না বন্ধু!’

–‘হুম।’

–‘তাহলে বন্ধুদের মাঝে সিক্রেট কিসের?’

তনুর সুযোগ বুঝে কোপ বসিয়ে দিল।

–‘তাহলে তো বলতে পারি আমিও আপনার সিক্রেট জানি না।’

–‘আমার কোন সিক্রেট নেই।’

–‘হতেই পারে না।’

–‘বিশ্বাস করছো না তো!’

–‘না।’

–‘তাহলে তুমিই বলো আমার কী সিক্রেট আছে।’

–‘আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে। অথচ তার সম্পর্কে আপনি আমাকে কিছুই জানাননি।’

–‘আমার গার্লফ্রেন্ড নেই তনু…

তনু টাইপ করেও ইহান কেটে দিল। উঁহু, তনু লিখা যাবে না। তাহলে তনু বুঝে ফেলবে ইহান সব জানে। কিছুই জানে না সে এমন ভান করে যেতে হবে তাকে। এই মেয়েটা সত্যিই পাগল। এক মাস ধরে ইহানের পেট থেকে কথা বের করতে চাইছে। নিজের পরিচয়, পিক দিচ্ছে না। কলে কথাও বলতে চাইছে না। সে কী ভেবেছে ইহান বুঝতে পারবে না এটা কে! ইহান তনুকে ধরতে পারবে না! এতটাই বোকা ভেবেছে সে ইহানকে! এমন ছেলেমানুষি তনু ছাড়া আর কে করবে? এটা যে তনু তা ইহান প্রথম দিন থেকেই জানত। প্রথম দিকে শিওর না থাকলেও এক দু’দিন কথা বলার পরই শিওর হয়েছে। তবুও ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কথা চালিয়ে গেছে। তনুর সামনে পড়লে ইহান এমন ভাব করে যেন তনুর চালাকি সে ধরতে অক্ষম। মাঝে মাঝে হাসি পায় তার। একা একা হাসেও অনেক সময়। তনু যেন তাকে কী নাম বলেছিল? হ্যাঁ, মুনতাহা। ইহান ইচ্ছে করেই তনুকে খেপাতে চাইল।

–‘কোন গার্লফ্রেন্ড এর বিষয়ে জানতে চাও বলো। যা জানতে চাইবে সব বলব।’

সাথে সাথে তনুর রিপ্লাই এলো,

–‘কোন গার্লফ্রেন্ড মানে! আপনার গার্লফ্রেন্ড কয়টা?’

–‘দুই তিনটার কমে না। তুমি কয় নাম্বারটার কথা জানতে চাও?’

–‘আপনার দুই তিনটা গার্লফ্রেন্ড!’

–‘তার বেশিও হতে পারে। বর্তমানে তিনটা আছে। বাকি গুলার সাথে ব্রেকআপ হয়ে গেছে।’

–‘বাকি গুলা মানে! আপনার এক্সের সংখ্যা কত?’

–‘সাত, আট ছাড়িয়ে যেতে পারে। দশের বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। অত জনের কথা মনে থাকে না বুঝছো। স্মৃতিশক্তি দুর্বল। অনেক কিছুই ভুলে যাই। অনেক জনের তো নাম, চেহারা কিছুই মনে নেই।’

রাগে তনুর ফোনটা ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বেঁচে আছে কেন সে? মরে যাচ্ছে না কেন? ইহান ভাইয়ের নাকি তিনটা গার্লফ্রেন্ড! এই কথাও বেঁচে থেকে শুনতে হচ্ছে তাকে! এক্স নাকি দশটার উপরে। এই ছেলের তো সত্যিই চরিত্রের ঠিক নেই।

–‘তনু!’

পেছন থেকে ইহানের গলা পেয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে তনুর। লাফিয়ে ইহানের দিকে ফিরে সে। ইহান তনুর সাথে মজা নেওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে ম্যাসেজ করতে করতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তনু তার সাথে চ্যাটিং করছে, সে পেছন থেকে গিয়ে তনুকে চমকে দিবে। যেমন ভাবা তেমনই ঘটেছে। তনুর মুখ দেখে পেট ফেটে হাসি আসছে তার। তনু ভূত দেখার মতো ইহানকে দেখছে। তার মনে ভয় কাজ করছে ইহান ভাই কি তাকে ধরে ফেলেছে? নইলে হঠাৎ তার ঘরে এসেছে কেন?
তনুর হাতে ফোন দেখে ইহান কপালে বিরক্তির রেখা ফুটিয়ে বলল,

–‘সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে নাকি? পড়াশোনা কতদূর এগিয়েছে? কলেজে যাচ্ছ ঠিকমতো?’

