তুমি আমার প্রিয়তমা পর্ব ১৩+১৪

#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#পর্ব_১৩

সেদিন প্রিয়তাকে ঘোরের মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেছিলো সৌরভ তার হাতের অনামিকা আঙুলে স্বর্ণের একটা আংটি পড়িয়ে দিয়ে।প্রিয়তা ভাবেও নি এত সারপ্রাইজ্ড হবে সে।কল্পনাও যে বাস্তব হতে পারে তা বেচারির ধারণাতীত ছিলো।ভাবেই নি কখনো ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে খেতে গিয়ে নিজেরও একটা হিল্লে হয়ে যাবে!
তারপর কেটে গেছে পুরো একটাসপ্তাহ।আজ সৌরভ ও প্রিয়তার বিয়ে।সকাল থেকেই সবাই ভীষণ ব্যস্ত।একটা বিয়ে কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটা বিয়ের বন্দোবস্ত হয়ে গেছে।

এই একসপ্তাহ সৌরভের সাথে প্রিয়তার কোনো কথা হয় নি।দেখা হয়েছে মোটে একবার।সৌরভ প্রিয়তার হাতের মাপ,জুতার মাপ ও ব্লাউজের মাপ নিতে এসেছিলো তার মা চাচীদের সাথে।তখন একবার দেখা হয়েছিলো।প্রিয়তার জন্য কোনো শপিং টপিং কিছুই করতে হয় নি,কারণ সৌরভ কানাডা থেকে আসার সময় বিয়ের লেহেঙ্গা থেকে শুরু করে সবকিছু কিনে নিয়ে এসেছে।ওখান থেকে রোজগার করে মাকে টাকা দিয়েছিলো স্বর্ণের গহনা বানানোর জন্য।মিসেস মিনা অনেক গহনা বানিয়ে রেখেছেন সৌরভের বউয়ের জন্য।সবকিছু আগে থেকেই রেডি করা।এখন শুধু বিয়েটা করা বাকি।

বিয়ের দুদিন আগে বিয়ের লেহেঙ্গা গহনা সাজগোজের জিনিস সবকিছু প্যাকিং করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।প্রিয়তার আত্মীয়রা সৌরভের কিনে আনা সব জিনিস দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।কারণ প্রত্যেকটা কাপড় চোপড়ই দামী ব্রান্ডেড এবং কালারগুলোও অনেক বেশি আকর্ষণীয়।প্রিয়তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সৌরভের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে।এবং আজকেই তাদের বিয়ে।

সৌরভ আজকে গাঢ় মেরুন রঙের দামী শেরওয়ানি পড়েছে।ঠোঁটের কোণে একটুকরো তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তুলে নিজেকে আয়নায় পর্যবেক্ষণ করছে সে।তূর্য,আকিল,আবির ওরা সৌরভের পাশেই আছে।সৌরভের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো দুজন,ওরা বিয়েশাদি করে একজন লন্ডন,আরেকজন আমেরিকায় সেটেল।তাই তো ওরা বিয়েতে আসতে পারে নি।আবির সৌরভের হাসিমাখা চেহারা দেখে খোঁচা মারছে খালি।তবে বেশরমের মতো কিছু বলতেও পারছে না,কারণ যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে তাদেরই একমাত্র আদরের মামাতো বোন।

🖤

প্রিয়তাকে পার্লার থেকে আসা মেয়েরা সাজাচ্ছে।প্রিয়তা চুপচাপ বসে আছে।তানিয়া,মিশি আর জারা তার পাশেই বসে আছে।সৌরভ বলে দিয়েছে প্রিয়তা যেন বেশি সাজগোজ না করে।একদম সিম্পল ভাবে সাজতে বলে দিয়েছে তাকে।গর্জিয়াস মেকআপ করে নিজের চেহারা পরিবর্তন করাকে সৌরভ মোটেও পছন্দ করে না।

মেকআপ করা শেষে প্রিয়তার হাতে স্টোনের ও স্বর্ণের চুড়ি,আংটি এসব পরিয়ে দিচ্ছে মিশি আর তানিয়া।প্রিয়তা একদম চুপ করে আয়নায় নিজেকে দেখে যাচ্ছে।দরজার ওপাশ থেকে মিসেস প্রমি মেয়েকে দেখে আড়ালে চোখের জল মুছছেন।যতই শাসন ও বকাবকি করেন না কেন,একটামাত্র আদরের ছোট মেয়ে ওনার,কষ্টে বুকটা হাহাকার করছে।মায়ের মন বলে কথা।মায়েরা তো এমনই হয়।আজ মেয়েটা স্বামীর ঘরে চলে যাবে,ওনার সারা বাড়ি ফাঁকা করে দিয়ে।আর কখনো দুষ্টামি করে বলে বকাবকি করা হবে না।আর কখনো আচার বেশি খায় বলে চিল্লাফাল্লা করতে পারবেন না।

মিসেস প্রমি ওনার চাচীকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কান্না করছেন।যদিও সৌরভদের বাসা আর ওনাদের বাসার দূরত্ব ১৫ মিনিটের মাত্র।মেয়েকে কাছেই বিয়ে দিচ্ছেন অথচ মন মানছে না তার।মুসকান সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত।একটামাত্র আদরের ছোট বোন তার।বিয়ের সমস্ত কাজ সুষ্ঠু ভাবে যাতে সম্পন্ন করা হয় তার সম্পূর্ণ তদারকি সে করছে।সারাদিনে কিছু খাওয়ার সময়টাও পায় নি।

মি.মুজাফফরও ব্যস্ত হয়ে আছেন ঠিকই,কিন্তু ওনার মন ভীষণ খারাপ।প্রিয়তা ওনার কলিজার টুকরো মেয়ে।অনেক চাওয়ার পর আল্লাহ প্রিয়তাকে দিয়েছেন।একটা মেয়ের শখ পূরণ হয়েছে ওনার ঠিকই কিন্তু মেয়েটাকে বেশিদিন নিজের কাছে রাখতে পারলেন না।বিয়ে ছেলেদের জন্য হয়তো অনেক খুশির,কিন্তু একটা মেয়ে এবং তার পরিবার জানে একজন সদস্য কমে যাওয়ার কষ্ট কেমন!ওনারা কাজেকর্মে নিজেদের ব্যস্ত রাখলেও তাদের চেহারায় ফুটে আছে বিমর্ষ ভাব।

