#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(27)
ভরা পূর্ণিমার রাতে নিটোল চাঁদ তার ঝলমলে আলোর পশলা নিয়ে দূর আকাশে পাখা মেলেছে। চাদনি রাত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনে বিচিত্র ভাব ও উদ্দাম আনন্দের সঞ্চার করে। পূর্ণিমা নিশিতে নির্জন অরণ্যের আলো-ছায়া জড়ানাে পথে ঘুরে বেড়ানাে, আহ! ভাবতেই মনটা কেমন অনির্বচনীয় আনন্দে রােমাঞ্চিত হয় । কবির ভাষায়—
“শান্ত করাে, শান্ত করাে এ ক্ষুব্ধ হৃদয়
হে নিস্তব্ধ পূর্ণিমা যামিনী । অতিশয়
উদ্ভ্রান্ত বাসনা বক্ষে করিছে আঘাত
বারংবার তুমি এসাে সিন্ধু অশ্রুপাত
দগ্ধ বেদনার পরে।”
পূর্ণিমা নিশীথের সৌন্দর্যে অনেকে ব্যস্ত চন্দ্রবিলাশে, আবার কোনো কপোত কপোতী মেতে উঠেছে ভালোবাসার আদিম খেলায়। আবার কেউ হয়তো শিকার হচ্ছে কোনো হিংস্র মানুষরূপী হয়নার দলের। আদাভানের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে কিছুক্ষন আগের কথা ভেবে হেঁসে উঠলো অরুনিকা। মনে মনে পাগল উপাধী দিয়ে ঘুমন্ত আদাভানের লোমশ বুকে অধরের স্পর্শ এঁকে দিলো।
কিছুক্ষন আগে,
“অরু তোমার পা টা কোথায় এদিকে দেখাও তো। দারাও আমি ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসি।”
“আরে শুনুন, তেমন কিছু হয়নি আমার। এতো ব্যস্ত হতে হবেনা”
আদাভানের রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলে ওঠার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারলোনা অরুনিকা। আদাভানও বিনা বাক্য ব্যয়ে এদিক ওদিক খুঁজে কাঙ্খিত জিনিসটা নিয়ে এসে অরুনিকার পায়ের কাছে মেঝেতে বসলো।
“এই এই, কি করছেন আপনি। উঠুন দেখি।”
“নো মোর টক প্রাণপাখি। এমনিতে এতক্ষন পরে ব্যাথার কথা বলার জন্য তোমার শাস্তি বাকি আছে।”
অরুনিকা কিছু বলতে গিয়েও না বলে চুপচাপ পা গুটিয়ে বসে পড়ে।
“এটা কি ধরনের বাচ্ছামি। আমাকে ওষুধ লাগাতে দাও। অনেকটা কেটে গেছে। ইশ কতোটা রক্ত বেরিয়েছে।”
“আমার যা ইচ্ছে হোক, আপনার কিছু করতে হবেনা।”
বেডের একপাশে শুয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে অরুনিকা। আদাভানের দিকে পিছন করে থাকলেও আদাভান বেশ বুঝতে পেরেছে অরুনিকা কান্না করছে। আর কান্না করাটাও স্বাভাবিক। মনে মনে মুচকি হাসলেও মুখে গাম্ভীর্যটা বজায় রেখে অরুনিকাকে কোলে তুলে সোফায় এনে বসিয়ে দেয়।
“একদম নড়াচড়া করবেনা। আমার কাজে যদি একটুও বাঁধা পেয়েছি তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবেনা। নিজে তো দারুন ফুর্তিতে ছিলে, তবে আমার উপর রাগ দেখানোর কারণ কি?”
