আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -৩৩

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(33)

এতবছর পর চোখের সামনে হিয়াকে দেখে অবাক হয়ে যায় আদিল। শুকনো একটা ঢোক গিলে আড়চোখে পিছনে তাকাতে গেলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে হিয়া। এবার আদিলের গলা শুকিয়ে কাঠ। কাকে রেখে কাকে বোঝাবে এবার।

“কেমন আছো তুমি? ইউ নো কতো মিস করেছি তোমাকে? তুমি তো আমাকে আর একটা কল পর্যন্ত করোনা কয়েক বছর ধরে। ভুলেই গেছো।”

হিয়ার অভিমানী কণ্ঠ শুনে আড়চোখে পাশে দাড়িয়ে থাকা নূরের দিকে হালকা হেঁসে বলে উঠলো,

“আরে না না ভুলবো কেনো? তুই আমার একমাত্র ফুফাতো বোওওওন। কিভাবে ভুলি।”

“বোন এটা এত জোরে বললে কেনো? আমরা কি কালা নাকি?”

“যাতে আমার উপর আক্রমণ না হয় পরে।”

আড়চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে কথাটা বললো আদিল। নূর নির্বিকার ভাবে দুজনের কথোপকথন শুনে আদিলকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো খাওয়ার টেবিলে। আদিল আর হিয়াও ডাক পড়ায় আর কোনো কথা না বলে চলে আসলো খেতে।

“দেখ রে আদিলের মা, দুজনকে কি দারুন মানিয়েছে। কতো করে বললাম আমার হিয়ার মতো স্মার্ট মেয়ে কোথায় পাবি তুই। তারউপর দুজনে একে অপরের সাথে কতো সহজ। শুনলিনা আমার কথা। এই মুখপুড়ি মেয়ে কি দিয়েছে তোকে বলতো? এতো বছরে একটা বাচ্চার মুখও তো দেখাতে পারলোনা। বলি কি শোন, এখনও সময় আছে। তালাক দিয়ে দিতে বল আদিলকে এরে। আমার হিয়ার সাথে এই মেয়ের কোনদিক দিয়ে যায় শুনি?”

“আহ আপা, বাদ দিন না এসব। যা হাওয়ার তা তো হয়েই গেছে। দুজনে ভালো আছে এটাই তো অনেক আমাদের জন্য তাইনা। ওরা নিজেদের জীবন নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিক। এটাতে আমরা বড়রা না বলাই ভালো। আর আদিলকে তো আমি চিনি। ও যা করবে ভেবে চিন্তেই করবে। ”

“ওর আর দোষ দিয় কি করে বলতো? তোরা তো ধরে বেধে বিয়েটা দিলি। মনে নেই, বিয়ের আগের দিনও বিয়ে করবেনা বলে চলে যাচ্ছিলো। তোর কসমের জন্য তো শুধু থেমে গেলো।”

এতক্ষন কথাগুলো নূরের খারাপ লাগলেও নিজের মতো করে কিচেন থেকে সব এনে সাজাচ্ছিল টেবিলে। কিন্তু আদিল বাধ্য হয়ে নূরকে বিয়ে করেছে, কথাটা শোনামাত্র হাতে থাকা পানির মগটা পড়ে গেলো। নিজেকে কেমন যেনো শূন্য শূন্য লাগছে। আদিত্যকে ভুলে নতুন করে আদিলের ভালোবাসায় বাঁচতে শিখেছিল সে। ভালোবাসাও কি জোর করেই ছিলো তবে?

আওয়াজ পেয়ে সেদিকে দৌড়ে আসে আদিল। নূরকে থম মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অথচ চারিদিকে কাঁচের ছড়াছড়ি। সাবধানে দুইপা এগিয়ে কোলে তুলে নিলো নূরকে। সাবধানে পরিস্কার জায়গা দেখে নামিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।

“এতো কেয়ারলেস কেউ হয় নূর? একটু হলেই তো পায়ে ফুটে যেতো কাঁচ।”

ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুর আদিলের দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে আসলে কোনটা ঠিক। উৎকণ্ঠা নিজের মাঝে চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠলো,

“আমাকে আম্মুর কসমের জন্য বিয়ে করেছিলেন আপনি?”