প্রিয়তার পুরোপুরি সাজগোজ শেষ হতেই পার্লারের মেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।আজকে প্রিয়তাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে ঠিকই কিন্তু বড় নেকাব লাগানোয় তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না।লেহেঙ্গার সাথে বড় হিজাবও পড়েছে সে।হিজাবের ওপর আবার বড়সড় একটা স্টোনের কারুকাজ করা দোপাট্টা দেয়া।

প্রিয়তার মনের মধ্যে এক মিশ্র অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে।প্রথমত সৌরভকে নিজের করে পাওয়ার উচ্ছ্বাস,দ্বিতীয়ত মা,বাবা,ভাইকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট।এরকম অনুভূতির সম্মুখীন আজ প্রথম হতে হয়েছে তাকে।এই মিশ্র অনুভূতির তোপে পড়ে তার কেমন রিয়েক্ট করা উচিৎ সে সেটাই ভুলে গেছে।তাই তো চুপচাপ বসে আছে বিছানায়।

🖤

দামান (বর) এসেছে বলে উল্লসিত হয়ে ওঠেছে সেন্টারের বাইরের দাঁড়ানো সব ছেলে মেয়েরা।এরকম একটা কলরব প্রিয়তার কানে এলো।বাইরে যারা কলরব করছে ওরা সবাই প্রিয়তাদের আত্মীয় হয়।তানিয়া ফিসফিস করে বললো;

তানিয়া:-ভাইয়ারা এসে গেছে।তুই এখানে থাক প্রিয়ু,আমি এক্ষুনি আসছি।

তানিয়া তড়িঘড়ি করে চলে গেল।প্রিয়তার শরীরে হীম শীতল স্রোত বয়ে গেল সৌরভের আসার কথা শুনে।এমন আজব অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না সে।

সৌরভকে মিষ্টিমুখ করিয়ে সোজা সেন্টারের ভেতর প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া হলো।দুই বংশের মধ্যে প্রিয়তা সবার ছোট তাই তো সৌরভের শালা শালি কেউ নেই যে গেট আটকে টাকা আদায় করবে বা দুলাভাইয়ের সাথে দুষ্টামি করবে।সবাই এডাল্ট।

সৌরভ অন্যদিকের একটা হলরুমের সাজানো স্টেজে বসেছে।প্রিয়তা আরেকটা হলরুমের স্টেজে অবস্থান করছে।দুজন দুই জায়গায়।সৌরভের সাথে সবাই ছবি তুলছে।সৌরভও বর সুলভ স্বাভাবিক আচরণ করছে সবার সাথে।প্রিয়তার সাথে নিজ ভাই ছাড়া অন্য কোনো ছেলের ফটো তোলা এলাউ করছে না মুসকান।সেও সৌরভের ক্যাটাগরির।

সবার খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে সৌরভ ও প্রিয়তাকে একটা স্টেজে একসাথে বসানো হলো।সৌরভ তো চোখ ফেরাতে ভুলে গেছে প্রিয়তাকে দেখে।নেকাব লাগানো ও হিজাব পড়া সত্ত্বেও মেয়েটাকে অনেক মোহনীয় লাগছে তার কাছে।টকটকে মেরুন রঙের লেহেঙ্গা,হিজাব,নেকাব।সাথে স্বর্ণের গহনা ও স্টোনের গহনা।হাইহিল জুতা পায়ে।নরমাল পার্টি মেকআপে তাকে জোসস লাগছে দেখতে।

প্রিয়তা লজ্জার কারণে তাকাতে পারছে না সৌরভের দিকে।সৌরভ বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো শুধু।দুজনের ওপর ফুলের বর্ষণ হচ্ছে।একজন আরেকজনের দিকে আরচোখে বারবার তাকাচ্ছে।চোখে চোখে প্রেম নিবেদন করছে দুজন।

একটু পর কাজী সাহেব ও উকিল এলেন বিয়ে পড়ানোর জন্য।সাথে মুরব্বিরাও ছিলেন।সৌরভকে যখন কবুল বলতে বলা হলো,তখন সৌরভ মোটেও সময় নেয় নি।সে সাবলীলভাবে কবুল বলে দিয়ে কাগজে সিগনেচার করে দিলো।

তবে প্রিয়তাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন সে একটু ঝিম মেরে গেল।মা বাবা ও ভাইকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে দুফোঁটা দুর্ভেদ্য জল তার চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে।কষ্টে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার।মুসকানের বিমর্ষ গম্ভীর চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে ধীর কন্ঠে কবুল বলে দিলো।সিগনেচার করার সময় কাগজের ওপর টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে তার অক্ষিকোটর থেকে।ব্যস দুজন বাঁধা পড়লো এক পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনে।বিয়ে হয়ে গেল তাদের।আজ থেকে আইনত ও ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী দুজন স্বামী স্ত্রী।

বেশ কিছুক্ষণ দুজনের ফটোসেশান চললো।ফটোগ্রাফার হলো আকিল আর তূর্য।টিপিকাল বিয়ের মতো অনেক কিছুই সৌরভ তার বিয়েতে স্কিপ করে গেছে।মুসকানও এতে খুশিমনে সায় দিয়েছে।সৌরভের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে তার পরিবারের লোকেরা সবাই জ্ঞাত তাই কেউ কোনো কথা বলে নি এ বিষয়ে।প্রিয়তাকে সোনাদানা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে সৌরভ।কোনোকিছুরই কোনো কমতি রাখে নি।এমনকি সে যে চাকরি করতে যাচ্ছে সেখানে মাসিক বেতনই প্রচুর টাকা।প্রিয়তার কোনো কিছুরই অভাব হতে দিবে না সে।

বিদায়ের সময় প্রিয়তা মুসকানকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না করছে।মুসকান নিজেও চোখের পানি ফেলছে সমানে।আজ থেকে আর কাউকে শাসন করতে হবে না।কেউ এসে আবদার ধরে বলবে না ভাইয়া আমায় আচার আর চকোলেট কিনে দাও।মুসকানের বুকে এক তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।কষ্টে বুকটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার।এত কষ্ট জীবনেও হয় নি।পাশে মিসেস প্রমিও কান্নাকাটি করছেন।তাকে মিসেস শিলা আর মিসেস মিনা সামলাচ্ছেন।

প্রিয়তা:-ভাইয়া আমি যাবো না কোথাও তোমাদের ছেড়ে।প্লিজ ভাইয়া আমাকে এভাবে বিদায় দিয়ো না।খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।কীভাবে থাকবো আমি তোমাদের ছেড়ে?বলো!

