তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৪৬+৪৭

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪৬

রিয়ার বার্থডের আয়োজন অবশেষে করাই হচ্ছে। আফিন অনেক ভেবেচিন্তে একটা কফি শপে বার্থডে সেলিব্রেশন করার বুদ্ধি আটল। রিয়ার কফি বেশ পছন্দ, এই ফাঁকে নিশ্চয়ই সে বসে বসে তিন চার কাপ খেয়ে ফেলবে। এতে ওর মন ভালো থাকবে, রাগবে না। নাহলে রিয়া যা, পান থেকে চুন খসলেই রেগে যায়।
সকাল সকাল আফিন আর নীলাভ্র দেখেশুনে ভালো একটা কফি শপ বুক করে ফেলল। কাজ তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। কফি শপের দোতলাটা পুরোটা ভাড়া করা হলো। দুপুরের দিকে শান্ত, আহনাফ, তানিশা, নিঝুম, ইফা, তিথি, আহিম, আফিন আর নীলাভ্র সবাই উপস্থিত হলো। উপরের সাজানোর কাজ টা শুরু হবে খানিকক্ষণ পর। আপাতত চেয়ার টেবিল সব সরিয়ে একপাশে রাখা হয়েছে। লাইটিং’র‌ কাজটাও হবে তখন। নিচে সবাই মিলে ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে। কিভাবে কি হবে, না হবে সবকিছু!

নিঝুমের ভাবটা বেশ শান্ত শিষ্ট। ঘুরে ঘুরে দেখছে সে পুরোটা। এখন এখানে তেমন একটা কাস্টমার নেই। নিঝুমের ইচ্ছে করছে এখানকার কফি একবার ট্রাই করতে। নিশ্চয়ই ভালোই হবে। পেছন থেকে তানিশার কণ্ঠ ভেসে আসতেই চট করে পেছন ফিরল নিঝুম। তানিশা একটা টেবিলের উপর বসা। তার হাতে একটা কোল্ড কফি, নিঝুমের দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে বলল, “তুমি আমাকে অবাক করে দিচ্ছ?

“কেন?

“এতো বড় একটা খবর, অথচ তোমার হাবভাব আগের মতোই। মনেই হচ্ছে না কিছু হয়েছে?

নিঝুম হাসল। তানিশা এদিক ওদিক ফিরে বলল, “তাহলে বেশ সুখেই আছো বলা যায়।

নিঝুম ফিরল। ইফা আর তিথি কি নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে। নিঝুম কে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল ইফা। নিঝুম হাসল। তানিশা নিচে নামল। নিঝুমের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “বোধহয় সংযতা হয়ে গেছে, আমি আরো ভাবলাম কতো কি দেখবো। ওহ হ্যাঁ একটা কথা, আমি কিন্তু তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ রেখেছি। খুব শীঘ্রই পেতে চলেছো তুমি সেটা!

বলেই চোখ টিপে তানিশা চলে গেল। নিঝুম কিছু একটা আঁচ করতে পারল বটে। মুখ ফিরে এদিক তাকিয়ে দেখল নীলাভ্র মনমরা হয়ে আছে। ইফা’র ব্যাপারটা অবশ্য সে, তানিশা আর নীলাভ্র ছাড়া আর কেউই জানে না। ইফার এমন কাজে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নীলাভ্রের উপর। ভাবতেই পারছে না, বন্ধুদের আড়ালে এভাবে কেউ শত্রুতাও করতে পারে। রাগের চেয়ে বেশি কষ্টটাই পেয়েছে সে‌। ইফা কে নিজের ছোট বোনের মতো ভাবতো, নিজের ছোট বোন যদি এমনটা করতো তাহলে এতোক্ষণে তার দু গালে দুটো চড় মার*তো। সেখানে এখনো কিছুই করতে পারছে না। আহনাফ কে বলতে গিয়েও ফিরে এসেছে নিঝুমের কারণে। কাউকে জানাতে দেয় নি সে!

নীলাভ্র এবার অতিষ্ট হয়ে পড়ল। যেখানে সে চিন্তায় অস্থির সেখানে নিঝুমের এমন শীতল মনোভাব আরো উত্তেজিত করছে তাকে। হঠাৎ’ই নীলাভ্র এসে নিঝুমের সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাত ধরে টেনে উপরের দিকে নিয়ে গেল। শান্ত’র‌ নজর কাড়ল দৃশ্য টা, তবুও কিছুই বলতে পারল না । এদিকে ইফাও তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তার হাতে একটা চিরকুট, রক্তশূন্য মুখে স্থির নয়নে তাকাচ্ছে আশপাশ। এক কোনে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করছে তানিশা। নিজে শান্তিতে নেই, আর কাউকেই শান্তিতে থাকতে দেবে না বলে ঠিক করে রেখেছে।

“আমি নিচে গিয়ে সবাইকে এখন বলে দেবো?

“কি বলবেন?

“কি বলবো মানে, যা ঘটেছে তাই বলবো। তুমি পারছো এভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকতে আমি পারছি না।

“কিছু বলার দরকার নেই।

“কেন দরকার নেই?

“ঘটনাটা এখন সবাই ভুলে গেছে তাই।

“আমি তো আর ভুলে যেতে পারছি না।

“তাহলে ভুলে যান, আমার তো। আমিও তো ভুলে গেছি।

নীলাভ্র শব্দ করে শ্বাস। আশপাশ তাকালো বিচলিত হয়ে। অতঃপর বলল, “তুমি বিরল প্রজাতির জীব, এটা জানো। এতো কিছু ঘটে গেল আর তুমি বলছো ভুলে যেতে।

“না গিয়ে এখন কি উপায়। কি বলবো আমি এখন, এই একটা কিছুর জন্য এখন কতো কি হবে, বন্ধুত্ব ভেঙে যাবে, সম্পর্ক নষ্ট হবে ‌আর সবচেয়ে বড় কথা, আজকের দিনটা খারাপ হবে। আপনি চান এটা। আহনাফ, অশান্ত, আহিম, আফিন যারা এখন ইফা কে ছোট বোনের মতো দেখছে, এতো আদর করছে সবার কাছে এক নিমিষেই খারাপ হয়ে যাবে।

পেছন থেকে ইফা বলে উঠল, “কেন খারাপ হয়ে যাবো!