যান্ত্রিক পুতুলের মতো তনু একপাশে মাথা কাত করে জানাল সে কলেজে যাচ্ছে। পড়াশোনাও ভালোই হচ্ছে। ইহান তনুর সামনে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকার রিস্ক নিল না। যেকোনো মুহূর্তে সে ফোঁস করে হেসে ফেলতে পারে। মুখে আলগা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে ইহান বলল,

–‘ফেসবুক টেসবুক বাদ দিয়ে এখন পড়াশোনায় মনযোগ দাও। ওসব চালানোর জন্য এখনও আরও অনেক সময় পড়ে আছে, বুঝেছ?’

–‘হু।’

চলে এলো ইহান। আড়ালে এসেই পকেট থেকে ফোন বের করে তনুকে মেসেজ দিল। একা একাই হাসছে সে। এই মেয়ে যতদিন তার জীবনে আছে ততদিন মন খারাপ হতে পারবে না তার। তনুটা এমন কেন? তাকে দেখে মুখ থেকে কেমন রক্ত নেমে গেছে। ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল পুরা। তাকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে? এত লুকোচুরি না করে সামনে এসে বলে দিয়েই তো পারে, ইহান ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি।
ইহান নিজেকে কড়া করে ধমক দিল।

–‘ইহান, কী ভাবছিস তুই এসব? তনুর সাথে সাথে তুইও পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি? মন থেকে এসব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেল বাবা। ও মেয়ে পাগল। তুই তো সুস্থ।’

সেদিন তনু কলেজ থেকে ফিরে দেখে বাড়িতে নতুন একটা মানুষ এসেছে। তনু জানত না বসার ঘরে মানুষটা বসে আছে। সে মনের সুখে হেলেদুলে দরজা দিয়ে ঢুকে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কে এই লোক? আগে তো কখনও দেখেনি। তনু ব্যাগ কাঁধে না ঝুলিয়ে সামনে দিয়ে বুকের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল। মাথার দুই পাশের দুই বিনুনি ধরে চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটাও তাকেই দেখছে।
ফুলির গলা পাওয়া গেল।

–‘ভাইজান, আপনি এখানে বইসা আছেন কেন? ঘরে যান না।’

সাদাফ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। মা তাকে এক ফোঁটাও বাড়িয়ে বলেনি। বরং তনুকে দেখে মনে হচ্ছে মা ওর সম্পর্কে যা বলেছে তা কমই।
সে দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থেকে এসেছে। সেখানে কত মিনি স্কার্ট মেয়েদের সাথে মেলামেশা করেছে। সবার গায়ের চামড়া সাদা হলেও কোন মেয়ে এই মেয়ের ধারের কাছেও ঘেঁষার যোগ্য না। তনুর মধ্যে এমন কিছু আছে যা তনুকে বাকি সবার থেকে আলাদা করেছে। সাদাফ মনে মনে মা’র পছন্দের উপর কতটা খুশি হলো তা সে বলে বুঝাতে পারবে না। মা’কে বলতে হবে, বিয়ে করবে সে। তনুকে বিয়ে করতে তার কোনো আপত্তি নেই।

–‘মা তুমি সব সময় আমার জন্য পারফেক্ট জিনিসই বেছে নিয়েছ। বউমা বাছতেও তুমি পৃথিবীর সবথেকে মায়াবতী মেয়েটাকে খুঁজে নিয়েছ। আমার কী লাগবে তা তুমি আমার থেকে ভালো জানো। থ্যাঙ্কস মা। আমি তোমার পছন্দের উপর সন্দেহ করেছিলাম। আমি তনুকেই বিয়ে করব। শুধু বিয়েই করব না, সকাল দুপুর ওর পায়ের কাছে বসে থাকব। ওকে রেখে কোত্থাও যাব না৷ চুলোয় যাক ক্যারিয়ার।’#সুখের_পাখি

২৮
–‘আমি তনুকেই বিয়ে করব মা। তুমি যেদিন বলবে সেদিনই করব। বাবাকেও বলে দাও আমি বিয়েতে রাজি।’