প্রিয়তার কান্না ও আহাজারি দেখে যারা ছিলেন পাশে ওনাদের সবার চোখে পানি চলে এসেছে।এমনকি তানিয়া,ডলি,জারা,মিশি,পান্না ওরাও চোখের পানি ফেলছে সমানে।কারও মুখে সান্ত্বনাটুকু দেয়ার ভাষা নেই।

প্রিয়তার এত কষ্ট সৌরভ সহ্য করতে পারলো না।তাই তো সে তার আব্বুকে দিয়ে জোর করিয়ে প্রিয়তার আব্বু আম্মু ও মুসকান সাথে তাদের নিকটাত্মীয় যারা প্রিয়তাদের বাসায় থাকবেন ওনাদের সবাইকে কষ্ট করে হলেও কনভিন্স করে ফেললো সৌরভদের বাসায় যাওয়ার জন্য।মুসকান নাকচ করতে গিয়েও পারলো না,বোনের এত কান্নাকাটি তারও সহ্য হচ্ছে না।তাই সবাই একসাথে রওনা দিলো সৌরভদের বাসার উদ্দেশ্যে।আগেই বলেছি সৌরভ এসব নিয়ম কানুনের ধারও ধারে না,এর মাঝে নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হয়েছে তাই কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না।

মুসকান ও আব্বু আম্মু সাথে যাচ্ছেন দেখে প্রিয়তা কান্নাকাটি অফ করে নিজে থেকেই লাল গোলাপ ফুলে সাজানো গাড়িতে ওঠে বসলো।সৌরভ আর প্রিয়তা এক গাড়িতে উঠে বসেছে।সৌরভের দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ছলছল নয়নে তাকালো প্রিয়তা।সৌরভ প্রিয়তার নেকাব তুলে দিয়ে দুচোখের জল মুছে দিলো সযত্নে।সৌরভের এত কেয়ার দেখে প্রিয়তা হাজার দফা মুগ্ধ হয়েছে।এত ভালো জীবনসঙ্গী পাওয়ার খুশিতে আল্লাহর কাছে কয়েকবার শুকরিয়া আদায় করলো সে।

🖤

বাসায় আসার পর সৌরভ প্রিয়তার হাত শক্ত করে ধরলো।তারপর দুজন দুজনার হাত ধরে বাসার ভেতর প্রবেশ করে।মিসেস মিনা দুজনকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিলে এশা আর ইশা ওদের দুজনকেই সোফায় নিয়ে বসালো।প্রিয়তা মুসকানের হাত ধরে বসে আছে চুপচাপ।কিছুক্ষণ পর মুসকান নিজের হাতে বোনকে রাতের খাবার খাইয়ে দিলো।যদিও তখন রাত সাড়ে ৯ টা বাজে।প্রিয়তা তৃপ্তি নিয়ে ভাইয়ের হাতে খাবার খেলো।সৌরভ মুখে হাসি নিয়ে ভাইবোনের ভালোবাসা দেখছে।মুসকান সৌরভের ছোট হলেও বোনের প্রতি টান সৌরভদের থেকেও বেশি।সৌরভ এত মারাত্মক পসেসিভ নয় বোনদের নিয়ে।ইদানীং মুসকানের মতো ভাই তেমন একটা পাওয়া যায় না।তবে প্রিয়তার ভাগ্য বলতে হবে!মুসকানের মতো এত ভালো একটা ভাই পেয়েছে সে!

ডলি,তানিয়া,ইশা,এশা,পান্না,জুই,জারা ও সারা ওরা প্রিয়তাকে সৌরভের রুমে নিয়ে রেখে এলো।সৌরভের সারা রুম জুড়ে ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে।ফুলের ঘ্রাণে ম-ম করছে সারা রুম।প্রিয়তা শুধু রুমের চারপাশে মুগ্ধ হয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে।এতদিন ধরে অন্যান্যদের বাসর ঘর দেখে আসছে,আর আজ নিজের জন্য সাজানো বাসর দেখে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেল মন জুড়ে।আজকে রাতের কথা ভাবতেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে তার মনের মাঝে।লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে সে।

অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না প্রিয়তার।কখন তার প্রাণের প্রণয়ীকে দেখতে পারবে সে নিয়েই চুপচাপ দরজা বরাবর তাকিয়ে বিছানায় বসে আছে প্রিয়তা।অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে সৌরভের আগমন ঘটলো রুমে।প্রিয়তা একটু নড়েচড়ে তারপর বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।তারপর সংকোচ নিয়ে এগিয়ে এসে সৌরভের পায়ে ধরে সালাম করতে নিলো।কিন্তু সৌরভ প্রিয়তার দুই বাহু আঁকড়ে ধরে আটকে ফেললো তাকে।প্রিয়তা প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকাতেই সৌরভ বললো;

সৌরভ:-পায়ে ধরে সালাম করতে নেই প্রিয়।মুখে সালাম দিতে পারো,তবে কখনো কাউকে পায়ে ধরে সালাম করতে যেও না।কেমন?

