#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_১৭ (দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
এক্সাম শেষ হয়েছে আজ বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো। মনটা এই দিন গুলোতে প্রায়শই খারাপ যেতো। চেনা মানুষজনের এমন হুট করে পরিবর্তন যে কারো বুকে ঝড় তুলতে সক্ষম। খুব খারাপ একটা অনুভূতি আমাকে অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করছে। যাদেরকে নিজের ভেবে এসেছিলাম, দুজনের কেউ আমার কাছে নেই এখন। একজন নিরুদ্দেশ তো অন্যজন আমার মুখ অবধি দেখতে নারাজ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হয়তো ভার্সিটি লাইফ শেষ হবার আগেই বন্ধু বিচ্ছেদের স্বাদ নেওয়াটা আমার ভাগ্যেই ছিল।
কিছুক্ষণ ওই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক হাসির রেখার দেখা মিললো। এটা অবশ্যই আরহান এর জন্যই।
আরহান বলেছিলেন না, ‘ভালোবাসি’ না বলেই ভালোবাসার উপলব্ধি করাবেন! হ্যাঁ! ভালোবাসার সহস্র রং চিনিয়েছেন। উনি যখন হাসেন, ইচ্ছে করে পুরো দুনিয়া ভুলে শুধু এই একটি মানুষের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। আরহান আমাকে নিজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া শিখিয়েছেন। সব ভুলে আমি উনার দিকেই তাকিয়ে থাকি। এ দেখার মধ্যে আলাদা এক শান্তি আছে। ভালো লাগা আছে।
আরহান আমার সাথে রেগে কথা বলেননি কখনো। রাগ দেখাননি।
ইদানিং আমার কি যেন হয়েছে, রাতে ঘুম আসে না। নির্ঘুম আমি সারাটা রাত ভরে আরহানকে দেখতে থাকি। আরহানের কাছাকাছি এলেই আমার হৃদস্পন্দনগুলো বেড়ে যায়। অন্যরকম কিছু একটা অনুভূত হয়। নাম না জানা একটা টান কাজ করে। আরহানের সামান্য প্রশংসাতেই লজ্জায় আমার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। আরহানকে খানিকক্ষণ না দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাঁসফাঁস করে। দুদিন ধরে শহরের বাইরে আছেন আরহান। আমি আরহানকে দেখতে পাইনি এই দুদিন। তবে যেনো মনে হচ্ছে, কতো জনম উনাকে দেখে চক্ষু তৃষ্ণা মেটাতে পারছি না।
“উহুম উহুম! ভাবি বুঝি ভাইয়ার বিরহে আকাশের তারা গুনছে?”
হালকা কেশে নিশা এই কথাটা বলে উঠলো। এতোক্ষণে খেয়াল করলাম, আমার পাশেই নিশা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তা জানা নেই আমার। খানিকটা অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললাম, “এমা! তুমি! কখন এলে?”
নিশা হালকা হেসে বললো,“যখন তুমি তারা গুনতে ব্যস্ত ছিলে।”
লজ্জা লাগছে ভীষন। মেয়েটা কি না কি ভাবলো!
“ভাবি শোনো না!”
“হুঁ! বলো।”
“শাড়ি পরিয়ে দেবে? আমি না! শাড়ি পরতে জানিনা।”
তীক্ষ্ণ নজরে তাকালাম নিশার পানে। হঠাৎ মাথায় শাড়ি পরার ভূত কোত্থেকে উদয় হলো এর? আমার এরূপ চাহনি দেখে নিশা মেকি হেসে বললো,“এভাবে তাকাও কেনো ভাবি? ভয় লাগে।”
নিশার ছেলেমানুষী কথা বার্তায় আমিও হেসে ফেললাম।
___________________________
“মা! এসব কি?”
