এক মুঠো প্রেম পর্ব -৩৬+৩৭+৩৮+৩৯+৪০+শেষ

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৬

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। প্রণবের কথার মানে সে বুঝে উঠতে পারছে না। মিসেস সামায়রার প্ল্যান ফ্লপ হওয়ার পেছনে প্রণবের হাত ছিল? কিন্তু প্রণব তো তাকে তখন চিনত-ই না! আর৷ মিসেস সামায়রার প্ল্যান ফ্লপ হলো কীভাবে? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে অবশেষে প্রশ্ন করেই ফেললো সে,

-আপনি আমায় আগে থেকে চেনেন?

প্রণব কথার মাঝে প্রশ্ন শুনে ঈষৎ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। পরমুহূর্তেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের কথার গতি অব্যাহত রেখে বললো,

-মিসেস নিস্তব্ধতার অপারেশনে অনেক কমপ্লিকেশন্স ছিল। আর এধরণের কেসগুলো ডক্টর রিশাদ হ্যান্ডেল করতেন। কিন্তু তিনি সেদিন দেশে ছিলেন না। এই সুযোগটাই আমি কাজে লাগাই। এক্সপেরিয়েন্সড্ ডক্টর হিসেবে মাকে ওটিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। মা যখন অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করলো, তখন তাকে বলা হয়েছে তিনি যেন অর্গান কেটে বা অন্য কোনো উপায়ে পেশেন্টের মাতৃত্ব নষ্ট করে দিতে। মা সম্মতি জানালেও তেমন কিছুই তিনি করেননি। আমার কথা মতো কৌশলে কাউকে কিছু বুঝতেও দেননি আর কেউ জানতেও পারেনি যে, স্পৃহার মাতৃত্ব নষ্ট হয়নি। বরং সবাইকে ভুল তথ্য দেওয়া হয় যে, স্পৃহা কখনো মা হতে পারবে না।

স্পৃহা থমকালো। তার মানে, সে এতোদিন ভুল জানতো! তার জীবনটা পুরোপুরি নিঃস্ব না। ভাবতেই চোখে পানি চলে এলো ওর। না চাইতেও মনের কোণে একটু শান্তির আভাস পেল স্পৃহা। সর্বাঙ্গে অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভূত হচ্ছে।

প্রণবের কথা শেষ হতেই মিসেস মেহরীন বললেন,

-সেদিন জানতাম না, আমার ছেলে একটা বিবাহিতা মেয়ের জন্য এসব কিছু কেন করছে! আজও জানি না ও স্পৃহাকে কীভাবে চেনে। আর জানতে চাইও না। তবে এটা আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, স্পৃহার অপ্রাপ্তির সাথে প্রাপ্তির হিসেব মেলালে স্পৃহার জীবন ধন্য। যতোবারই স্পৃহা আঘাত পেয়েছে, বিপদে পড়েছে, ততবারই প্রণব ওকে দূর থেকে বা কাছে থেকে আগলে রেখেছে। এর চেয়ে চাওয়ার কিছু কি একটা মেয়ের আদৌ আছে?

প্রণব বিরক্ত হলো। মিসেস মেহরীনের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো,

-স্টপ ইট, মা! এসব এখানে বলার কোনো দরকার নেই।

-কেন বলবেন না উনি? উনি তো ভুল কিছু বলেননি!!

স্পন্দনের কথা শুনে প্রণব খানিকটা চমকে উঠলো। মনে মনে ভীতি নিয়ে ওর দিকে তাকালো। যদিও ভয়টা ওপর দিয়ে প্রকাশ করলো না। ভয়ের কারণ একটাই- স্পন্দনকে সে এতোদিন মিথ্যে বলেছে। স্পৃহা তার সাথেই ছিল, অথচ ও বলেছে স্পৃহাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। যদিও স্পন্দন সেটা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু প্রণব অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিল স্পন্দনকে। তবে এখন তো স্পন্দনের চোখের সামনে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। স্পৃহা দেশেই ছিল। এখন যদি স্পৃহাকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়! সবটা তো ও স্পৃহার ভালোর জন্য করেছিল! এতো কিছুর পরও কি স্পন্দন ওর ওপর রাগ দেখাবে?

ভাবতে ভাবতেই পলক ফেলে দেখলো স্পন্দন একদম ওর সামনে এসে দাড়িয়েছে। প্রণব আটকে যাওয়া কন্ঠে বললো,

– ভ্ ভাইয়া! আ… আসলে আমি মিথ্যে বলেছি কারণ ……

-পিহুর ভালোর জন্যই করেছো সবটা। আমি জানি।

প্রণব অবাক চোখে তাকালো। কথাটা বোধগম্য হতেই প্রশান্তিতে মনটা হালকা হলো। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

-কীভাবে জানলেন?

-পিহুর সেইফটির জন্যই ওকে এতোদিন লুকিয়ে রেখেছো। যে মহিলা এতো জঘন্য কাজ করতে পারে, সে নিজের স্বার্থের জন্য পিহুর আবার কোনো ক্ষতি করবে না, এটা তো বলা যায় না। তাই না?

প্রণব হাসলো। স্পন্দনের চোখে পানি, মুখে হাসি। প্রণবের হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো,

-ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না তোমায়। তবে তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার বোনটাকে সবার আড়ালে এভাবে আগলে রেখেছো তুমি! ছোট থেকেই ওর জীবনটা রঙহীন। আমি ছাড়া ওকে কেউ কোনো দিন ভালোবাসেনি। ভেবেছিলাম ওকে কেউ একজন ভালোবেসে আগলে রাখবে। কিন্তু সেটাও বাস্তবে ঘটেনি। জানিনা তুমি ওকে কীভাবে চেনো! কিন্তু ওকে এতো বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছো। মৃত্যুর মুখ থেকেও বাঁচিয়েছো। এতোদিন এভাবে আগলে রেখেছো। এমন একটা ভরসার হাত-ই আমি আজীবন চাচ্ছিলাম। অবশেষে আল্লাহ মিলিয়েই দিলো।

প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্পন্দনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ওর হাতের ওপর হাত রেখে বললো,

-মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসময় কোনটা, জানেন ভাইয়া? নিজের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা নিজের কাছে পেয়েও সেটা গ্রহন করতে না পারার সময়টা। আমার অবস্থাটাও সেরকম। এই যে দেখুন, মিসেস নিস্তব্ধতা এখন আমার নিজের। কেউ বা কোনো বাঁধা নেই ওনার আর আমার মাঝে। তবুও আমি ওনাকে গ্রহন করতে পারবো না, শুধু মাত্র উনি সম্মতি দেয়নি বলে। বিয়েটা তো আমি ওনার মতের বাইরে বা ওনাকে ধোকা দিয়েই করেছি, তাই না? কীভাবে ওনার সম্মতি ছাড়া ওনাকে নিজের সাথে জড়াই, বলুন তো!

স্পৃহার চোখ পানিতে টলমল করছে। একথা শুনে অবশেষে গাল বেয়ে গড়িয়েই পড়লো পানি। কী নেই এই প্রণব মেহরাজের জীবনে? তবুও নিজের সবটা দিয়েই ওকে আগলে রেখেছে, নিজের অর্ধাঙ্গিনী করেছে। শুধু মাত্র ওর মতামতের কারনে প্রণব অধিকার থাকা সত্ত্বেও ওকে গ্রহণ করতে পারছে না। ব্যক্তিত্বটা অদ্ভুত হলেও শ্রদ্ধার দাবিদার।

প্রণব স্পৃহার দিকে এক পলক তাকালো। ওর অশ্রু পূর্ণ চোখদুটো আর লালাভ মুখশ্রী দেখে প্রণবের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল নিমেষেই। কেন কাঁদছে মেয়েটা? বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কি ওর চোখের পানি ফেলাটা খুব জরুরি? চোখের পানি কি সবসময় রেডি থাকে নাকি?

স্পন্দনও মুখটা কালো করে রেখেছে। স্পৃহা কি কখনো এই সম্পর্কে সম্মতি দিবে? নিজের বোনকে ও ভালো করেই চেনে! প্রণব স্পৃহার মতের জন্য অপেক্ষা করছে, আর এদিকে স্পৃহার প্রণবের ডাকে সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে কী পরিণতি হবে প্রণব আর স্পৃহার সম্পর্কের? ভাবতেই মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে স্পন্দনের।

এরই মাঝে কয়েকজন পুলিশ এসে মিসেস সামায়রাকে নিয়ে গেল। ওদেরকে প্রণবই সাথে নিয়ে এসেছিল। কেউ বাঁধাও দিলো পুলিশকে। মিসেস সামায়রারও বলার মতো কোনো ভাষা নেই। সবাই নীরব দর্শকের মতো পুলিশকে বিদায় জানালো। মিস্টার চৌধুরী প্রণবকে বললো,

-আমরা তাহলে বাসায় ফিরে যাই। এমনিতেই অনেক বেলা হয়ে গেছে। প্রান্তি বাড়িতে আশফিকে নিয়ে একা আছে।

প্রণব সম্মতি দিতেই মিস্টার চৌধুরী, মিসেস মেহরীন আর আনিলা চলে গেলো। প্রণব স্পন্দনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো,

-আমারও থানায় কিছু ফর্মালিটি বাকি আছে। মিসেস নিস্তব্ধতা চাইলে আপনার সাথে যেতে পারে। আমি বাঁধা দেবো না। আসছি।

বলেই প্রণব কারো দিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। স্পৃহা কিছু বলার সুযোগ পেল না। কিন্তু ওর তো অনেক প্রশ্ন আছে প্রণবের কাছে! সেগুলো তো জানতে হবে! ওর জন্য এতো কিছু করলো, একবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটাও জরুরি। ভেবেই ও-ও প্রণবের পিছু পিছু ছুটে বেরিয়ে গেল। স্পন্দন বাঁধা দিলো না। চোখ ঘুরিয়ে আদ্রের দিকে তাকালো। আদ্র মাথার চুল আঁকড়ে ধরে সোফায় বসে পড়লো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে ওর। নিজেই নিজেকে বললো,

-আজ আমি সত্যি সত্যিই নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এটাই কি তাহলে স্পৃহার বিশ্বাস ভাঙ্গার পরিণতি? কীভাবে বাঁচবো আমি বাকি জীবনটা এমন নিঃস্ব একটা জীবন নিয়ে?

স্পৃহা বেরিয়ে এলো বাড়ির বাইরে। কিন্তু প্রণব নেই। চলে গেল ছেলেটা? ভাবতেই মনটা যারা হয়ে গেল!

-আমাকে খুঁজছেন, মিসেস নিস্তব্ধতা?

পরিচিত সম্বোধনটা শুনে স্পৃহা চমকে উঠলো। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে দেখে না চাইতেও মনে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করলো ওর। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলো না।

প্রণব স্পৃহাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে ওর দিকে এগিয়ে এলো। ওর দিকে সামান্য ঝুঁকে বললো,

-আমি জানতাম, মিসেস নিস্তব্ধতা। আপনি আসবেন, এটা আমি জানতাম।

স্পৃহা অবাক চোখে তাকালো। প্রণবের হাসিটা দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো। বললো,

-আপনি যেমন ভাবছেন, তেমন কিছু না!