প্রিয়তা নিরবে মাথা হেলিয়ে সায় জানালো।সৌরভ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর পানে।সৌরভের চোখ এত সুন্দর রমণী যেন আগে কখনো দেখে নি।সৌরভ প্রিয়তার কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু খেল।প্রিয়তা আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।কলিজা কাঁপছে তার এক অদ্ভুত রকমের অনুভূতির কারণে।যা একমাত্র সৌরভের কাছাকাছি থাকলেই অনুভব হয়।এখন সৌরভকে এত কাছে পেয়ে প্রিয়তার যেন হার্টবিট তড়িৎ গতিতে লাফাচ্ছে।

সৌরভ:-আসসালামু আলাইকুম আমার প্রিয়তমা।আমার প্রাণের স্পন্দন।নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা রইলো প্রিয়।

প্রিয়তা দুহাত দিয়ে আলতো ভাবে ধরে রেখেছে সৌরভের শেরওয়ানির কোণা।অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌরভের দিকে।সৌরভ এত আদুরে কন্ঠে কথা বলছে যে নিজেকে তার কাছে আহ্লাদী কোনো রাজকুমারী মনে হচ্ছে।প্রিয়তা লজ্জায় কোনো জবাব দিতে পারলো না।সৌরভ তা বুঝতে পারলো।

সৌরভ:-গহনাসব খুলে কাপড় চেঞ্জ করে ওযু সেড়ে এসো।দুজন একসাথে এশার সালাত আদায় করবো।

প্রিয়তা কোনোমতে মাথা নুইয়ে সায় জানিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে এলো গহনাদি সব খোলার জন্য।কয়েক মুহূর্ত গহনা খোলার জন্য টানাটানি করলো প্রিয়তা কিন্তু একচুলও নড়াতে পারলো না।সৌরভ তা দেখে ঠোঁট টিপে হেসে প্রিয়তার দিকে এগিয়ে গেলো তাকে সাহায্য করার জন্য।প্রিয়তা সৌরভকে দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো।জানে না কেন এই লোকটাকে এত লজ্জা পাচ্ছে সে।এর আগে তো নির্লজ্জের মতো কী কান্ডটাই না ঘটিয়েছিলো।অথচ আজ লজ্জায় বাকহারা।

সৌরভ মনযোগ সহকারে প্রিয়তার পরণের সব গহনাদি খুলে সমস্ত পিন ছুটিয়ে দিলো।এরই মধ্যে প্রিয়তা আরচোখে অনেকবার সৌরভের দিকে তাকিয়েছে।সৌরভ যে খেয়াল করে নি তা না,সে ঠিকই খেয়াল করেছে যে প্রিয়তা তার পানে লুকিয়ে চুরিয়ে তাকাচ্ছে।সৌরভ কিছু বললো না।

সব ছোটানো হয়ে গেলে প্রিয়তা আলমারি থেকে নতুন সেলোয়ার-কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল চেঞ্জ করতে।প্রিয়তার ফ্রেশ হতে হতে সৌরভ ঘরেই কাপড় পাল্টে ফেললো।প্রায় পনেরো মিনিট পর প্রিয়তা কাপড় পাল্টে মেকআপ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে একদম ওযু করে বেরিয়ে এলো।প্রিয়তা আসতেই সৌরভ গিয়ে ওযু করে এলো।তারপর দুজনে নামাজে দাঁড়ালো জায়নামাজ বিছিয়ে।সৌরভ আগে আর প্রিয়তা পিছনে।

দুজনে নামাজ আদায় করে বিছানায় গিয়ে বসলো।সৌরভ তার সেন্টার টেবিলের ড্রয়ার থেকে বেশ বড় একটা প্যাকেট বের করলো।প্রিয়তা উৎসুক দৃষ্টিতে সৌরভের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছে।সৌরভ প্রিয়তার হাতে প্যাকেটটি তোলে দিয়ে বললো;

সৌরভ:-এতে তোমার মোহরানা সব রাখা আছে।নিজের কাছে রেখে দিয়ো।এবং যত টাকা খরচ করতে মন চায় করো।কেউ তোমায় মানা করবে না।দরকার হলে বলো আরও দিবো।

প্রিয়তা নিচু কন্ঠে জবাব দিলো;

প্রিয়তা:-জ্বী না আর কিছু লাগবে না।এই টাকাও আমার কোনো খরচে লাগবে কী না সন্দেহ আছে।আমার অহেতুক টাকা খরচ করার বাতিক নেই।

সৌরভ:-হুমম,ভালো।তারপরও তোমার পারসোনাল বলে কিছু কথা আছে।সবসময় প্রয়োজনে আমার কাছে চাইতে তোমার লজ্জা লাগতে পারে।তাই এই ব্যবস্থা।

সৌরভ বসা থেকে ওঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা বক্স নিয়ে এলো।বক্স খুলতেই প্রিয়তা বেশ কিছু নরমাল ও সিম্পল অর্নামেন্টস দেখতে পেল।সৌরভ নিজের হাতে প্রিয়তার হাতে চিকন দুটো স্বর্ণের চুড়ি,চিকন দুটি ডিজাইনার আংটি,একদম সিম্পল একজোড়া দুল ও একটা নাকফুল পরিয়ে দিলো।এগুলো কানাডা থেকে নিয়ে এসেছে সে।গলায় একটা চিকন চেইন,ও পায়ে একজোড়া পায়েল পড়িয়ে দিলো সৌরভ।

প্রিয়তা স্বপ্নীল চোখে সৌরভের দিকে তাকিয়ে আছে।বাসর নিয়ে প্রতিটা মেয়ে স্বপ্ন দেখে।প্রিয়তাও দেখেছিলো।কিন্তু তার বাসর রাত যে এত স্মরণীয় হবে তা সে কখনো কল্পনাও করে নি।সৌরভকে যত দেখছে ততই মোহিত হচ্ছে সে।নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।না জানি কোন নেকির কাজ করেছিলো সে যার জন্য এত ভালো একটা স্বামী পেয়েছে জীবনে।

সৌরভ প্রিয়তার কপালে হাত রেখে বিরবির করে কীসের যেন একটা দোয়া পাঠ করলো।প্রিয়তা এতই মুগ্ধ হয়ে সৌরভের দিকে তাকিয়ে আছে যে সে কী দোয়া পড়ছে তা জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেছে।সৌরভ প্রিয়তাকে বললো;

সৌরভ:-প্রিয়,ঘুমিয়ে যাও এখন।আজকে সারাদিন তোমার ওপর অনেক ধকল গিয়েছে।এখন ঘুমিয়ে রেস্ট নাও বরং নয়তো শরীর খারাপ করবে।