নিঝুম আর নীলাভ্র দুজনেই পিছু ফিরল। নীলাভ্র কিছু কঠিন কথা বলার জন্য প্রস্তুত নিলেও নিঝুম তার হাত আটকে দিল। ইফা সামনে এগিয়ে এলো। হাতের চিরকুট সামনে ধরে বলল, “এটার মানে কি নিঝুম?

নিঝুম চিরকুট হাতে নিল। বেশ বুঝতে পারল তানিশা এই সারপ্রাইজের অপেক্ষা করতে বলেছিল, এতো তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে ভাবে নি। নীলাভ্র বলে উঠল, “তুই কেন এমনটা করলি ইফা!

ইফা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। বেশ বোঝাই যাচ্ছে এখন সে শুধুই নিঝুমের সাথে কথা বলতে চাইছে। নীলাভ্র কে উদ্দেশ্য করে নিঝুম বলল, “আপনি চলে যান নীলাভ্র, আমাদের কিছু কথা বলার আছে!

বিরক্ত হয়ে হন হন করে চলে এলো নীলাভ্র। শান্ত উপরে যাবে বলে ভেবে নীলাভ্র কে নামতে দেখে আর আগালো না। কিন্তু নীলাভ্র কে রেগে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো। কি হচ্ছে এসব!

নিঝুম আর ইফা এখন মুখোমুখি! ইফা চোখ মুখ কঠিন করে রেখেছে। নিঝুমের দৃষ্টি মলিন। নিঝুম হাসল। ইফা বলে উঠল, “তুই হাসছিস?

“হাসবো না তো কি করবো?

নিঝুমের কথায় গোলমেলে হয়ে গেল সবকিছু। বিচলিত হয়ে উপর ইফা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে সে। নিঝুমের দিকে আর দৃষ্টি রাখতে পারল না। শুকনো ঢোক গিলে চোখ সরিয়ে ফেলল। নিঝুম চোখের চশমা খুলে উড়না দিয়ে মুছে আবারো চোখে পড়ে বলল, “এতো ভয় পেয়ে যাচ্ছিস কেন?

ইফার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে এখন। তার চোখে ভয় স্পষ্ট! নিঝুম হাসি হাসি মুখে বলল, “আমার এতো বড় ক্ষতি কেন করতে চাইলি!

“তুই আমার সর্বনাশ করেছিস!

“কি বলতে চাস তুই!

“আমি ভালোবাসি শান্ত ভাইয়া কে, এখন না আরো আগে থেকে ভালোবেসে আসছি। আমার প্রতিটা স্বপ্ন আমি তাকে নিয়ে বুনিছে। আর তুই, তুই মাঝে এসে কি করলি। কেড়ে নিলি আমার থেকে শান্ত ভাইয়া কে।

“আমি কেড়ে নিয়েছি, ইফা তুই ভুল বুঝছিস।

“না বুঝছি না, যা ঠিক তাই বুঝছি। যা বলছি সব সত্যি বলছি। সবকিছু ঠিক চলছিল, মাঝে তুই, শুধু তুই এসে সবকিছু নষ্ট করে দিলি।

চেঁচিয়ে কথা গুলো বলতে লাগলো ইফা। তার চোখ মুখ ইতিমধ্যে লাল হয়ে গেছে। চোখে জল টলটল করছে। নিঝুম সামনে এগিয়ে এসে ইফার হাত ধরে বলল, “ইফা শোন, তুই ভুল বুঝছিস আমায়।

চট করে হাতটা সরিয়ে নিল ইফা। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।‌ ভার ভার গলায় বলতে লাগলো, “যখন তোকে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম নিজের বন্ধু ভেবেছিলাম, খুব ভালো এক বন্ধু। খুব আপন ভাবতাম তোকে। কিন্তু যখন দেখলাম তুই, তুই আমার ভালোবাসা থেকে আমার থেকে কেড়ে নিচ্ছিস তখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল আমার। কেন এমনটা করলি তুই নিঝুম, বল কেন?

“ইফা তুই শোন তো…

“প্রথমে আমি ভাবলাম তুই আহনাফ ভাইয়া কে ভালোবাসিস। কিন্তু না, পরে যখন দেখলাম তুই সবসময় শান্ত’র ভাইয়ার পিছু পিছু ঘুরিস, তখনি আমার দুনিয়া উল্টে গেল নিঝুম। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি নিজেকে পারি নি। ভাবতাম তুই বোধহয় আহনাফ ভাইয়া কে ভালোবাসিস। শান্ত ভাইয়া শুধু তোর বন্ধু, কিন্তু তবুও নিজেকে মানাতে পারি নি। জানিস, একমাত্র তুই সে মেয়ে যাকে শান্ত ভাইয়া এতো ইম্পর্ট্যান্ট দিচ্ছিল। অস্থির হয়ে উঠছিলাম আমি। কি করবো, বুঝতে না পেরে পোস্টার ছাপালাম তোদের। ভাবলাম এটা তোদের আলাদা করে দিবে। কিন্তু না, তেমন কিছুই হলো না। তিশা আপু চলে গেল আহনাফ ভাইয়া কে ছেড়ে, আহনাফ ভাইয়া ভালোবাসলো তোকে। আমিও ভাবলাম বোধহয় এবার কিছু একটা হবে। তুই সরে আসবি শান্ত ভাইয়ার কাছ থেকে। কিন্তু না, সেটাও হলো না। তুই.. ( নিঝুমের চোখের দিকে তাকিয়ে ) নিঝুম তুই শান্ত ভাইয়া কে ভালোবাসিস, তাই না বল!

