#আমার_গল্পে_আমি_খলনায়িকা
পর্ব—১১
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
পরেরদিন সকালে একটা পার্সেল এলো আমার জন্য।পার্সেলটা আর কিছু নয়,সাহিলের পাঠানো ডিএনএ রিপোর্ট।ফাইলটা খুলে রিপোর্টগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখলাম আমি।সাহিল যা বলেছিলো তাই ঠিক।ফেইক প্রত্যয় আর মায়ের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পজেটিভ।ডিএনএ রিপোর্টটা আমি একটা নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রাখি।সময় হলে এটা বের করবো,এখন আপাতত নিরাপদ স্থানেই থাকুক।
–
–
–
–
ঘর থেকে বেরিয়ে আমি রোদেলার কাছে একটা ফোনকল করি।ও প্রথমে কল রিসিভ না করলেও দ্বিতীয়বারে রিসিভ করলো।আমি ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম।
—কি ব্যপার,ফোন ধরতে এতো লেইট কেনো?
—একটু বাইরে গিয়েছিলাম।কি হয়েছে বলুন।
—তুমি কি আমাকে অ্যাভোয়েড করার চেষ্টা করছো,দেখো আমার সাথে একদম চালাকি করার চেষ্টা করবে না।সেইদিনের ঘটনা আশা করি ভুলোনি।
—না,ভুলিনি আমি।কিছুই ভুলিনি,এবার আপনি কেনো ফোন করেছেন সেটা বলুন।
—তুমি প্রত্যয়কে কিচ্ছু বলোনিতো আমার ব্যপারে,
—আপনার ব্যপারে কি বলার আছে আমার?
—এইযে আমি সবটা জেনে গিয়েছি ওর ব্যপারে,ও আসলে প্রত্যয় নয় অন্য কেউ।
—আমি এটা কেনো বলবো ওকে,কিচ্ছু বলি নি আমি।
—তোমাকে বিশ্বাস করি না।তুমি কখনোই নিজের পার্টনারের ক্ষতি চাইবে না তাই না।আমার তো মনে হয় সবটা বলেছো তুমি প্রত্যয়কে।
—চুপ করুন আপনি,আমি কাউকে কিছু বলিনি।আর কিসের পার্টনার?আমি কারোর পার্টনার নই।
—তাহলে প্রত্যয় কে,যাকে তুমি সাহায্য করছো।
—হ্যাঁ করেছি সাহায্য,কিন্তু সেটা ওকে ভালোবেসে নয় কিংবা ওর ভালোর জন্যেও নয়।
—তাহলে কেনো?
—আমি নিরুপায়।আর কোনো অপশন নেই আমার কাছে।আপনি জানেন না ও কি কি করেছে আমার সাথে,
—তুমি ফেইক প্রত্যয়ের কথা বলছো তো,ও কি করেছে তোমায়?
—সেটা আমি বলতে পারবো না আপনাকে।তবে শুধু এইটুকু মনে রাখবেন আমি ফেইক প্রত্যয়ের কোনোরকম বন্ধু বা শুভাকাঙ্খী নই।আমি ঠিক ওকে ততোটাই ঘৃনা করি যতোটা আপনি করেন।হয়তো তার থেকেও বেশী।
আমার মনে হচ্ছে ফেইক প্রত্যয় রোদেলার সাথে এমন কিছু করেছে যার কারণে ও ওর বশ্যতা স্বীকার করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।রোদেলার সাথে তো প্রত্যয়ের রিলেশন ছিলো,ও কেনো নিজের প্রেমিকের হত্যাকারীর সাথে জেনেও অভিসন্ধী করতে যাবে।এটা আগে মাথাতেই আসেনি আমার।আমি এইটুকু স্পষ্ট রোদেলা পরিস্থিতির স্বীকার।
—কি হলো কি ভাবছেন,কথা বলছেন না কেনো?শুনুন আমি প্রত্যয়কে কিচ্ছু বলিনি,আর বলার তো প্রশ্নই আসে না।আপনি ওকে যা খুশি তাই করুন।দরকার পড়লে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিন।আমি বেঁচে যাবো।
(এই বলে রোদেলা কাঁদতে আরম্ভ করলো)
—কান্না থামাও রোদেলা,আমার একটা খটকার জবাব দাও।
—আমি জানি আপনি আমায় কি জিজ্ঞেস করতে চাইছেন,কেনো সেদিন আমি বিষের ব্যপারে জানিয়ে ফেইক প্রত্যয়কে বাঁচালাম।তাই তো?
—হ্যাঁ,একদম ঠিক ধরেছো।
—এই প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়ার কোনো মূল্য নেই।আমি চেয়েছিলাম ফেইক প্রত্যয় যেনো এতো তাড়াতাড়ি ধরা না পড়ে,কারণ ওর থেকে আমার অনেক বিষয় জানার বাকি ছিলো।
—তো এখন কি জানতে পারলে?