প্রিয়তা মুচকি হেসে টুপ করে সৌরভের গালে একটা চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে;

—-“এভাবেই দিন রাত ঢলে যায়,
মন আমার বারবার বলে যায়,
ভালোবেসে কোনো ভুল করি নি আমি।

সৌরভও মুচকি হেসে প্রিয়তার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকালো।প্রিয়তা বিছানায় শুয়ে পড়ে সৌরভের আসার অপেক্ষা করতে লাগে।সৌরভ রুমের লাইট নিভিয়ে প্রিয়তার পাশে এসে শু’লো।সৌরভ আসতেই প্রিয়তা কম্বল নিজের ও সৌরভের শরীরের ওপর দিয়ে সৌরভকে দুহাত দিয়ে ঝাপটে ধরলো।আজকে কোনো বাঁধা নেই।তাই সৌরভও প্রিয়তাকে নিজের বুকের সাথে আগলে নিলো।

প্রিয়তা:-আপনিও আমাকে পছন্দ করতেন তাই না?ওই যে একবার বলেছিলেন,একজনকে আপনার মনে ধরেছে!আমিই তো সে?হুম?

সৌরভ:-হ্যা,তোমাকেই ভালো লেগেছিল আমার।

প্রিয়তা:-আর আমি কত বুদ্ধু!একটুও ধরতে পারি নি সেটা যে আমি।আমাকে বললে কী হতো?আমি কী খেয়ে ফেলতাম আপনাকে?জানেন আমি আপনার হেঁয়ালি মার্কা কথা শুনে কত কষ্ট পেয়েছি?

সৌরভ প্রিয়তার কপালে চুমু খেয়ে আদুরে কন্ঠে বললো;

সৌরভ:-আমি জানতাম তুমি যে আমায় পছন্দ করতে।তাও আমি বলি নি কারণ আমি চাই না বিয়ে ব্যতিত কোনো হারাম সম্পর্ক আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হোক।তোমাকে হালাল ভাবে আল্লাহর কাছে চেয়েছি।দেখো,আল্লাহ তায়ালা কিন্তু আমায় ফেরান নি।তিনি ঠিকই তোমাকে আমার অর্ধাঙ্গিনী স্বরূপ দিয়ে দিয়েছেন।চাওয়ার মতো চাইতে পারলে আল্লাহ কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরান না।আমার ওনার ওপর ভরসা ছিলো।তাই তো তোমায় এত সহজে পেয়ে গেছি।

প্রিয়তা:-আমিও নিজেকে প্রায় পরিবর্তন করে ফেলেছি।এখন আপনার সাহচর্যে থেকে পুরোপুরি পাল্টে যাবো ইনশাআল্লাহ।শুধু আপনি সবসময় আমার পাশে থাকবেন।কখনো ভুল বুঝে সরে যাবেন না।আমি আপনাকে অনেক অনেক অনেক বেশি চাই।ভালোবাসি জামাই।

এই বলে প্রিয়তা সৌরভের অধরের সাথে নিজের অধরোষ্ঠ মিলিয়ে দিলো।সৌরভ প্রিয়তার ঘন চুলের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে গভীর ভাবে চুমু খাচ্ছে।দুজনেই সমানতালে রেসপন্স করছে।এই শীতল আবহাওয়ায় এমন স্পর্শে কেঁপে কেঁপে ওঠছে প্রিয়তা।আর সৌরভ যেন নিজের মধ্যে নেই।হারিয়ে গেছে কোন অজানায়।

মিনিট পাঁচেক পর সৌরভ প্রিয়তার ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দিলো।প্রিয়তা ঘনঘন শ্বাস ফেলছে।সৌরভ প্রিয়তার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে।দুজন দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দের গভীরতা মাপছে।সৌরভ অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো;

সৌরভ:-ঘুমাও প্রিয়তা।আজ তুমি রেস্ট নাও।সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠতে হবে।আমি চাই না সকালে ঘুম থেকে ওঠে আমার কারণে তুমি বারংবার আনইজি ফিল করো।রোমান্স পরেও করা যাবে।এখন ঘুমিয়ে যাও বরং।

সৌরভের নেশা ধরানো কন্ঠ শুনে প্রিয়তা আরেকদফা ক্রাশ খেলো।ছেলেটার ভয়েসও মন কেঁড়ে নেয়ার মতো সুন্দর।প্রিয়তা সৌরভের কথায় সায় দিয়ে সৌরভের বুকে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে ফেললো।সৌরভও দুহাত দিয়ে তাকে বিড়াল ছানার মতো জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো ঘুমানোর জন্য।অবশেষে মহা আরামের ঘুম তাদের চোখ দ্বয়ে ধরা দিলো।দুজনে পাড়ি জমালো নিদ্রার শহরে।❤️#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#পর্ব_১৪

পরদিন,,
মধ্যরাতে অর্থাৎ ফজরের ওয়াক্তে ঘুম ভাঙলো সৌরভের।মূলত ফজরের নামাজ পড়ার জন্যই এই সময় ঘুম থেকে ওঠে সে।তখনও ভোর হয় নি।চোখ খুলে দেখলো প্রিয়তা তার বুকের সাথে একদম লেপ্টে ঘুমাচ্ছে।আলুথালু চুলগুলো মুখের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সৌরভ প্রিয়তাকে এমন অবস্থায় দেখে মুচকি হাসলো।
অবশেষে মেয়েটাকে নিজের করে পেল সে।যদিও তেমন একটা কাঠখড় পোড়াতে হয় নি তার।সৌরভ বলে মুসকান এত সহজে বোন বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে,অন্য কেউ হলে মোটেও এত সহজে রাজী হতো না সে।

সৌরভ প্রিয়তার কপালের ও মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে কানের পিছে গুঁজে দিয়ে কপালে আলতো ভাবে একটি চুমু খেলো।প্রিয়তা তো মরার মতো ঘুমাচ্ছে।কোনো হুঁশ নেই তার।সৌরভ এই আলো আঁধারের মাঝে প্রিয়তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