নিঝুম চোখের জল আড়াল করল। আকাশের দিকে তাকাল, ঝিমিয়ে পড়া এই দুপুর। সূর্য এখন মেঘের আড়াল থেকে রোদ দিচ্ছে, সেই রোদ গায়ে লাগছে না। ইফার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল, “তুই আমাকে মা*রার চেষ্টা করেছিলি ইফা, ছেলে লাগিয়ে আমাকে মাঝ রাস্তায় চশমা ছাড়া এই কারণেই এনে দাড় করিয়েছিলি। তুই বেশ জানতি, আমি চশমা ছাড়া অন্ধ তাই না বল!

ইফার চোখের মনি ছোট হয়ে এলো। চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সে। তার শরীর কাঁপছে, বার বার ভয়ে ঢোক গিলছে সে। নিঝুম হেসে বলল, “যার জন্য তুই এতোকিছু করলি সেই অশান্ত কিন্তু তোকে ভালোবাসে না। তোর একবারও মনে হচ্ছে না তুই ভুল করছিস!

ইফা চমকে তাকাল। নিঝুম এবার তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলল, “অশান্ত তোকে ভালোবাসে না,তাই না ইফা! তুই উনাকে একপাক্ষিক ভালোবাসছিস‌।

“এসব কিছু তোর জন্য, তোর জন্য এসব কিছু!

“তুই আবারো আমায় দোষ দিচ্ছিস!

“হ্যাঁ হ্যাঁ কারণ সব দোষ তোর, তোর জন্য হয়ে গেছে এতো কিছু। তোর জন্য আমি এতো নিচে নেমে গেছি, শুধু তোর জন্য!
নিঝুম থমকে গেল। যার চোখ এতোক্ষণ ভয়ার্ত ছিল এখন তার চোখেই নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে নিঝুম। এ কি করে হয়, এই একই চোখে সে দেখেছিল বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আজ সেই চোখে ঘৃণা। সত্যিই কি ইফা এতো ঘৃণা করে তাকে। তানিশা কি তবে ঠিক বলল‌।‌ নিঝুম শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, “তুই আমায় এতো ঘৃণা করিস ইফা!

ইফা চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমার সহ্য হয় না তোকে। কখনো সহ্য হয় না। তুই আমার থেকে শান্ত ভাইয়া কে কেড়ে নিয়েছিস। তুই শুধু পারিস কেড়ে নিতে, তানিশা আপুর থেকে কেড়ে নিলি আহনাফ ভাইয়া কে আর আমার থেকে কেড়ে নিচ্ছিস শান্ত ভাইয়া কে।

“ইফা চুপ!

থমকে উঠল ইফা। নিঝুমের ঠোঁট কাঁপছে, তার চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। নিঝুম নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করল। ইফা হঠাৎ হেসে বলল, “সত্যি বললাম তাই না বল। আমি এখন বুঝতে পারছি, কেন তানিশা আপু তোকে সহ্য করতে পারে না। তুই আসলেই কি রকম মেয়ে!

নিঝুম স্তব্ধ ইফার কথাবার্তা শুনে, এই কি তবে বন্ধুত্ব, খুব তুচ্ছ কারণে বন্ধুত্ব কি এভাবে ভেঙে যায়। সতিই কি ভালোবাসা এভাবেই বন্ধুত্ব কে নষ্ট করে দেয়। রাগে ফুসফুস করছে ইফা, নিজ বন্ধুর চোখে এভাবে ঘৃণা দেখতে পেয়ে হতবাক সে । তবুও হেসে নিঝুম মৃদুস্বরে ইফার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “যার জন্য এমনটা করলি, তাকে কি তুই সত্যিই পাবি ইফা। অশান্ত কি সত্যিই তোকে ভালোবাসে! আমি আবারো জিজ্ঞেস করছি তোকে ইফা।

ইফা রেগে গেল, বিচলিত হয়ে তাকিয়ে রইল নিঝুমের দিকে। অস্থির হয়ে পড়ছে সে। চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। সামনে এসে এবার মিনতি করে নিঝুম কে বলল, “নিঝুম তুই চলে যা, প্লিজ তুই চলে যা। আমাদের মাঝে থেকে চলে যা। দেখ আমরা তো খুব ভালো বন্ধু, বন্ধু হয়ে আমার এই উপকার টা কর। তুই চলে যা না এখান থেকে প্লিজ চলে যা। আর থাকিস না আমাদের মাঝে।

“আমি তো তোদের মাঝে আসি নি,

“এসেছিস তুই! তুইই এসেছিস আমাদের মাঝে।

” ইফা তুই বলছিস বন্ধুত্বের কথা। তুই আমার বন্ধুতের সুযোগ নিয়েছস।

ইফা চুপ হয়ে গেল। সুর এবার উল্টো দিকে ঘুরল।
কাছে এগিয়ে নিঝুমের বাহু শক্ত করে ধরে বলল, “নিঝুম তুই দয়া কর আমার উপর। আমি ভালোবাসি শান্ত ভাইয়া। অনেক অনেক‌ বেশি ভালোবাসি। তার পাশে কাউকে সহ্য হয় না আমার, কাউকে না।

“বন্ধুত্বের নামে এভাবে ঠকালি আমায়!

“বিশ্বাস কর, আমি এমনটা করতে চায় নি। শুধু হয়ে গেল, কিভাবে জানি হয়ে গেল।

“তুই সবটা জেনেশুনে করেছিস তাই না!

