#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(21)
“বেরিয়ে যাও আমার বাড়ী থেকে”
তাহসান সাহেবের কথা শুনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় আদাভান। এমন কিছুই তার কল্পনায় ছিলো তবুও কেনো জানো মেনে নিতে পারছেনা এই সিদ্ধান্ত। এখানে আসার আগেই কল্পনা করেছিলো এই যাত্রাই হয়তো তাদের শেষ যাত্রা হবে। কখনও চাইলেও হয়তো আর অরুনিকার কাছাকাছি থাকা হবেনা তার, ঘুম জড়ানো আদুরে কন্ঠ শোনা হবেনা, সকালের স্নিগ্ধ সদ্যস্নাত তার প্রাণপাখিকে দেখা হবেনা। হবেনা সে হাজারো রাত জাগার কারণ। এতো না পাওয়ার মাঝেও পাবে অরুনিকার মুখের হাসি। অরুনিকার সুখের জন্য নিজের না পাওয়াগুলো নতশিরে মেনে নিতে পারে সে। দূর থেকেই দেখবে প্রাণোচ্ছল তার প্রাণপাখিকে। ভালোবাসার জগতে যদি কিছু প্রাপ্তি থাকে, তা হলো বেদনা।
“বেদনার গরল হাসি মুখে করে পান,
লিখে দিলাম সুখের জোৎস্নাতে তোমার নাম।”
অরুনিকা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদাভানের যাওয়ার পানে। চোখজোড়া ভীষণ জ্বালাপোড়ার সাথে অশ্রুপাতে ব্যাস্ত। একদিকে এতদিন পর নিজের পরিবারকে ফিরে পাওয়া তো অপরদিকে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলা। দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে প্রবাহিত সময়ের সাথে অদৃশ্য হয়ে যায় আদাভান। ধরা ছোঁয়ার বাইরে যাওয়ার আগে সবকিছু উপেক্ষা করে দৌড় দেয় অরুনিকা। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে।
হাঁটু মুড়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে অরুনিকা। বাবা মাকে ফিরে পেতে গিয়ে আদাভানকে হারাতে হবে তা কখনো ভাবেনি। নিজের ভাগ্যের উপর দোষারোপ করেও কোন লাভ নেই, কারণ এটা সত্যি যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চেয়ে ছিল অরুণিকা। কান্নায় ভেঙে পড়ে সেখানেই জ্ঞান হারায় সে।
আদাভানকে একা বাড়িতে ফিরতে দেখে বারবার উঁকি ঝুঁকি মেরে পিছনে কারোর আসার অপেক্ষা করেন আনিকা আহসান। মূর্ছা পরা আদাভানের চেহারা আর সময়ের সাথে সাথে অরুণিকার অনুপস্থিতিতে ভয় জেঁকে ধরে তাকে।
“আদাভান! অরুনিকা কোথায়”
মায়ের উৎকণ্ঠাপূর্ণ কন্ঠ শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না আদাভান। একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়লো মায়ের কোলে। আনিকা আহসানও পরম মমতাময়ী হাতে আঁকড়ে ধরেন ছেলের মাথা। বিস্ময়ে তিনি হতবাক, এতগুলো বছরে ছেলেকে কখনো কাঁদতে দেখেননি। শেষ কান্না ছিল যেদিন পিতা নামক মানুষের ছায়া ওর মাথা উপর থেকে সরে গেছিল। বাবারা নাকি বটগাছের ন্যায় সন্তানকে ছায়া প্রদান করেন। শত ঝড়, ঝাপটা, আঘাত নিজের গায়ে মেখে সন্তানের শেষ রক্ষা করে যায়। অথচ সেই ছায়া থেকে ছোটো কালেই বঞ্চিত হয়েছিল আদাভান। অতীত মনে হতেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে তার।
______________
সদ্য নবম শ্রেণীতে পড়া আদাভান বরাবরের মতো স্কুলে প্রথম স্থান অধিকার করে বেশ খোসমেজাজে বাড়ি ফিরছে। সদ্য কিশোরে পদার্পণ করা আদাভানের চোখে রয়েছে নতুন স্বপ্ন। দুই চোখ ভরে স্বপ্ন সাথে রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে সে। বাড়িতে ঢুকতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে। আব্বু বলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরায় খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেননি সেই মানুষটি। অথচ এতগুলো বছর পর বাবাকে চোখের সামনে দেখে আবেগে আপ্লুত আদাভান। বাবাকে ছেড়ে দৌড়ে যায় মায়ের কাছে। রুমের দরজা খুলতেই বিধ্বস্ত আনিকা আহসানকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। ফ্যানের সাথে ওড়না পেচিয়ে মাত্র ফাঁ*স দিতে যাওয়ার মুহূর্তে ছেলেকে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েন আনিকা আহসান। ভয় আর লজ্জা তুই জেঁকে ধরে তাকে। ছেলের সামনে এভাবে অপ্রস্তুতভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাননি তিনি কখনো। চোখ মুখ মুছে এগিয়ে এসে দাঁড়ান আদাভানের সামনে।
“আম্মু! কি হয়েছে তোমার? আব্বু এসেছো তো। তুমি এসব কি করছিলে আম্মু?”