কখনো ভাবে নি সে এত জলদি বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হবে।কারণ এত এত মেয়ের মধ্যে একটাও পছন্দের মানুষ খুঁজে পায় নি সৌরভ।সে তো ভেবেছিলো তার চাহিদামতো মেয়ে খুঁজে পাওয়া সাংঘাতিক দুষ্কর হবে।অথচ দেশে আসার পরই নিজের মনের মতো একজনকে পেয়ে গেল সে।আশাই করে নি এত জলদি পেয়ে যাবে।তার প্রিয়তমাকে পেয়ে গেছে সে।আল্লাহর কাছে চাইতে চাইতে অবশেষে পেয়ে গেছে।সৌরভ আবারও চুমু খেলো প্রিয়তার কপালে।ওর গলার পাশে হাত রেখে থুতনিতে একটা চুমু খেলো।

একটুপর সৌরভ প্রিয়তাকে আস্তে ধীরে ডাকতে লাগলো।প্রিয়তার গালে আলতো ভাবে চাপড় মেরে আদুরে কন্ঠে বলতে লাগলো;

সৌরভ:-প্রিয়,ও প্রিয়।ওঠো।ফজরের আযান হয়ে গেছে।নামাজ পড়বে না?

প্রিয়তা উম উম বলে কম্বল মুড়ি দিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাে।সৌরভ তার ঠান্ডা ডানহাতটা প্রিয়তার কামিজের ভেতর ঢুকিয়ে পেটের ওপর রাখলো।এবার প্রিয়তা ঘুম ঘুম চোখে পিটপিট করে চাইলো সৌরভের দিকে।পেটের ওপর অনেক ঠান্ডা অনুভব হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেছে তার।সৌরভ দাঁত বের করে হাসছে।সৌরভের বা’হাতের তুলনায় ডান হাত অনেক ঠান্ডা থাকে শীতের সময়।

প্রিয়তা:-উম,হাত সরান।প্রচুর ঠান্ডা আপনার হাত।

সৌরভ:-আচ্ছা সরাবো,এখন ওঠে ওযু করে আসো যাও।দুজন নামাজ পড়বো একসাথে।

প্রিয়তা দু চোখ ভালো করে কচলে জিজ্ঞেস করলো;

প্রিয়তা:-আযান হয়ে গেছে?কখন?আমি তো শুনি নি!

সৌরভ:-এমন বেদম ঘুমে থাকলে বাসায় ডাকাত পড়লেও তো কখনো টের পাবে না।(হেসে দিয়ে)

সৌরভের বলা কথা ও হাসি দেখে প্রিয়তা লজ্জা পেল ভীষণ।আসলেই,সে ঘুমে পড়লে দিনদুনিয়ার খবর থাকে না।এতটাই ঘুম পাগলি।প্রিয়তা সৌরভের দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো;

প্রিয়তা:-আপনি গিয়ে ওযু করে আসেন,যান।আপনি আসার পর আমি যাবো।

সৌরভ প্রিয়তার হাতের ওপর হাত রেখে বললো;

সৌরভ:-ঘুমিয়ে যাবে না তো আবার?

প্রিয়তা:-নাহ,ঘুমাবো না,নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।এখন যান।

সৌরভ শোয়া থেকে ওঠে বসলো।পায়ে পমপমের স্যান্ডেল পরে বললো;

সৌরভ:-ওকে।আমি যাই।

সৌরভ ওয়াশরুমে চলে গেল।প্রিয়তা একটু গড়াগড়ি করে শোয়া থেকে ওঠে বসলো।চুলগুলো খোঁপা বেঁধে চুপচাপ বসে রইলো কম্বলের নিচে।সৌরভের বেরোনোর অপেক্ষা করছে সে।কিছুক্ষণ পর সৌরভ বের হতেই সে গিয়ে ঢুকলো।

ওযু করে বের হলো প্রিয়তা।ততক্ষণে সৌরভের নামাজ শেষ।সে লাইট অন করে কোরআন তেলাওয়াত করছে।জায়নামাজ আগে থেকেই বিছিয়ে রেখেছে সৌরভ।প্রিয়তা তার পাশে গিয়ে নামাজে দাঁড়ালো।প্রিয়তার নামাজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর সৌরভের তেলাওয়াত অফ করলো।কোরআন রেখে প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করলো;

সৌরভ:-আমি হাঁটতে চলে যাই?তুমি নাহয় ঘুমাও!

প্রিয়তা মাথা নেড়ে না জানিয়ে সৌরভের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বললো;

প্রিয়তা:-নাহ,এখন কোথাও যেতে পারবেন না।আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো আমি।আহ শীতের সময় বরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর মজাটাই আলাদা।

সৌরভ হেসে ফেললো প্রিয়তার কথা শুনে।সৌরভ কোলে নিয়ে নিলো প্রিয়তাকে।তার নাকের সাথে নিজের নাক ঘষে বললো;

সৌরভ:-আমার একটামাত্র বউয়ের আদেশ আমি কী অমান্য করতে পারি বলো?চলো ঘুমাবো।

প্রিয়তা সৌরভের গলা জড়িয়ে ধরে ওর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।প্রিয়তা ও সৌরভ দুজন দুজনকে এমনভাবে ট্রিট করছে যে মনে হচ্ছে তাদের দুজনের বিবাহিত জীবন অনেক দীর্ঘ সময়ের।অথচ বিয়ে মাত্র কাল হয়েছে তাদের।সৌরভ প্রিয়তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে লাইট নিভিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়লো কম্বল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে।প্রিয়তা দুহাত দিয়ে সৌরভকে জড়িয়ে ধরে তার পুরুষালি গলায় মুখ গুঁজে দিলো।সৌরভ কেঁপে ওঠে এমনতর স্পর্শে।প্রিয়তা অস্পষ্ট স্বরে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো;

প্রিয়তা:-সেদিন চাইলে আমি আপনার ঠোঁটে চুমু খেতে পারতাম,বাট আপনার এত সুন্দর আকর্ষণীয় গলাটা আমায় যে ভীষণ টানে।আপনার এই গলায় চুমু খেতে অনেক ভালো লেগেছে আমার।যখন কথা বলেন তখন সবুজ রগগুলো গলায় স্পষ্ট ভেসে ওঠে।যখন হাসেন তখন কন্ঠনালি উঁচু হয়ে থাকে।ইচ্ছে করে একদম কামড়ে খেয়ে ফেলি।

সৌরভ প্রিয়তাকে আগলে নিয়ে আবেশে চোখ বন্ধ করে বললো;

সৌরভ:-ভীষণ অদ্ভুদ তুমি!সেদিনের বাইটের স্পটগুলো এখনো কিন্তু আমার গলায় আছে।

প্রিয়তা:-থাকবে না?আমি দিয়েছি বলে কথা!এখন থেকে প্রতিদিন এমন লাভ বাইটের চিহ্ন আপনার গলায় পাওয়া যাবে।এই গলাটাও অনলি মি করে রেখে দেবো আমি।একান্তই আমার সম্পত্তি।

সৌরভ:-শুধু গলা কেন?এই পুরো আমিটাই তো তোমার!

