#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃআহানিতা
বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টুকু দেখছিলাম কেবল।কখন এই বাসা থেকে বেরোনো যায় সেটাই একপ্রকার চিন্তা এখন।হঠাৎই খাবার খাওয়ার জন্য ডাক পড়তেই সবাই গিয়ে খাওয়ার টেবিলে হাজির হলো।আমিও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।টেবিলে ঠিক আমার মুখোমুখি বসলেন অর্কভাই।এবার যেন অস্বস্তিতে দমে উঠল আমার মন।উনার দিকে তাকানোর সাহস করে উঠতে না পেরেই খাবার খাওয়ায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা চালালাম দ্রুত।কিন্তু অবাধ্য চোখ জোড়া কি এত সহজে হার মানে?আমি না চাওয়া স্বত্ত্বেও চোখজোড়া উনার দিকেই দৃষ্টি ফেলল।তখন ও কোন সমস্যা ছিল নাহ কিন্তু যখন দেখলাম উনিও আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন তখনই অস্বস্তিতে হাত পা ঘেমেউঠল।খাবার যেন আর গলা দিয়ে নামছে নাহ।চোখজোড়া চোখাচোখি হতেই আমি তৎক্ষনাৎ চোখ সরালাম।যেন কোন এক যুদ্ধ থেকে পলাতক কোন যোদ্ধা আমি।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মুখে এক গ্রাস খাবার দিয়েই আবারো তাকালাম উনার দিকে।উনি ঠিক সেভাবেই স্থির ভাবে তাকিয়ে ছিলেন।আমি দ্বিতীয়বার অস্বস্তিতে চটফটিয়ে উঠলাম।বিরক্ত যেন মাথার মধ্যে ভনভন করে উঠল। খাবার নিয়ে ঠিক সেভাবেই বসে রইলাম।আর কোন খাবার গলা দিয়ে নামল না আমার।উনি যে ঠিক সেভাবেই চোখ স্থির করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা বুঝতে পেরেই চোখ নামিয়ে তাকিয়ে রইলাম।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কেবল এই চেয়ারটা ছেড়ে উঠার অপেক্ষা!
ঠিক তখনই আহি বলে উঠল,
‘ এমাহ!মেহুল আপু?খাচ্ছো না কেন তুমি?’
আমি ড্যাবড্যাব করে তাকালাম আহির দিকে।আড়চোখে অর্কভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উনাকে সেভাবেই থাকতে দেখে দ্রুত চোখ সরালাম আবার।হালকা কেঁশেই বলে উঠলাম,
‘ এমনি, এমনিই।’
মেঘা বা হাত দিয়ে গুতা দিয়েই পাশ ফিরে চাইল আমার দিকে।ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ এমনিই?’
আমি কোনভাবে উত্তর দিলাম কেবল,
‘ হু।’
তারপর অবশ্য মেঘা আর কোন কথা বলল না।ও ওর মতো খেতে লাগল।অর্কভাই আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেই হয়তো মুচকি হাসলেন।আমি আরেকবার তাকাতেই চোখ টিপে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়েই বাঁকা হাসলেন উনি।আমি আর এক মুহুর্তও বসে না থেকে সোজা উঠে দাঁড়ালাম।লজ্জ্বা পাচ্ছি কিনা বোধগম্য নয় আমার। কিন্তু হাত পা হালকা কাঁপছে আমার।অস্বস্তি, লজ্জ্বা সব যেন একসাথেই কাজ করতে লাগল।তাই উঠে পড়েই হাত ধুঁয়ে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।আন্টিকে গিয়ে কিচেনে খুঁজেই বলে উঠলাম,
‘ আন্টি খাওয়া শেষ।আমি যাচ্ছি তবে?দেরি হয়ে যাবে।’
উনি মৃদু হেসেই বলে উঠলেন,
‘ উহ! এত তাড়া কীসের তোর?মেঘা তো ইহানের সাথে যাবে তাহলে তুই তো একা।’
আমি দ্রুত বললাম,
‘ সমস্যা নেই আন্টি।আমি পারব। পারব যেতে।’
আন্টি আমার কথাটাকে সেভাবে না নিয়েই বলে উঠলেন,
‘ উহ।চুপ করে বস তো গিয়ে।মাত্র তো খেলি।একটু বসে তারপর যাবি।অর্ক পৌঁছে দেবে।ওর তো আজ অফিস নেই।ফ্রীই আছে।তুই একা যাওয়ার থেকে অর্ক পৌঁছে দেওয়াই বেটার না মা?’