নূরের কথা শুনে চমকে উঠলো আদিল। কড়া চোখে তাকালো ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবার দিকে। পরক্ষনেই নিজের রাগ সংযত করে কোমল চোখে তাকায় নূরের দিকে।

“কে বলেছে নূর এসব তোমায়?”

“আমি হ্যা অথবা না শুনতে চাই।”

বিয়ের এত বছরেও নূরের কঠিন কণ্ঠ কখনও শোনেনি আদিল। হাজার কটু কথাও চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া নূরকে অন্যরকম লাগছে আজ। চোখ কেমন জানি রক্তিম হয়ে আছে। মিথ্যে বলা কোনোদিনও আদিলের স্বভাবে পড়েনা। তাই নিঃসংকোচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই প্রাণহীন হাঁসি হাসলো নূর। নূরের হাসি দেখে ভয়টা আরো গাঢ় হয়ে উঠলো আদিলের।

“নূর আই ক্যান এক্সপ্লেইন।”

“উত্তর জেনে গেছি।”

আদিলকে থামিয়ে দিয়ে উল্টোপথে হেঁটে সদর দরজার দিকে এগোতেই ফুফি বলে ওঠেন,

“যাক এতদিনে আপদ বিদেয় হয়েছে। শোন রে আদিল, সত্যি কখনও ঢাকা দেওয়া থাকেনা। জোর করে তোর আর সংসার করতে হবেনা। দিন কয় পরে ডিভোর্স দিয়ে হিয়াকে বিয়ে করে নিবি। এমনিতেই এই মেয়ে তোকে সুখ দিতে পারতনা। এতগুলো বছরে বাপ ডাকটাও তো শুনাইতে পারলোনা। ভালো হইছে জেনে গেছে। অপয়া মে……”

“ফুফি।”

আদিলের হুংকারে দরজার কাছে গিয়েও কেঁপে ওঠে নূর। ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে ফুফুর দিকে আদিলের রক্তচক্ষুতে তাকানো দেখে ভয় পেয়ে যায়।

“তোমার সাহস কি করে হয় নূরকে নিয়ে এসব বলার? সুখের তুমি কি জানো? সারাজীবন তো শশুরবাড়ীতে এই কুটনামি করেছো বলে ভাইয়ের ঘরে পড়ে থাকতে হয়। এতোদিন অনেক সম্মান করেছি তোমাকে ফুফি, আর নয়। আজ তুমি সব সীমা অতিক্রম করে গেছো। আর কি বললে তুমি, নূর আমাকে সুখ দিতে পারবেনা? তবে শোনো নূরের কাছে আমি যে সুখ খুঁজে পাই তা আর কারোর কাছে পাবোনা। তোমার কাছে যদি শারীরিক সুখ শুধু ম্যাটার করে, তবে সেটা আমি নূরকে নিয়েই সুখি। কিন্তু আমার কাছে সুখ বলতে মানসিক। ক্লান্ত শরীরে একমাএ নূরের কাছে গেলেই আমি শান্তি খুঁজে পাই। জ্বরের ঘোরে বমি করে সারাগা ভাসিয়ে দিলেও নূরের একটাও অভিযোগ থাকেনা, বরং আমাকে পরিষ্কার করে আমার নূর। তোমার হিয়া স্মার্ট হতে পারে তবে আমার নূরের ধরে কাছেও না সে। ও পারে বিজনেস ডিল করতে, আমার নূর পারে একা হাতে পুরো পরিবার সামলাতে। তোমার এই তিন বেলার খাবার ভাগ্য হয় নূরের জন্য।”

“আদিল প্লিজ চুপ করুন। শান্ত হোন।”

“তুমি আজ একটা কথাও বলবেনা নূর। তোমার মেয়ে হিয়ার মত শরীর দেখায়না বলে নূর আনস্মার্ট? ছেলেদের গায়ে ঢলে পড়েনা বলে আমাকে সুখ দিতে পারেনা? আমাদের বন্ধ দরজার মধ্যে কি হচ্ছে সেসব নিয়ে কথা বলতে তোমার লজ্জা করেনা? এতো যে ডিভোর্স ডিভোর্স করে চিল্লাচ্ছ, নিজের সময় ভুলে গেলে? ফুফা যখন ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল মনে পড়ে সেই সময়? তুমি একজন মেয়ে হয়ে আর একজন মেয়েকে কিভাবে এমন বলতে পারো আমি সত্যি বুঝতে পারছিনা।”