প্রিয়তা:-হুম,আপনি আমার।তবে কোনো মেয়ে যদি আপনার দিকে অন্য নজরে তাকায় তাহলে তার চোখ গেলে নেবো আমি।

সৌরভ:-আচ্ছাহ ঠিক আছে,এখন ঘুমাও।

প্রিয়তা:-হুমম।

প্রিয়তা সৌরভের গলায় বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে গেল।এতক্ষণ প্রিয়তার আদর অনুভব করছিলো সৌরভ।অতঃপর প্রিয়তার মতো সেও ঘুমিয়ে গেল।

🖤

সকাল দশটার দিকে ঘুম ভাঙলো প্রিয়তার।ঘুম থেকে ওঠে দেখলো সৌরভ রুমেই নেই।সে একাই ঘুমিয়ে আছে।সৌরভ আসলে সকাল ৯ টায়ই ওঠে গেছে।তবে প্রিয়তা ঘুমোচ্ছে দেখে আর জাগায় নি।বাসার কেউই প্রিয়তা ঘুম থেকে ওঠে নি বলে কিছু বলছে না।কারণ তারা তাদের বাড়ির মেয়ের অভ্যাস সম্পর্কে জ্ঞাত।তবে তাদের মুরব্বি গোছের মহিলা আত্মীয় কয়েকজন খোঁচা দিয়ে প্রিয়তার কথা জিজ্ঞেস করলেন।যদিও প্রিয়তা এসব বিষয়ে কিছু জানে না।জানলে সে নিজেই ডিটারজেন্ট পাউডার ছাড়া ধুয়ে দেবে তাদের।

প্রিয়তা ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে কাপড় চোপড় পাল্টে নতুন একসেট সেলোয়ার-কামিজ পড়লো।অতঃপর মাথায় কাপড় দিয়ে নবাবের মতো রুম থেকে বেরিয়ে এলো।সোজা নিচেই নেমে এলো সে।এত আত্মীয় স্বজন দেখে ওর টনক নড়লো।ও তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে কাল ওর বিয়ে হয়েছে।আসলে ছোটবেলা থেকেই তো এখানে আসতো অনেক তাই এখন আর চাইলেও অচেনাদের মতো আচরণ করতে পারছে না সে।আত্মীয়রা প্রিয়তার দিকেই তাকিয়ে আছে।যেন সে ভিনগ্রহের প্রাণী।নিজেকে এলিয়েন মনে হচ্ছে প্রিয়তার কাছে।সে একটু কাচুমাচু ভঙ্গি নিয়ে ডাইনিং রুম পেরিয়ে রান্নাঘরে গেলো।

মিসেস মিনা চা খাচ্ছিলেন।পাশেই মিসেস শিলা,মিসেস জেসমিন,মিসেস প্রমি ও এশা,ইশা, সারা দাঁড়িয়ে ছিলো।রান্নাঘরেও গিজগিজ অবস্থা।সর্বপ্রথম মিসেস মিনার দৃষ্টি প্রিয়তার ওপর পড়লো।তিনি একপ্রকার ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন;

মিসেস মিনা:-ওঠে গেছিস মা?তুই রান্নাঘরে আসতে গেলি কেন?কাউকে দিয়ে বললেই তো আমি তোদের রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দিতাম।

প্রিয়তা:-ইয়ে বড়আন্টি,আমার আসলে মনে ছিলো না যে আমি নতুন বউ।তাই তো লাফাতে লাফাতে চলে এসেছি এখানে।

প্রিয়তার বোকা বোকা কথা শুনে হাসির রোল পড়ে গেল রান্নাঘর জুড়ে।হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে একেকজনের।মিসেস প্রমি মেয়ের মাথায় আলতো চাপড় মেরে বললেন;

মিসেস প্রমি:-বিয়ে হয়ে গেছে,অথচ এখনও বাচ্চামি ছাড়ে নাই।

মিসেস শিলা:-তোর বিয়ে হলেও তুই আমাদের মেয়েই রয়ে গেছিস প্রিয়ু।এখন হুট করে বউ সাজতে হবে না।মেয়ে ছিলি মেয়ে হয়েই থাকবি আজীবন।

মিসেস মিনা:-তুই ডলি বা তানিয়ার রুমে নাহয় চলে যা মা।আমি তোর নাশতা পাঠিয়ে দিচ্ছি।ওদের সাথে গিয়ে আড্ডা দে বরং।যা।

প্রিয়তা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে চুপচাপ চলে এলো।আশেপাশে চোখ বুলিয়েও কোথাও সৌরভকে দেখতে পেল না সে।কোথায় গেল লোকটা?