ইফা আবারো ঢোক গিলল। আশপাশ তাকালো, মানুষজনের তেমন কোন চিহ্ন নেই। তার চোখ দুটোতে ভয় স্পষ্ট। নিঝুম ভ্রু কুঁচকালো। ইফা কম্পিত স্বরে বলল,

“সরি নিঝুম!

বলা মাত্র ইফা নিঝুম কে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ছাদ থেকে। নিঝুম নির্বাক! ইফা এমনটা করতে পারে হয়তো এটা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। সে নিচে পড়ে যাচ্ছে, তবে কি এখন মা’রা যাবে সে। মা’রা পড়ছে কি সে। চোখ বুঝে নিল নিঝুম। এদিকে কারো ফোন আসায় শান্ত ফোন হাতে সবে বের হতেই উপর থেকে চশমিস কে পরতে দেখে নিস্তব্ধ! হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল তার।‌ নিঝুম ধপাস করে এসে পড়ল একটা বালির ট্রাকের উপর। শান্ত হতভম্ব, কি করবে না বুঝতে পেরে দ্রুত ট্রাকের পেছন দৌড়াতে লাগল। এদিকে কিছু একটা হয়েছে বুঝে ট্রাক ড্রাইভারও ট্রাক থামিয়ে গেল। শান্ত তড়িখড়ি করে ট্রাকের উপর উঠে দেখল বালিতে মাখামাখি হয়ে আছে নিঝুম। মাথা নেড়ে চশমা খুঁজে যাচ্ছে সে। শান্ত অস্থির হয়ে নিঝুমের কাছে গিয়ে বলল,
“চশমিস, চশমিস তুমি ঠিক আছো?

নিঝুম চোখ বুঝে বলল, “অশান্ত, অশান্ত আমার চশমা!

শান্ত চশমা খুঁজে মুছে নিঝুমের কাছে দিল। নিঝুম চশমা খুলে প্রথমেই তাকাল ছাদের দিকে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ইফা! নিঝুমও তাকিয়ে আছে তার দিকে। শান্ত নিঝুমের ঘাড়ে হাত রেখে বলছে, “এই চশমিশ, চশমিশ ঠিক আছো তুমি। লাগে নি তোমার?

নিঝুম মাথা দুলাল। দ্রুত তাকে জড়িয়ে ধরল শান্ত। নিঝুমের দৃষ্টি এখনো ইফার দিকে, তাকেই বোঝার চেষ্টা করছে সে। ইফা কি এখন বুঝতে পারল, “অশান্ত কাকে ভালোবাসে?

শান্ত ফিরে তাকাল ছাদের দিকে।‌ ইফা সরে গেল মুহুর্তেই, তার মুখে চোখে ভয়ের ছাপ। শান্ত বলে উঠল, “তুমি ওখান থেকে পড়লে কি করে?

“পা পিছ*লে !

চটপট উওর দিল নিঝুম। শান্ত নিঝুমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো মুখে বালির ছড়াছড়ি। পরিস্থিতি হাস্যকর না, তবুও শান্ত’র‌ হাসি পাচ্ছে। নিঝুম চোখ ছোট ছোট করে বলল, “অশান্ত আপনি হাসছেন? আমি মরে যে*তে পারতাম!

“চুপ করো, শয়তান এতো সহজে ম”রে না!

“অশান্ত!

বলামাত্র বালি ছুড়ে মার*ল তার দিকে। শান্ত সরে গিয়ে এবার হাসতে লাগল। নিঝুমের পুরো শরীর জ্বলছে অশান্ত’র হাসিতে। এদিকে আবার কেমন লাগছেও। পুরো বালিতে তার শরীর মাখামাখি, অদ্ভুত অনুভূতি! ছেলেবেলায় এমনটা করলে অবশ্যই মজা পেত , কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। ড্রাইভার আর হেলপার দুজনেই তাদের দেখে অবাক। ড্রাইভার খক খক করে কেশে বলল, “ম্যাডাম নামেন, আমাগো দেরি হইতাছে!

নিঝুম মুখ ফিরে তাকাল। হেলপার উঁকি দিয়ে বলল, “ভ্যাগিস বালি আনছিলাম, আমাগো আনার কথা ছিল রড, কিন্তু আনতে পারি নাই!

নিঝুম আতঙ্কিত চোখে তাকাল শান্ত’র দিকে। শান্ত আবারো হেসে উঠলো। হেসে বলতে লাগলো, “ভালোই হতো, চশমিশ ভেঙে চুর*মার হয়ে যেত!

হেলপার দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,‌ “মজা করেন স্যার!

নিঝুম কাঁদো কাঁদো মুখে আশপাশ তাকিয়ে বলল, “অশান্ত,‌ এখান থেকে নামান আমাকে!
শান্ত দাড়িয়ে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে বলল, “চলো!

##তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪৭

শান্ত নিঝুমের হাত ধরে ট্রাক থেকে নামতেই সামনে আহনাফ কে দেখতে পেয়ে তার হাতটা ছেড়ে দিল। আহনাফ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “এই হাল কি করে?

“অনেক কাহিনী, বলছি। তার আগে বাসায় যাবো। যত তাড়াতাড়ি পারি গোসল করতে হবে।

শান্ত দুই হাত প্যান্টের প্যাকেটে ঢুকিয়ে আহনাফ কে উদ্দেশ্যে করে বলল, “তুই চশমিশ কে বাসায় দিয়ে আয়!

নিঝুম ভ্রু কুঁচকালো। আহনাফ মাথা নেড়ে বলল, “চলো!
কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে নিঝুম আহনাফের সাথে চলে গেল। শান্ত হেসে কফি শপে ঢুকে পড়ল!

সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। বন্ধুরা বাদেও রিয়ার আরো কিছু কাজিনও এসেছে পার্টিতে। আফিনের ইচ্ছা ছিল খোলা আকাশের নিচে রিয়ার বার্থডে কেক কাটা হবে। তবে সেটা ভন্ডুল হবে বলে। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢেকে গেছে আরো আগেই। দরুন বৃষ্টি আসার সম্ভবনা। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে একটু পর পরই। অবশ্য শপের ম্যানেজার কে বলা আছে, নিচে যেন ব্যবস্তা করেই রাখে। রিয়া যতোটা খুশি হবে বলে ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি খুশি। একদম সবার সামনে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে টেয়ে অস্থির। লজ্জায় ম*রে যায় আফিন। আর বাকিরা তো আছেই খোঁচা মারার জন্য। মাঝে আহিম তো খোঁচা মেরে বলেই ফেলল, “এরা তো পারে না এখানেই বাসর করে ফেলতে!

নীলাভ্র বলে উঠে, “পরের বার সেই ব্যবস্থাই করতে হবে!”
সবাই হেসে উঠল তখন। নিঝুম চোখের চশমা ঠিক করে চেয়ারে বসে পড়ল। সে চেয়ে দেখে রিয়া হাতে কফি।আফিন সত্যিই অনেক ভালোবাসে রিয়া কে, বুঝতেও পারে। সে ভেবেছিল রিয়া অনুষ্ঠানে বসেও কফি খাবে,‌ রিয়াও তাই করছে। সবাই এখন নিচে, বৃষ্টি কখন আসে ঠিক নেই। বৃষ্টির মাঝে ভিজে আহামরি একটা কান্ড ঘটার আগেই সবাই নিচে এসে বসেছে। নিচের দিকটাও খারাপ না। গোছগাছ ভালোই আছে। লাইটিং ব্যসস্থাও এর মাঝে শেষ। গান বাজছে কম ভলিউমে।

তানিশা এসে বসল নিঝুমের পাশে। কোল্ড ড্রিংক এ চুমুক দিয়ে সামনের দিকে ফিরল। নিঝুম তার উপস্থিতি টের পেল। তানিশা হেসে বলল, “ভালোই বন্ধুত্ব আছে দেখছি এখনো?

তানিশার কথায় তার দিকে না ফিরে ফিরল ইফার দিকে। বেশ স্বাভাবিক হয়েই বসে আছে একদিকে। বেশ সুন্দর লাগছে তাকে। তানিশা আবারো বলে উঠল, “আমার সারপ্রাইজ টা কি পছন্দ হয়েছে!

নিঝুম হেসে বলল, “হুম, খুব।

“তা আমার কি মনে হয় জানো, পোস্টারের কাজটাও তোমার বান্ধবীর।

“কি জানি, হতেও পারে।

“তুমি এখনো খুব ঠান্ডা।

নিঝুম হেসে ইফাকে ইশারা করে বলল, “ওকে দেখছো।

“ও তো বেশ চুপচাপ, কিন্তু মনে হচ্ছে না ভয় পেয়ে আছে।

“পেয়েছে, ভয় ওর মুখের ধরণ বদলে গেছে। ঠিক কি রিয়েকশন দিবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

তানিশা হাসল। নিঝুম এবার তানিশার চোখে চোখ রেখে বলল, “তুমি আমার শ*ত্রু হলেও ভালো, পেছন থেকে ছুরি মা*রো না। কিন্তু গোপন শত্রু খুব ভ*য়ানক!

“তোমার মতলব টা কি বলো তো!

নিঝুম আবারো হাসল। নীলাভ্র দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়ে দুটো কোল্ডড্রিংক হাতে নিল। তানিশা ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি কি এক এক করে একজন কে টার্গেট করছো নাকি।

“তোমার কি মনে হয়?

“এখন নীলাভ্র!

“এমন কিছুই না!

“আহনাফ কে কষ্ট দিলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।

নিঝুম উঠে দাঁড়াল। নীলাভ্র তার কাছে এগিয়ে এলো। তার হাত ধরে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলল, “আমি আসার পর কি হলো?

নিঝুম নীলাভ্রের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে বলল, “কি হবে?

“তুমি দু’তলা থেকে পড়লে কি করে?

“এমন বড় বড় চোখ করে কথা বলবেন না, মানুষ ভাববে সিরিয়াস কিছু?

“আজব, তাহলে আমি কি তোমার সাথে মজা করছি। ইফা করেছে না এমনটা?

নিঝুম জবাব না দিয়ে অন্যদিকে ফিরল। তার গায়ে মনে হচ্ছে এখনো বালি আছে। কি অদ্ভুত লাগছে বোঝানো দায়। নীলাভ্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিঝুম হেসে বলল, “আপনি জানেন নীলাভ্র মেয়েদের নাম।

“কথা কেন ঘুরাচ্ছে?

“আরে না আমি সত্যি বলছি? আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে এক ভদ্রমহিলা থাকতেন, তার মেয়ের নদনদের ভাইঝির নাম হচ্ছে নীলাভ্র!

“তুমি আমায় পাগল করে ছাড়বো।

বলামাত্র নীলাভ্র চলে যেত নিল। নিঝুম ফট করে তার হাত ধরে বলল, “আরে আরে ধাঁধা টার উওর দিন।

“এটা আবার ধাঁধা নাকি?

“তাহলে কি? এখন বলুন নীলাভ্র নামটা কার?

নীলাভ্র খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “আমার!

নিঝুম হেসে বলল, “হয় নি! ওই ভদ্রমহিলার মেয়ের মেয়ে!

“নিঝুম প্লিজ থামো, আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।

“আচ্ছা আরেকটা ধরছি।

“এই না না।

“আরে আরে শুনুন তো!

নীলাভ্র হেঁটে চলে এলো একপাশে। নিঝুম তার পিছন পিছন হেঁটে ফট করে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এটা শুনুন, এক ভদ্রমহিলা….