“আর বাচ্চা! বাচ্চা আমি নিতে দিয়নি নূরকে। আমি চাইনি অল্প বয়সে নূরের উপর এত চাপ পড়ুক। এটা ঠিক যে আমি বিয়ে করতে চাইনি, কারণ আমার বিয়ে করার কোনরকম ইচ্ছে ছিলোনা। তবে নূরের সংস্পর্শে আমি বুঝেছি আসল ভালোবাসার মানে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি আমি নূরকে। ভীষণ ভালোবাসি আমি তোমাকে নূর। প্লীজ ছেড়ে যেওনা। সহ্য করতে পারবোনা আমি।”

রাগে, অপমানে ফুঁসছেন ফুফি। কোনো কথা না বলে তিনি বেরিয়ে যান। আদিলের মা অনেক আটকানোর চেষ্টা করলেও তিনি থামলেন না। মায়ের পিছু পিছু অশ্রুসিক্ত চোখে বেরিয়ে গেলো হিয়া। যাওয়ার আগে একবার হিংস্র চোখে তাকালো আদিল আর নূরের দিকে।
_________________

সকাল থেকে আদাভানের ব্যবহারে অবাক হচ্ছে অরুনিকা। কেনো যেনো এই অবহেলা সহ্য হচ্ছেনা। অরুনিকা তো কোনো দোষ করেনি, তবে কেনো আদাভান তাকে অবহেলা করছে?

“মুখের সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে সরে দাঁড়াও।”

“আপনি কাল থেকে এমন বিহেভ করছেন কেনো?”

“হা হা হা হাসালেন মিস অরুনিকা। আপনি যে কতোগুলো মাস ধরে দিনের পর দিন আমাকে অবহেলা করে গেছেন। তবে আমি কিভাবে সহ্য করেছি ভাবুন। যদিও আপনার অবহেলার কারণ আমার কাছে স্পষ্ট এখন।”

“আপনি কি বলতে চাইছেন আদাভান। আর এটা কিভাবে কথা বলছেন আমার সাথে? আমি মিসেস এটা কি ভুলে গেছেন নাকি? নাকি মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে?”

“মাথায় আমার না তোমার ঘুরছে। ওহ সরি সরি মনে ঘুরছে। তোমার পুরোনো প্রেমিক। তো ডিভোর্স কবে দিচ্ছ আমাকে? নাকি দুটো একসাথে চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে?”

“নিজের দোষ ঢাকতে একদম আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলবেন না আদাভান। এর ফল ভালো হবেনা তবে।”

“আমি প্রমাণ ছাড়া কাউকে কিছু বলিনা মিস অরুনিকা। ডিভোর্স লেটার আসলে বলবেন আমি সই করে দেবো। আমার সাথে সম্পর্কে থেকে এইসব নোংরামি অন্তত চলবেনা।”

“আদাভান বাড়াবাড়ি করছেন আপনি। নিজের চরিত্রের ঠিক নেই, সে আবার এসেছে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে। হাহ।”

ঠাস করে পড়া থাপ্পড়ে অবাক হয়ে তাকায় অরুনিকা। অরুনিকার দুই গালে হাতের আঙ্গুল ডেবে ধরে একদম কাছাকছি নিয়ে আসে আদাভান।

“কি পেয়েছিস তোর ওই প্রেমিকের মাঝে যা আমি দিতে পারিনি? এতো ভালোবাসলাম তারপরও তুই আমার হলিনা কেনো? সবজায়গায় মুখ মারা কি তোর স্বভাব নাকি?”