-আমি কী ভাবছি?

স্পৃহা চোখ তুলে তাকালো। প্রণব এক ভ্রু উঁচিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো,

-জ্… জানি না‌!!

প্রণব হেসে ফেললো। বললো,

-আমি জানি, আপনি আমার কাছে আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে আসেননি। বেশ দেরী হবে আপনার। তবে একটা কথাই বলবো। কালও বলেছিলাম। আজ সকালেও বলেছি। খুব বেশি দেরী করে ফেলবেন না যেন!

প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্পৃহার মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে পা ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগলে স্পৃহা পেছন থেকে ডাক দিলো,

-শুনুন!!!

প্রণব থামলো। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালো না। বললো,

-ধন্যবাদ বলার দরকার নেই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজন নেই। আপনি আমার। একমাত্র আমার। আর আমার জিনিসটা অবশ্যই আমিই আগলে রাখবো। বলেছিলাম না, আপনার ছায়া আপনার থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও এই প্রণব মেহরাজ চৌধুরী আপনার থেকে দূরে সরবে না কোনোদিন।

বলেই প্রণব গটগট করে হেঁটে চলে গেল। স্পৃহা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে।
#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৭

রাতগুলো নির্ঘুম কাটছে ইদানীং! অকারণেই! হাজারো ক্লান্তি শরীরে ভর করলেও ঘুম ধরা দিচ্ছে না। চৌধুরী ভবন থেকে আজ নিজের বাগান বাড়িতে চলে এসেছে প্রণব। পরিবেশ বদল করলে যদি মনে একটু শান্তি মেলে, সেই আশায়! কিন্তু ফলাফল শুন্য! বিছানায় মন টিকছে না। কপালে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে নিজের ওপরই বিরক্তি ঝাড়ছে অবশেষে। হঠাৎ ঘরের সব আলো নিভে অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এতো রাতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল!! কিছুক্ষণ পরেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ! অবাকতা ও বিরক্তির মিশ্র প্রকাশ ছেয়ে গেল মুখশ্রী জুড়ে। একটু শান্তি কি কপালে নেই নাকি? শোয়া থেকে চট করে উঠে বসলো প্রণব। কপালে গভীর ভাজ ফেলে বললো,

-কাম ইন!

দরজা আনলকড্-ই ছিল! তাই কেয়ারটেকার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে অস্থির স্বরে বললো,

-স্যার, নিচের মেইন ইলেক্ট্রিক সার্কিটটাতে কী যেন হয়েছে! বারবার শুধু লাইটেনিং হচ্ছে।

প্রণব ফোনের ফ্লাশলাইটটা অন করে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,

-বলো কী? এমনটা কীভাবে হলো? চলো, গিয়ে দেখি!

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলা থেকে নিচতলায় চলে এলো প্রণব। পিএ-কে ফোন দিয়ে ইমার্জেন্সি লোক পাঠাতে বললো। সার্কিটের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সত্যি সত্যিই লালচে বর্ণের স্ফুলিঙ্গ বারবার জ্বলে উঠছে। ভেতর থেকে পোড়া বিদঘুটে গন্ধ।

মিনিট দশেকের মধ্যে পিএ কয়েকজন ইলেক্ট্রিশিয়ান নিয়ে বাড়ির সামনে পৌছালো। তারা সবটা পরখ করে প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-এই সমস্যাটা তো আজকের নয়! বহু আগে থেকেই। আজকেরটা শুধু ক্লাইমেক্স ছিল। আরেকটু দেরি হলেই আগুন লেগে যেত! ভাগ্যিস!!

প্রণব চমকে উঠলো। অনেক বড় অঘটন ঘটতে চলেছিল আজ। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো ওর। চোখ বন্ধ করে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিন্তু দৃশ্যপটের সামনে অকস্মাৎ স্পৃহার অবয়বটা ভেসে উঠলো। মায়া জিনিসটা অদ্ভুত! একবার জড়িয়ে গেলে সবকিছুতেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

সব ঠিকঠাক করতে করতে রাত আড়াইটা বেজে গেছে। ইলেক্ট্রিসিটিও চলে এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। প্রণব নিজের ঘরে এসে ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো। আজ নিঃসঙ্গতা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। প্রণব অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করলো, সব কিছু থাকতেও সে বড্ড একা! কাছের ও প্রিয় মানুষ গুলো ওর থেকে দূরে। আচ্ছা, সে যাদের প্রিয় মনে করে, তাদের কাছেও কি সে একই রকম প্রিয়? না কি বিষয়টা এক তরফা? প্রশ্নটা মনের কোণে নাড়া দিয়ে উঠলো।

-মিসেস নিস্তব্ধতা!

নিশ্বাসের সঙ্গে চাপা স্বরে এই শব্দ দুটোই বেরিয়ে এলো শুধু। মা আর বোনের পর এই একটা নারী-ই তার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। প্রণয়টা শুধুই তার পক্ষ থেকে ছিল। পরিণয়টাও ছিল এক তরফা। কিন্তু বিশ্বাসের পরিচিত সত্তাটা বলছে পরিণতিটা দু-তরফাই হবে! আনমনেই হেসে ফেললো প্রণব। ইদানীং বিশ্বাসের ঢালটা প্রচন্ড মজবুত হয়ে গেছে ওর।

বিছানায় বসতেই সামনে আহিরের ছবিটার দিকে চোখ পড়ে গেল প্রণবের। তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এই ব্যক্তিটারই বিচরণ তার প্রণয়িণীর মনোজগৎ জুড়ে! ব্যক্তিটার সত্তাটা-ই ভদ্রতা দিয়ে ঘেরা। প্রফেসর মানুষ বলে কথা! সবদিক থেকেই সে ভালোবাসা লাভের যোগ্য।

প্রণব ছবিটার ওপর হাত বুলিয়ে বললো,

-হুট করেই আগমন ঘটেছিল আপনার। আমার আগেই মিসেস নিস্তব্ধতার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন আপনি। অথচ আমি ছিলাম প্রথম। আপনার জায়গায় আমার থাকার কথা ছিল। কিন্তু আপনার প্রতি কোনো রাগ বা জেলাসি আনতে পারি না আমি! হয়তো আপনি মিসেস নিস্তব্ধতার শুভাকাঙ্ক্ষী তাই। আমি হয়তো আপনার মতো ত্যাগি নই! বরং আপনার সত্তার উল্টোপিঠ। এজন্যই মনের মধ্যে হারানোর ভয়টা জেঁকে বসেছে আজকাল। সত্যিই শান্তি পাচ্ছি না!
____________________

খাটের ওপর উবু হয়ে জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে স্পৃহা। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে গাল স্পর্শ করে আরেকহাত দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে সে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় যাবৎ নিজের বাড়িতেই আছে স্পৃহা। তবে বাড়ির পরিবেশে পরিবর্তন এসেছে। এখন তাকে দেখে বাবা-মায়ের মুখে বিরক্তি প্রকাশ পায় না। ফুপি এটা-সেটা বললেও আগের মতো এ বাড়িটা বিষাক্ত মনে হয় স্পৃহার।

মনটা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই হালকা ও ফুরফুরে লাগে তার। আগের মতো মন খারাপেরা এসে মনোরাজ্যে ভীড় জমায় না। অকারণেই ঠোঁটে হৃষ্টতার ছোঁয়া ফুটে ওঠে। তবে কোথাও না কোথাও একটা শূন্যতা রয়েই যায়! মনে এসে উঁকি দেয় এক অপেক্ষমাণ সত্তা। ভেবেই হাসি মুখে ভাটা পড়ে স্পৃহার। চোখ চলে যায় হাতের পাশে অলস পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিনের ওপর। বুক চিরে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে। রাগ নাকি অভিমান, জানা নেই! কিন্তু ভেতর থেকে কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি জেগে বসে! এতো দিনে একটা বার খোঁজও নিলো না তার। দেখা করা তো দূরে থাক! একবার কল তো করতে পারে! এই তার আগলে রাখার নমুনা? অথচ এতো মুড দেখিয়ে যখন বলে,

-আপনি আমার! একমাত্র এবং একান্তই আমার নিজের।আর আমার জিনিসটা অবশ্যই আমি আগলে রাখবো। এর বিনিময়ে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন ও অযৌক্তিক!

ভেবেই ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা ভেংচি কাটলো স্পৃহা। বইয়ের পৃষ্ঠায় মনযোগ দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। স্পৃহা চমকে উঠলো। অতি উৎসাহ নিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই মুখটা আবার কালো হয়ে গেল। আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির ফোন ছিলনা সেটা। মন খারাপ করেই ফোনটা কানে ছোয়ালো সে,

-হ্যাঁ, আহান! বল!

-কেমন আছিস?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। আহান কখনো ওকে এসব জিজ্ঞেস করে না। তার মতে, “তোরা আমার বন্ধু! আর বন্ধুদের সাথে এসব ফর্মালিটি কেন? যারা কাছের মানুষ নয়, তাদের সাথে কথা বলার সময় ‘কেমন আছেন? ভালো আছি!’ এসব আজাইরা কথা বলে সবাই।” তাই স্পৃহা জিজ্ঞেস করল,

-এসব ফর্মালিটি কবে থেকে দেখানো শুরু করলি বল তো?

আহান হাসলো। বললো,

-আরে ফর্মালিটি না! তোদের সাথে কী ফর্মালিটি দেখামু?

-তাহলে কেমন আছি জিজ্ঞেস করছিস যে?

-অনেক দিন পর কথা বলছি, তাই খোঁজ নিলাম আর কি! এসব জিগাইতে ভালোও লাগে না, বইন। পাবলিক তো ভালো থাকলেও কয়, ভালো আছি! খারাপ থাকলেও কয় ভালো আছি!

স্পৃহা হাসলো। বললো,

-আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু এতোদিনে তোর হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো যে?

-তোর না, তোদের বল! নীড়ের মনে পড়সে তোর কথা!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

-মানে?

ওপাশ থেকে নীড়ের গলা শুনতে পাওয়া গেল,

-সেলিব্রিটির বউ! একটা গুড নিউজ আছে।

সম্বোধন শুনে স্পৃহা খানিকটা চমকে উঠলো। কিন্তু গুড নিউজের কথা মাথায় আসতেই বললো,

-তুই কি বিয়ে করে ফেলেছিস?

আহান কিটকিটিয়ে হেসে দিলো। নীড় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-হারামি! বিয়ে ছাড়া কি আর কোনো গুড নিউজ নাই না কি? সবে মাত্র তেইশ বছর চলছে। এটা কি বিয়ের বয়স? আমি এখনো অনেক ছোট, বুঝলি?

স্পৃহা মনে মনে হাসলো। বললো,

-হুম, বুঝলাম। তো গুড নিউজটা কী?