আমি মুখ কালো করেই বলে উঠলাম,
‘ নাহ আন্টি।আমি একা যেতে পারব আন্টি।’
‘ চুপ কর তো।গিয়ে বস।অর্ক পৌঁছে দেবে।বড়দের কথার উপর কথা বলতে নেই জানিস তো?’
আমি অসহায় চোখে চাইলাম কেবল।তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে।
.
দুপুরের তড়তড়ে রোদটা এখন আর নেই।হালকা পিনপিনে বাতাস বইছে চারপাশে।পাশেই অর্কভাই বেশ আরাম করে বসে ড্রাইভ করছেন।হেলেদুলে থাকা সূর্যের একটু আলো গাড়ির গ্লাস ভেদ করে এসে পড়ল উনার মুখে।আমি স্তব্ধ হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম।এক ধ্যানে তাঁকিয়ে উনার কপালে পড়া চুল, খোঁচা দাঁড়ি আর চোখজোড়া দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।কিন্তু হঠাৎ ঐ ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন অর্কভাই।বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম চলে এসেছি। নেমে পড়ার আগেই উনি আমার দিকে তাকিয়েই কড়া গলায় বলে উঠলেন,
‘ এভাবে হাবার মতো তাকিয়ে আছিস কেন তুই?’
আমি দ্রুত চোখ সরালাম।কাঁপা কন্ঠে দ্রুত মিথ্যে বলে উঠলাম,
‘ ক্ ক্ কী বলছেন?আমি?’
উনি বাঁকা হাসলেন।ভ্রু উঁচু করে বললেন,
‘ অবশ্যই তুই।এখানে কি অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছিস তুই?’
‘ ক্ কই নাহ তো।আমি তো ওপাশের রাস্তাটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।’
উনি সেভাবে থেকেই বললেন,
‘ তাই নাকি?লুকিং গ্লাসে বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল তুই যে ওপাশের রাস্তাটা দেখছিলি।কিন্তু আই হ্যাভ এ ডিপ কোইশ্চেন মিস মেহুলতা।কোনভাবে আমার প্রেমে টেমে পড়ে যান নি তো?তাহলে কিন্তু সাংঘাতিক বিষয় হয়ে যাবে।খুব সাংঘাতিক।’
কথাটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলেন উনি।আমি চোরের মতো দৃষ্টি সরিয়ে লজ্জ্বায় কাচুমাচু করে বসে রইলাম।আমি যে বারংবার ধরা পড়ে যাচ্ছি তা বেশ বুঝতে পারছি।মাথা নিচু করে বসে থাকার এক পর্যায়েই উনি ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলে উঠলেন,
‘ এত লজ্জ্বা কি তোকে মানায়?’
আমি বিস্ফোরিত চোখে চাইলাম।আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
‘ ল্ লজ্জ্বা?’
উনি মৃদু হাসলেন।হাতের ঘড়িতে সময় দেখেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ।লজ্জ্বা। লজ্জ্বায় তোর মুখ লালরাঙ্গা হয়ে আছে।বিশ্বাস করিস না?আয়নায় দেখ।’
আমি চোখ তুলে সামনের আয়নাটায় তাকালাম।উনি লুকিং গ্লাসে নিরন্তর ভাবে চেয়ে আছেন।উনার দৃষ্টির এই চাহনিতে বারবার আমার হৃদয় কম্পিত হলো যেন।বারবার উনার চোখে চোখ পড়তেই যেন এক গাঁধা অস্বস্তি এসে ভর করল আমার মধ্যে।আমি হাত জোড়া বারংবার কছলে নিয়ে মাথা তুলে বললাম,
‘ ক্ কই নাহ তো।মিথ্যে বলছেন আপনি।’
উনি নিঃশব্দে হাসলেন।তারপরই বললেন,
‘ মিথ্যে তো তুই বলছিস।ভালোবাসা কি মিথ্যে বলতে শেখায় মিস মেহুলতা?শেষ পর্যন্ত প্রেমে ট্রেমে পড়ে গড়গড় করে মিথ্যা বলা শিখে গেলি মেহুল?তাও পাক্কা মিথ্যুকের মতো মিথ্যে বলা?আ’ম ভেরি শক্ড!’