হাতের ডায়েরিটা দীপ্তি ওর মায়ের দিকে এগিয়ে এই কথাটা বললো। ওর মা একবার ডায়েরির দিকে তাকালো। এরপর আবার দীপ্তির দিকে।
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,“তোকে এই শিক্ষা দিইনি আমি। কাউকে না বলে তার জিনিস ধরাটা তোকে শেখাইনি।”
“দেখো মা! মানছি আমি এটা দেখে অন্যায় করেছি। সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু এখন তোমাকে এর উত্তর দিতে হবে। বলো তুমি। এটা কি?”
দীপ্তির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ আর কি করে লুকোবে? সত্য যে সবটা সামনেই আছে। মৃদু কন্ঠে বললো, “যা জেনেছিস, সবটাই সত্যি।”
“এসব লুকিয়ে এসেছো কেনো মা? কাউকে বলোনি কেনো?”
“দুনিয়া অনেক কঠিন। আর দুনিয়ার মানুষ নিষ্ঠুর, পাষাণ। এরা তোর ক্ষততে নুন আর সুখে নজর খুব ভালো করে লাগাতে জানে। কখনো দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। এরা তোকে ভেঙ্গে চূরে শেষ করে দেবে। আবার তোর আনন্দময় জীবনও এদের সামনে প্রকাশ করবি না। এদের হিংসে হয়। মারাত্মক হিংসে। অতি সহজেই তোর সুখময় জীবনকে ক্ষণস্থায়ী করে দেবে। এদের জন্য শুধু থাকবে কৃত্রিম হাসি। যেটা তোর ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। এজন্যই মূলত কিছু জিনিষ অপ্রকাশিত থাকাই শ্রেয়।”
“তাই বলে তুমি আমাকে বলোনি কেনো মা?”
দীপ্তির প্রশ্নে তার মা মৃদু হেসে বললো,“কী হতো বলে? পুরনো ঘা তাজা বৈ আর কী’ই বা হতো? যা পেছনে ফেলে এসেছি, তা পেছনেই থাক না! কেনো সেগুলো মনে করে কষ্ট পাবো?”
মায়ের কথায় দীপ্তি দমে গেলো। পুনরায় একটা কথা মস্তিষ্কে আসতেই বলে ফেললো,“মা! আপু কোথায়?”
“ওর মামার কাছেই রেখে এসেছিলাম। আমার ভাই ওর খেয়াল রাখায় কোনো রকমের অপূর্ণতা রাখবে না।”
__________________________
শাড়ি পরিহিত নিশা নিচে নামতেই ড্রইং রুমে রুদ্রকে বসে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে হাসলো। নিশা জানতো রুদ্র আসবে, এজন্যই শাড়ি পরেছে। লজ্জা মাখা মুখশ্রী নিয়ে নিশা এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে।
সামনে কারো উপস্থিতির আভাস পেয়ে রুদ্র চোখ তুলে তাকালো। একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। সেদিনের কথা ভীষণভাবে মনে পড়লো রুদ্রের। নিশাকে পাবার যেই এক চিলতে আশার আলো দেখেছিলো, তা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। নিশা যে অন্য কাউকে ভালোবাসে!
কোনো কথা না বলেই, ফোন কানে নিয়ে উঠে চলে গেলো। এমন ভাব ধরলো যেনো এখানে রুদ্র ব্যতীত অন্য কেউ ছিলো না।
হাস্যোজ্জ্বল নিশার মুখ নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। চোখ দুটো ছলছল করছে নিশার। এখানে আর একপলক না থেকে দৌঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। যার জন্য শাড়ি পরলো, সে যে ফিরেও তাকালো না।
রাতের খাবার খেতে নিশা যখন নিচের নামলো তখন ওর ফোলা মুখশ্রী দেখেই বুঝে ফেললাম ও কেঁদেছে। কিন্তু কেনো, তা বুঝতে পারলাম না।
নিশা এসে আমার পাশের চেয়ার টেনে বসলো। ধীরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,“কি হয়েছে? চোখ মুখ ফোলা কেনো?”