“হ্যাঁ বাবা তোমার আব্বু এসেছে তো। কথা হয়েছে আব্বুর সাথে?”
কোনোরূপ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় আদাভান ড্রয়িংরুমে। আব্বুর পাশে আরও এক মহিলাকে বসে থাকতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক আদাভান। কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায় আব্বুর কাছে, ছোট্ট দুই হাতের মাঝে তোর হাত রেখে প্রশ্ন করে,
“উনি কে আব্বু?”
“তোমার নতুন আম্মু”
হাসান সাহেবের এমন সাবলীল উত্তর শুনে কেঁপে ওঠে আদাভান। মনে মনে আওড়ায় “নতুন আম্মু”। ছোট হলেও ব্যাপারটা বোঝার মতো বয়স হয়েছিল তার। বিস্ফোরিত নয়নে দুই কদম পিছিয়ে হাসান সাহেবের দিকে তাকিয়ে ফিরে আসে আনিকা আহসানের কাছে।
“আম্মু তুমি এজন্য আ*ত্ম*হ*ত্যা করছিলে?”
আদাভানের কথায় অবাক নয়নে তাকায় ড্রয়িং রুমের সবাই।
কুড়ি বছরের সংসার জীবনে একজন যোগ্য স্ত্রী, যোগ্য বৌমা, যোগ্য মা হাওয়ার চেষ্টা অনবরত চালিয়ে গেছেন তিনি। স্বামীর প্রতি কখনও এতটুকুও অভিযোগ করেননি কখনও। তবে কেনো তার ভাগ্যের লেখন এমন হলো? কেনো স্বামীকে পরনারীতে আসক্ত হয়ে হলো? কই তিনি তো কোনো কোনো পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকাননি? অথচ আমাদের সমাজ কতো সহজে সব দোষ চাপিয়ে দেয় নারী জাতীর উপরে। পুরুষ পরনারীতে আসক্ত হওয়ার পিছনে অধিকাংশ মানুষই দায়ী করেন স্ত্রীকে। কিছু মানুষ সমাজের চাপে পড়ে মুখ বুঁজে মেনে নেয় স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে, আবার কিছু মানুষ নিজের আত্মসম্মানের কাছে হেরে না গিয়ে, সমাজের পরোয়া না করে বেরিয়ে আসেন সেই ঠুনকো সম্পর্ক থেকে। যে সম্পর্ক থাকাকালীন অন্য নারীর প্রয়োজন পরে সে সম্পর্কে না থাকে ভালোবাসা, না থাকে সম্মান। এমন অধম রূপে নিজেকে প্রকাশ না করে বেরিয়ে আসেন সেই নামমাত্র সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন আনিকা আহসান। শয়তানের প্ররোচনায় গিয়ে আদাভানের কথা একবারও চিন্তা না করে সেদিনের নিতে যাওয়া ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজও অনুতপ্ত তিনি।
সেদিন থেকেই আদাভান ঘৃণা করে হাসান সাহেবকে। ভাগ্যক্রমে আনিকা আহসানের নামে এই পৈতৃক বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন তার শশুর। নাহলে সেদিন ছেলেকে নিয়ে পথে বসতে হতো তাকে। সমাজ নামক নোংরা মানুষিকতার কিছু মানুষের তোপের মুখে বারবার পড়তে হয়েছিলো তাকে। কিন্তু আদাভান সবসময় ছিলো তার পাশে ঢাল হিসেবে।
অতীত থেকে ফিরে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলান তিনি।
“আদাভান, বাবা কি হয়েছে বল আমাকে।”
“আম্মু অরু চলে গেছে আম্মু। আর ফিরবেনা অরু”
“কি বলছিস এসব, কোথায় গেছে অরু মা?”
“আম্মু অরুনিকা ওর আব্বু আম্মুর কাছে আছে। আমি দিয়ে এসেছি ওনাদের কাছে। ওনাদের ছেড়ে অনেক কষ্টে ছিলো আম্মু আমার অরু। ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই তাইনা! আমি দুর থেকেই আমার অরুকে ভালোবাসবো, সবসময় আগলে রাখবো। যদি কখনও ওনারা নিজে থেকে আমার হাতে অরুকে তুলে দেন সেদিনই আমি অরুকে ফিরিয়ে আনবো, তার আগে নয়।”
চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে যায় আদাভান নিজের রুমের দিকে।
চলবে?
আপনারা জানেন আমি পেজ ছাড়া কোথাও গল্প দিয়না, তাই সাইলেন্ট রিডার হয়ে না থেকে একটু রিয়েক্ট, কমেন্ট করবেন সবাই। লেখালেখিতে উৎসাহ পাই তাহলে🙂