-আমার কানাডার স্কলারশিপ এপ্লিকেশনটা গ্র্যান্টেড হয়েছে, ইয়ার। অনার্স শেষ করেই আমি ওখানে চলে যেতে পারবো।

নীড়ের গলায় আনন্দের আভাস। স্পৃহারও বেশ ভালো লাগলো। কাছের মানুষগুলোর সাফল্য দেখে সত্যিই অদ্ভুত একটা আনন্দ কাজ করে। ওদের সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলে ফোন কাটলো স্পৃহা। জানালো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, গোধূলির হলুদ আকাশ লালচে আভা ছড়াতে ব্যস্ত। মনের ভেতর শূন্যতাটা আবার জেঁকে বসলো। অপেক্ষার প্রহর কি শেষ হবার নয়?

হঠাৎ কিছু ভাঙার শব্দে চমকে উঠলো স্পৃহা। চিন্তা জগৎ থেকে বেরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। বেলকনির দরজা ভেদ করে লাল কাগজে মোড়ানো কিছু একটা ওর ঘরে ছুঁড়ে মেরেছে কেউ, যার আঘাতে একটা ছোট ফুলদানি টেবিল থেকে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে। রাগে কটমট করে উঠলো স্পৃহা। যে এই কাজটা করেছে, তাকে ঝাড়ার জন্য বেলকনিতে গিয়ে নিচে তাকালো স্পৃহা। দোতলা থেকে নিচের খালি রাস্তাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পরিচিত গাড়িটা দেখে স্পৃহা থমকালো। গাড়ির ভেতরে কে আছে, বোঝা না গেলেও স্পৃহা নিশ্চিত যে, ভেতরে সেই পরিচিত মানবটি-ই! হঠাৎ গাড়িটা শা করে চলে গেল।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। জিনিসটার কথা মাথায় আসতেই ভেতরে ছুট লাগালো সে। ফ্লোরে পড়ে আছে লাল কাগজে মোড়ানো সেই বস্তুটা। স্পৃহা হাতে নিলো সেটা। পেচিয়ে রাখা লাল ফিতাটা খুলতেই কাগজ আলগা হয়ে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বড় একটা পাথরের টুকরো। স্পৃহার কপালে ভাজ পড়লো। এটা দেওয়ার মানে কী? পরমুহূর্তেই লাল কাগজটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। কুঁচকানো কাগজটা ভালো ভাবে মেলে ধরতেই সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শব্দমালা ফুটে উঠলো দৃষ্টির সামনে,

“আপনার মতো নিষ্ঠুর মানবী আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি, মিসেস নিস্তব্ধতা! এতো কঠিন কেন আপনি? কেউ একজন যে অধীর অপেক্ষায় আপনার পথ চেয়ে বসে আছে, সেটা কি আপনি জানেন? অপেক্ষার বিষাক্ত দংশনে কেন বারবার আহত করছেন আমায়? এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আর কতোদিন একাকী নিঃসঙ্গ রাত নির্ঘুমভাবে কাটাবো আমি? অন্তঃদহনে গোমরাতে আর ভালো লাগছে না কিন্তু! শুন্য এই বক্ষস্থলে কবে আপনাকে পাবো বলুন তো? আপনার কি আমার কথা মনে পড়ে না, মিসেস নিস্তব্ধতা? আমার তো প্রতিটা মুহুর্ত-ই বিষাক্ত লাগছে! সহ্যের সর্বোচ্চ সীমা পেরিয়ে গিয়েছি কিন্তু আমি! এরপর আপনার বিরহে দমবন্ধ হয়ে আমার শ্বাসরোধ ঘটলে তার দায়ভার কি আপনি নেবেন, মিসেস নিস্তব্ধতা?

-এক_মুঠো_প্রেমের জন্য অপেক্ষিত এক মানব…”

কাগজের লেখাগুলোতে স্পৃহার দিকে এক গাদা অভিযোগ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। সম্বোধন-ই বলে দিচ্ছে চিঠিটার প্রেরক কে! শেষের কথাটা পড়ে স্পৃহা ফিক করে হেসে দিলো। পুরো চিঠিটাই আবেগে ভরপুর। আর এটা পাঠাতেই এতো কাহিনী! নিজের অজান্তেই স্পৃহার ঠোঁটের কোণে হৃষ্টচিত্তের রেখা ফুটে উঠলো।
#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৮

আকাশের কোলে সরু এক ফালি বাঁকা চাঁদ। হাত-পা হিম করার মতো শীত না থাকলেও উত্তরে শীতল হাওয়ার প্রবাহ কিন্তু থেমে নেই। জানালার কিনারা ঘেঁষে সেই বক্র চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্পৃহা মনে মনে আওড়াচ্ছে, “বসন্তের আগমন ঘটেই গেল তাহলে!”

হাতের মুঠোয় থাকা সেই অগোছালো ভাবো মোচড়ানো লাল কাগজ টার ওপর পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো সে। কুঁকড়ে যাওয়া জায়গা গুলো সমতল করার বৃথা চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। কিছুটা সফল হলো হয়তো। কিন্তু মনে তেমন তৃপ্তি পেল না। কাগজের ওপর লেখা বাক্য গুলো পড়লো আরেক বার। এই নিয়ে কতবার পড়া হলো, সেই হিসেব জানা নেই। লেখাগুলো ওর অধরপ্রান্তে কতবার তৃপ্ততার প্রসারণ ঘটালো, সেটাও বেখেয়ালি লক্ষ করেনি স্পৃহা। মনের ভেতরে থাকা কষ্টে দ্বি-খন্ডিত হৃদয়টা জানান দিলো,

-ভালো লাগছে চিরকুটটা পড়তে, ভালো লাগছে হাসতে, ভালো লাগছে আজ বসন্তের এই আগমনী প্রকৃতিটাকে! মনের জোয়ারে তাহলে দ্বিতীয় বসন্তের ঘটেই গেল নাকি অবশেষে?

প্রশ্নটা মনে জাগতেই ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হলো স্পৃহার। ঠোঁটের কিনারাও আগের চেয়ে প্রসারিত হলো একইভাবে। কী যে ঘটছে তার সাথে, জানা নেই! এই অজানা অনুভূতিরও কোনো নাম নেই। কিন্তু খুব শীঘ্রই যে তা প্রগাঢ়তা লাভ করবে, এতেও কোনো সন্দেহ নেই। মন জিনিসটা বাক্সে বদ্ধ করে রাখার মতো নয়। কারো না কারো মায়ায় সে জড়াবেই! ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পৃহা। চিঠিটা দিকে তাকিয়ে আরেক বার হাসলো। ভাজ করে সযত্নে ডায়েরির ভাজে তুলে রাখলো। সেই সাথে কিছু কথা লিখেও রাখলো একপৃষ্ঠার কিনারা জুড়ে।

বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই বিছানার ওপর থেকে ফোনটা বেজে উঠলো। স্পৃহা অবাক হলো। আজ হঠাৎ এতো ফোন আসছে কেন? কই এতো দিন তো আসেনি? আচ্ছা, ফোন তুললে কি আবার মিসেস নিস্তব্ধতার প্রতি একরাশ অভিযোগ ছুড়ে দেবে অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি। ভেবেই খানিকটা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় স্পৃহা। দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে ফোন হাতে নেয়। আননৌন নাম্বার! তার মানে কি তার ধারণাই সঠিক? কলটা সেই অপেক্ষিত মানবের-ই? কম্পিত হাতে ফোনটা রিসিভ করতে নিলেই সেটা কেটে গেল। স্পৃহা বিরক্ত হওয়ার অবকাশও পেল না। দুই সেকেন্ড গড়াতেই আবারও ফোনটা বেজে উঠলো।

অকারণেই হাসি পেল স্পৃহার। কল রিসিভ করে কানে ছোঁয়াতেই ওপাশের নীবরতা ব্যতীত অন্য কিছু কর্ণগোচর হলো না স্পৃহার। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কেটে গেল। স্পৃহার কথাগুলো গলায় আঁটকে আছে। এই প্রাপ্তবয়সেও আবেগ গুলো গলা আঁকড়ে ধরেছে যেন! অকস্মাৎ ওপাশ থেকে প্রতিধ্বনিত হলো,

-স্পৃহা!!!

উৎসাহ, উৎফুল্লতা, আবেগ ও আনন্দগুলো মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেল স্পৃহার। মুখের হাসিটাও উবে গেল মুহুর্তেই! এটা তো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটা নয়! সে তো এই নামে সম্বোধন করে না! ‘মিসেস নিস্তব্ধতা’ বলে অভিযোগকারী ব্যক্তিটা ফোন করেনি ওকে। মুখটা কালো করে নিমীলিত কন্ঠে বললো,

-জ্বি, কে বলছেন?

অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটা হাসলো। হাসির আওয়াজটা স্পৃহার কানে হালকা ধ্বনিতও হলো। হাসিটাতে তাচ্ছিল্য ছিল! হয়তো ব্যক্তিটার নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যবোধ, নয়তো কারো প্রতি না! কিন্তু বিষয়টা স্পৃহার অজানাই রয়ে গেল।

-চিনতে না পারারই কথা! আমি তো তোমার মনের কোথাও জায়গা করে নিতে পারিনি। এতোটাই হতভাগা আমি!!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। কথাগুলো বোধগম্য হতেই চোখে মুখে কাঠিন্য ফুটে উঠলো। শক্ত গলায় বললো,

-কেন ফোন দিয়েছেন আমায়, আদ্র? আমার মনে হয় না আপনার আর আমার মধ্যে বলার মতো কোনো কথা থাকা উচিত।

-স্পৃহা, প্লিজ। শেষবারের মতো আমার একটা কথা রাখো। আই সোয়্যার, তোমায় কোনোদিন ডিস্টার্ব করবো না।

আদ্রের কন্ঠে কাতরতা। কিন্তু স্পৃহা নরম হলো না। শক্ত ভঙ্গিতেই বললো,

-আপনাকে বিশ্বাস করিনা আমি। আজ বলছেন, কখনো ডিস্টার্ব করবেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে এই কথাটা আপনি রাখবেন না।

-স্পৃহা! বললাম তো, শেষবার।

স্পৃহা চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ফেললো। সত্যিই বড্ড বেশি কঠোর আচরণ করছে সে! নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

-আচ্ছা, বলুন!

আদ্র সংকোচ নিয়ে অগোছালো ভাবে বললো,

-আব্… আসলে তোমার সাথে সরাসরি কিছু কথা ছিল। তোমার বাড়ির বাইরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। যদি একবার……

-যা বলার, ফোনে বলুন!

আদ্র অসহায় কন্ঠে বললো,

-প্লিজ, বেশি সময় নেব না আমি। অনলি পাঁচ মিনিট!

স্পৃহা স্বাভাবিক হলো। বারবার রেগে যাচ্ছে আজ! তাই যতটা সম্ভব শান্ত গলায় বললো,

-আচ্ছা, আমি আসছি!

বলেই ফোনটা রাখলো স্পৃহা। মাথায় গোমটা টেনে শালটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। এ সময়ে সবাই যার যার ঘরে ব্যস্ত। তাই বাইরে বের হওয়াটা কারো চোখে পড়েনি। নিচের গেইট পেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেই সুনশান রাস্তায় অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল স্পৃহা। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল, গাড়ির সামনের বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্র। দৃষ্টি তার আকাশের দিকে নিবদ্ধ।

-বলুন, কী বলবেন?