অপ্রস্তুত নিশা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,“আসলে ভাবি, অবেলায় ঘুমিয়েছিলাম তো! এজন্য।”
নিশার কথা বিশ্বাসযোগ্য ছিলো না। তবুও আর পাল্টা প্রশ্ন করলাম না।
আরহানের কথা খুব মনে পড়ছে। খাবার না খেয়ে বার বার নেড়ে যাচ্ছি। খাচ্ছি কম, আরহানকে ভাবছি বেশি। আমাকে এভাবে দেখে মা বললেন, “কিরে মা! খাচ্ছিস না কেনো? কোনো সমস্যা?”
বেশ গভীর ভাবনায় থাকার দরুন এভাবে ডাকায় চকিতে তাকালাম। মেকি হাসি দিয়ে বললাম,“না মা। তেমন কিছু না। খাচ্ছি।”
“কি খাচ্ছিস দেখাই যাচ্ছে। নে, এদিকে আয়।”
পাশের চেয়ারের দিকে ইশারা করে মা এই কথাটি আমাকে বললেন। এগিয়ে গিয়ে সেদিকে বসলাম। মা হালকা হেসে, খাবার মেখে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,“আমি যদি খাইয়ে দিতে চাই, তবে কি আমার মেয়েটা খাবে?”
আমি হাসলাম। আরহান একদম উনার মায়ের মতো হয়েছে। এভাবে কথা বলা তো আরহান উনার মায়ের কাছেই শিখেছে।
পাশ থেকে নিশাও ওর মন খারাপের রেশ সব পাশে রেখে বলে উঠলো,“আজ কেউ নেই বলে, নিজ হাতে খেতে হয়।”
আমি আর মা নিশার এমন অভিমান মিশ্রিত কথায় হেসে ফেললাম। মা হাসিমুখে বললেন,“তুইও এদিকে আয়।”
নিশাও এলো। এভাবেই মায়ের হাতে খেয়ে যাচ্ছি। না পাওয়া ইচ্ছেগুলো এভাবেই পূরণ হচ্ছে। মানুষের কোনো ইচ্ছে কখনো অপূর্ণ থাকে না। হয়তো তা আজ পূর্ণতা পাবে, কিংবা শতাব্দী বাদে। হয়তো সেটা বাস্তবে পাবে, কিংবা কল্পনায়। হয়তো সেটা নিজেকে ঘিরে পাবে, কিংবা সামনের মানুষটির মধ্যে নিজেকে দেখে।
______________________
আজ আবারও এই রুমটাতে একা থাকতে হবে। উনার স্মেল আছে, তবে মানুষটাই যে এই রুমে নেই। একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম বেডের পাশে। সন্ধ্যায় নিশাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার দরুন রুমটা অগোছালো হয়ে আছে। গোছাতে গোছাতেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে হাসি চলে এলো।
এগিয়ে গিয়ে রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“মিস ইউ শুকতারা…”
একটা বাক্য! হ্যাঁ! এই একটা বাক্য কারো হৃদপিন্ডের স্পন্দন গতি বাড়াতে সক্ষম। কাতর কণ্ঠস্বর আরহানের। এভাবে কেউ বলে?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় আরহান বললেন,“আচ্ছা সেসব বাদ দাও। খেয়েছো?”
“হুঁ, আপনি?”
“হ্যাঁ। কি করছিলে এখন?”
“এইতো কিছুনা।”
“ঘুমোবে না? রাত হয়েছে তো অনেক।”
আরহানকে এবার কি করে বলবো? উনি না থাকলে শান্তিতে দুচোখ এক করতে পারিনা। তবুও বললাম,“হুঁ, ঘুমোবো।”
“আমার ফিরতে আরো দুদিন লাগবে।”
রেগে গেলাম আমি আরহানের এই একটি কথায়। উনার তো কাল ফেরার কথা ছিলো। আরো দুদিন মানে?
ধারালো কন্ঠে বললাম,“সেখানেই থেকে যান। আরো তিনটে বিয়ে করে নিন না! আসতে হবে না আপনার।”
আরহান হাসলেন। শব্দ করেই হাসলেন। আমি তীব্র রাগে কল কেটে দিলাম। একেতো রাগিয়ে দিলেন, তার উপর হাসছেন!