—না,তবে এইটুকু বুঝে গিয়েছে ওর বেঁচে থাকাতে আমার কোনো লাভ নেই।আপনাকে পরে আমি সবটা বলবো,এতো কথা ফোনে বলা সম্ভব নয়।শুধু মনে রাখবেন আমি ফেইক প্রত্যয়ের সঙ্গী নই,ঘৃনা করি ওকে আমি।শুধুই ঘৃনা।আর কিছু না।
এই বলে রোদেলা কলটা কেটে দিলো।জানি না কি চলছে মেয়েটার মনের ভেতরে তবে ওকে কিছুতেই আমি হাতছাড়া করতে চাই না।ওর যদি সত্যিই ফেইক প্রত্যয়ের ওপর রাগ থেকে থাকে তবে সেটা ব্যবহার করে আমি আমার কাজ করবো।
আজ প্রত্যয় বাড়িতে নেই।একটু আগেই বেরিয়েছে।ঘরে ঢুকে ড্রয়ারের দিকে চোখ পড়তেই আমি একটা অসঙ্গতি লক্ষ্য করি।বাম পাশে রাখা ফুলদানিটা একটু সরিয়ে পেছনে রাখা হয়েছে।কেউ এসেছিলো নিশ্চয়ই ঘরে।সর্বনাশ,এই ড্রয়ারের ভেতরেই তো ডিএনএ রিপোর্টের ফাইল রেখেছি আমি।কারোর হাতে পড়লো না তো ওটা?একটা অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো আমার।এই ফাইলটা প্রত্যয়ের হাতে পড়লে আমি পুরোপুরি শেষ।ব্যতিব্যস্ত হয়ে ড্রয়ারটা খুলে ফাইলটা খুঁজতে লাগলাম আমি।যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হয়েছে,কোথাও নেই ফাইলটা।তার মানে নিশ্চয়ই প্রত্যয় কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলো আর ওই ফাইলটাকে সরিয়েছে।ফাইল খুঁজে না পেয়ে আমি অবশেষে ড্রয়ারটা বন্ধ করে বাইরের দিকে ঘুরতেই দেখি মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।ওনার হাতে সেই ডিএনএ রিপোর্টের ফাইলটা।
—ফাইলটা আমার কাছে,শুধু শুধু খুঁজে লাভ নেই।
মায়ের কথা আমায় আরোও অবাক করে দিলো।আমি ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
—আপনি এটা কোথায় পেলেন ?
—কাল যখন তুমি এটা ড্রয়ারে চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে রাখছিলে আমি দেখে ফেলেছিলাম,
—আপনি ফাইলটা খুলে দেখেছেন নিশ্চয়ই….নাকি?
—হ্যাঁ দেখেছি।সবটা দেখেছি আমি।আচ্ছা তুমি এটা কি করেছো বলো তো?আমার আর প্রত্যয়ের ডিএনএ টেস্ট করিয়ে কি প্রমাণ করতে চেয়েছিলে।ও আমার ছেলে নয়?
—হ্যাঁ,দূর্ভাগ্যজনকভাবে ও আপনার ছেলে,আর এটাই সবথেকে বেশী অবাক করছে আমায়,
—প্রত্যয় কল্লোলের মতো আমারই ছেলে,আমাদের দুজনের ডিএনএ ম্যাচ করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।কেনো তোমার কি অন্য কিছু মনে হয়েছিলো?
মা যখন এই ডিএনএ রিপোর্টের ব্যপারে জেনেই গিয়েছে,তার কাছে আর কিছু লুকিয়ে লাভ নেই
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে সবটা খুলে বলার।
—মা আপনি ভুল জানেন,এতোদিন ধরে আমরা সবাই ভুল জেনে এসেছি।প্রত্যয় আপনার ছেলে,কল্লোলও আপনার ছেলে ছিলো?এই লোকটাও আপনার ছেলে,কিন্তু ও প্রত্যয় নয়।অন্য কেউ।
—তুমি কি খেয়ালী করছো এগুলো,আমি মা আমি জানবো না কে আমার ছেলে কে আমার ছেলে নয়?এটা হয়,
—হয় অনেক কিছুই হয়,এই পৃথিবীতে আমাদের চোখের আড়ালে অনেক কিছুই ঘটে মা যা আমরা চাইলেও জানতে পারি না।
—আমি তোমার কথার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।ঐ লোকটা কাকে বলছো তুমি,ও আমার প্রত্যয় আমার ছেলে।
—না ও প্রত্যয় নয়,ও অন্য কেউ।
—যদি তোমার কথা মেনেও নেই আমার প্রত্যয় কোথায়,বলো।জবাব দাও,
—বললে সহ্য করতে পারবেন না আপনি,
—কেনো কি হয়েছে?