ওপাশ থেকে রাশেদা হাসলো। ছেলের পাগলামি দেখে উনার হাসিই পাচ্ছে। এখন এই কথা বলছে। অথচ ওখানে যাওয়ার আগেও অন্য কথা বলেছে। রাশেদা বাড়ি আসার দুই দিন পরই সাদাফ বাড়ি আসে। ও আসার পরে কয়েকটা দিন এভাবেই কেটে যায়। রাশেদা ছেলের বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা তুলে না। কারণ ছেলে এক শর্তেই দেশে এসেছে। এবার সে কোন মতেই বিয়ে করবে না। মা তাকে বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করতে পারবে না। রাশেদা অনেক কায়দা করে ছেলেকে তনুর কথা জানায়। তবুও সাদাফ বেঁকে বসেছিল।

–‘তুই অন্তত একটা বার তোর মামার বাড়ি গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আয়। তারপরও যদি বলিস আমি বিয়ে করব না, তাহলে আমার আর কোন আপত্তি নেই। তনুকে তোর পছন্দ না হলে আমি তোকে একটুও জোর করব না।’

–‘আমি তবুও ওই মেয়েকে দেখতে যাব না মা।’

–‘আচ্ছা মেয়ে দেখতে না গেলি তোর মামী, মামাতো ভাইকে দেখে আসবি। কত বছর পর দেশে ফিরলি। ওদের সাথে তো অনেকদিন দেখা হয় না।’

–‘তুমি বড় নাছোড়বান্দা মা। কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। তোমার কথা যতক্ষণ না মানব ততক্ষণ তুমি জ্বালিয়ে যাবে। আচ্ছা যাব। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।’

রাশেদা উৎসুক গলায় বলেন,

–‘কী শর্ত বল।’

সাদাফ বিরক্ত হয়। মুখ বাঁকিয়ে বলে,

–‘বলেও লাভ নেই। বিয়ে করব না শর্তেই দেশে এসেছিলাম। আসার পর একটা সপ্তাহ মাত্র শান্তি দিয়েছ। তারপর থেকেই বিয়ের প্যাঁচাল।’

–‘আমি কি তোর খারাপ চাই?’

–‘পৃথিবীর কোন বাবা মা’ই তা চাইবে না।’

–‘তনুকে দেখিস নি বলেই এত কথা বলতে পারছিস। ওকে দেখার পর আমার হাতে পায়ে ধরে বিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঠিক করতে বলবি।’

–‘হুহ্, পাগলে কামড়াইছে আমারে।’

–‘কামড়াবে। দেখিস তুই।’

–‘আচ্ছা দেখা যাবে। তুমি কিন্তু আগে থেকে কাউকে কিছু বলতে পারবে না। ইভেন মামীকেও না। আমি অনুমতি দিলে তবেই সামনে আগাবে তুমি। আমি চাই না এসব কথা উঠে ওই মেয়ের জন্যও পরিস্থিতি গোলমেলে হোক।’

–‘হু।’

রাশেদা আগের কথাগুলো মনে করে ছেলেকে টানা দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করল না। সাদাফ লজ্জা পেয়ে মিনমিনে গলায় বলল,

–‘তখন কি আর জানতাম নাকি আমার মা আমার জন্য মেয়ে না, একটা পরী পছন্দ করে রেখেছে।’

রাশেদা শব্দ করেই হেসে ফেলল।

–‘তুমি আমাকে তনুর বর্ণনা দিতে কৃপণতা করেছ। আমি মনে মনে যেমন কল্পনা করেছিলাম তনু মোটেও তেমন না। ও সত্যিই একটি আদর্শ বাঙালি মেয়ে। ভীষণ মিশুক। চটপটে, খোলামেলা মনের।’

–‘হয়েছে, হয়েছে। আমি জানি তনু কেমন। ওর কথা আর আমাকে শুনাতে হবে না। এখন বল সাবিনার কাছে তোর জন্য তনুর হাত কবে চাইতে যাব? বাড়ি আসবি তুই? নাকি আমি ওখানে যাব?’