কিছুক্ষণ বাদে আরহানের নম্বর থেকে কল এলো। কেটে দিলাম আমি। আবারো এলো। এবারও কেটে দিলাম। তৃতীয় বারের মাথায় কল এলে রিসিভ করে কানে তুলতেই, ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“রাগ করবে, রাগ ভাঙ্গাবো। বকবে তুমি? চুপচাপ বকা খাবো। তবুও দূরে যাবার কথা চিন্তা করবে না। এখন আমি কাছে নেই তোমার, চাইলেও নিজের কাছে বেঁধে রাখতে অক্ষম আমি। তাই কল কাটার কথা ভুলেও ভাববে না। বাড়ি ফিরলে না হয় মেরো, আটকাবো না।”
পুরো কথাটা গম্ভীর ভাবে বললেও শেষ উক্তিটি হেসেই বলেছেন।
“আচ্ছা এবার ঘুমাও।”
“হুঁ, আপনিও।”
চলবে…!#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_১৮ (ধোঁকা)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
সকালে ফোনের কলিং টিউনে ঘুম ভেংগে যায় আমার। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আননৌন নাম্বার থেকে একটা কল এসছে। এতো সকালে আমাকে কে কল দেবে?
কৌতুহল নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ ভেসে এলো, “স’সরি বীনু। রিয়েলি ভেরি সরি।”
কান্না ভেজা কণ্ঠস্বরটা চিনতে আমার বিন্দু মাত্র সমস্যা হয়নি। এটা রুশী। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন চলে এলো। সেদিনের ব্যবহার, রাগ, কথা না বলা এসব কি ছিলো?
আমার কিছু বলার আগেই রুশী কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো,“আমাকে মাফ করে দে বীনু। তিন মাস আগে আমার লাইফ পুরোটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে রে। আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এই খবরটা শুনে মুহূর্তেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি। কি বলছে রুশী এটা! বিয়ে? তবে অয়ন কোথায় আছে? অয়ন না ওকে ভালোবাসতো! রুশীও তো অয়নকে ভালোবাসে।
“কি হয়েছে, খুলে বল।”
রুশী একে একে সব কথা খুলে বললো। অয়নকে ছেড়ে চলে আসা, মারুফকে বিয়ে করা পর্যন্ত সবটা বললো। আমি নিশ্চুপ থেকে রুশীর কথা শুনলাম। নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে এসবের জন্য। কেনো সেদিন ওর পাশে ছিলাম না আমি?
আমার নিস্তব্ধতার মাঝেই রুশী বলে উঠলো,, আ’ আমি প্রেগন্যান্ট বীনু।”
অবাক হলাম না। বিয়ে হয়েছে, প্রেগন্যান্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। অবাক হলে বরং ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগতো। খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,‘সেদিন বলেছিলাম, দেরি হয়ে যাবে। শুনলি না আমার কথা।’ কিন্তু এটা বলা যাবে না এখন। মেয়েটা অনেক বাজে একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছে।
তাই বললাম,“বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে তোর, তার উপর তুই মা হতে চলেছিস। যদি ব্যাপারটা শুধু বিয়ে অবদিই থাকতো, তবে আমি যে করেই হোক, তোকে ডিভোর্স দিইয়ে অয়নের কাছে দিয়ে আসতাম। কিন্তু, তোর বাচ্চা! ও তো কোনো দোষ করেনি তাইনা? দেখ, আমি জোর করছি না। জাস্ট বলছি তোকে। পারলে নিজেকে এই সংসারেই গুছিয়ে নে। আর কারো জন্য না হলেও, তোর সন্তানের জন্য নতুন একটা জীবন শুরু কর।”