স্পৃহার গলার আওয়াজে চমকে উঠলো আদ্র। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই চোখ গেল স্পৃহার ওপর। আবছা আলোয় মলিন মুখটা হৃদয় হরণ করার জন্য যথেষ্ট। আজ বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলে এই মুখটা ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা এভাবে দমিয়ে রাখতে হতো না। এমন এলোমেলো জীবনের অধিকারী হতেও হতো না হয়তো! ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে গেল আদ্রের। সেটা আড়াল করে মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বললো,

-কেমন আছো, স্পৃহা?

স্পৃহা স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

-ভালোই আছি। খারাপ থাকার মতো কোনো কারণ তো ছিল না!

আদ্র শুকনো হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-আমাকে এখনো ক্ষমা করতে পারোনি তুমি, তাই না?

স্পৃহার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। কঠোর গলায় বললো,

-আজ হঠাৎ আমার ক্ষমা নিয়ে কেন পড়লেন আপনি? ‘আমি’ নামক ব্যক্তিটা হঠাৎ এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন হয়ে গেল আপনার কাছে? কই? এতোদিন তো আমার কথা আপনার মনে আসে নি! বেশ তো ছিলেন আপনি নিজের জীবন নিয়ে! যখন আমায় গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল, তখন তো আপনি স্বার্থপরের মতে নিজের সুখটাকে বেছে নিয়েছিলেন। নিজের জীবনটা সুন্দর করার জন্য সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটা বার দেখা পর্যন্ত করেন নি। যেই জীবনের জন্য এতো কিছু, আমার মতো সাধারণ একটা মেয়েকে নিয়ে ভেবে সেই জীবনটার গতি কেন নষ্ট করছেন?

একদমে কথাগুলো বলে শ্বাস ফেললো স্পৃহা। আদ্র ওর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

-স্পৃহা, আমি……

-দয়া করে ক্ষমা চাইবেন না আমার কাছে। অনুরোধ রইলো আমার। আপনাকে ক্ষমা করার মতো মহানুভবতা আমার মধ্যে নেই। সত্যিই নেই। তবে আপনার প্রতি কোনো অভিযোগও আমার নেই এখন। অভিযোগ তখনই জন্মায়, যখন কোনো মানুষের প্রতি অনুভূতি থাকে। আর সে রকম কোনো অনুভূতি আপনার প্রতি আমার ছিল না। থাকুন না আপনি আপনার মতো! আমি না-হয় নিজের জীবনটা নতুন আঙ্গিকে সাজানোর চেষ্টা করবো। ভালো থাকবেন।

আর কথা বাড়ালো না স্পৃহা উল্টো দিকে পা বাড়ালো। আদ্র হাত বাড়িয়ে আটকাতে চেয়েও পারলো না। কী বলে আটকাবে? কোন অধিকারে আটকাবে? সম্পর্কটা আগেই ভেঙে গেছে। কিন্তু আজ চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্নতাই পরিণতি হিসেবে ধরা দিলো। একটা ভুল সিদ্ধান্ত জীবনের মোড়-ই ঘুরিয়ে দিলো তার। ভেবেই শার্টের হাতায় চোখ মুছলো।

মাথা নিচু করে বড় বড় পা ফেলে সামনে এগোচ্ছিল স্পৃহা। কিন্তু হঠাৎ কারো প্রশস্ত বুকের সাথে সজোরে ধাক্কা লাগলো তার। মাথা বারি খেলো ব্যক্তিটার গলদেশের নিচে। পড়তে পড়তেই কারো মুঠোয় হাত বাঁধা পড়লো স্পৃহার। ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো সে। পরমুহূর্তেই একটানে ওকে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলো। চোখ খুলে মুখ তুলে তাকাতেই কারো রাগী দৃষ্টি চোখে পড়লো। সাথে সাথে কানে ভেসে এলো ভরাট কন্ঠের বাক্যস্রোত,

-এভাবে কেয়ারলেস ভাবে কেউ হাঁটে? আপনার সামান্য আঘাতে আপনার পাশাপাশি আরো একজন ব্যথা পায়। তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি আপনি কখনো বুঝবেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা?

কথাগুলো আদ্রের কানেও ভেসে এলো। মলিন হাসলো সে। এ হাসিই হয়তো ভবিষ্যতের একমাত্র সঙ্গী। নীরবে স্থান ত্যাগ করলো সে।
#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৯

-আপনাকে আমি কিছু বলেছি, মিসেস নিস্তব্ধতা!

প্রণবের চাপা আওয়াজটা স্পৃহার কর্ণভেদ হলো না। সে নিবিষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে আছে সেই অপেক্ষিত মানবের দিকে। পলক ফেলাটাও দুঃসাধ্য মনে হচ্ছে তার। এতোদিন পর এভাবে হঠাৎ দেখা হওয়াটা কল্পনাতীত ছিল স্পৃহার। কিন্তু চোখের তৃষ্ণা মেটানোতে অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে মনে। ভয়ঙ্কর এক ব্যধি যে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। চাইলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না সে। অনুভূতি গুলো কি এভাবে অজান্তেই মনে জায়গা করে নেয়?

-মিসেস নিস্তব্ধতা!!!

দ্বিতীয় ডাকটা বেশ জোরেই দিয়েছে প্রণব। ভাবনার রাজ্যে ভাটা পড়লো স্পৃহার। চকিত দৃষ্টিতে তাকালো সে প্রণবের দিকে। যদিও এতোক্ষণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সেই স্থির দৃষ্টিটা সচল হলো। প্রকৃতস্থ হয়ে বললো,

-কিছু বললেন?

-অনেক কথা-ই তো বলি! কিছু প্রকাশ্যে, কিছু নীরবতায়। আপনি তো আমার মুখে বলা কথাগুলোই শুনতে পান না! নীরবে প্রকাশিত অনুভূতি গুলো কীভাবে শুনবেন?

স্পৃহা আহত দৃষ্টিতে তাকালো প্রণবের মলিন চাহনির দিকে। প্রণবের চোখে মুখে ম্লানতা, অদ্ভুত বিষাদময় অভিব্যক্তি, যা হাসির আড়ালেও প্রকাশ পাচ্ছে। এই বিষাদের একমাত্র কারণ কি স্পৃহা নিজেই?

-আমি সত্যিই যোগ্য নই আপনার! আমার যোগ্যতা নেই আপ………

স্পৃহার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে দিয়েছে প্রণব। কথাটা আর শেষ করতে পারলো না সে। অবাক চোখে তাকালো প্রণবের দিকে। প্রণব ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-যোগ্যতা নিয়ে ফারদার যেন আমার মুখ থেকে একটা কথাও না শুনি আমি। আপনি আমার কাছে ঠিক কী, সেটা আপনি নিজেও জানেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা! তবে জানবেন খুব শীঘ্রই। আপনি হয়তো আমার নীরবে বলা কথাগুলো শুনতে পারেন না। কিন্তু আপনার চোখের ভাষাটা আমি খুব ভালো করেই পড়তে পারি। নিখুঁতভাবে পড়তে পারি। সেটা কি আপনি জানেন, মিসেস নিস্তব্ধতা?

স্পৃহা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। সেটাও প্রণবের দৃষ্টি এড়ালো না। প্রণব বরাবরের মতোই বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বললো,

-ভয় পেলেন? ভয় পাওয়ার মতো আমি কিছু বলিনি। শুধু মনটাকে খোলাবই বানাতে শিখুন। সেটাকে বুঝতে শিখুন। অনুভূতি গুলো অব্যক্ত রাখতে নেই! তাড়াতাড়ি প্রকাশ করে দিয়েন।

স্পৃহা এখনো নিজের চোখে মুখে অবাকতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই ব্যক্তিটা কীভাবে বুঝে ফেলে তার না বলা কথাগুলো? প্রণব সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আশেপাশে একবার তাকালো। রাস্তাটা নীরব। তবুও বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা পছন্দ হচ্ছে না প্রণবের। তাই নিজেই স্বগোতক্তি করলো,

-আপনাদের বাসার ভেতরে নিয়ে যাবেন আমায়? নয়তো আমার বাড়িতে চলুন!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

-আপনি এই অসময়ে এখানে কেন এসেছেন? বিকেলেও না এলেন?

-আপনি বুঝেছেন তাহলে চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম! ধন্য হলাম আমি। আর এখানে আসার কারণ আছে। কিন্তু সব কথা কি রাস্তায়-ই সারবেন?

স্পৃহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,

-চলুন, ভেতরে যাই।

.

প্রণব স্পৃহার ঘরে বিছানার ওপর পা মুড়িয়ে বসে আছে। দৃষ্টি সারা ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর। মেয়েটা বড্ড গোছালো! ঘরের ভেতর নজর কাড়ার মতো তেমন কিছু না থাকলেও গোছালো আছে বেশ। ভাবনার মাঝেই স্পৃহা ভেতরে প্রবেশ করে ওর দিকে কফি মগ বাড়িয়ে দিলো। বললো,

-ডিনার না করে এমনিতেও যেতে পারবেন না! আপাতত কফিটাই ভালো লাগবে, যদিও আমি অতো ভালো কফি বানাতে পারি না।

প্রণব প্রসন্নচিত্তে হাসলো। মগটা স্পৃহার হাত থেকে নিয়ে বললো,

-অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দ আপনি বুঝবেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা!

স্পৃহা কথাটা ঠিক বুঝতে পারলো। বললো,

-মানে?

-কিছু না। আপনি একটু কম কঠিন হলেও পারতেন, মিসেস নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে আপনাকে অনেক নিষ্ঠুর মনে হয়। আপনি সবটা বুঝেও বুঝেন না, হয়তো… হয়তো বুঝতেই চান না!

কথাটা বলে তপ্ত শ্বাস ফেললো প্রণব। স্পৃহা মলিন হাসলো ওর কথা শুনে। পড়ার টেবিলের সামনে থেকে চেয়ার টেনে এনে প্রণবের মুখোমুখি বসতেই বললো,

-আমাকে দেখে এমনটাই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কথা শুনে বা ভাবভঙ্গি দেখে তো ভেতরটা যাচাই করা যায় না!

-আমি জানি, আপনার মনটা অনেক নরম ছিল। কিন্তু রিয়েলিটি ফ্যাক্টস্ ট্যু মাচ্! আর আঘাতের মাত্রাগুলো অনেক বেশি ছিল। অতি আঘাতে মনটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়!

বলেই কিছুটা থেমে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো প্রণব। বললো,

-কিন্তু পাথরের বুকেও ফুল ফোটে, মিসেস নিস্তব্ধতা!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। মানুষটা আস্ত একটা রহস্য! একে ভেদ করা অসম্ভব। প্রতিটা কথা, কাজ ও পদক্ষেপের বাঁকে বাঁকে রহস্য তার। সবকিছুতেই সাসপেন্স ক্রিয়েট করাটা কীভাবে সম্ভব? ভেবেই আশ্চর্যান্বিত হয় স্পৃহা। তবে এই প্রসঙ্গটা আর দীর্ঘায়িত করে না সে।

-আপনি হঠাৎ এখানে এলেন কেন, সেটা বললেন না যে?