–‘এখন না মা। আমার এত তাড়া নেই। আমি তনুকে কিছুটা সময় দিতে চাই। আমি চাই না জোর করে ওর উপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হোক। মামী বললে তনু কখনও মামীর কথা অমান্য করবে না। আমি ওকে বাধ্য করতে চাই না। তনু মন থেকে রাজি হলে তবেই বিয়েটা হবে। কিছুদিন যাক। ও আগে আমাকে বুঝুক। আমাদের ওদের মাঝে ভালো একটা বন্ডিং তৈরি হবে। তারপর বিয়ের কথা।’

–‘আচ্ছা। মেয়েটা সত্যিই জাদু জানে। সবাইকে কেমন নিজের মায়ায় ফেলে দেয়৷ ওর বাবা মা নেই এইজন্য করুণা করে আমি ওকে তোর বউ করতে চাইছি না। তনু তোর বউ হলে তুই কোনদিনও অসুখী হবি না। এটা আমি ভালো করেই জানি। সাবিনা মানুষ চিনতে ভুল করেনি৷ কিন্তু আফসোস এই ভালো মেয়ের বাবার সাথে আমি দেখা করতে পারলাম না। মানুষটা মেয়েকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি। পরপারে ভালো থাকুক উনি।’

ইহান বাড়ি ফিরে সাদাফকে দেখে। অনেক বছর পর দেখা। সাদাফ ভাই একটুও পাল্টায় নি। আগের মতই আছে। সাদাফ ইহানকে দেখে একগাল হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে। হাসি হাসি মুখেই বলে,

–‘কিরে ছোট, কেমন আছিস তুই? অবশ্য তোকে এখন ছোট বলা যাবে না। তুই তো দেখছি আমার থেকেও বড় ব্যাটা হয়ে গেছিস। রাগটা আগেই মতই আছে নাকি? তোকে ‘ছোট’ বলায় খেপে মারতে আসতিস। মনে আছে ওসব?’

ইহান হাসল৷ সাদাফ ভাই আহান ভাইয়ের এক বছরের বড়। তার থেকে দুই বছরের বড়। তবুও ওদের পেছনে এমন ভাবে লাগত!

–‘কখন এসেছ তুমি?’

–‘অনেকক্ষণই তো হলো। কী শুনছি ভাই? লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে খুব নাকি গান বাজনা নিয়ে পড়েছিস! অবশ্য ভালোই করেছিস৷ কলেজের সময় আমার মাথাতেও এই ভূত চেপেছিল। কিন্তু তোর রাগী ফুপুর জন্য সুবিধা করতে পারিনি।’

ইহান সাদাফকে নিয়ে ওর রুমে গেল। ওরা অনেক কথাই বলল। সাদাফ জিজ্ঞেস করল,

–‘তা কোনো মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে কথা হয়েছে? প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হবে। নতুন সিঙ্গারদের কেউ সুযোগ দিতে চায় না। একটা হিট গান দিয়ে দিতে পারলেই ওসব সমস্যা সমাধান। লোকে তোর বাড়ির সামনে লাইন দিবে।’

ওরা সবাই একসাথে বসে রাতে খেলো। সাদাফ রাশেদা ফুপ্পির ছেলে। এটা জেনে তনুর জড়তা কেটে গেছে। সে সাদাফ ভাই, সাদাফ ভাই ডেকে ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। ভাই কেন তনু? তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকো না। বলতে গিয়েও সাদাফ আটকে গেছে। সে নিজেকে এতদিন অতন্ত্য সাহসী ভাবতো। আজ তনুর সামনে সব সাহস উড়ে গেছে। প্রথম দেখায়ই মেয়েটার প্রেমে পড়েছে সে। আর প্রেমে পড়ে দুই ঘন্টাও হয়নি। তার মধ্যেই বাঘ থেকে বিড়াল হয়ে গেছে। সাদাফ তনুর মুখে ভাই ডাক মেনে নিতে না পারলেও মুখে কিছুই বলতে পারছে না। মুখে হাসি নিয়ে তাকে তনুর সাথে বিদেশের গল্প করে যেতে হচ্ছে। মেয়েটা একটু বাচাল৷ তবে মনটা শিশুর মতন। সাদাফ সত্যি সত্যিই তনুর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। তনু বলল,

–‘ও দেশে কেউ কাউকে বাধা দেয় না? যার যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে?’

–‘বাইরের সব কয়টা দেশেই তো এমন।’

–‘ফুপ্পি বলছিল আপনি নাকি বিয়ে করতে দেশে আসছেন। ওখানে আপনার কোন গার্লফ্রেন্ড ছিল না? দেশের মেয়েকে কেন বিয়ে করবেন?’