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা হলো রুশীর সাথে। অয়নের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।
এখন, একসাথে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা মনে হচ্ছে খুব। অয়ন যখন ক্যাম্পাসের পেছনের ঐ বকুল ফুল গাছতলায় বসে গান গাইতো, তখন রুশী কেমন মুগ্ধ নজরে দেখে যেতো! আর অয়নের অব্যক্ত সকল কথার ভীড়ে একটা এটাও ছিলো,“রুশী! আমার সব গান তোকে ডেডিকেট করে গাই আমি।”
আচ্ছা! সবাই তো সত্যিকারের ভালোবাসতে পারেনা। তবে যারা পারে, তাদের ভালোবাসা কেনো পূর্ণতা পায় না? অয়ন, রুশীকে কতটা ভালোবাসতো তা আমি জানি। আমি এ ও জানি, রুশী ওকে কতোটা ভালোবাসতো। ওদের একসাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতির সাক্ষী আমি নিজেই। ভাগ্য এরকম নিষ্ঠুরতা না দেখালেও পারতো।
________________________
নিজ বাড়িতে চিন্তিত তৃষ্ণা একাকী বসে রয়েছে তৃষ্ণা। তার নয়নতারাকে এখনও খুঁজে চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আরহানের বাড়িতেও খোঁজ করেছে। কিন্তু টাইট সিকিউরিটির দরুন পারেনি। এখন তৃষ্ণার আরো বেশি সন্দেহ হচ্ছে ঐ বাড়ি নিয়ে। হয়তো সেখানেই আছে তার নয়নতারা।
ভালো লাগছে না তৃষ্ণার কিছু। এতো অপূর্ণতা নিয়ে একটা মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে?
কিছুক্ষণ বাদে তৃষ্ণার নম্বরে তার একটা লোকের কল এলো। রিসিভ করতেই বললো,“বস! আপনি ঠিকই ধরেছেন। ম্যাম ওখানেই আছে। কিন্তু…”
“কি?”
“ঐ বাড়িতে যাওয়া অসম্ভব।”
তৃষ্ণা কিছু একটা ভাবলো। তৃষ্ণাকে চুপ থাকতে দেখে, ফোনের ওপাশের ব্যক্তি বলে উঠলো,“এবার কি করবো স্যার?”
“অনেক কিছুই করবো। আমরা যেতে পারবো না, তবে কাউকে বাড়ি থেকে বের করা অতোটাও কঠিন হবে না।”
কথাটা বলে বাঁকা হাসলো তৃষ্ণা। খুব জলদি তার নয়নতারাকে পেয়ে যাবে।
কল কেটে দিয়ে বললো,“আপনাকে আমি শুধু পছন্দ করি না, শুধু মায়ায় জড়াইনি। ভালোবেসেছি আপনাকে। অন্যরকম ভালোবেসেছি। যেই ভালোবাসায়, আমি দৃষ্টিহীন হয়ে গেলেও, চোখের ক্যানভাসে আপনি থাকবেন। আমার হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলেও, হৃদযন্ত্রে আপনারই বসত থাকবে। যেই ভালোবাসায়, এই তৃষ্ণা নিঃস্ব হয়ে গেলেও, তার একমাত্র সম্বলে, তার কল্পনায় আপনার অস্তিত্ব প্রতি ক্ষণে অনুভূত হবে। আমি আপনাকে সেই রকম ভালোবাসি নয়নতারা।”
তৃষ্ণা থেমে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মন থেকে যা চেয়েছে তৃষ্ণা, তা কি আদৌ পেয়েছে? হঠাৎ অস্থির হয়ে গেলো। কাতর কণ্ঠস্বরে শুধালো,“আপনাকে পাবো তো? আমি নিজের পছন্দের সবকিছু ছিনিয়ে নিতে জানি। বাই হুক অর বাই ক্রুক। কিন্তু…. আমি আপনাকে নিয়ে কোনো গেইম খেলতে পারবো না।”
_________________
গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে আমি নিজ রুমে বসে আছি। ভাবনাটা অবশ্যই আরহানকে ঘিরেই। অবশেষে উনার দুদিন পূর্ণ হলো। আজ আসবেন। আমি অভিমান নিয়েই উনার অপেক্ষায় বসে আছি। এতো অভিমান কখনো কারো প্রতি আসেনি আমার।
ফোনে আচমকা মেসেজের শব্দ একটু ঘাবড়ে গেলাম। হাতে নিয়ে দেখি আরহানের মেসেজ,“কি করো?”