প্রশ্ন শুনে প্রণব খানিকটা নড়ে চড়ে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-ভোরে আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি। এক সপ্তাহের জন্য। হুট করেই রিসেন্ট একটা শো-তে লিডিং জাজ হিসেবে থাকতে হবে। অনেক আগেই ডিলটা হয়েছিল। আমি ক্যান্সেল করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন না গেলে ওনাদের অনেক লস হয়ে যাবে। ইট ডিপেন্ডস্!

প্রণবের মুখশ্রীতে পাংশুটে ভাব। বিমর্ষ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে বসে আছে সে। স্পৃহারও মনটা কিছুটা খারাপ হলো।

-দুরত্ব জিনিসটা অনেক কষ্টকর, মিসেস নিস্তব্ধতা। যেখানে আপনার কাছাকাছি থেকেও দূরে থাকার মতো দুরত্বটা আমার সহ্য হয় না, সেখানে এতো মাইল দূরে থাকতে … … আই জাস্ট কান্ট এক্সপ্লেইন!!

স্পৃহা পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনাকে এসব পাগলামি মানায় না! এক সপ্তাহের-ই তো ব্যাপার!

প্রণব অগত্যা কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। থমথমে গলায় বললো,

-আপনার কাছে একসপ্তাহ কোনো কিছু মিন করে না হয়তো! কিন্তু আমার কাছে প্রতিটা মুহূর্ত-ই ভয়াবহ লাগে। মা-রা-ত্ম-ক ভয়াবহ!

স্পৃহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। মুখ বাকিয়ে বললো,

-ভয়াবহ!!! হুহ্! এজন্যই তো এক সপ্তাহ কোনো খোঁজ-খবর নেননি! মিথ্যেবাদী কোথাকার!

বলেই মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো স্পৃহা। প্রণবের দৃষ্টিতে অবাকতা। ঠোঁট মেলে দুই প্রান্তে ছড়িয়ে মুখ হা হয়ে গেছে বিস্ময়ে। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে। সবটা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই প্রণবের ঠোঁট প্রসারিত হলো। মুখে ফুটে উঠলো প্রসন্নতার হাসি। কফিতে শেষ চুমুক বসিয়ে সেটা টেবিলে রেখে বললো,

-অনুভূতি লুকিয়ে রাখা বা দমিয়ে রাখা বড্ড কঠিন! আর এই কঠিন কাজটার চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ বরাবরই ব্যর্থ হয়। আপনিও তার ব্যতিক্রম নন।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-মানে?

প্রণব একটু এগিয়ে এসে স্পৃহার দিকে ঝুঁকতেই ও চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। প্রণব ধীর কন্ঠে বললো,

-প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছুই দিয়ে ফেলেছেন, মিসেস নিস্তব্ধতা! অনেক বেশি। এতোটাও আশা করিনি আমি আপনার কাছ থেকে। এন্ড ফর দ্যাট……

বলেই স্পৃহার কপালে নিজের অধর বসিয়ে দিলো অকস্মাৎ! স্পৃহার চোখ দুটো নিজের অজান্তেই বন্ধ হয়ে গেল। কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ অশ্রু কণা। প্রণব কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে রেখেই হাত দিয়ে স্পৃহার গাল স্পর্শ করলো। সযত্নে মুছে দিলো পানিগুলো। স্পৃহা অবাক হলো। চোখ মেললো সাথে সাথেই। প্রণব ওর কাছ থেকে দূরে সরে বসে বললো,

-এই চোখ দুটোতে পানি দেখতে চাই না আমি। দমবন্ধ হয়ে যায় কেন যেন! কিন্তু আফসোস! আপনি বুঝলেন না!

-আপনি কীভাবে না দেখে বুঝলেন যে, আমি কাঁদছিলাম?

প্রণব হাসলো। স্পৃহার কাছে গিয়ে পুনরায় ওর কপালে অধরস্পর্শ করে চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। বিমর্ষ ভঙ্গির সেই হাসি বজায় রেখেই বললো,

-হার্ট ক্যান হেয়ার দ্য ফিলিংস অফ স্পেশাল ওয়ান’স্! দ্য মোস্ট স্পেশাল পারসন আফটার অল।৷ হাত ধরা আর খাইয়ে দেওয়া পর্যন্ত-ই সীমাবদ্ধ ছিলাম। আজ সেই লিমিটেশনটা একটু ব্রেক করলাম। তবে আপনিময় সম্পর্কটা সবসময় এমনই থাকুক না-হয়! আপনাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলে একটা মোহনীয় অনুভূতি, জানেন? অদ্ভুত মোহনীয়তা আচ্ছন্ন করে আমায়। আমি সেই মোহ কাটাতে চাই না, মিসেস নিস্তব্ধতা! একদমই চাই না! #এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৪০

“নিজের খেয়াল রাখবেন, মিসেস নিস্তব্ধতা। আপনার ব্যথায় কিন্তু আরো একজন ব্যথিত হয়!”

ভোরবেলায় মেসেজ টোন বেজে উঠতেই ঘুমের মাঝে মুখ কুঁচকে ফেললো স্পৃহা। ঘুমঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিনে লেখাটায় চোখ বুলাতেই ঘুম গুলো মুহুর্তেই উবে গেল যেন। আননৌন নাম্বার! কিন্তু বুঝতে সমস্যা হলো না মেসেজটা কে পাঠিয়েছে। সম্বোধন! মিসেস নিস্তব্ধতা! অজান্তেই হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোল ঘেঁষে। পলক ফেলতেই দ্বিতীয় লেখাটা ভেসে উঠলো,

-এই দুরত্বটা-ই যেন শেষ দুরত্ব হয়! ছয়টা বছরের দুরত্ব মিটিয়ে দেবো আমি। চিরতরে মিটিয়ে দেবো।

কপালে ভাজ পড়লো স্পৃহার। ছয় বছর! এতো বছর ধরে প্রণব ওকে চেনে? কীভাবে?
__________________

আজ বহুদিন পর চৌধুরী ভবনে পা রাখলো স্পৃহা। সব কিছু আগের মতোই আছে। থাকারই কথা! এক সপ্তাহে কী এমন পরিবর্তন ঘটবে? আবার ঘটতেও পারে। অসম্ভব কিছুই নয়।

স্পৃহাকে দেখেই আশফি ছুটে এলো। চেঁচিয়ে বললো,

-কিউট মাম্মা এসেছে! কিউট মাম্মা এসেছে!!

স্পৃহা হাঁটু মুড়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। গালে চুমু দিয়ে বললো,

-মিস করছিলাম আপনাকে! কিন্তু আপনি তো ভুলেই গেছেন!

আশফি ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

-কে বলেছে ভুলে গেছি? আমিও তো মিস করছিলাম তোমায়! এত্তোগুলো মিস করছিলাম, হুম!

স্পৃহা হেসে ওর নাক টেনে দিলো। ভেতরে ঢুকতেই মিস্টার চৌধুরী, মিসেস মেহরীন আর আনিলার সাথে দেখা হলো। সবার সাথে কথা বলা শেষে আনিলা স্পৃহার কানে ফিসফিস করে বললো,

-দুদিন আগে এলেই পারতে, স্পৃহা! তোমার বিরহে তো কেউ একজনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

এমন কথা শুনে স্পৃহা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। স্পৃহার এমন মুখশ্রী দেখে আনিলা হেসে বললো,

-আরে, এতো ইতস্তত করার কী আছে? আমিই তো!তবে প্রণব কিন্তু প্রণব-ই! বরাবরই জেদি। শুধু মাত্র তোমার প্রতি-ই ওকে আমি নরম হতে দেখেছি। ও হয়তো তোমায় কখনো ‘ভালোবাসি’ বলবে না! তবে ওর অনুভূতির গভীরতা কতটা, সেটা হয়তো তোমার অজানা নয়!

স্পৃহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সত্যিই প্রণব ওকে এখনো ‘ভালোবাসি’ বলেনি। বলবে কি না, জানা নেই! ওর প্রেমানুভূতি প্রকাশের ধরণটা ভিন্ন। একদমই অন্য রকম! ‘ভালোবাসি’ না বলেও ভালোবাসা প্রকাশের এই অদ্ভুত ধরণটাই হয়তো শ্রেষ্ঠ!

ঘরের ভেতর অন্ধকার। খাটের একপায়ায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে প্রান্তি। দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে তাকালো সে। বাইরের একফালি আলোয় অন্ধকার কিছুটা দূরীভূত হলো। স্পৃহা এসেছে। ওকে দেখে প্রান্তি তেমন ভাবাবেগ দেখালো না। স্পৃহা অবাক হলো। এগিয়ে এসে প্রান্তির পাশে বসে বললো,

-এভাবে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে?

প্রান্তি মলিন চাহনিতে তাকালো। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে ওর। পলক ফেলতেই গড়িয়ে পড়লো পানি। স্পৃহার ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেল। মেয়েটা কাঁদছে কেন? প্রণবের জন্য নয়তো! হতেও পারে। প্রণব দূরে কোথাও গেলেই প্রান্তি সবসময় মুখ কালো করে রাখতো। ভাইয়ের প্রতি মেয়েটা প্রচন্ড দূর্বল। সে নিজেও তো! ভেবেই কম্পিত হাতে প্রান্তির গাল মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-আরেহ্! এভাবে কাঁদছিস কেন? তোর ভাইয়ের জন্য মন খারাপ করলে ফোন ক……

কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রান্তি ফুপিয়ে উঠে বললো,

-আহানকে তুই একবার বুঝিয়ে বল না, পিহু! ও কেন আমায় বুঝে না? কেন?

স্পৃহা থমকালো। আহান! অবাক কন্ঠে বললো,

-মানে? কী বলছিস এসব তুই?

-আমার জন্য সম্বন্ধ এসেছে, ইয়ার। বাবার পছন্দ হয়েছে। ভাইয়াও দ্বিমত করবে না। কিন্তু আমি কীভাবে রাজি হবো? আহানকে আজ ফোন দিয়ে বলতেই ও আমায় কতো কথা শোনালো! সবজায়গা থেকে ব্লক করে দিয়েছে ও আমায়।

স্পৃহা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। বিস্ময় নিয়ে বললো,

-তুই আহানকে ভালোবাসিস? সিরিয়াসলি!!!

প্রান্তি মাথা নিচু করে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। বিষয়টা স্পৃহার কাছে অসম্ভব-ই ঠেকছে! এটা আদৌও সম্ভব? সারাজীবন আহান আর প্রান্তিকে ঝগড়া করতেই দেখেছে। সাপেনেউলে সম্পর্ক যাকে বলে। দুজনেই দুই মেরুর দুই প্রান্ত। এখন সেখানেই প্রেমের জোয়ার!