‘ মিথ্যা?কি মিথ্যে বলছি আমি?’
উনি আমার দিকে হালকা ঝুকলেন।তৎক্ষনাৎ নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হওয়ার প্রয়াস আমার।চোখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই উনি বলে উঠলেন,
‘ যদি বলি সব মিথ্যে? যদি বলি এতক্ষন পর্যন্ত বলা সব কথা মিথ্যে তোর?যদি বলি তুই সবটা মিথ্যে বলছিস?সত্যতার কোন প্রমাণ কি অাধো আছে তোর কাছে?আমার কাছে কিন্তু সবটার প্রমাণ আছে।’
আমি তৎক্ষনাৎ কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলাম,
‘ প্ প্রমাণ?কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?কি প্রমাণ?কোন প্রমাণ নেই আপনার কাছে।’
উনি হাসলেন।আমার দিকে আরেকটু ঝুকেই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘ এই যে আমার চোখজোড়া।এই যে আমার হৃদয়।এই যে তোর অনুভূতি।তোর লালাভ মুখটা কিন্তু আমার চোখজোড়া একমুহুর্তেই ধরে নিয়েছে।তুই কি ঐ চোখজোড়াকে প্রমাণ হিসেবে ধরবি না?এই যে তুই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি সবটা পথ তাও কিন্তু আমার ঐ চোখজোড়ায় ধরে নিল।তুই কি বলতে চাস আমার চোখজোড়া প্রত্যক্ষ সাক্ষী নয় তার?এই যে তুই ভালো্…’
কথাটা বলতে লেগেই উনি থেমে গেলেন আবার।তারপর একটা নিঃশ্বাস নিয়েই আবার বললেন,
‘ এই যে তুই আমায় ভালোবাসিস। এটা কিন্তু আমার হৃদয় বেশ ভালোই বুঝে। বুঝলি?এই যে আমাকে নিয়ে তোর অনুভূতি তাও তো আমি বেশ বুঝে নিয়েছি।অথচ তুই বললি আমায় ভালোবাসিস নাহ।এটা কি ঢের মিথ্যে বলা নয়?তাও বলবি আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই?এসব প্রমাণ কি যথেষ্ট নয় তোকে মিথ্যুক প্রমাণ করতে?’
আমি স্থির চোখে চেয়ে রইলাম।উনি একটু বেশি ঝোকায় উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ল আমার ঘাড়ে।কানের কাছে উনার ফিসফিসানো কন্ঠটা বারংবার বাঁজতে লাগল কেবল।উনি লুকিং গ্লাসে একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কয়েক সেকেন্ড পর চোখ বন্ধ করেই সিটে হেলান দিয়ে বসলেন।আমি উনার দিকে সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম।উনি চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠলেন মৃদু কন্ঠে,
‘ একবার বলবি ভালোবাসি?’
আমি নির্বাক হয়ে তাকালাম।উনি করুন চাহনিতে তাকিয়েই বললেন আবারও,
‘ বলবি একবার? “ভালোবাসি” শব্দটা?’
আমি হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকিয়েই বললাম,
‘ মানে?’
উনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘ ওকে নো প্রবলেম। বলিস নাহ।জোর করছ নাহ।কিন্তু একদিন আসবে অবশ্যই যেদিন তুই আমায় ভালোবাসি বলবি।রাইট? ‘
আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে বসে রইলাম নাহ।দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে তড়িগড়ি করে পা বাড়ালাম ওখান থেকে।যার ফলে অর্কভাইকে বাই বলার প্রয়োজন বোধ ও করলাম না।উনার দিকে পেছন ফিরে দ্বিতীয়বার তাকালাম ও না।
#চলবে…..
[কেমন হয়েছে জানাবেন❤️❤️]