আদাভানের বলা শেষ কথা, “ফুর্তিতে ছিলে” এর মানে কিছুতেই বোধগম্য হলোনা অরুনিকার। ভাবনার মাঝে পায়ে জ্বালা অনুভব হতেই “আহ” করে ওঠে। আদাভানও পরম যত্নে ফু দিয়ে আস্তে আস্তে ক্ষতগুলো পরিস্কার করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই উঠে অরুনিকার পাশে বসে আদাভান। এতক্ষন যদি অরুনিকা আদাভানের দিকে তাকিয়ে থাকতো তবে বুঝতে পারতো প্রেমীক হৃদয়ের ব্যাকুলতা। যেভাবে আস্তে আস্তে অয়েন্টমেন্ট লাগাচ্ছিল, মনে হয় নিজেরই ব্যাথা।
আদাভান যতো অরুনিকার কাছে সরে আসছে অরুনিকা ততোই সরে যাচ্ছে। সরতে সরতে সোফার একদম কিনারায় পৌঁছে গেলে অরুনিকাকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নেয় আদাভান। একপলক অরুনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ গুঁজে নেয় অরুনিকার ঘাড়ে।
“প্রাণপাখি”
এই কোমল মোহনীয় ডাক কোনকালেই উপেক্ষা করতে পারেনি অরুনিকা। কিন্তু আজ মনের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে সেই ডাক উপেক্ষা করে গেলো।
“আমি বাধ্য ছিলাম প্রাণপাখি।”
“মানে?”
আদাভান এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
“যেদিন তোমাকে এবাড়িতে রেখে বাড়ী ফিরেছিলাম, বোঝাতে পারবোনা কি অবস্থা হয়েছিলো আমার। আম্মুর কোলে মাথা রেখেও একটুও শান্তি পাইনি আমি। তুমি চলে আসার পর আমি আর কখনও বেডে ঘুমায়নি। প্রথম প্রথম রুমেই থাকতাম না, পুরো রুমটা যেনো আমাকে গিলতে আসতো। তোমাকে ছাড়া সবকিছু প্রাণহীন হয়ে গেছে। আম্মু একদিন দেখে নেয় তাই বাধ্য হয়ে সোফাতে ঘুমাই এখন।”
“তোমাকে ছাড়া এমনিতেও কিছু ভালো লাগছিলোনা, আবার আংকেলের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে নিজের কাছে রাখতেও পারছিলাম না। রাতে তোমাকে কল করার জন্য ফোনটা নিতেই একটা মেসেজের উপর আমার চোখ আঁটকে যায়। সেখানে লেখা ছিল, “অরুনিকাকে সুস্থ দেখতে চাইলে ওর থেকে দূরে সরে যাও। কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে এর পরিণাম অনেক খারাপ হবে। কারোর প্রাণও যেতে পারে।” এটা দেখার পর অনেক ভয় পেয়ে যাই আমি। আমি কোনোকিছুর মূল্যেই তোমাকে হারাতে পারবোনা। তাই জোর করেই কিছুদিন যোগাযোগ করিনি। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো ফোন করবে। তারপর যেদিন তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো তার আগের দিন রাতে অনেকবার ট্রাই করি আমি তোমার ফোনে, কিন্তু বারবার সুইচ অফ বলে। আমার ফোনের জন্য তোমাকে সত্যি সত্যি কষ্ট দেবে আমি ভাবতেও পারিনি। সেদিন তোমার হাতে ব্যান্ডেজ দেখে আমি আরও বেশী ভয় পেয়ে গেছিলাম। আর নিশ্চিত হয়েছিলাম যে কেউ এই কাজটা করছে সে আমাদের দুজনকে খুব ভালো করে চেনে।”
সবটা শুনে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদাভানের বুকে মাথা এলিয়ে দেয় অরুনিকা। আদাভানের শার্টের বোতাম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,
“তবে আমি ফুর্তিতে ছিলাম বললেন কেনো?”