-দ্যাখ, ছেড়ি! এহন তুই আমার কাছে ঐ ফাজিল মাইয়ার হইয়া কোনো কথা কইতে আসবি না কইয়া দিলাম। মনমেজাজ তুঙ্গে উইঠা গেসে ওর ঢঙের কথা শুইনা! সামনে পাইলে ঠাটিয়ে দুইটা চড় মাইরা দাঁত ফেলে দিতাম।

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আহানের কর্কশ কথাগুলো শুনে ফাঁকা গলায় ঢোক গিললো স্পৃহা। প্রান্তির দিকে একপলক তাঁকিয়ে আমতাআমতা করে বললো,

-দেখ, আহান। তুই তো আর কাউকে ভালো-টালো বাসিস না, তাই না? আর সারাজীবন নিশ্চয়ই অবিবাহিত থাকবি না। তাই বলছিলাম ……

-তাতে কী হইসে, হ্যা? তুই আর প্রান্তি, দু’জনরেই আমি বন্ধুর চোখে দেখি, বুঝলি? এখন এতো একসেস ভাবাটা আবেগ ছাড়া কিছুই না। আর সবচেয়ে বড় কথা হইলো, ও হইতাসে ধনী বাপের একমাত্র দুলালি, আর আমি নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবারের। আকাশপাতাল পার্থক্য আমাদের মধ্যে। তাই এসব ফাউল মার্কা চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বল। তুই এতো আস্কারা দিস না। কয়েকদিন পর এসব আবেগ কেটে যাবে।

বলে খট করে ফোন কেটে দিলো আহান। ওর কথায় ভুল নেই। কিন্তু প্রান্তিকে দেখেও মনে হচ্ছে না, এটা শুধু আবেগ। আহানকে আরেকবার বুঝিয়ে বলতে হবে।
___________________

প্রণবের ঘরে সবার দৃষ্টি আড়াল করে প্রবেশ করেছে স্পৃহা। আজ এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য এটাই। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে এ বাড়িতে এসেছে সে! এই ঘরে তো কিছুনা কিছু আছেই!

প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে খোজাখুজির পরও তেমন কিছু পেল না স্পৃহা, যেটায় ওর প্রশ্ন গুলোর উত্তর পাবে সে। ক্লান্ত দৃষ্টিতে সারা ঘরে চোখ বুলাতেই কাবার্ডের ওপর চোখ পড়লো তার। দেখে মনে হচ্ছে এটাতে শুধু কাপড়চোপড়-ই রাখা। তবুও একবার খুঁজে দেখা উচিত। ভেবেই কাবার্ডটা খুলে খোঁজা শুরু করলো স্পৃহা। সবশেষে ওপরের তাকে হাত ছোঁয়াতেই শক্ত কিছু আছে বলে মনে হলো। নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে না। স্পৃহা দুই হাত উঁচিয়ে সেটা নামালো বহু কষ্টে। সুন্দর কারুকার্যে খচিত একটা কাঠের বক্স! স্পৃহার চোখ চকচক করে উঠলো মুহুর্তেই। তড়িঘড়ি করে বিছানায় বসে সেটা মেলে ধরতেই ভেতরে একটা ডায়েরি পেল। তার নিচে সাদা রঙের লালপেড়ে সুতি শাড়ি।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো। এসবের মানে কী? চিন্তিত ভঙ্গিতে ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি পেল স্পৃহা। চোখ দুটো বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেল। এটা তো তার ছবি! বহু পুরাতন ছবি। ক্লাস এইট বা নাইনে পড়াকালীন তোলা। এটা প্রণব কীভাবে পেল?

ডায়েরির কভারটা হালকা উচুনিচু লাগছে। ভেতরে হাত ঢুকাতেই একটা পায়েল বেড়িয়ে এলো। এটাও স্পৃহার। স্পন্দন দিয়েছিল ওকে। কিন্তু ভার্সিটিতে হারিয়ে গিয়েছিল এটা। এটাই বা প্রণবের কাছে কীভাবে এলো?

ডায়েরি পুরোটা উল্টেপাল্টে দেখে বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে ফেললো স্পৃহা। পুরো ডায়েরিটাই খালি। পুরো ব্ল্যাঙ্ক। কিচ্ছু লেখা নেই কোনো পৃষ্ঠায়। আজব তো!

ডায়েরিটা সরিয়ে রেখে শাড়িটা হাতে নিল স্পৃহা। শাড়ির নিচে একটা লাল কাগজ। হাতে নিতেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

“আমি জানতাম! আপনি আসবেন, আপনি খুঁজবেন। কিন্তু আপনার মানুষটা একদমই ব্যতিক্রমধর্মী, মিসেস নিস্তব্ধতা! সে অনুভূতি গুলো মনের কোণে জমিয়ে রাখতেই পছন্দ করে, ডায়েরির ভাজে নয়। আর সেটার প্রকাশ ঘটবে শুধুই নিস্তব্ধতার প্রণয়ের আড়ালে।”
_____________________

গাড়িতে গা এলিয়ে দিয়েছে প্রণব। আজই দেশে ফিরেছে সে। বেশ ক্লান্ত লাগছে এখন। ফোনটা হাতে নিলো। স্পৃহাকে একটা টেক্সট করা দরকার। যদিও মেয়েটা রিপ্লে দিবে না ওকে। শুধু দেখাটাই যেন তার কাজ! ভেবেই প্রণবের হাসি পায়।

মেসেজ সেন্ড হতেই ফোনটা বেজে উঠলো। স্পন্দনের নাম্বার। ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো সে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চেচামেচি ও কোলাহলের আওয়াজ ভেসে এলো কানে।

-হ্যালো!

অপর প্রান্ত থেকে স্পন্দন নিশ্চুপ। প্রণব চিন্তিত স্বরে বললো,

-ভাইয়া, কথা বলছেন না কেন? কিছু কি হয়েছে?

হঠাৎই স্পন্দনের ফুপিয়ে ওঠার আওয়াজ শুনতে পেল প্রণব। এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলো সে। স্পন্দন কাঁদছে কেন? ভীতসন্ত্রস্ত ও উত্তেজিত ভঙ্গিতে ঢোক গিললো প্রণব।
#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter

অন্তিম পর্ব.

-তোমার বাগান বাড়িতে আগুন লেগেছে, প্রণব। আগুনে পুড়ছে তোমার ডুপ্লেক্স বাংলোটা!

স্পন্দনের ধরা গলায় বলা কথাটা কানে পৌঁছুতেই চোখ দুটো সচকিত হয়ে উঠলো প্রণবের। বাংলোতে আগুন লেগেছে! এর আগেও তো দু’বার লাগার মতো অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু লাগার আগেই ব্যবস্থা নিতে পেরেছিল তারা। কিন্তু এবার ইলেক্ট্রিশিয়ান দিয়ে সব ঠিক করানোর পরও আগুন লেগেই গেল। ইলেকট্রিক্যাল স্ট্রাকচারেই মূল সমস্যা – এটা তারা বলেই গিয়েছিল। আগুন লাগাটা অসম্ভব কিছু না। তবে সে তো ওয়াটার সিংকিং সিস্টেমের ব্যবস্থাও করে রেখেছে, যেন আগুন লাগলেও কারো ক্ষতি না হয়! ভেবেই হতাশ কন্ঠে বললো,

-বাড়ির ভেতরেই তো শুধু সার্ভেন্ট আর কেয়ারটেকার ছিল! আর তারা তো নিচ তলায় থাকে। সবাই বের হতে পারার কথা।

স্পন্দনের কান্নার আওয়াজ যেন আরো ঘন হলো। কোলাহলের মাঝেও শব্দটা কর্ণকুহরে বারবার তরঙ্গিত হচ্ছে প্রণবের। দৃষ্টি মুহূর্তেই টানটান হয়ে গেল তার। স্পন্দন সেই প্রথম থেকেই কাঁদছে। কেন কাঁদছে? ওকে তো কখনো কাঁদতে দেখেনি প্রণব! স্পন্দন শুধু স্পৃহার ব্যাপারেই দূর্বল। স্পৃহার কি কিছু হয়েছে? ভাবতেই গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে ওর।

-আপনি কাঁদছেন কেন, ভাইয়া? কান্না করার মতো কিছু ……

কথাটুকু আর শেষ করতে পারলো না প্রণব। স্পন্দনের গুমরে ওঠা আর্তনাদ ওর বাকপথ অজান্তেই বন্ধ করে দিয়েছে,

-আমার বোনকে বাঁচাও, প্রণব! আমার বোনটা মরে যাবে। প্লিজ, বাঁচাও ওকে। তুমি তোহ্…… তুমি তো আমাকে ক্ কথা দিয়েছিলে, তাই না? সবসময় ওর পাশে থাকবে। কোনো বিপদ ওকে স্পর্শ করতে পারবে না, তুমি ওর পাশে থাকলে। এমনটাই তো বলেছিলে তুমি! আজ ও ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। এই আগুনে আমার পিহু পুড়ে শেষ হয়ে যাবে! কীভাবে সহ্য করবো আমি? বাড়ির ভেতরে আমার বোনটা হয়তো পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে! তুমি ……

বাকি কথা আর প্রণবের কানে পৌঁছতে পারলো না। ফোনটা হাত গলিয়ে কান থেকে পড়ে গেছে। কোথায় পড়লো, তা জানার ইচ্ছে নেই তার। স্থির হয়ে পাথরের মতো বসে আছে সে। থমকে গেছে প্রণব! মুহূর্তেই থমকে গেছে ওর দুনিয়া। স্পৃহা! ওর মিসেস নিস্তব্ধতা! স্পন্দন এসব কী বললো? কেন বললো? কথাগুলো কানে বাজছে বারবার। স্পন্দনের আহাজারি! সারা শরীর প্রচন্ড ভাবে কাঁপছে প্রণবের। ভারী একটা ঢোক গিলে কাঁপা হাতে কপালের ঘাম টুকু মুছলো!

বাংলোর সামনে হৈচৈ ও কোলাহলে মুখরিত পরিবেশ। ফায়ার সার্ভিস ও দমকল বাহিনীর তীব্র সাইরেন। নরম রোদের প্রকৃতিও এখন বিপন্ন ঠেকছে। সাদা মেঘে ঢাকা আকাশটা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। পোড়া বিদঘুটে গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আগুন এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও, তার উত্তাপ কমেনি কোনো অংশে। সাদা প্রাসাদ তুল্য বাড়িটার ভেতর থেকে জ্বলতে থাকা রক্তিম ও হরিদ্রাভ অগ্নিশিখা চোখ ঝলসে দিচ্ছে। দেয়ালগুলো কালচে ঠেকছে। এই নির্জন এলাকায় শুধু আগুনের কারনে আজ কতশত মানুষের আগমন।

গাড়ি থেকে নেমে এমন পরিবেশ দেখে প্রণবের সব শক্তি যেন নিমেষেই হারিয়ে গেছে। সুঠাম দেহটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতেও বেগ পেতে হচ্ছে ওকে। মনে মনে একটাই কথা ঘুরছে,

-এই বাড়ির ভেতরে স্পৃহা নেই। এখানে স্পৃহা থাকতে পারে না। স্পন্দন মিথ্যে বলেছে। নির্ঘাত মিথ্যে বলেছে।

হুট করে স্পন্দন কোত্থেকে এসে প্রণবের দুই হাত আঁকড়ে ধরলো। প্রণব চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। সবাই উপস্থিত এখানে। ওর বাবা, মা, প্রান্তি, আনিলা, স্পৃহার বাবা, মা, আহান, নীড়সহ বাকি সবাই। কিন্তু আশ্চর্য! ওরা কাঁদছে কেন? সবার চোখে পানি কেন? মুখে এমন ভয়ের ছাপ কেন? সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে প্রণব স্পন্দনের দিকে তাকালো। সেও কাঁদছে? তার মানে, সত্যিই স্পৃহা বাংলোর ভেতরে?