—আমি কখনো চাইনি আপনাকে আসল সত্যিটা জানাতে,কারণ আপনি একজন মা।কোনো মায়ের পক্ষেই এটা মেনে নেওয়া বা সহ্য করা অসম্ভব।তাই চুপ থেকেছি এতোদিন।
—হয়েছে কি বলবে আমায়,আমায় সব বলো তুমি।
—মা আপনার ছেলে প্রত্যয় আর বেঁচে নেই।তাকে খু ন করা হয়েছে,আর সেই খু ন আর কেউ নয় এই লোকটাই করেছে যে প্রত্যয় সেজে আছে।আমি নিজে দেখেছি সেই দৃশ্য।
আমার কথাগুলো শোনার পরে মা নিথর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।সে যেনো সমস্ত কথা হারিয়ে ফেলেছে।একজন মায়ের পক্ষে ছেলের মৃত্যুর খবর শোনা কতোটা কষ্টকর আমি জানি।এর আগেও কল্লোলের মৃত্যুর শোক পেতে দেখেছি মাকে।যাই হোক আমি মাকে শান্ত করার সবরকম চেষ্টা করলাম।আজ আর মায়ের সাথে কোনো কথা হলো না।তার পরেরদিন মা যখন তার ঘরে বসে আছে আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম।রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি মায়ের,তার চোখদুটো সন্তান হারানোর শোকের জানান দিচ্ছে।যদিও মা এবার আর আগেরবারের মতো ভেঙ্গে পড়েনি।মা আমাকে দেখে বললেন।
—কিছু বলবে?
—বলার জন্যই তো এসেছি।মা দেখুন যে আমি ডিএনএ টেস্ট করিয়েছি তাতে আপনার আর নকল প্রত্যয়ের পজেটিভ রেজাল্ট এসেছে।তার মানে ও যেই হোক না কেনো আপনার সাথে ওর নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে।
—সেটা যেনো কোনোদিনও না হয়,আমার সন্তানের খু নি র সাথে আমার সম্পর্ক থাকতে পারে না।
—এভাবে বললে তো হবে না,আমাদের আসল সত্যিটা খুঁজে বার করতে হবে।
—কি করতে চাইছো তুমি এখন?
—মা আমি যতোদূর জানি প্রত্যয়ের জন্ম কোনো হাসপাতালে হয়েছিলো,আর সেটা অপারেশনের মাধ্যমে।
—হ্যাঁ,
—সেই হাসপাতালের নাম কি আর কোথায় সেটা,আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই?
—কেনো মনে থাকবে না।প্রত্যয়ের জন্ম আমার বাবার বাড়িতে থেকেই হয়েছিলো আর হাসপাতালটাও সেখানের।সিটি হাসপাতাল নাম ছিলো।এখন কি অবস্থা হয়েছে জানি না।
—বেশ আমাদের দুজনের ঐ হাসপাতালে যেতে হবে।আমি বুঝতে পারছি এই মূহুর্তে কাজটা আপনার জন্য সহজ নয়।তারপরেও বলবো আমি চলুন আমার সাথে,আমরা নিশ্চয়ই চাইবো না ফেইক প্রত্যয় আর কোনো অন্যায় করার সুযোগ পাক।
অবশেষে মাকে আমি বুঝিয়ে রাজি করালাম।বিকেলের দিকে আমি আর মা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়না দিলাম।প্রত্যয়কে মাকে হাসপাতালের কথা বলেই বের হয়েছি তবে সেটা মায়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে।হাসপাতালে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজলো।রাস্তায় জ্যাম না থাকাতে বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়েছি।হাসপাতালটা আগের জায়গাতেই আছে,শুধু কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন হয়েছে।আমি আর মা যখন হাসপাতালে ঢুকছি,মা আমার পিছনে।ঠিক তখন একজন মধ্যবয়স্কা মহিলার সাথে হোঁচট খাই।তার হাতে একটা ব্যাগ ছিলো।ব্যাগটা মেঝেতে পড়ে যায়,সে জিনিসগুলো তুলে ব্যাগের ভেতরে রাখতো লাগলোও।আমিও নুয়ে তাকে একটু হেল্প করতে লাগলাম।
—আপনার লাগলো না তো কোথাও?
—না মা,আমি ঠিক আছি।
—ক্ষমা করবেন আমি ঠিক খেয়াল করি নি,
—তোমার দোষ নেই,আমিই একটু অসাবধান ছিলাম।
ব্যাগে জিনিসগুলো তুলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন সাথে আমিও।মা আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে তখন।মায়ের মুখোমুখি হতেই সেই মহিলা যেনো হঠাৎ ঘাবড়ে যেতে শুরু করলো।মনে হচ্ছে মাকে যেনো সে চিনতো,বা আগেও কোথায় দেখেছে।আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই সে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে একপ্রকার পালিয়ে যায়।
চলবে…..
।😊