শান্ত হা হয়ে দেখছে তাদের। এটা কি সত্যি’ই চশমিশ নাকি, এই কয়েকদিনে নীলের সাথে এতো ভাব। দু’জনে কি হাসাহাসি। চশমিশ এতো বদলে গেল। এখন তো অশান্ত কে চোখেই পড়ে না তার। একবার এসে তো কথাও বলল না। কে জানে , পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিল কি না। কানের কাছে আহিম এসে বলল, “এভাবে তাকিয়ে থাকিস না, চোখ বের হয়ে যাবে?

শান্ত মুখ ভেংচি কেটে, “ভালো হবে!

আহিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে, “ভালো ম্যাচ! একদম মেড ফর লেট ইচ আদার।

“চুপ কর?

“আবারো কিছু জ্বলছে, এই আফিন ম্যানেজার কে বল আশপাশ দেখতে, কখন জানি আবার আগুন ধরে যায়।

কথাগুলো বলে আহিম কেটে পড়ল। শান্ত ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে তো করছে আহিম কে ছাদে নিয়ে টুপ করে একটা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দি*তে। কিন্তু সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আবারো ফিরল নিঝুমের দিকে। বুঝতে পারে না, ইদানিং এই নীলের সাথে কেন এতো চিপকে আছে। “আঠা নাকি ও – কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতে আহিম বলে উঠল, “চুম্বক!” শান্ত ফিরে তাকানোর আগেই আহিম উধাও।

সব চিন্তা বাদ দিয়ে খুঁজছে আহনাফ কে। নিজের গার্লফ্রেন্ড কে নিজে দেখতে পারে না, এ কিসের বয়ফ্রেন্ড! তিশা কি এভাবে এভাবেই চলে গেছিল নাকি। নিশ্চিত ওর প্রতিও এই অবহেলা করেছিল তাই আজ এই দশা। ভয় হচ্ছে সে যে পথে চলছে নীল না আবার সেই পথে চলে যায়। নীলের চোখমুখ অন্যরকম হয়ে যায় আশেপাশে নিঝুম থাকলে। শেষে যদি তিন বন্ধুই এক মেয়ের প্রেমে পড়ে তাহলে তো সর্ব*নাশ! শান্ত মাথা জোরে দুলিয়ে বলল, “না না এ হয় না!”‌ আহনাফ তার শান্তি মতো এক চেয়ারে বসে দেখছে সবাইকে। তার হাতেও কফি! গরম গরম কফি কে খায় পার্টিতে, এটা একমাত্র রিয়া আর আহনাফের পক্ষেই সম্ভব! দুটোই কফিঘোর। শান্ত ধপাস করে তার পাশে বসতেই আহনাফ ভ্রু কুঁচকে নিল।

“কি হয়েছে?

শান্ত চোখ ঘুরিয়ে ওদিকে ফিরতে বলল। আহনাফ নিঝুম কে দেখতেই কিঞ্চিত হাসল। নিঝুম কে দেখতে পেয়েই এই হাসির রেখা। শান্ত ভাবছে আর তাকাচ্ছে, নীলের ঠোঁটের কোণেও হাসি আর আহনাফের ঠোঁটে ও হাসি। মনে করতে পারছে না, এমন ভাবে কি সেও হাসে নাকি!
আহনাফ হেসে বলল, “নিঝুম কে খুব সুন্দর লাগছে?

“তো সুন্দর লাগছে ভালো কথা, নিজের গার্লফ্রেন্ড কে নিজের কাছে রাখ না। এভাবে রেখে দিয়েছিস কেন? আর কিছু বলছিস না’ই বা কেন?

বলেই মুখে বিয়ারের বোতল চুমুক দিল। আহনাফ থমথমে মুখে শান্ত’র দিকে ফিরে বলল, “ও আমার গার্লফ্রেন্ড না!

শান্ত “ওহ আচ্ছা!” বলেই থমকে গেল। কম্পিত স্বরে বলল, “তাহলে কি এক্স! কিন্তু তোদের তো প্রেম’ই শুরু হলো কিছুদিন আগে। এতো তাড়াতাড়ি ব্রেকাপ!

“ধুর শা*লা! দম নিয়ে কথা বল, এক্স এক্স কি করছিস। প্রেম’ই তো হয় নি!

“তোরা না সেদিন ডেটে গেলি।

“হ্যাঁ গেছিলাম, তো!

“তো, মানে ডেটে তোরা দু..জন এ..কা ছি..লি।

“তো ডেটে তো সবাই একাই থাকে।

“আচ্ছা আহনাফ, আমি একটা সিরিয়াস কথা জিজ্ঞেস করি?

“কি!

“তোদের ডেটে কি হয়েছিল?

আহনাফ ভ্রু কুঁচকালো‌! শান্ত হালকা কেশে বলল, “না মানে আমি জানি এসব জিজ্ঞেস করা ঠিক না তবুও..

আহনাফ স্পষ্ট স্বরে বলল, “রিজেক্ট! রিজেক্ট করেছে ও আমায়!

শান্ত নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ জোরে হেসে বলল, “নিঝুম তোকে রিজেক্ট করেছে!

“এতো হাসছিস কেন?

“কিছু না, আমার বিশ্বাস’ই হচ্ছে না‌। কিন্তু বাই দ্যা ওয়ে, তুই একথা আমায় আজ কেন বলছিস? এতোদিন বলিস নি কেন?

আহনাফ চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ বলে উঠল, “ও মনে পড়েছে, ( শান্ত’র মাথায় বাড়ি মেরে ) সেদিন যে এক্সিডে*ন্ট’র ঘটনা মনে আছে। এতেই তো আমার সব গুলিয়ে গেল।

শান্ত ঢোক গিলল। তার মনে এখন এক ধরণের শান্তি অনুভব করছে‌। খারাপ লাগছে আহনাফের জন্য। সে আরেকটু কাছে এগিয়ে বলল, “আহনাফ তোর খারাপ লাগছে না!

“কেন?