-স্পৃহা কোথায়, ভাইয়া? আপনারা কাঁদছেন কেন? ফোনে ওসব মিথ্যে বলেছেন আপনি আমায়, তাই না? প্লিজ, বলুন! ওসব মিথ্যে কথা ছিল। স্পৃহা, আমার মিসেস নিস্তব্ধতা! ও এই আগুনের ভেতর নেই। একবার বলুন।

চিৎকার করে কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিয়েছে প্রণব। কেন কান্না পাচ্ছে? স্পৃহা তো এই বাংলোর ভেতরে নেই! ও থাকতে পারে না এখানে! তাহলে ওর কেন নিজেকে এমন পাগল পাগল লাগছে?

-স্পৃহা এখানেই এসেছিল। সকাল থেকে এখানে অপেক্ষা করছিল ও তোমার জন্য। সার্ভেন্টদের মধ্যে যারা বেরোতে পেরেছে, তারা বলেছে আগুন লাগার সময় স্পৃহা দোতলায় ছিল। আর ও বের হতে পারেনি। তার মানে……

মিস্টার চৌধুরীর বলা কথাগুলো শুনে প্রণব নিজের সামনে থেকে স্পন্দনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ঠিক-বেঠিক বিবেচনা বোধ হারিয়ে গেছে ওর। চেঁচিয়ে উঠে বললো,

-তার মানে ও এই আগুনের ভেতরে? তোমরা… তোমরা এতোক্ষণে আমার বলছো এ কথা? আরে আমার মিসেস নিস্তব্ধতা বের হতে পারছে না ভেতর থেকে। ওকে বের করে আনতে হবে আমায়। সরো তোমরা। আমি ওকে বের করে না আনলে ওর গায়ে আগুন লেগে যাবে তো!

বলেই প্রণব বাংলোর দিকে ছুট লাগালো। কেউ আটকাতেই পারলো না ওকে। মিসেস মেহরীন আর প্রান্তি কেঁদেই দিয়েছে প্রণবের পাগলামি দেখে। তারা এই ভয়টা-ই পাচ্ছিলো।

অকস্মাৎ একজোড়া বলিষ্ঠ হাত ঝাপটে ধরে আঁটকে দিলো প্রণবকে। প্রণব কাঁদছে আর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলছে,

-ছাড়ো আমায়! কেন আটকালে? আমার স্পৃহা যে কষ্ট পাচ্ছে! আমাকে ওর কাছে যেতে দাও। ওর গায়ে আগুনের তাপ লাগছে না? ও ব্যথায় কাঁদছে! সহ্য হচ্ছে না আমার। একটুও সহ্য হচ্ছে না। ওর কাছে যাবো আমি। ওকে বাঁচাতে হবে আমার!

-পাগলামি করিস না, প্রণব! এই আগুনে গেলে তুই নিজেই পুড়ে যাবি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসুক আগে।

প্রণব রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওকে ধরে রাখা ব্যক্তিটির ওপর। আদ্র! আদ্র-ই ঝাপটে ধরে রেখেছে ওকে। প্রণব ওর থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য কতোগুলো কিল-ঘুষি-ধাক্কা দিলো হিসেব নেই।

-ছাড় আমাকে। তুই চাস না মিসেস নিস্তব্ধতা বেঁচে থাকুক। আমি জানি সেটা! এতো জঘন্য তুই? আমি থাকতে স্পৃহার কিচ্ছু হবে না। ওকে ছাড়া থাকবো কীভাবে আমি? দমবন্ধ হয়ে যাবে আমার। ছাড় তুই আমায়!

আদ্র চেষ্টা করেও ওকে আটকে রাখতে পারছে না। স্পন্দন, আহানেরাও ওকে গিয়ে ধরলো। কিন্তু প্রণব নাছোড়বান্দার মতো আগুনের ভেতর চলে যেতে চাইছে। এমন পাগলও হয়? এই আগুনে কোনো মানবদেহের আদৌ টিকে থাকা সম্ভব? কিন্তু সেটা প্রণবকে কে বোঝাবে?
__________________________

স্বচ্ছ দিবালোক! প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে নরম রোদের মিষ্টতা। লেকে টলমলে পরিষ্কার পানিতে ফুটে উঠছে পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রবীন বৃক্ষের প্রতিকৃতি। তার ডালে বসে কোকিলের কুহুতান যেন থামছেই না। গাছটায় হেলান দিয়ে বসে সেই পাগল প্রেমিক কোকিলের তোলা সুরগুলো শুনছে। চোখ দুটো বন্ধ তার। কিন্তু চোখের নিচের গভীর কালো দাগ দুটো ওর সহস্র নির্ঘুম রাতের প্রতীক। কোলে মেলে রাখা ডায়েরিটায় হাত দুটোর স্পর্শ চলছে অনবরত। যেন অতি ভালোবেসে ছুঁয়ে দিচ্ছে বস্তুটাকে। কিন্তু এটা কি তার কাছে শুধুই একটা বস্তু? সে নিজেই একমাত্র জানে হয়তো!

প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে। নিয়ম মেনেই এসেছে সে। বরাবরের মতোই নিয়ে এসেছে রঙের বহর। এরকম বসন্ত তার জীবনেও এসেছিল। রঙিন বসন্ত। আরো দশ বছর আগে। ভাবতেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত হলো প্রণবের। বদ্ধ চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে সেই প্রথম দেখা ষোড়শী প্রণয়িনীর প্রতিচ্ছবি। আনিলার জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। সবেমাত্র এইচএসসির কোঠা পেরিয়েছে প্রণব। আবেগগুলো ধীরে ধীরে অনুভূতিতে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে তখন। আনিলার জন্মদিনেই প্রথম দেখেছিল সে স্পৃহাকে। আনিলার সাথে তখন আয়াফের সম্পর্কের সূচনা পর্ব। সেই সুবাদে আহির আর স্পন্দনও সেখানে গিয়েছিল। আর স্পন্দনের সাথে ছিল সেই ষোড়শী কিশোরী। প্রথম দেখায় ভালোবাসার মতো কিছু ঘটেনি প্রণবের সাথে। কিন্তু মেয়েটাকে সবার থেকে আলাদা মনে হয়েছিল। এই বয়সে এতো চুপচাপ! চোখে মুখে অদ্ভুত ভীতি ও আতঙ্ক নজর কেড়েছিল প্রণবের। তখনই নাম দিয়েছিল ‘নিস্তব্ধতা’। কথা বলতে গিয়েছিল সে। কিন্তু স্পৃহা ওর কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ভয়ে। পুরো সময়টাতে প্রণব খেয়াল করেছিল ওকে। অকারণেই! কয়েকটা ছবিও তুলেছিল আড়ালে। এসব-ই ওর রাতের ঘুম কেড়ে নেবে, সে কি জানতো? যখন নিজেকে বুঝতে পেরেছে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আনিলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রিয় ব্যক্তিটিকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা কম করেনি সে।

কিন্তু এরই মধ্যে স্পৃহার জীবনে এতো গুলো মোড় চলে আসবে, সেটা প্রণবের কল্পজগতেও আসেনি। প্রান্তির মুখে সারাজীবন পিহু নামে শুনে আসা মানবীটি-ই যে তার প্রেয়সী, সেটাও জেনেছে অসময়ে। ভার্সিটির গেইটের সামনে থেকে স্পৃহার পায়েলটা পেয়েছিল। প্রথম দেখাতেই সেই পায়েল চোখে পড়েছিল প্রণবের। তবে স্মৃতিতে একটু ভাটা পড়ায় সন্দেহও ছিল, এটা কি আদৌও নিস্তব্ধতার? তবুও যত্নে রেখে দিয়েছিল সেটা। বিশ্বাস ছিল, নিস্তব্ধতা ফিরবে। ফিরেছে-ও! দৈবাৎ ভাবে। প্রেগন্যান্সি ও মিসক্যারেজ- এর জন্য পরিবর্তন এসেছিল স্পৃহার মধ্যে। এক দেখায় চিনে উঠতে পারেনি সে। পরিস্থিতিও এসব ভাবতে দেওয়ার অনুকূলে ছিল না। কিন্তু প্রান্তির মুখে প্রথম বারের মতো পিহুর প্রকৃত নাম স্পৃহা শুনে চিনে ফেলেছিল প্রণব। আর সে রাতেই স্পন্দনকে নিজের বাড়িতে দেখে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু তার নিস্তব্ধতার মনে তখন অন্য ব্যক্তির বাস! রাতের আড়ালে সে ‘আহির’ নাম জপতো। বিয়েও হয়ে গিয়েছিল স্পৃহার। ভয়ংকর কান্না কেঁদেছিল সে সেদিন। যখন আদ্রের ব্যাপারটাও জানতে পারলো, তখন-ই সবার অজান্তে নিজের সাথে নিজের নিস্তব্ধতাকে বেঁধে নিয়েছে সে। অতি সংগোপনে ও জটিল ভাবে। হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়া ভালোবাসা! একান্তই নিজের করে ফিরে পাওয়ার আনন্দটা কেমন ছিল, বর্ণনা করা অসম্ভব। হয়তো সে তাকে ভালোবাসে না। কিন্তু দ্বিতীয় প্রেমের জোয়ার উঠবেই- এটা তার বিশ্বাস ছিল।

-সেই বিশ্বাস হারে নি, মিসেস নিস্তব্ধতা। আমার বিশ্বাস হারেনি। যদিও আমি নিজেই হেরে গিয়েছি।

বিরবির করে কয়েকবার কথাটা বললো প্রণব। চোখের কোণে জমে থাকা পানিগুলো গড়িয়ে পড়লো। চোখ মেলে তাকালো সে। ডায়েরির লেখায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। প্রণবের সেই প্রথম লাল কাগজে লেখা চিঠিটা। স্পৃহা যত্ন করে রেখে দিয়েছে ডায়েরির গায়ে। কোণায় লিখেছে,

“আমি কঠিন, আমি নিষ্ঠুর। এই পাথর হৃদয়ে কেন নিজের স্থান করে নিতে চাইছো তুমি? কেন ‘তুমি’ বলতে ইচ্ছে করছে তোমায়? এটা তো আবেগ নয়! কিন্তু মনের আঙিনায় ক্ষত হয়েছে। ভয়াবহ ব্যাধি। দুঃসহ রোগ। এটাই কি তবে দ্বিতীয় বসন্তের প্রত্যূষাগমন?”