আমি লিখে দিলাম,“কিছু না।”
ওপাশ থেকে আবারও মেসেজ এলো,“মন খারাপ?”
“জানিনা..”
“রাগ করেছো?”
“না…”
“অভিমান?”
“হুঁ”
আরহান খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবারও মেসেজ পাঠালেন,“তবে তো হয়েই গেলো।”
ভ্রু কুচকে ফেললাম। কী হলো আবার? জিজ্ঞেস করলাম,“কী?”
“ভালোবাসা….”
“কিভাবে?”
“ভালো না বাসলে অভিমান আসে না।”
মেসেজটা দেখার সাথে সাথেই আমার হৃদস্পন্দন পরপর কয়েকটা মিস করে আবারও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে লাগলো। কেমন যেনো লাগছে আমার! আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। সত্যি কি তাই? আরহানের শেষ মেসেজের আর কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। ফোন রেখে দিলাম। ব্যালকনিতে গিয়ে এই গোধূলি বেলাটা উপভোগ করতে চাচ্ছি। কিন্তু আরহানের শেষ কথাটায় আর এদিকে মন দিতে পারছি না। আমি কি সত্যি উনাকে ভালো বেসে ফেলেছি?
অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না বিধায়,নিশার রুমে চলে এলাম।
ডোর নক করতেই নিশা খুলে দিলো। মিষ্টি হেসে বললো,“আরে ভাবি তুমি! আমি মাত্রই তোমার কাছে যাচ্ছিলাম। ভালো হলো এসেছো। ভেতরে এসো।”
আমি এগিয়ে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ মনে হলো, আজ নিশার সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন।
নিশা আমার পাশে বসতেই জিজ্ঞেস করলাম,“ভালোবাসার মানে কী তোমার কাছে নিশা?”
আমার হুট করে এভাবে করা প্রশ্নে নিশা খানিকটা বিস্মিত হলো।
“হঠাৎ এটা জিজ্ঞেস করছো যে!”
“আহা! বলো না!”
“আচ্ছা। বলছি।”
“হুঁ”
“প্রথম দেখায় যদি কাউকে দেখে জানার আগ্রহ জন্মায়, এরপর তার সম্পর্কে এ টু জেড জেনে যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাস নামক শব্দগুলো চলে আসে, ধীরে ধীরে তার প্রতি মায়া কাজ করা শুরু করে, তাকে নিজের কাছাকাছি দেখলে শান্তি অনুভূত হয়ে, অন্য কারো পাশে দেখলে বুকে যন্ত্রণা হয়, সারাজীবন নিজের করে না পেলেও চোখের সামনে দেখার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, তবে এই অনুভূতি গুলোর নামই হচ্ছে ভালোবাসা।”
ভালোবাসা! তাই কি! নিশা এখন ভালোবাসার গভীর খেয়ালে ডুবে আছে। হয়তো ভাবছে তার ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসা নিয়েই। জিজ্ঞেস করে বসলাম,“কাউকে ভালোবেসেছো?”
বেখেয়ালি নিশা ভুলে বলে ফেলে, “হ্যাঁ। ভীষণ ভালো বেসেছি।”
পরক্ষণেই নিশার খেয়ালে এলো, ও কি বলেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করলো,“ইয়ে মানে না।”
আমি হাসলাম। নিশার চিবুকে হাত রেখে বললাম,“রুদ্র ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসো?”