🖤

আজকে কিছুটা আয়োজন করে বাসার ছাদেই রিসিপশন পার্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে।চাইলে সৌরভ সেন্টারে বড় করে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারতো।কিন্তু সে প্রায় বেশ অর্ধেক টাকা এতিমখানায় দান করে দিয়েছে।এতে এতিমরা অন্তত একবেলা ভালো খাবার পেটপুরে খেতে পারবে।তার এমন সিদ্ধান্তে প্রায় সব মুরব্বিরাই খুশি।মুসকান তো খুশি হয়ে নিজের কিছু টাকাও এড করেছে এতে।

সৌরভ রিসিপশনের কাজে বাইরে ব্যস্ত ছিলো বিধায় প্রিয়তা তাকে দেখতে পায় নি।প্রিয়তা ডলির রুমে গিয়ে তাদের কাছে বসতেই শুরু হলো রাতে কী হয়েছে?সৌরভ তাকে গিফট করলো?কেমন আদর করলো?হেন তেন সব প্রশ্নের ভান্ডার।প্রিয়তার মাথা ঘুরছে তাদের এসব কথা শুনে।ওরা বয়সে বড় হয়েও কী নির্লজ্জের মতো প্রিয়তার পার্সোনাল বাসর রাতের কাহিনী শুনতে চাচ্ছে!কী লজ্জা কী লজ্জা!প্রিয়তা কানে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ করে বসে আছে।একটা প্রশ্নেরও জবাব দিলো না সে।ওরা হতাশ হলো না শুনতে পেরে।

🖤

আজ সারাদিনের মধ্যে সৌরভের দেখা মিললো না।সৌরভ নিজের রিসিপশনের তদারকি নিজেই করছে।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়।অর্থাৎ শেষ বিকেল।প্রিয়তাকে আজ সারা সাজিয়ে শাড়ি পড়িয়ে দিলো।শাড়ির ওপর বড় একটা কটি পড়তে হয়েছে।সাথে অবশ্যই আছে হিজাব নেকাব।আর যাইহোক,সৌরভের কথা প্রিয়তার দ্বারা অমান্য করা সম্ভব হবে না।

প্রিয়তা সাজগোজ শেষে একা একা নিজের রুমে বসে আছে।বাকিরা রুম থেকে বেরিয়ে গেছে নিজেরা তৈরী হতে।এমনসময় সৌরভ রুমে প্রবেশ করলো।প্রিয়তা সৌরভকে দেখে ওঠে দাঁড়িয়ে কাছে আসলো।সৌরভ প্রিয়তার ওই কাজল রাঙা চোখ জোড়ায় আটকে আছে,অনুভূতিটা সেই প্রথম দিনের মতো।এই চোখের মায়ায়ই আটকে গেছিলো সে ওইদিন।আজও তার ব্যতিক্রম নয়।

আজ প্রিয়তা ডার্ক পার্পল কালারের কালো পাড়ের স্টোনের কারুকাজ করা দামী শাড়ি পড়েছে।এটা সৌরভ কানাডা থেকে কিনেছে।শাড়ির সাথে ম্যাচিং সব পড়েছে,তাকে দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে।সৌরভের মুগ্ধ হয়ে তাকানো দেখে প্রিয়তা লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো।সৌরভ প্রিয়তার গাল আলতো ভাবে টেনে দিয়ে বললো;

সৌরভ:-লজ্জা পাচ্ছো কেন?

প্রিয়তা:-আপনি এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?

সৌরভ প্রিয়তার দুই বাহু ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জবাব দিলো;

সৌরভ:-আজকে আমার বউটাকে যে মারাত্মক সুন্দর লাগছে।তাই এভাবে তাকিয়ে আছি।

প্রিয়তা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে পুরো।সৌরভ মুচকি হেসে প্রিয়তার দুইগালে,দুচোখের পাতায়,কপালে ও থুতনিতে চুমু খেলো।শেষে নাকের সাথে নাক ঘষে আদুরে কন্ঠে বললো;

সৌরভ:-ভালোবাসি তোমায় প্রিয়তমা।এভাবেই আমাদের দুজনের টোনাটুনির সংসারে আল্লাহর রহমত নেমে আসুক।দুজন সবসময় এভাবেই একে অপরের পরিপূরক হয়ে থেকে যাবো।ক্লান্তিহীন হয়ে একইভাবে ভালোবেসে যাবো সারাজীবন।

প্রিয়তা:-আমি নিশ্চয়ই কখনো কোনো পূন্যের কাজ করেছিলাম এজন্যই তো আল্লাহ আমাকে এত ভালো মনের একজন মানুষকে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাঠিয়েছেন।এত ভালো ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি আমি জানতামই না।আমিও অনেক ভালোবাসি আপনাকে জামাই।

দুজন কিছু মুহূর্ত একান্তই নিজের মতো করে কাটালো।একটু পর সৌরভ ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রিসিপশনে পড়ার জন্য ড্রেস পরে এলো।এত হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে দেখতে যে প্রিয়তা জাস্ট হা করে তাকিয়ে আছে তার বরের দিকে।আজকে মেয়েরা মনে হয় নজর দিয়ে খেয়ে ফেলবে তার জামাইটাকে।প্রিয়তার সাথে ম্যাচ করে ডার্ক পার্পল কালারের শার্ট আর ব্ল্যাক কালারের শ্বশুর বাড়ি থেকে দেয়া কালো রঙের ব্রান্ডেড স্যুট কোট পরিধান করেছে সে।সাথে ব্যাকব্রাশ করা চুল।চোখে সানগ্লাস,হাতে ঘড়ি,পায়ে শু’জ,হাতের আঙ্গুলে শ্বশুর বাড়ি থেকে দেয়া প্লাটিনামের দামী রিং সবমিলিয়ে জাস্ট ওয়াও লাগছে তাকে দেখে।

সৌরভ প্রিয়তার হাত ধরে নিচে চলে আসে।মেহমানরা পুরো বাসায় গিজগিজ করছে।অনেক মেহমান এসেছে আজ।প্রিয়তা ও সৌরভকে একসাথে এত হাসিখুশি দেখে মুসকানের মনটা খুশিতে ভরে গেছে।এত খুশি সে কোনোদিনও হয় নি।আজ বোনের মুখের হাসি দেখে মনটা তার তৃপ্তিতে পূর্ণ হয়ে গেল।

ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠানটা শেষ হলো।সৌরভ নিজে তদারকি করেছে সবকিছুর।কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে যায় নি।সবাই তাদের আতিথেয়তায় খুশি।প্রিয়তা আর সৌরভের অনেক ফটোশুট করা হয়েছে।তাদের শখ অপূর্ণ থাকে নি।অনেক গিফট এবং সালামিও পেয়েছে ওরা দুজন।সেসব তাদের রুমে রাখা হয়েছে।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here