“ছিলেই তো।”
অরুনিকা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আদাভান সেদিন বৃষ্টির মাঝের সব কথা খুলে বলে।
“আমার যন্ত্রণায় ভরা হৃদয় যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম, তবে বুঝতে এ হৃদয়ে কতশত ক্ষতর বাস”
আদাভানের চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দুই নেত্রে অধরের স্পর্শ এঁকে দেয় অরুনিকা। এটাই প্রথম অরুনিকার নিজে থেকে কাছে আসা। আদাভান চমকালেও গভীর ভালোবাসার স্পর্শে দুই হাতে অরুনিকার কোমর আঁকড়ে ধরে। আদাভানের আবদার বুঝতে পেরে অরুনিকা মুচকি হেঁসে এক হাতে আদাভানের গলা জড়িয়ে ধরে। অপর হাত মাথার পিছনে দিয়ে দুটি অধরের মাঝের দূরত্ব শূন্যে পরিনত করে। আদাভানও ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রেয়সীর প্রেমসুধা পান করতে।
লজ্জায় লাল হয়ে আদাভানের কোল থেকে উঠে দৌড়ে চলে যেতে নিলে, ধরে ফেলে আদাভান। সোফা থেকে উঠে অরুনিকার চুলের মাঝে নাক ঘষে বলে,
“নেশাও হার মেনে যাবে তোমার নেশার কাছে,
মদও নতস্বীকার করবে তোমার মাদকতার কাছে।
বাতাসে এ কি নেশা ছড়ালে প্রেয়সী,
শুধু তোমার নেশায় আমি মাতাল রূপসী।”
অরুনিকাকে সামনে ঘুরিয়ে থুতনি ধরে উঁচু করে দেয় আদাভান। অতিলজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেও পারছেনা অরুনিকা।
“এই কাশ্মীরি আপেল, কামড়ে দেবো কিন্তু।” বলেই লাজে রাঙা গালে আলতো করে কামড় বসিয়ে দেয় আদাভান। তারপর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“এতদিনের ভালোবাসা সুদে আসলে আদায় করে নেবো কিন্তু। প্রাণপাখি সহ্য করতে পারবে তো!”
______________
অন্ধকার রুমে হাতে একটা কিউব নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে কিছু একটা চিন্তা করতে ব্যাস্ত এক লোক। তখনই হন্তদন্ত পায়ে কেউ প্রবেশ করতেই রূমের গার্ডগুলো বেরিয়ে যায়।
“আমি বলেছিলাম তোমাকে অন্য কোনো জায়গায় রাখতে, শুনলেনা তো আমার কথা। কেমন আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেলো দেখলে তো?”
“শান্ত হও তুমি। আমি ইচ্ছে করেই পাহারা কম রেখেছিলাম। আমি জানতাম ওই মেয়ে এত সহজে হার মানবেনা। তাহসানের মেয়ে তো, ছোটো থেকেই অনেক শক্ত। শক্তি দিয়ে ওকে ভাঙা যাবেনা, ওকে ভাঙতে হলে মানষিক ভাবে ভাঙতে হবে। মানসিক ভাবে একবার ভাঙলে আর উঠে দাড়াতে পারবেনা, আর সেটাই হবে আমাদের সুযোগ।”
“কিন্তু আর কতদিন অপেক্ষা করবো আমাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য”
“ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা তো করতেই হবে। জোর করে আদায় করতে গিয়ে একজন মরেছে, একে কোনোভাবে হাতছাড়া করা যাবেনা। নজর রাখ।”
“কেউ কখনও জানবেনা এসবের পেছনে আসল মাষ্টার মাইন্ড কে। আড়ালে থেকে সবাইকে শেষ করে দেবো আমি। আর তোমাকেও ছাড়বোনা আমি। নিজের ছেলে কাব্যর হাতেই মারবো তোমাকে।”
বলেই বিকট ভাবে হেঁসে উঠলেন ভদ্রলোক। ফাঁকা ঘরের মাঝে সেই হাঁসির ঝঙ্কার ভয়ংকর কিছুর আলাপন দিয়ে গেলো।
চলবে?
#Fiza_Siddique