নিশা চমকালো। মুখশ্রীতেই ওর চমকের রেশ ফুটে উঠেছে। আমি আবারও মুচকি হাসলাম।
নিশা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,“তাকে ভালোবাসতে বাসতে দুনিয়া থমকে যাবে, তবুও তৃষ্ণা মিটবে না।”
________________________
অস্থির হয়ে নিজের রুমে পায়চারি করছি। আরহানকে কল দিচ্ছি, রিসিভ করছেন না। একটু আগেই আমার নম্বরে মেসেজ এলো,“আরহানকে বাঁচাতে চাইলে ***ঠিকানায় চলে আসুন।”
জাস্ট এই একটা মেসেজ। এই একটা মেসেজে আমার শ্বাস আটকে ফেলতে সক্ষম। অনেকক্ষণ ধরে আরহানের নম্বরে ট্রাই করেই যাচ্ছি।
পুনরায় সেই নম্বর থেকে আবারও মেসেজ এলো,“আরহানকে মেরে দেবো?”
সাথে সাথে রিপ্লাই করলাম,“নাহ্! আসছি আমি।”
আবারো মেসেজ এলো,“একা আসবেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিট দূরত্বে আমার গাড়ি আছে, ওটাতে চলে আসবেন। আর খবরদার, কাউকে জানালে কিন্তু আরহান যাবে…..”
মাথায় আর কোনো কিছু না এনে এভাবেই বেরিয়ে পড়লাম। এতোটা অস্থির কখনো লাগেনি আমার।
বেরোনোর সময় মা, নিশা দুজনেই নিজের রুমে থাকায় আমাকে কেউ দেখেনি। তবে বিপত্তি বাঁধলো গেইটের কাছে এসে। গার্ড আমাকে বের হতেই দিচ্ছে না। সামনের একজন বললো,“ম্যাম! স্যার আপনাকে বাহিরে যেতে না করেছেন। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে, আমাদের বলুন।”
এদের কিভাবে বলি! যেতে হবে আমার। আমার আরহান বিপদে আছে
আরহানের যদি কিছু হয়ে যায়! কম্পিত কন্ঠে বললাম,“আ’আমাকে যেতে দিন। আরহান ন’নিজেই যেতে বলেছে।”
তাও আমাকে যেতে দিচ্ছে না উনারা। প্রচুর বিরক্তি নিয়ে উনাদের চাকরির হুমকি দিয়ে বের হলাম। বের হতে অবশ্য অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমার মূল লক্ষ্য আরহান।
অতিরিক্ত টেনশনে থাকায় আমার মাথায় পেইন শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুদূর যেতেই, ফাঁকা রাস্তায় একটা ব্ল্যাক মাইক্রো দেখে এগিয়ে গেলাম। আমি যেতেই দরজা খুলে গেলো। পেছনে একজন বসা আছে, আমাকে ইশারা করলো তার পাশে বসতে। এগিয়ে গিয়ে সেখানে বসে পাশের লোকটিকে অবলোকন করে নিলাম। সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরা, মুখ গ্লাস-মাস্ক দিয়ে ঢাকা। আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই লোকটি মাস্ক খুললো।
অস্থির আমি, আরহানের চিন্তায় অবস্থা নাজেহাল হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম,“আরহান কোথায় আছে?”
তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি আরহান কল দিয়েছেন। কপাল কুঁচকে এলো। রিসিভ করতেই পাশের লোকটি ফোন নিয়ে লাউডস্পিকারে দিলো।
আরহানের চিন্তিত কণ্ঠস্বরে শোনা গেলো,“কি হয়েছে? এতো কল দিয়েছো যে? আমি ফোনের কাছে ছিলাম না তখন। তুমি ঠিক আছো তো?”
পাশের লোকটি “এখন থেকে ঠিক থাকবে”—বলে কল কেটে দিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দিলো।
আমি বড়বড় চোখ করে এই লোকটির দিকে তাকালাম। হালকা চেনা চেনা ঠেকলো। ততক্ষণে গাড়ি চলা শুরু হয়ে গিয়েছে।
রেগে চিল্লিয়ে বললাম,”কী হচ্ছে এটা?”
লোকটি বাঁকা হেসে বললো,“ধোঁকা…”
চলবে…..!