গালে আঙ্গুল ডেবে কোনরকম কথা বলতে পারছেনা অরুনিকা। অনেক কষ্টে বলে উঠলো,

“আপনি কার কথা বলছেন আদাভান। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। প্লিজ এসব বলবেন না। আর যায় হোক আমি চরিত্রহীন নই।”

খোপা করা চুলের মুঠি ধরে মুখটা আরো কাছে টেনে এনে,

“আমিও আগে সেটাই ভাবতাম। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ অরুনিকা। আমি ঠকে গেছি।”

এটুকু বলেই দুই ঠোঁট এক করে দিলো। প্রথমে আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলেও পরে হাত পা ছুড়তে থাকে অরুনিকা। একের পর এক কামড়ে কষ্টে যন্ত্রণায় দম বেরিয়ে আসছে অরুনিকার। এদিকে একের পর এক কামড় বসিয়ে যাচ্ছে আদাভান। পশুদের মতো হয়ে উঠেছে সে। এবার ঠোঁট ছেড়ে গলায় একের পর এক কামড় বসাতে থাকে। ধাক্কা দিয়ে একবিন্দু সরাতে পারছেনা অরুনিকা। অবশেষে বিছানায় ফেলে পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো আদাভান। খুবলে খুবলে যেনো শেষ করে দেবে আজ সব। এই আদাভানকে চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে অরুনিকার। রাগে ঘৃণায় আল্লাহর কাছে নিজেকে বাঁচানোর ফরিয়াদ করতে থাকে।

শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অরুনিকা। কোনরকমে ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে ওঠে। ঠোঁট ফুলে লাল হয়ে আছে, গলা থেকে শুরু করে পুরো শরীরে কামড়ের দাগ। পানির ফোঁটা গায়ে পড়তেই আগুনে ছেকা লাগার মতো জ্বলে উঠছে পুরো শরীর। শাওয়ারের নিচে বসে নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিতে থাকে অরুনিকা। কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। বিয়ের এতগুলো বছরেও এই হিংস্ররূপ কখনও দেখেনি আদাভানের। অবশ্য এই কয়েকমাসে অনেক নতুন করেই চিনছে আদাভানকে। তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে শাওয়ার সেরে বেরিয়ে এলো।

খাটের সাথে হেলান দিয়ে আদাভানকে বসে থাকতে দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয় অরুনিকা। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় ব্যালকনির দিকে। ব্যালকনিতে রাখা সোফায় বসে হাতার উপর মাথা এলিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলতে থাকে। হঠাৎ পাশে কারোর উপস্থিতি বুঝতে পেরে নড়েচড়ে উঠতে গেলে হাত ধরে থামিয়ে দেয় আদাভান। এক হাতে গ্লাস আর পানি এগিয়ে দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

পাঁচদিন পর বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়েছে অরুনিকা। কাব্যের সাথে দেখা করাটা জরুরি, এই কয়দিন শরীরের অবস্থা খারাপের জন্য বের হতে পারেনি। বিশেষ দরকারের জন্য ডেকেছে আজ কাব্য। রাস্তা পার হতেই কাব্যকে দেখে এগিয়ে যায় অরুনিকা। দুজনে মিলে সামনের এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে কফি অর্ডার করে নিজেদের মতো কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

“আমি তো ভাবতে করছিনা অরু, আদাভান এত নিষ্ঠুরভাবে তোকে আঘাত করবে। তুই ছেড়ে দে আদাভানকে। এরকম মানুষের সাথে একসাথে থাকা অসম্ভব।”

“আমি বর্ষা আপুকে কথা দিয়েছি ওনার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো। আমাকে আমার প্রতিশোধ নিতেই হবে যেভাবে হোক।”

“তবে তার জন্য আদাভানকে আঘাত করতে হবে। তুই কি আদৌ এই কাজটা পারবি? ভেবে দেখ।”

“আমি পারবো।”

“বেশ, তবে কালকেই হবে ওর শেষ দিন।”

“কিভাবে?”

“সেটা আমার উপর ছেড়ে দে। তবুও যদি কাজ না হয় তবে অন্য পদ্ধতি দেখতে হবে।”

অরুনিকাকে কি করতে হবে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় কাব্য।

চলবে?
#Fiza_Siddique

আমি জানি বেশ কিছুদিন ধরে গল্প দেওয়া হয়নি। আসলে দুটো যৌথবইয়ে গল্প দিতে গিয়ে এখানে কন্টিনিউ করতে পারছিলাম না। আজ থেকে আবারো কন্টিনিউ দেবো। আর কারা কারা চান আমি একটা গ্রুপ খুলি জলদি বলে ফেলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here