লেখাটায় আঙুল ছোঁয়ালো প্রণব। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে এসেছে ওর। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই বিষাক্ত স্মৃতির পাতা……

🍁
আগুন একটু দম নিয়ে দ্বিতীয় মাত্রায় কয়েকগুন বেড়ে গেছে। প্রণবকে ধরে বেঁধে আটকে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে গেছে এখন। ও ভেতরে যাবেই! সবাই ভেঙে পড়লেও ওকে সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন সময় কয়েকজন প্রণবের দিকে ছুটে আসলো। তারা আগুন নেভানোর কাজেই ছিল। এদিকে কেন আসছে বুঝতে না পেরে সবাই প্রশ্নসূচক চাহনি নিক্ষেপ করলো।

-বাংলোর পেছনের দিকে এক মেয়ে পাওয়া গেছে। শাড়ি পরা ছিল। হাত আর গায়ের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। মেয়েটা হয়তো পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়েছে কোনো মতে। জ্ঞান আছে, কিন্তু বাঁচবে বলে মনে হয় না। শ্বাস নিতে পারছে না ঠিক মতো।

প্রণব এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললো,

-ক্ কোথায় ও? কোথায়? আমি ওর কাছে যাবো। বলো কোথায় র…

অদূর থেকে স্ট্রেচারে করে সাদা কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আসা হলো মেয়েটাকে। গলা থেকে পা পর্যন্ত আবৃত হলেও মুখটা খোলা-ই। সারা মুখে অনেক জায়গায়ই কালি লেগে আছে তার। কিন্তু কারো চিনতে অসুবিধা হলো না এটা কে! কান্নারা আবারো এসে ভীড় করলো। প্রণব আটকাতে চাইলো ওদের। মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-ওর ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। এখন পাগলামি করে সময় নষ্ট করো না, প্রণব।

প্রণব দমে গেল। সত্যিই, তাড়াতাড়ি স্পৃহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু স্পৃহা আবছা চোখে সবাইকেই একটু-আধটু দেখছে। স্ট্রেচার বহনকারীর হাত আঁকড়ে ধরলো সে। তাদের পা থেমে গেল। স্পৃহা পোড়া হাত দিয়ে প্রণবকে ইশারা করলো। শুধু হাতটা দেখেই প্রণব দিগ্বিদিক ভুলে গেছে। এক ছুটে এসে স্পৃহার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে ও। কালিমাখা মুখটায় কতগুলো চুমো দিলো, হিসেব নেই। প্রণবের চোখের পানিতে স্পৃহার মুখ পুরো ভিজে যাচ্ছে। স্পৃহার চোখ দিয়ে প্রথম থেকেই পানি ঝরছে।

-আপনার কিছু হবে না, মিসেস নিস্তব্ধতা! কিছু হবে না। কেন এখানে এসেছেন আপনি? এই আগুনকে কেন সুযোগ দিলেন আপনাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়ার? কেন?

বলেই স্পৃহার পোড়া হাতটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো প্রণব। স্পৃহা হাসলো যেন! এসেছিল তো প্রণবকে নিজের মনে কথা গুলো বলতে আজ। সেই লালপেড়ে সাদা শাড়িটা জড়িয়েছিল গায়ে। এখান থেকেই নতুন পথচলার সূচনা চেয়েছিল সে। কিন্তু ভাগ্য তো শুরুর আগেই সবকিছুর ইতি টেনে দিলো। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,

-আপনার সাথে হাজার বছর বাচার স্বপ্ন ছিল আমার। জানি সেটা পূরণ হওয়ার নয়। তবে আমৃত্যু আপনাকে পাশে চেয়েছিলাম। সেই ইচ্ছে পুরন হয়েছে। কিন্তু আপনার সাথে আমার পথচলা হলো না, গায়ক সাহেব। আপনিময় সংসার হলো না। সময় শেষ আমার। এই বিদায়ের সময় আপনাকে বলতে চাই, আপনি পেরেছেন! আমার মনে নিজের স্থান তৈরি করতে। ভালোবাসি আপনাকে। আপনার বিশ্বাস জিতে গেছে। ভালোবেসে বিদায় নিচ্ছি আমি। কাঁদবেন না কখনো আমার কথা ভেবে। প্লিজ! কখনো কাঁদবেন না। আপনার কান্না আমারও সহ্য হবে না। আপনার কষ্ট দূরে বসে দেখবো কীভাবে আমি বলুন? এসে তো আপনার চোখের পানি মুছে দিতে পারবো না। দূর থেকে আমিও কাঁদবো তখন। আজ থেকে আমি একা হয়ে যাবো। আপনার বুকে মাথা রাখার অনেক ইচ্ছে ছিল, গায়ক সাহেব। সেটাও পূরণ হলো। আপনাকে জুড়ে জীবনটা পূর্ণতা পেল না আমার। তবে আপনি অপূর্ণ থাকবেন না। ভালো থাকবেন।

স্পৃহার ভাঙা ভাঙা কথাগুলো প্রণবের দেহ থেকে যেন আত্মাকে আলাদা করে দিচ্ছে। স্পৃহা চোখ মেলে রাখতে পারছে না। বারবার বুঁজে আসছে চোখ জোড়া। প্রণব ওর গাল দুটো দুই হাতে আগলে ধরে বললো,

-হেই, মিসেস নিস্তব্ধতা! চোখ বন্ধ করবেন না, আপনি। একদম চোখ বুজবেন না। আপনি ছাড়া আমার নিঃশ্বাস কীভাবে চলবে? আমি নিস্তব্ধতা বলে কাকে ডাকবো? কে আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেবে? আপনাকে ছাড়া দেহ চললেও প্রাণ চলবে না, মিসেস নিস্তব্ধতা। আপনি আমায় একা করে যেতে পারেন না। ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করেছি বলে এতো বড় শাস্তি দিতে পারেন না। চোখ খুলে রা……

স্পৃহা চোখ খুলে রাখতে পারলো না। প্রণব থমকে গেল। আদ্র পালস চেক করলো। অনেক ধীর গতিতে চলছে। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো। স্পৃহার বাবা-মাও আজ কাঁদছে। প্রচুর কাঁদছে। এই মেয়েকে তো তারা কতো অবহেলা করেছে। স্পৃহার জন্মের পর পরই ওর বাবার ব্যবসায়ে ধস নামে। পুরনো ধ্যানধারণা জেঁকে বসেছিল স্পৃহার মায়ের মধ্যে। তাতে ঘি ঢেলেছিল স্পৃহার ফুপি। অপয়া- শব্দটা জুড়ে গিয়েছিল নামের আগে। তখন থেকেই স্পৃহার অযত্নের শুরু। সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল স্পৃহার বাবাকে। মেয়েকে তেমন সময় দিতে পারতেন না তিনি। ইচ্ছেও ছিল না। তাই মায়াটাও সেভাবে জন্মেনি মেয়ের প্রতি। আজ আফসোস হচ্ছে তাদের। ভয়াবহ আফসোস! হাউমাউ করে কেদেও আজ সেই দিনগুলো ফিরে পাবেন না তারা। স্পৃহাকেও ফিরে পাবেন না হয়তো। পুরনো দিন গুলো আজ তাদের পুড়িয়ে মারছে। কি নিষ্ঠুর বাবা-মা তারা!! মা-বাবার কলঙ্ক তারা!!
🍁

হসপিটালে দ্বিতীয় দিন-ই ছিল সেই বিষাক্ত দিন। অতি সন্তর্পণে পরপারে পাড়ি জমিয়েছিল প্রণবের নিস্তব্ধতা। তার পয়তাল্লিশ ভাগ পুড়ে যাওয়া দেহটা দেখেছিল প্রণব। সেদিন থেকেই মনটাও ঝলসে গেছে ওর। চারটা বছর পেরিয়ে গেছে আজ। তবুও প্রতিটা মুহুর্ত কাঁদে সে। প্রতিটা মুহূর্তে মনে আসে স্পৃহা নামক মানবীটা। কাঁদিয়েই ছাড়ে ওকে। নাক টানলো প্রণব। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনি কি কাঁদছেন, মিসেস নিস্তব্ধতা? আমি কাঁদছি, সেটা দেখতে পাচ্ছেন আপনি? আপনার কষ্ট হচ্ছে? আমার কিন্তু অনেক কষ্ট হচ্ছে! আপনি সেটা দেখে কষ্ট পেয়েন না। আপনার শেষ কথাটা রাখতে পারিনি আমি। কী করবো বলুন? প্রচন্ড কষ্ট হয়! নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। কাঁদতে না চাইলেও মন মানে না। চোখ দুটোও শোনে না কোনো বারণ। পানি ঝরাতে পারে বলেই হয়তো শ্বাস চলছে। যেদিন চোখের পানি ফুরিয়ে যাবে, সেদিন শ্বাসও থেমে যাবে।

বলেই চোখ দুটো মুছলো সে। ডায়েরির দ্বিতীয় ও শেষ লেখাটায় তাকালো,

“আপনার বিশ্বাস জিতে গেছে, গায়ক সাহেব! ভালোবাসি আপনাকে। কখন, কীভাবে এমনটা হলো? মনের অজান্তেই! কালকে দেশে ফিরছেন আপনি। আর কাল-ই নতুনভাবে শুরু হবে আমাদের জীবন নতুন সেই বাংলোতে। আপনার মিসেস নিস্তব্ধতা পুরোপুরি আপনার হয়ে যাবে।”

আরেক দফা জলে ভাসলো প্রণবের কপল ও গলদেশ। কান্নারা দলা পাকিয়ে ভীড় জমালো গলায়,

-শুরু হওয়ার আগেই তো পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল, মিসেস নিস্তব্ধতা। আমার হওয়ার আগেই আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন আপনি। আমি তো জিতেও হেরে গেলাম! ‘ভালেবাসি’ কথাটাই বলা হলো না আপনাকে। অথচ আপনি ঠিকই বলে গেলেন। এভাবে পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে যাবেন জানলে আপনাকে নিস্তব্ধতা বলে সম্বোধন করতাম না। কোনোদিনও করতাম না।

প্রান্তি অদূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। পাশে আহান, আনিলা, স্পন্দন, মেঘা, আদ্র সবাই-ই আছে। প্রণব এতোদিনে একই রকম আছে। গিটার ছেড়েছে সেদিনই, যেদিন নিস্তব্ধতা ওর থেকে হারিয়ে গেছে। চার-চারটে রংহীন বসন্ত পেরিয়ে গেছে। প্রণবের মুখের হাসিটাও এখন আর দেখা যায় না। বেঁচে থাকার মতোই বেঁচে আছে সে। শ্বাস নিয়ে, নিঃশ্বাস ছেড়ে। শ্রান্ত বিকেল গুলোতে আকাশের সাথে কথা বলে। রাতের আঁধারিয়া অম্বরে নোনা জলে বালিশ ভিজিয়ে। মন থেকে সরাতে পারেনি সেই প্রিয়দর্শিনীকে! তার মিসেস নিস্তব্ধতাকে। পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে সে। সেটা টানা অক্ষিদ্বয় এখন কারো দিকে তাকায় না। সেই সরু ভ্রদ্বয় এখন কারো কথায় কুঞ্চিত হয় না। সেই হলদেটে ত্বক এখন সূর্য কিরণে চকচক করে উঠে না। সেই মানবীটি এখন কষ্টের অশ্রু ঝরায় না। কষ্ট পেয়ে আবার কষ্ট নিয়েই চলে গেছে সে। কোনো বিনিময় আশা করেনি। পৃথিবীর মাটি থেকে সরে গেছে স্পৃহা নামটি। কিন্তু কেউ একজনের মন থেকে সে মুছে যেতে পারেনি। হয়তো পারবেও না। চিরদিন-ই রয়ে যাবে। হয়তো এতেই প্রাপ্তি, এতেই সুখ।

🍂সমাপ্ত🍂

৩১.০১.২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here