“ও যে তোকে রিজেক্ট করল তাই!

আহনাফ হাসল। শান্ত’র দিকে ফিরে বলল, “দেখ, কিভাবে নেচে নেচে কথা বলছে। তুই শুনে অবাক হবি, সেদিন কিভাবে কথা বলছিল। একদম মেচুয়র কথাবার্তা।‌ খানিকক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিল এটা নিঝুম না অন্যকেউ!

শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শান্তির অনুভব করলেও তার মন এখনো উধালপাতাল। চোখ বন্ধ করতেই দুজনের ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য যেন তার চোখে ভেসে উঠে। বিয়ারের বোতলে চুমুক দিয়ে শীতল গলায় বলল, “শুনি, কি বলেছিলো সেদিন!

আহনাফ আবারো কফি মগে চুমুক দিল। ঠান্ডা একটা গান বাজছে চারদিকে। আহনাফের দৃষ্টি এখন শূন্যে! কি ঘটেছিল সেদিন…

নিঝুম আহনাফের পিছন পিছন ঘুরে দেখছে সে কি করছে। আহনাফ ছু*রি হাতে ক্যাপসিকাম কেটে বলল, “তোমার আর বিড়ালের স্বভাব এক জানো!

“মানে?

“মানে এটাই, বিড়াল এভাবেই আগ্রহ নিয়ে মানুষের পিছন পিছন ঘুরে, সে কি করছে দেখতে। তুমিও তাই করছো।

নিঝুম মুখ ভেংচি কেটে বলল, “তাই বলে আপনি আমায় বিড়াল বলবেন। আহনাফ আপনি মোটেও ভালো না।

“আইসক্রিম আছে ফ্রিজে!

নিঝুম একগাল হেসে বলল, “আহনাফ আপনি খুব ভালো!

নিঝুম আইসক্রিম খাচ্ছে বসে বসে। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাকে খুশি করা দু মিনিটের ব্যাপার। আহনাফ এসে বসল সোফায়। পানির গ্লাস রেখে বলল, “ডিনার কখন করবে?

“আরেকটু পর করি।
অতঃপর পানি খেয়ে বলল, “আহনাফ!

“হুম বলো!

“ধন্যবাদ! আজ সারাটা দিন দারুন কেটেছে আমার , শুধুমাত্র আপনার জন্য।

“নো ম্যানশন!

আহনাফ লক্ষ্য করল নিঝুম কেমন উসখুশ করছে। আহনাফ মৃদুস্বরে বলল, “তুমি কি কিছু বলবে আমায় নিঝুম!

নিঝুম জোরে মাথা দুলাল। আহনাফ ভ্রু কুঁচকালো‌। নিঝুম বেশ সিরিয়াস মুডে আরেকটু এগিয়ে এসে বসল। অতঃপর বলতে লাগলো, “আহনাফ আপনি খুব ভালো, খুব সুদর্শন। যে কোন মেয়ে আপনাকে পছন্দ করবে এতে সন্দেহ নেই।

“কেন তুমি করো না?

মাঝপথে কথাটা বলল আহনাফ। নিঝুম অস্থিরতায় হেসে ফেলল। আহনাফও হেসে ফেলল। নিঝুম হাসতে হাসতে বলল, “আমার দ্বারা কখনো সিরিয়াস হওয়া সম্ভব না।

“তুমি এভাবেই বলো আমি বুঝবো।

নিঝুম শব্দ করে শ্বাস ফেলে আহনাফের চোখে চোখ রেখে বলল, “আহনাফ আপনি আমার ভালোলাগা, শুরু থেকেই আপনাকে আমি পছন্দ করি। একদম শুরু থেকে এখন অবদি। আর আমি চাই আপনি আমার সেই ভালো লাগাল মানুষটি হয়েই থাকুন।

“তুমি কাউকে ভালোবাসো নিঝুম!

নিঝুম মাথা দুলাল। আহনাফ কিঞ্চিত হাসল। খানিকটা ব্যাথিত হলো তার হৃদয়। নিঝুমের দৃষ্টি মেঝেতে। আহনাফ স্পষ্ট স্বরে বলল, “তুমি ভালোলাগা আর ভালোবাসার মাঝে পার্থক্য বুঝো!

নিঝুম হেসে হেসে মাথা দুলাল। এ যেন কোন সাত বছরের বাচ্চা। যার সবকিছুতেই হ্যাঁ। আহনাফ হাসল। নিঝুম বলতে শুরু করল, “আমার খুব হিংসে হতো তিশা আপুকে, এখনো হয়। আহনাফ আমি জানি আপনি আমাকে এখানে কেন এনেছেন। আপনার মনে হয় আমি আপনার সাথে থাকলে তিশা আপু কে আপনি ভুলে যাবেন। অসম্ভব ভালোবাসেন তিশা আপুকে। কিন্তু আহনাফ যাকে অসম্ভব ভালোবাসেন তাকে ভুলাও অসম্ভব! আপনি আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। আপনাকে দেখে আমি প্রথম যেটা অনুভব করেছি তাকেই ভালোবাসা বলে ভেবে নিয়েছি। পাগলামি করে সেই কার্ডটা অবদি লিখেছি। আমি জানি আপনি সেটা পড়েছেন। কিন্তু আহনাফ যখন সত্যি কাউকে ভালোবেসে ফেলা যায় তখন ভালো লাগা আর ভালোবাসার মধ্যেখানের পার্থক্য আলাদা করা যায়। যখন তখন যার কাছে আমি আবদার করতে পারি, যাকে নিজের মনের সবটুকু কথা বলতে পারি কোন দ্বিধা ছাড়া, যাকে ছাড়া নিজেকে একা মনে হয়, তার সঙ্গ পেলে ভালো লাগে, ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তার সাথে থাকি এগুলো কি ভালোবাসার লক্ষণ নয়। আর আপনি জানেন, আজ সারাটা দিন আপনার সাথে ছিলাম বলে আমি বুঝতে পারলাম , আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি। আমি বুঝতে পেরেছি আমার মন কি চায়!

কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস ফেলল নিঝুম। আহনাফ অবাক হয়ে তার কথা গুলো শুনছিল। খুব গুছিয়ে কথা গুলো বলছিল নিঝুম। সেকেন্ড’র জন্য মনে হচ্ছিল এটা নিঝুম না অন্যকেউ। আহনাফ ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “তুমি তোমার মনের সব কথা আমাকেও বলতে পারো, আমার সঙ্গ পেলেও তোমার ভালো লাগে। এদুটি আমার দিক থেকে মিলে গেল!

নিঝুম একগাল হেসে বলল, “এজন্য’ই তো আপনি আমার একজন ভালো লাগার মানুষ! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!

“যাক ভাই বানাও নি, এতে বেঁচেই গেছি!

নিঝুম খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। আহনাফ ভার হৃদয় এবার ঠান্ডা হলো। সে হেসে বলল, “কিন্তু নিঝুম, কে সে?

“কে?

“তোমার ভালোবাসার মানুষটি!

“ওহ, ( খানিকক্ষণ ভেবে ) পরে বলবো!

“তাহলে আমিও সেই আশায় থাকবো। কিন্তু আর যাই’ই বলো এখন কিন্তু আমার বেশ হিংসে হচ্ছে তাকে।

“হিংসে করে তো লাভ নেই, মন তো নিয়েই গেছে!

আহনাফ ঠোঁট কামড়ালো। নিঝুম হাসতে হাসতে বলল, “আউচ!

“কি হলো?

“আমার চুল!

আহনাফ তাকিয়ে দেখল কানের দুলের সাথে চুলগুলো আটকে আছে। আহনাফ সামনে এগিয়ে এসে বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও আমি দেখছি!

আহনাফ কাছে এগিয়ে এসে তার চুল গুলো সরিয়ে দিতে লাগল ( পাঠকদের জন্য, শান্ত’র আগমন সেই সময় ঘটে, তাই আবেগের বেশ দেখে এক আর বোঝে আরেক )

“আহনাফ, আমার সাধের চুল কিন্তু।

“আচ্ছা! তুমি চুপটি করে বসো!

আহনাফ চুল গুলো সরিয়ে দেবার পর রাগে নিঝুম তার কানের দুল খুলে ফেলল।
আহনাফ খুব চেষ্টা করল নিঝুম কে পৌঁছে দেবার। কিন্তু নিঝুমের মাথায় চেপে বসল সে একাই যাবে। আহনাফ শেষমেষ একটা সিএনজি ঠিক করে দিলি তাকে। নিঝুম সিএনজি তে উঠার আগে আহনাফ কে উদ্দেশ্যে করে বলল, “আহনাফ আপনাকে আমি বলেছিলাম আপনি বুদ্ধিমান!

“তুমি তানিশার কথা বলছো!

“ডেট আমাদের দুজনের হলেও তানিশা আপুও আড়ালে সারাটাক্ষণ ছিল আমাদের সাথে। আপনি তানিশা আপুকে নিয়ে একবার ভাববেন। ভাববেন তো!

অনেক আগ্রহ নিয়ে নিঝুম তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। আহনাফ কিঞ্চিত হেসে জবাব দিল, “তুমি জানো, যেই ছেলে তোমাকে পাবে সে খুব ভাগ্যবান হবে।

“হতেই হবে,‌আফটার অল সে আমাকে পাচ্ছে।

“দয়া মায়া নেই তোমার, সেই লিষ্ট থেকে আমাকে বের করে দিলে!

নিঝুম হাসতে হাসতে সিএনজিতে উঠে বসল। আহনাফ হেসে বলল, “সাবধানে যেও!

নিঝুম চলে গেল। একা রাস্তায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল আহনাফ। নিঝুমের কথাটা ভাবতে লাগলো সে। তার জীবনে আজ পর্যন্ত কাউকেই জোর করে আটকে রাখতে চায় না সে। যে থাকার সে থাকবে। কাউকে ধরে বেঁধে থাকার কোন কারণ দেখছে না। তানিশা তাকে ভালোবাসে , একটু বেশিই ভালোবাসে। এটাই যে তার সবচেয়ে বড় ভয়! অতিরিক্ত ভালোবাসা যে বিষের চেয়েও ভয়ানক, এটা ভালো করেই জানে সে!

বর্তমানে… 🐥

খালি কফি মগটা টেবিলে রেখে দিল আহনাফ। শান্ত’র বিয়ারের বোতলটাও শেষ। সে নিঝুমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তাহলে চশমিশ অন্য কাউকে ভালোবাসে!

আহনাফ মাথা নাড়ল। শান্ত ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে নিল। কিন্তু তার আগেই উঠে দাঁড়াল। নিঝুম কে দেখছে সে, এখনো নীলের সাথে চিপকে আছে। হঠাৎ মাথায় একটা কথা ঘুরল, “সেই ভালোবাসার মানুষটি আবার নীল নয়তো!

শান্ত’র মাথা এবার ঘুরতে লাগল। মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে রইল চশমিশের দিকে। কে জানি বলেছিল, “নারী মানেই রহস্য! আর সৃষ্টিকর্তা সব রহস্য দিয়ে রেখেছে এই চশমিশের মধ্যে। যদি তার ভাবনা সত্যি হয় তাহলে এর পরিণতি কি হবে!”

হঠাৎ করেই হইচই উঠলো সবার মাঝে। কেক কাটা হবে এখন। সবার আগ্রহ এখন সেদিকে। নীল তার আগেই চলে গেছে। নিঝুম সেদিকে যাবার আগে পা বাড়াল অন্যদিকে। অতঃপর!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here