ইহান মনে মনে তনুর উপর বিরক্ত হচ্ছে। সাদাফ ভাই কি তার মায়ের পেটের ভাই নাকি? আজই তো চেনাজানা হলো। তনু এমন ভাবে ভাই, ভাই করে গায়ে পড়ে গল্প করছে ইহানের চুপ করে থাকা কষ্ট হচ্ছে। সাদাফ ভাইকে পেয়ে তো তনু তাকে ভুলেই গেছে। তার দিকে একটা বার তাকাবে তো দূর তার অস্তিত্বই যেন ভুলে গেছে। এটাই নাকি ভালোবাসা! কটমট চোখে ইহান তনুর দিকে চেয়ে মনে মনে বলল,

–‘সাদাফ ভাই! এত কথা! এত গল্প! কই কখনও আমার সাথে তো এভাবে এত কথা বলোনি। আমার সামনে পড়লে মুখে তালা লাগে কেন? আর এই হাসিখুশি ভাব কোথায় যায়? আমার সাথে কথা বলার সময় মুখ তো দেখি অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার হয়ে যায়। ফাজিল মেয়ে একটা।’

–‘আচ্ছা আপনার যেহেতু গার্লফ্রেন্ড নেই। তাহলে আমার ফ্রেন্ড’দের থেকে কাউকে খুঁজে দেব।’

সাদাফ এক ধ্যানে তনুর কথা বলার ধরন দেখছে। ঠোঁটের নাড়ানোর সাথে সাথে কপালে নানা ভঙ্গিতে ভাঁজ পড়ে। নাকের পাশটা ফোলে উঠে। কথার ছন্দে হাত নাড়ানো তো চলছেই।

–‘আপনার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দিবেন তো সাদাফ ভাই?’

–‘ভাই ডেকো না তনু। ডেকো না ভাই। তোমার মুখে ভাই ডাক আমার কলিজায় গিয়ে বিঁধে।’

–‘কী হলো, দাওয়াত দিবেন না?’

সাদাফ অপ্রস্তুত হাসল। বলল,

–‘তোমাকে দাওয়াত না দিলে আমার বিয়েই হবে না। তুমি থাকবে এক নাম্বার গেস্ট।’ এটুকু জোরে বলে বিড়বিড় করে বলল, ‘ও কনে। কনে না থাকলে বিয়েটা কাকে করব আমি?’

ইহান সাদাফের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝে নিল। মুহুর্তে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। আশেপাশের সবকিছু অসহ্য লাগতে লাগল। এটা ঠিক হচ্ছে না। তনু বুঝতে পারছে না। সাদাফ ভাই অন্য উদেশ্য নিয়ে এবাড়িতে এসেছে। ওর এবারের আসার উদেশ্য শুধু বেড়ানো নয়। ফুপ্পিও তনুকে শেষ দিকে একটু বেশিই পছন্দ করে ফেলেছিস। ইহান যা ভাবছে তেমনটাই হতে যাচ্ছে। সাদাফ ভাইও তনুকে পছন্দ করে ফেলেছে। তনু এতটাই গাধা সাদাফ ভাইয়ের চোখ দেখেও ও কিছুই বুঝতে পারছে না। উল্টো ভাই ডেকে মন খুলে গল্প করে যাচ্ছে।
ইহানের হঠাৎ মনে হচ্ছে ওর ভীষণ মূল্যবান কোনো একটা জিনিস হারিয়ে গেছে। সাদাফ ভাই ছেলে হিসেবে কারো অপছন্দ হবার মতো না। দেখতে শুনতে, লেখাপড়ায়, চরিত্রে, লাইফে সেটেল্ড। বিয়ের পর বউ নিয়ে চলে যাবে। কারো আপত্তি থাকার প্রশ্নই আসে না। সাদাফ ভাই কি সত্যিই তনুকে বিয়ে করবে? আচ্ছা তনু রাজি হবে? উঁহু, ও কখনও রাজি হবে না। অথচ হওয়া উচিত। সাদাফ ভাই তনুকে ভালো রাখবে। ইহানের বুকের ভেতর এমন লাগছে কেন? অস্থির লাগছে৷ বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।
তনুর ভালোর জন্য ইহানের উচিত ওদের মাঝখান থেকে সরে আসা। যা হচ্ছে তা হতে দেওয়া। তনুকে বাধা দিবে না সে। সাদাফ ভাই ভালো ছেলে। অন্তত তার থেকে একশো গুণ ভালো। ইহান উঠে চলে গেল। তনু একবার ইহানকে যেতে দেখল। তারপর আবার সাদাফের সাথে গল্প করতে লাগল।

চলবে🍃
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here